You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.08 | ‘পূর্ব পাকিস্তান বায়াফ্রা নয়’ | গুস্তাভ এফ, পাপানেক, জান, ডব্লিউ টমাস - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
‘পূর্ব পাকিস্তান বায়াফ্রা নয়’ গুস্তাভ এফ, পাপানেক, জান, ডব্লিউ টমাস ৮ এপ্রিল, ১৯৭১

পূর্ব পাকিস্তান বায়াফ্রা নয়
স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের (অথবা বাংলাদেশ, যেহেতু সেখানকার অধীবাসীরা এই নামটিই ব্যবহার করে) সংগ্রামকে প্রায়ই বায়াফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যর্থ আন্দোলনের আলোকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে, যেখানে নাইজেরিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারই শেষপর্যন্ত জয়ী হয়েছে। বায়াফ্রা মডেল অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কর্মকান্ডের নীতিমালা প্রণয়ন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা কূটনৈতিকভাবে ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়া একটি সৈন্যদলকে বিগত যুদ্ধটিই আবার লড়তে পুনরায় প্রস্তুত করার সমকক্ষ হবে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন সফল হবেই, তা আগে হোক কিংবা পরে এবং দুটি আন্দোলনের পরিস্থিতির মধ্যে ছয়টি প্রধান পার্থক্য ব্যাপারটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

প্রথমত, এটি পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণ ধারণকারী অঞ্চল যার অধিবাসীরা স্বাধীনতা চায়। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি জনগণ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ যারা তাদের ৮৫ শতাংশ ভোট স্বাধীনতাকামী দলকে দিয়েছে। সেখানে নাইজেরিয়ায় বাইয়াফ্রার প্রধান সমর্থকেরা মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশেরও কম।

দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত পশ্চিম পাকিস্তানের ৬০০০০ সৈন্য তাদের পশ্চিমাঞ্চলের কর্মক্ষেত্র থেকে আকাশপথ/পানিপথ অনুযায়ী ৩০০০ মাইল রাস্তা দ্বারা বিচ্ছিন্ন। স্বাভাবিকভাবে অঞ্চলদুটি ১০০০ মাইল দূরে যা ভারতীয় অঞ্চল দ্বারা পৃথক হয়েছে। ভারত সরকার তাদের আকাশপথ পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে মালামাল পাঠাতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিমানকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের পাশ দিয়ে ঘুরে যেতে হচ্ছে। কোন উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক বাঁধা না থাকায় নাইজেরিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার সৈন্যদের স্থলপথেই মালামাল সরবরাহ করতে পারে এবং রণক্ষেত্রে নিয়োজিতরা মূল সরবরাহ কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়না।

তৃতীয়ত, প্রকৃতপক্ষে স্বীকৃত সংজ্ঞানুযায়ী বিবেচনা করলে সেখানে কোন রণক্ষেত্র নেই। প্রত্যেকটি স্থানই একেকটি বিচ্ছিন্ন রণক্ষেত্র এবং পুরো শহরজুড়ে সৈনিকদের ভিত্তিগুলো বিদ্রোহীদের সাগরে একেকটি ছোট দ্বীপের মত। যখন এটা লেখা হচ্ছিল তখন কৃষিপ্রধান পূর্ব পাকিস্তানের সেইসব শহরগুলো সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে ছিল যে শহরগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র দশ শতাংশ লোক বসবাস করে। বোমাবাজি এবং বিমান থেকে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা এখনো পর্যন্ত অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকার বিমানশক্তি ভিয়েতনামের গ্রামগুলো নিয়ন্ত্রণে যতটা সফল হয়েছিল, তার থেকে বেশি সাফল্য এখানে আশা করা যাচ্ছেনা।

চতুর্থত, বহিঃশক্তির হুমকির অনুপস্থিতিতে নাইজেরিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সমস্ত সৈন্যশক্তিকে বায়াফ্রান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চেপে ধরার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিল। বিপরীতে, ভারতীয় আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে পাকিস্তান তাদের অধিকাংশ সৈন্যদের সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত করছে।

পঞ্চমত, বাহির থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহের অভাবে বায়াফ্রান সৈনিক প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। মাঝখানে ভারতীয় জলাভূমি, পাহাড়, জঙ্গল প্রভৃতি পার করে ১০০০ মাইল দীর্ঘ দূরত্বের পূর্ব পাকিস্তানে যেকোন বস্তু পৌঁছাতে গেলে বাস্তবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সীমান্ত ব্যবহার করা। যদিও ভারতীয় সরকার অস্ত্র সরবরাহ থামিয়ে দিতে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল তবুও তা কার্যকর হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে অপরিসীম সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভারত প্রতিবেশী বাঙালীদের তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করেছে। তাদের মনোভাব এমন যেন পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব বন্দুকচালকের কোন অভাব হবেনা।

সর্বোপরি, পূর্ব পাকিস্তানে এত বড় একটি সৈনিক বিরোধের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন তা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থানুযায়ী নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার চেয়েও নাজুক। পাকিস্তানের সীমিত রপ্তানি আয়ের ৪৫ শতাংশই আসে পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি থেকে। পূর্ব পাকিস্তানে এবছর পাট চাষের পরিমাণ অত্যল্প হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পকারখানা এবং সৈনিকদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করা পাকিস্তান সরকারের কোষাগারে প্রচুর চাপ তৈরি করবে (বিমানের জ্বালানীর আমদানী মূল্য ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে)। বর্তমানে পাকিস্তানে রপ্তানি মজুদ আশঙ্কাজনকভাবে কম এবং বিদেশী সাহায্য ছাড়া পাকিস্তান সরকারের পক্ষে এই যুদ্ধের ব্যয় বহন করে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রাখা সম্ভব নয়।

এই ঘটনাগুলো একত্রে বিবেচনা করলে তা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের সফলতার দিকেই নির্দেশ করে বলে প্রতীয়মান হয়। দুইটি দূরবর্তী এলাকা নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা পাকিস্তানের একটি মহৎ প্রচেষ্টা ছিল যার জন্য পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ লোক তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। কিন্তু বিগত দুই সপ্তাহের রক্তবন্যার পর পূর্ব পাকিস্তান স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের অংশ থাকবে না বলেই প্রতীয়মান হয় এবং ওপরে দর্শিত কারণগুলোর ফলে তাদের সেই কাজের জন্য বাধ্য করাও সম্ভবপর হবেনা। সংগ্রাম যত দীর্ঘতর হবে, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান ততই নিঃস্ব হতে থাকবে এবং তত বেশি রক্ত মাটিতে প্রবাহিত হবে। পাকিস্তান সরকারের প্রতি আমেরিকার সাহায্য মধ্যস্ততা নয় তা উপরের প্রসঙ্গের প্রেক্ষিতে স্পষ্টতই বলার উর্ধ্বে। যতক্ষণ না তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সরাসরি সাহায্য করছে ততক্ষণ এটা অবশ্যই পক্ষপাতিত্ব।

বিশ্লেষণের জন্য তুলনা সবসময়ই দূর্বল বিকল্প। কিন্তু পাকিস্তানের বিবাদপূর্ণ পরিস্থিতিকে আরো অস্থির করে তুলতে জোর দেওয়া এবং পরিচিত অবস্থা তৈরিতে সচেষ্ট আমেরিকানরা আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা আন্দোলনকে বায়াফ্রার চেয়ে উপযুক্ত উপমা হিসেবে খুঁজে পাবে।

৮ এপ্রিল, ১৯৭১

গুস্তাভ এফ, পাপানেক
জন উব্লিউ থমাস