You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১ নম্বর সেক্টরে সংগঠিত যুদ্ধ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’- মেজর(অব) রফিক- উল- ইসলাম বীরউত্তম, ঢাকা, ১৯৮১ ——–১৯৭১

 

প্রতিবেদনঃ মেজর (অবঃ) রফিক-উল ইসলাম

বিলম্বিত কনফারেন্স

১০ জুলাই আমি আগরতলা থেকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একখানি বিমানে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে গোহাটিতে আধঘণ্টার জন্য থেমে রাতে সাড়ে আটটার দিকে কলকাতার আকাশে পৌছে গেলাম।নীচে তখন মুষল ধারার বৃষ্টির সাথে বেগে বাতাস বইছিল।এহেন দুর্যোগে কয়েকবার চেষ্টা করার পর আমাদের বিমান রানওয়ে স্পর্শ করল। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আমাদের চার ঘণ্টার কষ্টকর যাত্রা শেষ হলো। রাত তখন ৯ টা।

অচেনা কলকাতায় আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত আগন্তক।বিমানবন্দরের ভবনে কিছুক্ষণ পায়চারী করার পর একটি ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। শিখ ড্রাইভারকে বললাম বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়াটারে নিয়ে যেতে।কিন্ত রাতে আর্মি হেডকোয়াটার খুঁজে পেলাম না। তখন ড্রাইভারকে একটি মাঝারি হোটেলে নিয়ে যেতে বললাম।

বহুদিনের পরিচর্যার অভাবে আমার চুল দাঁড়ি সমানে বেড়ে উঠেছিল। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতো জোড়া ছেঁড়াও ময়লা। গায়ে বেঢপ ধরণের জামাটিও বেশ বড়,পরনে টাউজার এবং হাতে কিছু সরকারী কাগজপত্র ভর্তি একটি থলে এই ছিল আমার সেদিনের সর্বাঙ্গীণ চেহারা। শিখ ড্রাইভার নিশ্চয় আমার সাথে রসিকতা করে থাকবে। সে আমাকে একটি ব্যয়বহুল হোটেলে পৌছে দিল। হোটেলে ঢুকতেই অনুভব করলাম রিসেপশন রুমটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত।আমি যেন হঠাৎ করে দারুণ একটা আঘাত পেলাম। মনের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে আমার থলেটি স্পর্শ করলাম। সেখানে উপস্থিত সুন্দর বেশভূষার সজ্জিত পুরুষও মহিলার অবাক দৃষ্টির মুখে আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মুহূর্তের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করলাম,’’ একটা রুম পাওয়া যাবে কি?’’ ভদ্রলোক আড়চোখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটু জরিপ করে নিলেন। আমার জুতো,ট্টাউজার, শার্ট, থলে, দাঁড়ি কোনকিছুই তার দৃষ্টি এড়ালো না। তারপর কিছুটা কৌতুহলের হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’’আপনি কি…?’’ ‘’হ্যাঁ আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।‘’ সাথে সাথে জবাব দিলাম।

পরদিন সকালে হোটেল ত্যাগ করলাম। কিন্ত একরাতের ভাড়া হিসেবে পকেটে যা ছিল তার অর্ধেকটা বেরিয়ে গেছে।বাংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়াটার যাওয়ার সারাটা পথে আমি শুধু সেই শিখ ড্রাইভারকে অভিসম্পাত করছিলাম।

১১থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল।সম্মেলনের আলোচনা সকালে শুরু হয়ে শেষ হতো রাতে। সেখানে সকল সেক্টর কমান্ডারাই উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে আমরা নানা ধরণের সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করি। উলেখ্য যে, তখন পর্যন্ত আমাদের চিন্তার কিংবা কাজের কোন সমন্বয় ছিল না।

কলকাতা ৮ নম্বর থিয়েটার রোদের ভবনটিতে আমরা মিলিত হয়েছিলাম। এটা ছিল বি এস এফ এর অফিস। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারকে এটি ব্যাবহার করতে দেয়া হয়েছিল।

একাত্তরের মার্চে রফিক-উল-ইসলাম সাবেক ই পি আর সেক্টর হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রাম ক্যাপ্টেন পদে সেক্টর এডজুডেন্টের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

আমাদের প্রথম অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ বাহিনীর চীফ ইন কম্যান্ডার কর্নেল(অব) এম, এ, জি ওসমানী প্রথম দিনের অধিবেশনে যোগ দিতে পারেননি।
১২ই জুলাই দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে ছিলেনঃ

১। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ
২। কর্নেল(অব) এম, এ, জি ওসমানী
৩। লেঃ এম, এ, রব
৪। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ,কে খন্দকার
৫। মেজর(অব) নুরুজ্জামান
৬। মেজর সি আর দত্ত
৭। মেজর জিয়াউর রহমান
৮। মেজর কে, এম শফিউল্লাহ
৯। মেজর খালেদ মোশাররফ
১০। মেজর মীর শওকত আলী
১১। উইং কমান্ডার এম, কে বাশার
১২। মেজর ওসমান চৌধুরি
১৩। মেজর রফিক- উল- ইসলাম
১৪। মেজর নাজমুল হক
১৫। মেজর এম, এ,জলিল
১৬। মেজর এ, আর চৌধুরি

দশদিন ব্যাপী সম্মেলনে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। ওই বৈঠকে লেঃ এম, এ, রব চীফ অব –স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে খন্দকার ডেপুটি- চীফ- অব স্টাফ নিযুক্ত হন।

সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা হচ্ছেঃ

১। বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ

২। নিম্নলিখিতভাবে গেরিলা যুদ্ধের আয়োজনঃ
(ক)নির্ধারিত এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে পাঁচ অথবা দশজন নিয়ে গঠিত ট্রেনিং প্রাপ্ত গেরিলা দলকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে।
(খ)গেরিলাদের শ্রেণীবিভক্তিঃ

একশন গ্রুপঃ এই গ্রুপের সদস্যরা শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা হামলা পরিচালনা করবে। তারা শতকরা ৫0 থেকে ১০০ ভাগ হাতিয়ার বহন করবে।

গোয়েন্দা সেনাঃ এই গ্রুপের গেরিলারা সাধারণত সংঘর্ষে জড়িত হবেনা। এরা শত্রুপক্ষের খবরাখবর সংগ্রহ করবে। এদের সাধারণতঃ৩০ ভাগের বেশি অস্ত্র থাকবেনা।

গেরিলা ঘাঁটিঃ প্রতিটি ঘাঁটিতে গেরিলাদের থাকা খাওয়ার জন্য কয়েকটি নিরাপদ গৃহের ব্যাবস্থা থাকবে যেখান থেকে যথা যথ খবর প্রাপ্তির পরই তারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে পারে। প্রত্যেক ঘাঁটিতে একটি করে মেডিক্যাল গ্রুপ থাকবে যারা প্রয়োজনে গেরিলাদের চিকিৎসা করবে। প্রত্যেক ঘাঁটিতে একজন রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব থাকবে। এদের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে পাকিস্তানীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া এবং একই সঙ্গে বাঙ্গালীরা যাতে সাহসও শক্তি হারিয়ে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। শত্রুর বিরুদ্ধে বড় আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে আর বেশী সংখ্যকগেরিলা কিংবা নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের স্থান সংকুলানের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিকে তৈরি রাখাও এদের দায়িত্ব ছিল।

৩। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে ব্যাটালিয়ান ফোর্সএবং সেন্টার ট্রুপস এর ভিত্তিতে সংগঠিত করতে হবে।

৪। শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ
(ক) প্রতিটি সুবিধাজনক স্থানে শত্রুর বিরুদ্ধে রেইড এবং অ্যামবুশের মাধ্যমে আঘাত হানার জন্য বিপুল সংখ্যক গেরিলাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
(খ) শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে দেওয়া যাবেনা। বিদ্যুতের খুঁটি, সাবষ্টেশন প্রভৃতি উড়িয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ অচল করার মাধ্যমে একাজ করতে হবে।
(গ) পাকিস্তানীদেরকে কোন কাঁচামাল কিংবা উৎপাদিত পণ্য রফতানি করতে দেওয়া হবেনা। যেসব জিনিস গুদামে থাকবে সেগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে।
(ঘ) শত্রু পক্ষের সৈন্যও সামরিক সরঞ্জাম আনা- নেওয়ার জন্য ব্যবহারযোগ্য রেলপথ, নৌপথ পরিকল্পিতভাবে ধংস করে দিতে হবে।
(ঙ)রণকৌশলগত পরিকল্পনা এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে বাধ্য হয়্।
(চ) শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করার পর তাদের বিচ্ছিন্ন বাহিনীগুলোর উপর গেরিলারা মরনপ্রান আঘাত হানবে।
বিভিন্ন সেক্টরএবং ফোস পুনর্গঠনের কাজে ইপিআর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ন। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইপির বাহিনীর কাছ থেকেই বাংলাদেশ সরকার প্রায় সমুদয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যবস্থা করেছিল। শুধু তাই নয় প্রথম থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তারাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।ইপিআর এর অয়ারলেস সেট এবং যানবাহন ব্যাপকভাবে কাজে লেগেছিল। মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর এর সিগন্যাল এবং ড্রাইভাররা সেদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিয়া রাখে। সেই দুর্দিনে স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ ড্রাইভাররা শত্রুপক্ষের তুমুল গোলাবৃষ্টির মধ্যে আমাদের সৈন্য ও রসদ বহন করে দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

আমাদের এই সম্মেলনে বাংলাদেশকে১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।

১ নম্বর সেক্টরঃ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে(মুহুরি নদীর পূর্ব এলাকা) এই সেক্টর গঠিত হয় । সমস্ত সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।আমি এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হই।এই সেক্টরের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ২১শ’। এর মধ্যে ১৫শ’ ইপিআর, ২শ’ পুলিশ ৩শ’ সামরিক বাহিনী এবং নৌও বিমানবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় একশ। এখানে গেরিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায়২০হাজার। যার মধ্যে৮ হাজারকে একশন গ্রুপ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এদের মধ্যে শতকরা৩৫ ভাগকে অস্ত্রও গোলাগুলি দেওয়া হয়েছিল।

২ নম্বর সেক্টরঃ কুমিল্লাও ফরিদপুর জেলা এবং নোয়াখালীও ঢাকার অংশবিশেষ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন খালেদ মোশাররফ। সেক্টরটি ৬ টি সাব সেক্টরে বিভক্ত ছিল।সেক্টরটি৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। সমগ্র সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় ৪ হাজারএবং গেরিলা ছিল প্রায়৩০ হাজার।

৩ নম্বর সেক্টরঃ মেজর কে এম শফিউল্লাহর মৌলভীবাজার মহকুমা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমা, নারায়ণগঞ্জ মহকুমা এবং কেরানীগঞ্জের অংশবিশেষ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। ১০ টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরে গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায়১০হাজার। এস-ফোর্স গঠনের পর মেজর শফিউল্লাহকে তার কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। মেজর নুরুজ্জামানকে৩ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

৪ নম্বর সেক্টরঃ উত্তরে সিলেট সদর এবং দক্ষিণে হবিগঞ্জ থানার মধ্যবর্তী সমস্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। সেক্টরটি ৬ টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। সেক্টরের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার এবং গেরিলা ছিল প্রায়৮ হাজার। সেক্টর হেডকোয়াটার ছিল করিমগঞ্জে। পরে তা নাসিমপুরে স্থানান্তর করা হয়।

৫ নম্বর সেক্টরঃ সিলেট জেলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর মীর শওকত আলী। সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা প্রায় ৮০০ এবং গেরিলা প্রায় ৭ হাজার। সেক্টরটি ৬ টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল।

৬ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টর রংপুরও দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত। উইং কমান্ডার এম, কে বাশার ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। সাব-সেক্টর সংখ্যা ছিল ৫টি। সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১২শ এবং গেরিলা ছিল ৬ হাজার। সেক্টর হেডকোয়াটার ছিল রংপুর জেলার পাট গ্রামের নিকট বুড়িমারীতে।

৭ নম্বর সেক্টরঃ রাজশাহী,পাবনা,বগুড়া এবং দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর নাজমুল হক। যুদ্ধকালে এক মটর দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেলে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মেজর কিউ এন জামান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিল৮ টি।সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায়২ হাজার এবং গেরিলার সংখ্যা ছিল প্রায়২ হাজার।

৮ নম্বর সেক্টরঃ ১৫ জুলাই পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম,এ ওসমান চৌধুরী। এসময় মেজর এম, এ মঞ্জুর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন এবং তাকে ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এর আওতায় ছিল কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল পটুয়াখালী জেলা। পরে বরিশালও পটুয়াখালীকে এই সেক্টর থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেক্টরে সৈন্য সংখ্যা ছিল ২ হাজার। গেরিলা ৭ হাজার। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিল ৭টি। সেক্টর হেডকোয়াটার ছিল বেনাপোলে।

৯ নম্বর সেক্টরঃ বরিশাল, পটুয়াখালী, এবং খুলনাওফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর এম,এ, জলিল। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ছিল৮ টি। গেরিলা ছিল প্রায়১৫ হাজার। নিয়মিত সৈন্য ছিল এক ব্যাটালিয়নের মত।

১০ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টরের কোন আঞ্চলিক সীমানা ছিলনা। শুধু নৌ-বাহিনীর কমান্ডোদের নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের সদস্যদের শত্রুপক্ষের নৌযান ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতো। প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সংখ্যক কমান্ডো এক-একটি গ্রুপ গঠিত হতো। যে সেক্টরের এলাকায় কমান্ডো অভিযান পরিচালিত হতো সেই এলাকার সেক্টর কমান্ডারের অধীনে থেকে কমান্ডোরা কাজ করত। নৌ- অভিযান শেষ হওয়ার পর কমান্ডোরা তাদের মুল সেক্টর অর্থাৎ ১০ নম্বর সেক্টরে ফিরে আসতো।

১১ নম্বর সেক্টরঃ এই সেক্টরটি ছিল মেজর তাহেরের কমান্ডে। ১৫ নভেম্বর এক অভিযানে তিনি আহত হলে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহকে এই সেক্টরের কমান্ডার করা হয়। এখানে সাব-সেক্টর ছিল৮ টি এবং গেরিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার।

এই সম্মেলনে সেক্টর সমূহ সম্পর্কে সিদ্ধান্তের পর সৈনিকদেরও নিম্নলিখিত গ্রুপে পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

নিয়মিত আর্মি ব্যাটালিয়নঃ তখনকার স্বল্প সংখ্যক ব্যাটালিয়নগুলো নিয়ে বাংলাদেশ বাহিনী গঠিত হয়। এইসব ব্যাটালিয়নের জনশক্তি ছিল খুবই কম। প্রত্যেক সেক্টর থেকে লোক সংগ্রহ করে শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চলে। তারপর এগুলোকে ব্রিগ্রেডগ্রুপে ভাগ করা হয়। কে-ফোর্স , এস- ফোর্স এবং জেড-ফোর্স নামে এগুলো পরিচালিত হয়। এসব বাহিনীর অধিকাংশ লোকই ছিল ইপিআর এর।

সেক্টর ট্রুপসঃ উপরোক্ত ব্যাটালিয়নগুলোতে যেসব ইপিআর,পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি তাদেরকে যার যার সেক্টরে যুদ্ধ করার জন্য ইউনিটও সাব-ইউনিটে ভাগ করা হয়। নিয়মিত বাহিনীগুলোর চেয়ে সেক্টর ট্রুপের অস্ত্রবল ছিল কিছুটা কম।ওপরের প্রথমও দ্বিতীয় গ্রুপ, মুক্তিফৌজ, এম এফ মুক্তিবাহিনী অথবা নিয়মিত বাহিনী হিসেবে পরিচিত। এদেরকে সেনাবাহিনীর বিধিবিধানও নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। এদেরকে জীবন-ধারণের ভাতা হিসেবে একটি যুক্তিসংগত অর্থের অংক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় কিন্ত তারা কোন বেতন গ্রহণ করেননি।সরকারীভাবে তাদের নাম রাখা হয় ‘নিয়মিত বাহিনী’।

অনিয়মিত বাহিনী অথবা ফ্রিডম ফাইটার্স(এফ এফ)ঃ গেরিলা পদ্ধতিতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য জেসব লোককে ট্রেনিং দেওয়া হতো তারা ছিল ফ্রিডম ফাইটার্স। এর সরকারী নাম ছিল অনিয়মিত অথবা গণবাহিনী। এরা সেনাবাহিনীর নিয়ম-কানুন অনুসারে চলতে বাধ্য ছিলো না। অনেকক্ষেত্রে নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাব ছিলো এই গ্রুপের বৈশিষ্ট।তবে, আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, সুদীর্ঘ এবং কঠোর সংগ্রামী জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তারা আপনা থেকেই সুশৃঙ্খল হয়ে উঠবে।সাধারণতঃ এদেরকে বলা হত ‘গেরিলা’। মুক্তিফৌজ এবং ফ্রিডম ফাইটারদেরও সাধারণভাবে এফ-এফ অথবা ফ্রিডম ফাইটার্স বলা হতো এবং এই নামে সকল যোদ্ধাই সুপরিচিত ছিল।

অনিয়মিতবাহিনীর লোকেরা কোন বেতন কিংবা জীবনধারণ ভাতা পেতো না। ট্রেনিংয়ের পর বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানোর খরচ হিসেবে রাহা খরচ হিসেবে কিছু অর্থ দেওয়া হতো।একে বলা হতো ‘ইনডাকশন মানি’ বা নিযুক্তি ভাতা।

আমাদের নিয়মিত(এম এফ) এবং অনিয়মিত(এফ এফ) বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং সদস্য সংখ্যা হিসেব করে তাদের জন্য কাপড় চোপড়, রেশন,অস্ত্র, গোলাগুলি অয়ারলেসসেট, টেলিফোন সেট কম্পাস, বাইনোকুলার ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তালিকা তৈরি করে পুরো সেক্টরের অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের সাকুল্য তালিকা সরকারের কাছে পেশ করতে হতো।আমাদের সরকার আবার ভারত সরকারের কাছ থেকে জিনিসগুলো সংগ্রহ করতেন। অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা আগেও বলেছি। নিঃসন্দেহে এই সমস্যার জন্য আমরা প্রথম দিকে মার খেয়েছিলাম। সেক্টরগুলোতে ব্যবহৃত অশ্ত্র-শস্ত্রের তেমন কোন সামঞ্জস্য ছিলো না। কিছু ছিল চীনের তৈরি,কিছু ব্রিটিশ আবার কিছু আমেরিকান। এগুলোর গোলাগুলির নিয়ে আমাদের নিদারুণ সংকটে পড়তে হতো। শেষপর্যন্ত আমাদের শুধু একধরণের( সম্ভবত ভারতীয়) অস্ত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

যানবাহনের সমস্যার তো কোন অন্তই ছিলো না। খুচরো যন্ত্রপাতির অভাবে গাড়িগুলি প্রায়ই অচল থাকতো। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেভাবে হোক যতদূর সম্ভব বেশী গাড়ি চালু রাখতে হবে। ভারত সরকারের সাথে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ই-এম-ই(ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক্যাল এন্ড ইকুইপমেন্ট) বিভাগকে এই কাজের ভার দেওয়া হয়।

চিকিৎসার সুযোগ- সুবিধার অভাব ছিল প্রকট। ভারতের হাসপাতালগুলো আহত শরণার্থীতে ভরে গিয়েছিল। এদের বেশিরভাগই ছিল বুলেট কিংবা বেয়োনেটের আঘাতে আহত। আমরা বাঙ্গালী সৈনিকদের জন্য কয়েকটি অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই। পরে সবচাইতে সবচাইতে বড় হাসপাতালটি স্থাপিত হয়েছিল ২ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধের সময় খুব কম সংখ্যক চিকিৎসকই ভারত গিয়েছিলেন। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ৪র্থ বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রদের পর্যন্ত কাজে নিয়োগ করা হয়। তারা চিকিৎসা ক্যাম্প এবং সাব- সেক্টরের দায়িত্বও গ্রহণ করে। ভারতের সামরিক হাসপাতালগুলোতে আমাদের আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করার জন্যও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গেও একটি ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

এরকম আরো অনেক সমস্যার কথা এবং সেগুলো সমাধানের উপায় নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করা হয়। সেক্টরগুলোতে কতগুলো অত্তযাবশ্যকীয় দ্রব্য এবং যন্ত্রপাতি একেবারেই ছিলো না। এ ব্যাপারে আমাদের চাহিদা পুরণ করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম। কিন্ত যুদ্ধকালে কোনকিছুই আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাই নাই। হয়ত এর যুক্তিসঙ্গত কোন কারণও থাকতে পারে। বর্ষার সময়ে আমাদের অধিকাংশ সৈনিকদের জন্য জরুরী ভিত্তিতে আচ্ছাদন নির্মাণের কথা ছিল কিন্ত কোনসময়েই এই আচ্ছাদনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়নি। তাঁবুর সরঞ্জামও চাহিদা অনুযায়ী পাইনি। শীতে কম্বলের সংখ্যা ছিল অল্প , গরম কাপড় তারও কম। আমাদের সৈনিকরা অধিকাংশ যুদ্ধই করেছে খালি পায়ে। জঙ্গলে চলাচলের বুটও ছিল মাত্র কয়েক জোড়া। আমরা বিপুল সংখ্যক প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পেয়েছিলাম। ওগুলো ছিল বাথরুমের জন্য উপজুক্ত, যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য নয়।

প্রতিটি সেক্টরে সামরিক অভিযানের ক্ষমতা এবং কি পরিমাণ সৈন্য আমাদের আছে সেসব নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। কমান্ডো ধরণের হামলার জন্য তখনো আমরা সৈন্যদের পুরা পুনর্গঠন করতে কিংবা ট্রেনিং দিতে পারিনি। তাই বাংলাদেশের খুব ভেতরে প্রবেশ করার পরিকল্পনা আমরা কিছুদিনের জন্য বাদ দিয়ে তখনকার মত সমগ্র সীমান্ত এলাকা বরাবর শত্রুর উপর আঘাত হানার প্রস্তুতি নেই। গেরিলা তৎপরতা উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়াহয়। এই উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক লোককে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে আমরা স্বল্পসংখ্যক র ফ্রিডম ফাইটারকে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়। আমরা আশা করেছিলা এর দ্বারা কয়েকমাসের মধ্যে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ গেরিলা গড়ে তুলতে পারব এবং এদেরকে দিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখা যাবে। ইত্যবসরে সরাসরি অভিযান পরিচালনার জন্য নিয়মিতসৈন্যদের প্রশিক্ষণও পুনর্গঠন পূর্ণোদ্যমে চলবে। ফ্রিডম ফাইটারদের উপর যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি ধ্বংসের দায়িত্ব থাকবে। প্রয়োজনে তারা শত্রুদল্কে অ্যামবুশ করবে এবং সশস্ত্র ঘাঁটি, জ্বালানিও অস্ত্র মজুতের স্থান কিংবা সরবরাহ স্থানের উপর হামলা চালাবে। এরপর নিয়মিতবাহিনীর সর্বাত্মকঅভিযানে শত্রুপক্ষকে সহজে কাবু করা যাবে।

এইভাবে আমরা চূড়ান্ত রণকৌশল নির্ধারণ করি।কিন্ত প্রশ্ন দাঁড়ায় কে কখন সেই সর্বাত্মক অভিযান চালাবে।

তখনকার মতো যুদ্ধের জন্য সর্বাধিক সংখ্যক লোককে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারেই আমরা বেশী আগ্রহী ছিলাম। ট্রেনিং সপ্তাহের তা মেয়াদ ছিল দুই থেকে তিন সপ্তাহের। এসময়ের মধ্যে তারা রাইফেল, লাইট মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড, বিস্ফোরক প্রভৃতি কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শিখতো। এছাড়া অ্যামবুশের কায়দা- কানুন এবং রণাঙ্গনের কৌশল কিছু শেখানো হতো। আমাদের সব প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল গুণগত নয়, পরিমাণগত দিক দিয়ে কি করে আরও বেশি লোক গড়ে তোলা যায়।প্রয়োজনীয় সকল প্রকার দ্রব্য-সামগ্রীও ট্রেনিংের জন্য আমাদেরকে পুরোপুরি ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করতে হতো।এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ভারতীয় সরকার তাঁদের কয়েকজন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ করেন। ব্রিগ্রেডিয়ার রাঙ্কের এইসব অফিসার ভারতীয়বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সামরিক এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করতেন। তাদের নিযুক্তি ছিল ভারতীয় সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। ভারতের একজন সেক্টর কমান্ডার দুই অথবা তিনটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন। প্রধানতঃ ভারতীয় বাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়াটার এবং ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হতো। যুদ্ধের যাবতীয় আমাদের হেড কোয়াটার এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ড যৌথভাবে প্রণয়ন করতেন।এই সকল নীতি কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হতো ভারতীয় এবং বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডারদের হাতে। অনেকসময় পরস্পর বিরোধী একাধিক নির্দেশনা আসতো। তখন আরা পড়তাম বিপাকে, কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো।

১৫ই জুলাই আমরা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সাথে বৈঠকে মিলিত হই। এ অনুষ্ঠানে কোন মতবিনিময় কিংবা বিভিন্ন সেক্টরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন আলোচনা হয়নি। সে রাতে সেটি ছিল শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান।আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করি।

কলকাতা ত্যাগের পূর্বেই জানতে পারলাম পাকিস্তান থেকে কয়েকজন সামরিক অফিসার পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন। এইসব সামরিক অফিসারদের কাছে জানা গেলো যে, অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসাররাও আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে পালানোর চেষ্টা করছেন। কিন্ত পালানোর এই চেষ্টা অর্থাৎ পাকিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আসা এবংযুদ্ধে যোগ দেওয়া খুবই বিপজ্জনক ছিল বিশেষ করে পাকিস্তানে যারা পরিবার- পরিজন নিয়ে বসবাস করছিলেন তাদের জন্য ত বটেই। পাকিস্তান থেকে আমাদের অফিসাররা চলে আসছিলেন এই খবরে আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম। আবার অন্য কিছু ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিল। আমাদের যুব শিবির থেকে অসময় কিছু লোক পালিয়ে যায়। হয়তো যুবশিবিরের কষ্ট সহ্য না করতে পেরে কিংবা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা একাজ করেছিলেন। তবে এদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এই ঘটনা তেমন উল্লেখযোগ্য সমস্যারও সৃষ্টি করেনি।

যুবশিবিরের কিছু লোকের মধ্যে হতাশা ছিল একথা সত্য। জুলাইয়ের শেষদিকে মেজর খালেদ মোশাররফ এবং আমি আগরতলার কাছে এই ধরণের একটি শিবির দেখতে যাই। সেখানে তিন হাজারের বেশী যুবক দু’ মাসের বেশী সময় ধরে ট্রেনিংএর জন্য অপেক্ষা করছিলো। স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা ছিল খুবই দুঃখজনক। খাদ্যও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অন্যান্য যুবশিবিরেরও একই হাল। লক্ষ্যহীন সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি লোকের পক্ষে হতাশ হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। যুবশিবিরে সংখ্যা পরেরদিকে দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও এতো বিপুলসংখ্যক যুবকের জন্য সকল ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছিনা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী খুব কম লোকের মধ্যেই ট্রেনিং গ্রহণের কিংবা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ায় আগ্রহ দেখা যেতো। যুদ্ধকালে এক লাখেরও বেশী মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নেয়। কিন্ত এরমধ্যে শতকরা একভাগও শরণার্থী শিবিরের লোক ছিলোনা। এর কারণ সম্ভবতঃ যুবশিবিরগুলোতে যারা এসেছিলো তাদের পরিবার-পরিজন বাংলাদেশে ফেলে এসেছিলো তাই ট্রেনিং এর পরই এরা বাংলাদেশে ফিরে যাবার জন্য ছিল উদগ্রীব । তদের স্বদেশ ত্যাগের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করা।অন্যদিকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যারা যুবশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলো তারা পরিবার-পরিজন সহই সেখানে থাকতো। জীবন বাঁচানোর জন্য অন্ততঃ দু’বেলা দু’মুঠো আহার জুটবে এই নিশ্চয়তাও শিবিরে তাদের ছিল। বাংলাদেশে তাদের জন্য দুশ্চিন্তা করার খুব বেশী কেউ ছিলোনা। শিবিরে তাদের জীবনের ভয়ও কম ছিল। এসব কারনেই অন্ততঃ সেই মুহূর্তে দেশে ফেরার তেমন আগ্রহ তাদের ছিলনা।তাদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা কারা করছে ,কিভাবে করছে এই নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা ছিলোনা। মনে মনে তারা চাইত কষ্টের কাজটুকু অন্যে করুক, তারা একদিন ধীরেসুস্থে ফিরতে পারলেই হলো। শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে এবং নিছক ভয়ে যারা দেশত্যাগ করেছিলো তাদের মধ্যে এই মনোবৃত্তি লক্ষ্য করা গেছে। যুদ্ধে তাদের বিশেষ কোন আবদার ছিলোনা , থাকলে তা ছিল পরিস্থিতিসাপেক্ষ, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়। এদিকে শত ভয়ভীতি এবং দারুণ বিপদের মাঝেও যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী দেশে থেকে গিয়েছিলো, স্বাধীনতার জন্যই তাদেরকেই দিতে হয়েছে সবচাইতে বেশীমূল্য।

যুদ্ধের পরিবর্তিত গতি

জুন মাসের শেষদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। এইসময় প্রচলিত যুদ্ধপদ্ধতি এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশবাহিনীকে পুনর্গঠিত হয়।বস্তুতঃ জুনের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেওবিভিন্ন সেক্টরের ততপরতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে জুলাই মাসে আমরা এক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলাম।এই সম্মেলনের কথা আগেই বলেছি। ১৫ই মে পর্যন্ত আর যা কিছু সাহায্য পেয়েছিলাম তার ব্যবস্থা করেছিলো ভারতীয় বিএসএফ। যাহোক, সময়ের বিবর্তনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দু’টি নতুন ডিভিশনকে বাংলাদেশে এনে মোতায়েন করার পর যুদ্ধ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই কারণে সবকিছুতে ভিন্নতর সমন্বয়, প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি এবং ব্যাপক সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়।কিন্ত প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য বিএসএফ এর ছিলোনা। তাই ১৯৭১ এর১৬ই মে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিএসএফ এর কাছ থেকে বাংলাদেশ এই অস্বাভাবিক ঘটনাবলী মোকাবেলার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

লক্ষ্য করার বিষয় যে, বিভিন্ন পাকিস্তানী ডিভিশনে আক্রমণকারী দলগুলো ২৫শে মার্চ রাতে আকস্মিক আক্রমণের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্নস্থানে অবস্থান গ্রহণের জন্য কাজ সম্পন্ন করে। চলাচলের কাজ বিমানযোগে করা হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব বিবেচনা করে(১২০০মাইল ভারতীয় এলাকা)এবং ভারতের উপর দিয়ে সকল প্রকার পাকিস্তানী বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় পাকিস্তানের পুরো দুটো আর্মি ডিভিশনকে পূর্বাঞ্চলে স্থানান্তর করতে অন্ততঃ একমাসের কম সময় লাগার কথা নয়। সেই হিসেবে দ্যাখা যায় একমাস আগে অর্থাৎ ৭১এর ২৮ শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে যাত্রা প্রস্তুতি শুরু না করলে দুই ডিভিশন পাকসেনা বাংলাদেশে আসতে পারতো না। বাংলাদেশে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই এইসব আর্মি ডিভিশন এখানে এনে মোতায়েন করার ষড়যন্ত্র হয়েছিলো। সবকিছুর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল২৮ ফেব্রুয়ারির আগে। তাহলে দেখা যায়, ভুট্টো ১৬ই ফেব্রুয়ারি যে হুমকি দিয়েছিলেন তার সাথে এই ষড়যন্ত্রের নিশ্চয়ই একটা যোগসাজশ ছিল। ভুট্টো বলেছিলেন,” কেউ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা যেতে চাইলে তাকে নিজ দায়িত্বেই যেতে হবে, তা তিনি খাকী পোশাকে অথবা সাদাকালো যে পোশাকেই যাননা কেন।‘’ রাওয়ালপিন্ডির আর্মি হেড কোয়াটারে ২২শে ফেব্রুয়ারি যে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন হয়, সম্ভবত সেখানেই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে।

৯ম ডিভিশনের ৩১৩ বিগ্রেডকে বিমানযোগে সিলেট পাঠানো হয়।১১৭ বিগ্রেড যায় কুমিল্লায়। ১৪ ডিভিশনের অধীনে কুমিল্লায় যে ৫৩ বিগ্রেড অবস্থান করছিলো ইতিমধ্যেই তাকে চট্টগ্রাম যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ৯ম ডিভিশনের বাংলাদেশে আসার পরই মেঘনার পূর্বদিকে সমগ্র এলাকা অর্থাৎ সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামও পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুসারে ৫৩ বিগ্রেড চট্টগ্রাম, ১১৭বিগ্রেড কুমিল্লায় এবং ৩১৩ বিগ্রেড সিলেটে অবস্থানগ্রহন করে। আগে থেকেই পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন১৪ ডিভিশনের পর ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা প্রভৃতি জেলার দায়িত্ব ছিল। ৫৩ বিগ্রেডকে৯ম ডিভিশনের অধীনে এবং ৯মডিভিশনের২৭ বিগ্রেডকে ১৪শ ডিভিশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৪শ ডিভিশনের ৫৭ বিগ্রেড ঢাকায় অবস্থান করছিল। এই ডিভিশনের অপর বিগ্রেডটি ছিল উত্তরবঙ্গে।

পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে ১৬শ ডিভিশন চলে আসার পর উত্তরবঙ্গের দায়িত্ব এই ডিভিশন গ্রহণ করে। জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়া ছাড়াও এই সকল বাহিনীর সার্বিক কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১১ এপ্রিল লেঃ জেনারেল এ, এ, একে নিয়াজি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ার পর জেনারেল টিক্কা খান তার এই বাড়তি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর তিনি শুধু গভর্নর এবং সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন। পাকিস্তানীদের উল্লেখিত সেনাবাহিনী ছাড়াও পরে আর দুটি ডিভিশন গড়ে তোলা হয়। এই দুটি পাক ডিভিশনের জন্য বাংলাদেশবাহিনী এমনকি ভারতীয়বাহিনীতেও পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়।বাংলাদেশ বাহিনী পুনর্গঠনের সাথে সাথে সকল সেক্টরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানও অব্যাহত থাকে। আমাদের আক্রমণাত্মক তৎপরতা অক্ষুণ্ণ রাখা এবং লড়াইয়ের উদ্যমকে সমুন্নত রাখাই ছিল এর উদ্দেশ্য।

অপারেশন জ্যাকপট

ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৬ই মে বিএসএফ এর নিকট থেকে বাংলাদেশে পূর্ণ সামরিক তৎপরতা চালাবার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এক সপ্তাহ পরে ২৩শে মে ভাগীরথী নদীর তীরে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। এই ক্যাম্পের অবস্থান ছিল পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে। এর সাংকেতিক নাম দেওয়া হল ক্যাম্প ‘ সি২পি’।ক্যাম্পের জন্য লোক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর অফিসাররা বিভিন্ন যুবশিবির সফরে বেরিয়ে পড়েন। আমার ক্যাম্পে আগত নৌবাহিনীর অফিসার বললেন,’’ আমি কয়েকজন নিপুণ সাঁতারু বাছাই করতে চাই, তাদেরকে তরুণ এবন ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। জুন মাসের মধ্যে ১৫০ জন স্বেচ্ছাসেবকের প্রথম দলটি বাছাই করে ‘ সি২পি’ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। আগস্টের মধ্যে এরা কঠোর এবং শ্রমসাধ্য ট্রেনিং সম্পন্ন করে। পুরো ব্যাপারটাই ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর দায়িত্বে।

বাংলাদেশে নৌপথে সৈন্য এবং অন্যান্য সমর সরঞ্জাম পরিবহনের ব্যবস্থা বানচাল করার উদ্দেশ্যে জাহাজ এবং নৌযান ধ্বংস করাই ছিল এই উদ্যোগের লক্ষ্য অল্প খরচে দ্রুত লক্ষ্য অর্জনে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক দরকার ছিল যাদেরকে সাঁতারের এবং লিমপেট মাইনসহ বিভিন্ন প্রকার বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের ট্রেনিং দেওয়া যেতে পারে।এ কাজের জন্য উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকদের নিয়ে একটা বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় এ বিশয়ে বিস্তারিত কর্মসূচী প্রণীত হয় নৌবাহিনীর হেডকোয়াটারে। পরিকল্পনা অনুসারে চট্টগ্রামও মংলার সমুদ্রবন্দর, চাঁদপুর, দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ নগরবাড়ি, খুলনা, বরিশাল গোয়ালন্দ, ফুলছড়িঘাট এবং আরিচা ঘাটের নদীবন্দরগুলোর উপর সরাসরি আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।অভিযানের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়’ অপারেশন জ্যাকপট’। অপারেশন কার্যকরী করার চূড়ান্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় সংশিষ্ট সেক্টর কমান্ডারদের উপর।

২৮শে জুলাই আমি ডেল্টা সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং এর সাথে বসে চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম। চার ঘণ্টারও বেশী সময় আমরা বিস্তারিত আলোচনা করি এবং চট্টগ্রাম নদীবন্দর ও কর্ণফুলী নদীর ম্যাপও চার্ট পর্যালোচনা করি।চন্দ্রতিথি আবহাওয়ার অবস্থা, জোয়ার ভাটার সময়, বাতাসের গতিপ্রকৃতি, স্রোতের গতি এবং আরও অসংখ্য তথ্য আমাদের আলোচনায় প্রাধান্য লাভ করে। মে মাস থেকেই বন্দরের তৎপরতা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। আমরা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বন্দর এলাকা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার চিত্রও পেয়ে যাই। অপারেশনে আমাদের নৌ-মুক্তিযোদ্ধার কোথায় কি ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে তাও আমরা বিশদভাবে আলোচনা করি। বন্দরের জন্য পাকবাহিনী কি ধরণের রক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং সন্ত্রাসীরা কোথায় কিভাবে পাহারার ব্যাবস্থা করেছে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। সে সময়ে রাতের বেলায় নদীমুখে সকল প্রকার নৌ চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। প্রধান কয়েকটি গানবোট নিয়মিত টহলকার্যে নিযুক্ত ছিল। আমাদের পরিকল্পনা গোপন রাখতে পারলে এসব বাধা তেমন কোনই সমস্যা নয়। ঠিক হল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ১৪ই আগস্টে ৬০ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত তরুণ চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হল। রাতে তারা সাঁতার কেটে কর্ণফুলী পাড়ি দিয়ে যতবেশী সংখ্যক জাহাজে গিয়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দেবে।তারপর তারা ভাটার টানে দুরে সরে যাবে।

১০ আগস্ট ‘অপারেশন জ্যাকপট’ শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বাছাইকৃত ৬০ জন তরুণকে তিন ভাগে ভাগ করি। ১ এবং২ নম্বর গ্রুপ স্থলপথে মিরেশ্বরাই এবং চট্টগ্রাম শহর হয়ে কর্ণফুলী পূর্বপাড় চরলাক্ষার সর্বশেষ ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। ৩নম্বর গ্রুপ চারলাক্ষার উপনীত হবে নৌকাযোগে। তিনটি গ্রুপেরই সার্বিক কমান্ডে থাকবেন একজন কমান্ডার। তাদের সকলের কাছে থাকবে লিমপেট মাইন, একজোড়া ফিন( সাঁতারের সময় পায়ে লাগানোর জন্য) এবং শুকনো খাবার। প্রতি তিনজনের কাছে একটি করে স্টেনগান থাকবে। সার্বিক দায়িত্বে নিযুক্ত গ্রুপ কমান্ডারকে দেওয়া হয় হালকা অথচ শক্তিশালী একটি ট্টানজিস্টর সেট। তার জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের প্রতিটি সঙ্গীতানুষ্ঠান তাকে শুনতে হতো খুব মন দিয়ে। এতে ব্যর্থ হলে সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।

৯ আগস্টে হরিণা ক্যাম্পে তাদের চূড়ান্ত নির্দেশ দেই।পথপ্রদর্শক এবং কুলীসহ তাদের সকলকে বলে দেওয়া হয় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিভাবে অগ্রসর হতে হয়, পথে কোথায় কোথায় থামবে ইত্যাদি। প্রতিটি এলাকায় আমাদের বিশ্বস্ত গেরিলা বেস কমান্ডারের ঠিকানা দিয়ে দেওয়া হয় এরা তরুণদের খাদ্যও আশ্রয় দেবে এবং চরলাক্ষা যাওয়ার পথে ব্যবস্থা করবে। ১৩ই আগস্ট১নম্বরও২ নম্বর গ্রুপ চারলাক্ষার পূর্ববর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়। জায়গাটি চট্টগ্রামের কাছেই। পথে অবশিষ্ট অংশটুকু এদের জন্য খুবই মারাত্মক কারণ তাদেরকে শহরের ভেতর দিয়ে নৌকা দিয়ে নদী পার হতে হবে। তারপরই তাদের শেষঘাঁটি চরলাক্ষা।

এদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তান দখলদারবাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনী সাংঘাতিক আক্রমণ চালাবে। একারণে শত্রুরা ছিল পুরো সতর্ক অবস্থায়। সারারাত ধরে কারফিউ চলতো। লোকজনকে তল্লাশির জন্য পথে মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছিলো অসংখ্য চেকপোস্ট। মেশিনগান ফিট করা আর্মি জীপগুলো সারা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। নতুন করে আবার বাড়ি বাড়ি তল্লাশি শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা ঘেরাও দিয়েও অভিযান চালানো হয়।পথচারী সবাইকে কঠিন তল্লাশি শুরু হয়।এতসব তল্লাশি ফাঁকি দিয়ে শহরের মাঝখান দিয়ে পার হতে হবে ১নম্বরও ২নম্বর গ্রুপকে তারপর আছে নদী পার হওয়ার সময় তল্লাশির ঝামেলা। সেটি পার হলে আশা আছে সময়মত এই দুই গ্রুপ চরলাক্ষায় পৌঁছে যাবে। কিন্ত কনকারণে যদি দলের একজনও ধরা পড়ে তাহলে সমস্ত অভিযান বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা। তাই হামলাকারী দলের নেতাও আমাদের মত চিন্তিত ছিল।

আরও একটি কারণে এই দলের নেতা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নৌকায় করে ৩নম্বর গ্রুপটি ১৩নপম্বর ঘাঁটিতে পৌঁছার কথা ছিল, তারা সে ঘাঁটিতে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। এদিকে১৩ আগস্ট কলকাতা রেডিওর সঙ্গীতানুষ্ঠান শোনার ট্টানজিস্টর খুলতেই তার কানে ভেসে এলো পুরনো দিনের বাংলা গান’’ আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ী’’। এগানের ভেতর দিয়ে সে এবং তার দল প্রথম সংকেত লাভ করে। কমান্ডার জানে,আগামী২৪ ঘণ্টার আরেকটি গান সে শুনতে পাবে। ওটি শোনার পর সে ট্টানজিস্টর ফেলে দিতে পারবে। ‘ অপারেশন জ্যাকপট সফল না হওয়া পর্যন্ত তাদের আর কোন গান শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রেডিও শুনতে হবেনা।

নগরীতে মোতায়েন আমদের লোকেরা চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করছিলো। তারা মিশনের নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে একেবারে চরলাক্ষায় পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করে দেয় । রাস্তায় একটি এ্যাম্বুলেন্স এবং বিদ্যুৎ বিভাগের একটি পিকআপ দেখতে পেলেও পাকিস্তানী সৈন্যদের মনে তেমন প্রশ্ন জাগেনি। শুধু তাই নয়, পাকবাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে গেঁয়ো পোশাকপরা একদল লোক ফলমূল, মাছ, চাউল এবং লবণের ঝুড়ি নিয়ে ফেরী নৌকায় উঠলো এবং চালক যখন নিশ্চিত মনে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে কর্ণফুলীতে পাড়ি জমালো তখনও পাকিস্তানীরা কিছুই বুঝতে পারেনি। সবাই ভেবেছিলো বাজার সেরে বাড়ি ফিরছে। এইসব হাঁটুরে সওদার জন্যই আগেই তাদেরকে টাকাপয়সা দেওয়া হয়েছিলো । প্রতিটি ঝুড়ির একেবারে তলায় চটের থলেতে ছিল লিমপেট মাইন, ফিনা ইত্যাদি। আবার কোনটায় ছিল স্টেনগান।

১৪ই আগস্ট রেডিওতে দ্বিতীয় বাংলা গানটি শোনা গেলোঃ’’ আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম তার বদলে চাইনি কোন দান।‘’ আসলে এটা ছিল সাংকেতিক সংকেত। যার ফলে সেই রাতেই নৌ-মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানী জাহাজসমূহে আঘাত করার কথা।

কিন্ত দুর্ভাগ্য এই দলের অভিযান একদিন পিছিয়ে গেলো।৩ নম্বর গ্রুপ ছাড়া সকলেই রাতের মধ্যে চরলাক্ষায় পৌঁছে গিয়েছিলো। ৩ নম্বর গ্রুপের যোদ্ধারা প্রায় ৮০ মাইল হেঁটে আসার পর ১৪ই আগস্ট একদিন তাদের বিশ্রাম দরকার।দিনের আলোতে কিছুটা রেকিও করা দরকার। লক্ষ্যবস্তগুলো প্রতিটি সদস্যের দেখা উচিত। যেখান দিয়ে তারা পানিতে নামবে এবং কাজ শেষ করে যেখানে তাদের উঠতে হবে সেসব জায়গাও আগে থেকে তাদের দেখে রাখতে হবে। তাই একেবারে তাড়াতাড়ি করলেও পরবর্তী রাতের আগে আর কিছু হচ্ছেনা।

১৪ই আগস্ট এখানে কিছু না ঘটলেও শত্রপক্ষের জন্য সময়টি খুব স্বস্তির ছিলোনা। সারারাত্রি সমগ্র সীমান্ত এলাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে আমাদের যোদ্ধারা অসংখ্য আক্রমণ চালায়। আমাদের হতাশাগ্রস্তও জনগণও চাইছিলেন ১৪ই আগস্ট তাদের ছেলেরা কিছু একটা করুক। এমন কিছু করুক যাতে পাকিস্তানীদের উচিত শিক্ষা হতে পারে।

১৫ই আগস্ট চরলাক্ষায় আমাদের৪০ জন তরুণ যাদের অধিকাংশেরই বয়স বিশের কোটা পার হয়নি- তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে স্বল্পক্ষণের একটি ঘুম দেয়।

রাত ১টা। বন্দরনগরী পুরো নিদ্রামগ্ন। শান্ত নদীতে স্রোতের কুলুকুলু ধ্বনি। নিঃশব্দে ওরা নদীরপাড়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে যায়।অপর পাড়ের জেটিগুলো তখন বিদ্যুৎ আলোয় ঝলমল করছিল। সার্চলাইট ফেলে নদীর ওপর লক্ষ্য রাখছিল সান্ত্রীরা। ওরা ক্লান্ত। হয়ত ঘুমেঘুমে ঢুলুঢুলু।

১৪ই আগস্ট এবং তার পূর্ববর্তী কয়েকদিন পাকিস্তানীদের উপর বেশ বড়রকমের ধকল গেছে। এরাতে তাদের সকলেই যেন একটু নিশ্চিন্ত। পাকা প্লাটফরমের উপর লম্বা ক্রেনের ছায়াগুলো যেন ভৌতিক মনে হয়। তবে সান্ত্রীরা এই ছায়া চেনে। নদীর দিক থেকে তাদের ভয়ের কোন আশংকা নেই।কোন নৌকা কিংবা সাম্পান জাহাজের দিকে অগ্রসর করতে চাইলেই দেখা যাবে। সেক্ষেত্রে দূরপাল্লার কয়েকটি অস্ত্রের রাউন্ডই যথেষ্ট। কিন্ত তেমন কখনই ঘটেনি।

এমভি আল- আববাস এসেছে৯ই আগস্ট।১২নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা এই জাহাজ ১০,৪১০ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে।

একখানি বার্জে (ওরিয়েন্ট বার্জ নম্বর৬) ২৭৬ টন অস্ত্রশস্ত্রও গোলাবারুদ বোঝাই করে করে মৎস্য বন্দরের জেটির সামনে রাখা আছে। এটাকে ট্রেনে ঢাকা নিয়ে যাওয়া হবে।

এমভি হরমুজ ১৪ই আগস্ট চট্টগ্রাম পৌঁছেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে৯,৯১০ টন সমরসম্ভার।১৩ নম্বর জেটিতে জাহাজটি ভেড়ানো।

আরও কয়েকখানি জাহাজও বার্জ এদিকওদিক রয়েছে। নেভাল জেটিতে ছিল দুটি গানবোট এবং একখানি বার্জ। সন্ধার পরি গানবোট দুটি অজ্ঞাতস্থানের উদ্দেশ্য রওনা হয়ে যায়। আমাদের ছেলেদের কপাল খারাপ। এমন সুন্দর দুটি শিকার হাতছাড়া হল। রাত সোয়া আটটা। আল-আববাসও হরমুজের মাস্টার এবং ক্রুরা গভীর নিদ্রায় অচেতন। মিলিটারি এবং সান্ত্রীরা আধো ঘুম আধো জাগরণে ঢুলছে। রাত দুইটা বাজলে তাদের ডিউটি শেষ। আর মাত্র ৪৫ মিনিট বাকী। তারপর অন্যরা আসবে।

মাথাটা পানির উপর রেখে আমাদের ছেলেরা যার যার লক্ষ্যবস্তর কাছে পৌঁছে গেছে। কালবিলম্ব না করে তারা জাহাজগুলোর গায়ে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দিয়ে আবার তেমনি নিঃশব্দে নদীর ভাটিতে ভেসে যায়। আর দক্ষিণে সরে গিয়ে তারা পূর্বতীরে উঠে পড়ে। রাত পোহাতে তখনওঅনেক বাকি।নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় তারা পেয়ে যায়।সকাল নাগাদ তারা পটিয়া এবং সেখানে সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে১নম্বর সেক্টর হেডকোয়াটার হরিণার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।

রাত১টা ৪০মিনিট। হঠাৎ কান ফাটানো আওয়াজে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেঁপে উঠে। লোকজন শয্যা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে। শিশুরা ভয়ে কান্না করছে। কিন্ত কি ঘটছে তা কেউ বলতে পারেনা।

রাত১টা৪৫ মিনিট। আরেকটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তারপর তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম । একটির পর একটি বিস্ফোরণে চট্টগ্রাম তখন থরথর করে কাঁপছে। আতংক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।সান্ত্রীরা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলি ছুঁড়তে শুরু করে।৬ নম্বর ওরিয়েন্ট বার্জ দেখতে না দেখতে তলিয়ে গেলো।আল-আববাস এবং হরমুজও দ্রুত ডুবতে থাকে। জাহাজের খোলে প্রচণ্ড বেগে তখন পানি ঢুকছে। আশেপাশের বার্জগুলোও তখন ক্ষতিগ্রস্ত। বিস্ফোরণে জাহাজের ক্রুদেরও অনেকে হতাহত হয় কিন্ত ভয়ে কেউ সাহায্যের জন্য ওদিকে অগ্রসর হচ্ছেনা, পাছে আবার বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায়।

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সিনিয়র অফিসাররা বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। সমগ্র এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি করা হল। মুক্তিবাহিনীর খোঁজে হেলিকপ্টারগুলো আকাশে উড়ে গেছে। পাকিস্তানীরা তাদের জিঘাংসা মেটাতে নদীর পূর্বপাড়ের জনপদগুলোর উপর নির্বিচারে কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। নদীর পাড়ের গ্রামগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সন্দেহের বশবর্তী নিরাপদ গ্রামবাসী এবং জেলেদের ধরে এনে মুক্তিবাহিনীর খবর বের করার চেষ্টা করা হয়। শেষে কিছু না পেয়ে তাদের নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিরস্ত্র গ্রামবাসী আর জেলেদের লাশগুলো স্রোতের টানে ভেসে চলে সমদ্রের দিকে।

পটিয়াতে আমাদের যোদ্ধারা তখন বিশ্রাম নিচ্ছিল। তারা একটি অতিবিপদজনকও জটিল মিশন সফল করেছে। তাদের এই সফল অভিযান স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

ভোর তখন পাঁচটা। ঢাকাস্থ ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়াটারের অপারেশন রুমের কর্তব্যরত স্টাফ অফিসার ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ না করেই সত্ত্বর ঘটনা সম্পর্কে কোর কমান্ডারকে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। গেরিলাদের চাঁদপুর এবং মংলা বন্দরের হামলার খবরও কুমিল্লাও যশোর সেনানিবাস থেকে তড়িৎ গতিতে হেড কোয়াটারে পাঠানো হয়। এই সকল আক্রমণে একদিকে শত্রুর যেমন বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়, অপরদিকে পাকিস্তানীদের মিথ্যা দম্ভ আর অহমিক হয় ধূলিসাৎ। অপারেশন জ্যাকপট সফল হয় পুরোপুরিভাবে।

এই দিনের ঘটনা সম্পর্কে ১৬ই আগস্ট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তদন্ত রিপোর্টে লেখা হয়েছিলোঃ

‘’পরিস্থিতি পর্যালোচনার প্রেক্ষাপটে জাহাজের কোন ব্যক্তিকেই দায়ী করা চলেনা। কারণ পূর্ব থেকে কিছুই টের পাওয়া যায়নি এবং গেরিলারা যে এমন ধরণের অভিযান চালাতে পারে তা আগে থেকে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। অবশ্য নদীর দিকটা ভাল করে দেখাশোনা করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দিন রাত্রির কোন সময়েই নৌকা ইত্যাদি আর জাহাজগুলোকে ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছেনা।‘’(পাক সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত)

সামুদ্রিকও নদীবন্দরগুলোর উপর এই চমকপ্রদ হামলা পাকিস্তানীদের হতচকিত করে দিয়েছিলো। এমন দুঃসাহসিক অভিযান চালাতে পারে এটা ছিল পাকিস্তানীদের চিন্তারও বাইরে। এই হামলার আগ পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ –পদ্ধতি সম্পর্কে পাকিস্তানীরা মোটামুটি পরিচিত হয়ে উঠেছিলো। সারা দেশজুড়ে এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা ছোট ছোট হামলা চালায়। কিন্ত জুন-জুলাই মাসের এই ছোট ছোট হামলাগুলি ছিল কম তাৎপর্যপূর্ণ।হ্যান্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ , শত্রুর গাড়ি ধ্বংস , রাজাকার, দালাল,শান্তিবাহিনী বা আলবদর, আলশামস এর লোকজন হত্যার মধ্যে এসময়ের ঘটনাবলী সীমাবদ্ধ ছিল। কোন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষবস্তর উপর তখনও হামলা চালানো হয়নি শত্রপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিল তখন পর্যন্ত অক্ষত। এমনকি নেতৃস্থানীয় বাঙ্গালী দালালরা পর্যন্ত বেশ আয়েশের সাথে তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলো। মাঝে-মধ্যে এদের মধ্যে কয়েকটি পরিকল্পনাহীন হামলা হলেও তা ব্যর্থ হয়ে গেছে।মাঝখান থেকে গেরিলারা ধরা পড়ে পাকিস্তানীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে।
রণকৌশলের দিক থেকে শত্রপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রসমূহ বিভিন্ন হেডকোয়াটার,অফিসার মেস, অস্ত্রও রসদ গুদাম, বিদ্যুৎ ও জালানি কেন্দ্র, বন্দর, রেলওয়ে এসবের উপর আগস্ট পর্যন্ত কোন সুপরিকল্পিত হামলা হয়নি। ফলে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে বাংলাদেশ প্রশ্ন প্রায় মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দেশের মানুষের মনোবল কিছুটা যেন ভেঙ্গে পড়ে।

অন্যদিকে পাকবাহিনীর অবস্থা তখন বেশ সুবিধাজনক। যুদ্ধের প্রথমদিকে আমাদের নিয়মিতবাহিনী তাদের বেশকিছু ক্ষতি করেছিলো। শত্রুপক্ষের হতাহতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে মোটামুটি জানা যায় যে, পাঁচ থেকে ছয় হাজার শত্রুসৈন্য নিহত এবং তখন আট থেকে দশ হাজার আহত হয়েছিলো। আহতদের মধ্যে এক- তৃতীয়াংশ পুনরায় যুদ্ধ করার অনুপযুক্ত হয়েছিলো।

সামরিকভাবে গেরিলা তৎপরতা সন্তোষজনক না হলেও আমরা ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যই আশাবাদী ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ প্রচলিত পদ্ধতিতে ট্রেনিং পেতো এবং ট্রেনিং শেষ করেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদেরকে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে হতো।তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবারই বয়স কম, আবেগ বেশী। কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী। এরা প্রত্যেকেই গ্রুপলিডার কিংবা ঐ ধরণের কিছু একটা হতে চাইতো। এটা বুঝতে চাইত না সবাই লিডার হলে অনুসারী কোথা থেকে আসবে। অবশ্য যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এর চাইতে বেশি কিছু আমাদের আশা করার ছিল না।

এমনি যখন আমাদের অবস্থা যে সময়ে অপারেশন জ্যাকপট এর সাফল্য প্রমাণ করেছিলো যে, যথাযথ শিক্ষা এবং নেতৃত্ব দিতে পারলে আমাদের ছেলেরাও অবিশ্বাস্য কাজ করতে পারে। তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলোনা।তারা বুদ্ধিমান, কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে দ্রুত তা বুঝে নিতেও সক্ষম। তাদের মানসিক উৎকর্ষ ছিল নিঃসন্দেহে নিরক্ষর পাকিস্তানী সৈন্যদের চাইতে উত্তম। শিক্ষিত এক বিরাট গেরিলাবাহিনী আমরা পেয়ে ছিলাম, এটা আমাদের সৌভাগ্য।

সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিমাসে ২০ হাজার গেরিলাকে ট্রেনিং প্রদান করে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই হিসেবে ৭১ এর ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে গেরিলার সংখ্যা আনুমান করা হয় এক লাখের উপরে। এদের মধ্যে শতকরা৩০ ভাগ যথাযথভাবে কাজ করলেওপাকবাহিনীর পরিকল্পনায় একটা ভাঙ্গন ধরানো সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে গেরিলাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে। আর চূড়ান্ত আঘাত আনার সেটাই সুবর্ণ সুযোগ। একদিকে যেমন চলছিল এসব পরিকল্পনা, অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে ভারতও পাকিস্তান ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছিল একটা অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের দিকে।

কোণঠাসা

সেপ্টেম্বর থেকে ভারতে ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু হয়। ডিভিশনাল এবং কোর হেডকোয়াটারগুলো অগ্রবর্তী স্থানসমূহে অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে।সরবরাহ ব্যবস্থাও রণ প্রস্তুতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্ভাব্য- সংঘর্ষস্থল অভিমুখী সড়ক নির্মাণ,সেতুগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও মেরামতের কাজ পূর্ণ উদ্যমে শুরু করে। কতগুলো ইউনিট সীমান্তবর্তী ঘাঁটিসমূহে অবস্থান নেয়। ভূপ্রকৃতি এবং সম্ভাব্য রণাঙ্গনের অবস্থা বিশ্লেষণ সহ ব্যাপক পর্যবেক্ষণ তৎপরতা চলতে থাকে।

এদিকে আমরা প্রতিদিন ট্রেনিংপ্রাপ্ত শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠাচ্ছিলাম বটে, কিন্ত তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ফল পাচ্ছিলাম না।সকল স্তরে নেতৃত্বদানের অভাবই ছিল আমাদের প্রধান অন্তরায়। কোন স্থানেই আমাদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হচ্ছিল না এবং গেরিলা তৎপরতা আশানুরূপ জোরদার করার ক্ষেত্রেও পেছনে পড়ে যাচ্ছিলাম। এ সময়ে বাংলাদেশের নেতৃত্বেও শূন্যতা পূরণের জন্য, বিশেষ করে গেরিলা ঘাঁটিগুলোর জন্যকিছুসংখ্যক এম- সি- এ(গণপরিষদ সদস্য) কে ট্রেনিং দেওয়ার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। উপস্থিত এম-সি-এ দের যারা উৎসাহী এবং শারীরিক সমর্থ তাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের কায়দা কানুন বিশেষতঃ গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণও নেতৃত্বে দানের বিষয়ে ট্রেনিং প্রদানই এই প্রচেষ্টার লক্ষ্য। কথা ছিল ট্রেনিং এর পর তারা বাংলাদেশে যার যার এলাকায় গিয়ে গেরিলা তৎপরতা পরিচালনা করবেন। আমার সেক্টরে এম-সি-এ জনাব মোশারফ হোসেন এবং আর কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এব্যাপারে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গেরিলাদের নেতৃত্বদানের জন্য তাঁদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হয়েছিলো। অন্যান্য সেক্টরের কয়েকজন এম-সি-এ কে পাঠানো হয়। কিন্ত সারাদেশে একাজের জন্য প্রেরিত এম-সি-এদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। অল্প কয়েকজন এম-সি-এ ট্রেনিং করেছিলেন, যুদ্ধ করতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন তস্র চাইতেও কম। ফলে,পরিকল্পনাটি তেমন কোন কাজে আসেনি।

সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে একদিকে যখন ব্যাপকতর যুদ্ধ আসন্ন হয়ে আসছিল তখন অন্যদিকে সামরিক আরও জোরদার করার জন্য আমাদের অর্থাৎ সেক্টর কমান্ডারদের উপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। বলা হচ্ছিলো শত্রুকে ছত্রভঙ্গ করেও দুর্বল করে রাখতে হবে। তাহলে সহজে চূড়ান্ত অভিযান চালিয়ে তাদের পরাভূত করা সম্ভব হবে এবং এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে, সম্ভব হলে নভেম্বরের মধ্যেই।

অথচ অস্ত্রশস্ত্রও অন্যান্য দিক দিয়ে আমাদের যা সামর্থ্য তাতে করে এই সীমিত সময়ের মধ্যে আরদ্ধ দায়িত্ব পালন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমার ১ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিল মহুয়া নদীর সমগ্র পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পুরো চট্টগ্রাম, ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা। এখানে শত্রুপক্ষের শক্তি ছিল দুই বিগ্রেডের বেশী। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত আরও দুটি সামরিক ব্যাটালিয়ন এই অঞ্চলে শত্রুপক্ষের শক্তি বৃদ্ধি করছিলো। আমাদের পক্ষে ছিল ইপিআর, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর লোক নিয়ে তিনটি ব্যাটালিয়ন।সমগ্র সেক্টরে অফিসার পেয়েছিলাম সেনাবাহিনীর চারজন এবং বিমানবাহিনীর দুইজন। পাক সেনাবাহিনীর পক্ষে এখানে অফিসারের সংখ্যা ছিল অন্যূন ১৫০। ১ নম্বর সেক্টরে সাব সেক্টর করেছিলাম পাঁচটি। এর প্রতিটি কমান্ডে ছিল একজন অফিসার কিংবা একজন জেসিও। কমান্ডো সংক্রান্ত জটিল সমস্যাবলীর ব্যাপারে এঁদের অভিজ্ঞতা ছিল নিতান্তই সামান্য। আর আমার এলাকায় সক্রিয় যুদ্ধ চলছিলো অর্ধ শতাধিক মাইলেরও অধিক সীমান্ত এলাকাজুড়ে।

সেক্টর হেডকোয়াটারেই সমস্যার চাপ ছিল সবচাইতে বেশী। একজন মাত্র স্টাফ অফিসারকে সকল প্রশাসনিক এবং সরবরাহ ব্যবস্থা দেখতে হতো। কাজের মেয়াদ ছিল দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে সাতদিন। কাজের অসহ্য চাপে স্টাফ অফিসার শেষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্ত হাসপাতালে কয়েকদিন থাকার পর তাকে আবার কাজ শুরু করতে হয়। এই অবস্থায় কোন বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

আমাদের সরবরাহ ঘাঁটি ছিল আগরতলায়।তিন হাজার লোকের জন্য রেশন, জ্বালানী তাঁবুও অন্যান্য সরঞ্জাম,কাপড়চোপড়, অস্ত্রশস্ত্র, ঔষধপত্র সবকিছু সেখান থেকে নিয়ে আসতে হতো। সেই একই গাড়িতে করে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল পাড়ি দিয়ে এগুলো আবার বিভিন্ন সাব- সেক্টরে পৌঁছানো হতো। বৃষ্টি- বাদলের দিনে সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে আমাদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠছিল। কোন কোন সময় গাড়ি রাস্তার বাইরে গড়িয়ে পড়লে কিংবা হাঁটু সমান কাদায় চাকা বসে গেলে সেই গাড়ি না তোলা পর্যন্ত কিংবা রসদপত্র মাথায় করে গন্তব্যস্থলে না পৌঁছান পর্যন্ত সেখানে একজন অফিসারকে অপেক্ষা করতে হতো।

গেরিলা বাহিনীর প্রশাসনিক এবং অভিযান নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত দায়িত্ব ছিল আরও কষ্টকর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিযুক্ত লাভের আশায় শত শত গেরিলা আমার হেড কোয়াটারে আসতো। তাদেকে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করতে হতো, তারপর আসতো দায়িত্ব সম্পর্কে তাদেরও ব্রিফিং এর পালা। প্রতিটি গ্রুপকে ব্রিফিং করতে কম করে হলেও এক ঘণ্টা সময় লাগতো। বিশেষ কাজের জন্য ব্রিফিং এ সময় লাগতো আরও বেশী।প্রত্যেক গ্রুপকেই অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রাহা খরচ দিতে হতো। ছেলেদের নিরাপদে ভেতরে পাঠানোর জন্য শত্রুবাহিনীর তৎপরতা ও চলাচল সংক্রান্ত সর্বশেষ খবর সংগ্রহ করতে হতো। টহলদাতা শত্রুসেনারা এক জায়গায় থাকতো না বলে সর্বশেষ খবরেও পরিবর্তন ঘটতো। এদের কাছে গাইড থাকতো। তারা নিরাপদ রাস্তা ধরে নিকটবর্তী ঘাঁটিতে(সাধারনতঃ সীমারেখা থেকে ৮-১০ মাইলের মধ্যে) গেরিলাদের পৌঁছে দিতো। নতুন আগন্তকদের সম্পর্কে আগেই ঘাঁটিতে খবর দেওয়া থাকতো। সেখানে তাদের খাদ্যও আশ্রয়ের ব্যবস্থা হতো। একই পদ্ধতিতে সেখান থেকে তাদের রওয়ানা হতে হতো পরবর্তী ঘাঁটিতে। তাদেরকে অতি সাবধানে আক্রমণস্থলের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য যানবাহনের দরকার হতো। প্রত্যেক গ্রুপ সদস্যের নাম-ঠিকানা, তাদের পরিকল্পিত পথ, ঘাঁটি, অস্ত্র-শস্ত্র, গোলাবারুদের হিসাব, কাপড়চোপড়, রেশন, পথ খরচের টাকা পয়সা সবকিছুর বিস্তারিত রেকর্ড রাখতে হতো। দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর প্রতিটি গ্রুপের সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হতো। তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা এবং নির্ধারিত দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার ব্যাপারেও আমাদের তৎপর থাকতে হয়। গ্রুপ গুলো নিরাপদ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাওয়ার পর আমাদের তারা সে খবর জানিয়ে দিতো। তারা কোন অভিযান চালালে কিংবা শত্রুপক্ষের কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে তাও আমাদের জানাতে হতো। আমাদের সেক্টরের ভিন্ন জায়গায় তিনটি গোপন অয়ারলেস সেট চালু ছিল। এগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আমরা নিয়মিত খবর সংগ্রহ করতাম। এছাড়া খবর সংগ্রহ করে এক বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলাম। বিভিন্ন দলের কাছে খবর নিয়ে এরা সেক্টর হেড কোয়াটারে পৌঁছে দিতো। ফেরার পথে আবার তারা বিভিন্ন দলের গাইড হিসেবে কাজ করতো।এইভাবে তাদের আবর্তনমূলক কাজ চলতো দিনের পর দিন। চতুর্দিকে সবসময় সবকিছু চালু রাখাই ছিল আমাদের প্রধান দায়িত্ব।এর যেকোন একটা থামলেই বিপদের সম্ভবনা।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত সকল শ্রেণীর লোকেরই তখন সঙ্গীন অবস্থা।মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, আর্মি হেডকোয়াটার নেতৃবৃন্দ কিংবা ফ্রন্ট লাইনে সংগ্রামরত যোদ্ধা সকলেরই অবস্থা অভিন্ন। যুদ্ধরত সৈনিকও গেরিলাদের উপর নির্দেশ আসতে থাকে যুদ্ধ আরো জোরদার করার।মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুকে অনবরত আঘাত হেনে চলেছিল। তাদের হাতে বিপুল সংখ্যক শত্রু নিহত কিংবা আহতও হয়েছে। নিজেরাও হতাহত হয়েছে। কিন্ত কোনদিন এর স্বীকৃতি অথবা প্রশংসা তারা খুব বিশেষ পায়নি। একারণে স্বভাবতই তারা ছিল ক্ষুব্ধ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের একেবারে উত্তরপ্রান্তে ডেমাগিরিতে কয়েক শত ছেলে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন জ্বরেও রক্ত আমাশয়ে মারাও গেছে। অন্যদেরকে দিনের পর দিন সপ্তাহের পর সপ্তাহ অনাহারে কাটাতে হয়েছে। শত মাইল দুর্গম এবং পার্বত্য অঞ্চলও নিবিড় বনানী পার হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা এসেছিলো। কিন্ত কেউ তাদের সম্পর্কে সামান্যতম আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তারা যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল তার স্বীকৃতিও কারো কাছ থেকে তারা পায়নি।

যুদ্ধে নিয়োজিত গেরিলাদের শতকরা পঞ্চাশ জনের জন্য ভারত অস্ত্রও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিলো(পরে অবশ্য শতকরা৯০ জনকে অস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়।) বাকী ছেলেদের খালি হাতে যুদ্ধে পাঠানো কিংবা অপেক্ষা করতে বলা ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর ছিলোনা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেডকোয়াটারের নির্দেশ ছিল অস্ত্র ছাড়া কাউকে যাতে গেরিলা যুদ্ধে পাঠানো না হয়। আমাদের সবচাইতে সহজ উপায় ছিল দুই গ্রুপের অস্ত্র দিয়ে তিন গ্রুপকে পাঠানো। ফলে প্রতিটি গ্রুপে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ছেলেকে সরবরাহের অপ্রতুলতার জন্য বসিয়ে রাখতে হতো। এদের জন্য আবার রেশন পেতাম না, ফলে সমস্যা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতো। আমরা স্থানীয়ভাবে এর কিছুটা সমাধান বের করেছিলাম। সকল অফিসার, জেসিও এবং অন্যান্য রাঙ্কের সৈনিকরা মিলে একটা মাসিক চাঁদার ব্যবস্থা করেছিলাম। এর মাধ্যমে যা আয় হতো তা দিয়ে বাড়তি আহার যোগানোর চেষ্টা চলতো। এই ব্যবস্থা ছিল অনিয়মিত এবং পরিস্থিতির চাপে পড়েই আমাদের এটা করতে হয়েছিলো। অথচ এর জন্যও আমাদের ভুল বোঝা হতো, আমরা হতাম সমালোচনার পাত্র। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের সম্পর্কে গোপনে চিঠিতে লিখতেন,’’ বাংলাদেশের সেক্টর কমান্ডাররা পুরো নিয়ম নেনে চলছেন না’’। এবিষয়ে ভারতীয় অফিসারদের এই মতামত সম্ভবত অনেকাংশে সঠিক ছিল। তাদের উপর ভারতীয় আর্মি হেড কোয়াটারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতো, গেরিলাদের ট্রেনিং শেষ হওয়ার তিন চার দিনের মধ্যে সকলকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে তা সে সবাইকে অস্ত্র সরবরাহ করে কিংবা মাত্র কিছু অস্ত্র সরবরাহ করেই হোক। কিন্ত আমাদের উপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেডকোয়াটারের নির্দেশ ছিল সবাইকে অস্ত্র সজ্জিত না করে কোন গ্রুপকেই যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধে পাঠানো না হয়।

বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়াটার এবং ভারতীয় আর্মি হেডকোয়াটারের মধ্যে সমন্বয় তখনও পুরো গড়ে উঠেনি বলেই হয়ত আমাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো।

গেরিলা যোদ্ধা

আগস্ট মাস থেকেই কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী বাংলাদেশের একমাত্র তৈল শোধনাগারটি অচল করার জন্য চাপ দিচ্ছিলাম। কিন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র দুটি ধ্বংস হলে পাকিস্তানীদের চাইতে আমাদের ক্ষতি বেশি হবে বলে মনে করে আমি দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করি। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং জ্বালানির অভাব দেখা দিলে শত্রুদের যান চলাচল সীমিত হয়ে পড়বে এবং এতে করে তাদের তৎপরতাও হ্রাস পাবে। কিন্ত আমার মনে হচ্ছিলো কেন্দ্র দুটি ধ্বংস না করেও অন্যভাবে আমাদের লক্ষ্য হাসিল করা সম্ভব।

আমরা ভাবনাকে সামনে রেখে একটি নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার সাবেক সিং এর সঙ্গে কথা বলি। তিনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ১,২,৩ নম্বর সেক্টরের কার্যক্রমও চাহিদা সংক্রান্ত বিষয়ে সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিলঃ

১। মদনঘাটে বিদ্যুৎবিভাগের সাব- স্টেশন ধ্বংস করা।
২। কাপ্তাই এবং চট্টগ্রামের মধ্যে যতগুলি সম্ভব বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করতে হবে।

আমার বিশ্বাস ছিল দুটি কাজ করতে পারলেই শত্রুপক্ষের বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে এবং এতে করে ওদের বাণিজ্য অন্যান্য জাহাজ নোঙ্গরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে।

যথারীতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে একাজের জন্য আমি আমার সাথে কার্যরত বিমানবাহির নির্ভীক অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতানকে মনোনীত করলাম। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি তাকে পরিকল্পনাটি বুঝিয়ে দিলাম এবং রেইডিং বাহিনীর সদস্যদের বেছে নিতে বললাম। এরপর সবাই মিলে আমরা কয়েকটি মহড়া দিলাম। রেইডিং পার্টির সদস্যদের কি কাজে পাঠানো হতো তা আগে থেকে বলা হতোনা। একেবারে সর্বশেষ ঘাঁটিতে পোঁছানোর পর যখন লক্ষ্যবস্তর উপর আঘাত হান্তে যাবে ঠিক তখনই তাদেরকে বলা হবে, তার আগে নয়। সুলতান তার দলের লোক এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র বেছে নিলো। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করা ছাড়াও সুলতানের উপর ঐ এলাকার গেরিলা তৎপরতা হ্রাস পাওয়ার কারণ নির্ণয়ের দায়িত্ব দেওয়া হল।

১১ই সেপ্টেম্বর সুলতানের সঙ্গে কয়েকজন বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং কিছু সংখ্যক নিয়মিত সদস্যকে হরিণা থেকে এ অভিযানে পাঠানো হল।

৩রা অক্টোবর তার পার্টি দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে শহর থেকে মাইল খানেক দূরেই মদনাঘাটের ট্রান্সফরমার ধ্বংস করে দিলো। বহুসংখ্যক বৈদ্যুতিক পাইলনও উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে কাপ্তাই থেকে সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। বিশেষভাবে সুরক্ষিত মদনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চারদিকে ছিল ইটের দেওয়াল আর দুর্ভেদ্য কাটাতারের বেড়া। এখানে মোতায়েন থাকতো ১০জন নিয়মিত সৈন্য এবং২০ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যের একটি প্লাটুন। তারা সবসময় চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল। তার মধ্যে থেকে সুলতান তাঁর দল নিয়ে শত্রুর উপর সফলতার সাথে এই আক্রমণ সম্পন্ন করে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে বন্দরের জাহাজ ধ্বংসের পর আবার দুঃসাহসী হামলায় শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারলো যে গেরিলারা ক্রমান্বয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

অভিযান শেষ করে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান ঐ এলাকার অধিকাংশ গেরিলা গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করে তাদের অসুবিধা এবং সমস্যাবলী নিয়েও আলোচনা হয়। ১১ই অক্টোবর সুলতান হরিণায় এসে বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন।

গেরিলারা গ্রামাঞ্চলে বেশ কার্যকর অবস্থান গড়ে তুলেছিল। বস্তুতঃ সারা দেশটাই তখন পুরো গেরিলাঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিলো।ফলে যখন তখন যেকোনো দিকে সৈন্যরা অভিযান চালাতে পারতো। রাতগুলো ছিল একান্তভাবেই তাদের। ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা পারতপক্ষে রাতের বেলা বাইরে বের হতো না।

আমাদের পক্ষে জনগণের সমর্থন ছিল ব্যাপক। গেরিলাদের সাহায্যে আসতে পারলে লোকজন সম্মানিত এবং গর্ব অনুভব করতো। গেরিলাদের খাদ্য ও আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানীরা বহু লোককে হত্যা করেছে, তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে, সহায়- সম্পত্তি লুট করে সেই লুটের মালের বখরা পুরষ্কার হিসেবে রাজাকারও দালালদের দেওয়া হয়েছে। এতদশত্বেও জনগণের হৃদয় আবেগ এবং উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, যখন দেখেছে অল্প বয়সী তরুণেরা ভারী অস্ত্র- গোলাবারুদের ভারে নুজ্জ হয়েও দৃঢ় প্রত্যয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে শত্রু হননের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাংলার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানানোর জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে দিনের পর দিন। দেশের ভেতরে অবস্থানকারী লোকজন যদি সেদিন এই ত্যাগ স্বীকার না করতো তাহলে অঙ্কুরেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটতো।

যুদ্ধের মুখোমুখি

আমরা সিদ্ধান্ত নেই, রণকৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং যেসব সীমান্ত ফাঁড়িতে শত্রুর পাহারা একটু কম, সেগুলো দখলের মাধ্যমেই আমাদের অভিযান শুরু হবে। প্রতিটি অভিযান শুরুর পূর্বেই ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের সহয়তা করবে। সীমান্তবর্তী এলাকা এবং সীমান্ত ফাঁড়ি দখল পরিকল্পনার পেছনে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, সেগুলো হচ্ছেঃ

(ক) এইসব সীমান্ত ফাঁড়ি বা সীমান্ত এলাকা দখলের যুদ্ধে আমাদের বাহিনীর দক্ষতাও দুর্বলতা আমরা নিরূপণ করতে পারবে।
(খ) সকলকে বলে দেওয়া হবে এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা বদ্ধপরিকর। এবং আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।এতে করে শত্রুরা গেরিলা বিরোধী তৎপরতা কমিয়ে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থায় আরো বেশী শক্তি নিয়োগ করবে। শত্রুদের এভাবে সীমান্ত এলাকায় ব্যস্ত রাখতে পারলে দেশের অভ্যন্তরভাগে শত্রুর সংখ্যা কমে যাবে, ফলে গেরিলাদের কাজ আরও সহজ হবে।
(গ) এধরণের সংঘর্ষের মাধ্যমেই শত্রুর প্রস্তুতি এবং তার প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রাও আমরা পরিমাপ করতে পারবো।

সীমান্তরেখা বরাবর আমাদের তৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাকিস্তানীরা ঠিকই অভ্যন্তর ভাগের শক্তি কমিয়ে সীমান্তে এনে সৈন্য জড় করতে থাকে। এতে বিভিন্ন স্থানের পরিস্থিতি গেরিলাদের অনুকূল হয়ে উঠে।অবশ্য,এই সঙ্গে কিছু অসুবিধাও দেখা দেয়। সীমান্ত এলাকায় শত্রুর শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের সেই পথ দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। ভেতরে প্রবেশের প্রায় সকল পথই শত্রুসৈন্যরা বন্ধ করে দেয়।
২২শে সেপ্টেম্বর চম্পকনগর সীমান্ত ফাঁড়ি এবং প্রধান সড়কের উপর গুরুত্বপূর্ণ বল্লভপুর এলাকা দখল করার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালাই। আক্রমণের আগে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী লক্ষ্যস্থলের উপর গোলাবর্ষণের মাধ্যমে শত্রুর সুদৃঢ় অবস্থানগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে।

কিন্ত দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার যুদ্ধের পর আমরা পশ্চাদপসরনে বাধ্য হই। কামানের গোলায় শত্রুর তেমন ক্ষতি হয়নি। পাকিস্তানী বাংকারগুলো ছিল খুব মজবুত। প্রতিটি প্রতিরক্ষা বাংকারেই শত্রুরা ভূগর্ভে কয়েকদিন থাকার মতো রসদপত্র মজুত রেখেছিলো। ঘাঁটিগুলোর মধ্যে ট্রেঞ্চপথে যোগাযোগ ছিল। তাছাড়া আমরা যা অনুমান করছিলাম তার চাইতেও বেশী ছিল তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সম্ভার।

চম্পকনগর সীমান্ত ফাঁড়ি আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ক্যাপ্টেন মাহফুজকে। ফাঁড়ির ডান পাশ দিয়ে নিজেদের আড়াল করে আমি ওদের অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেই। কিন্ত লক্ষ্যস্থলের চারপাশে কয়েকশ গজ এলাকা গা ঢাকা দেওয়ার মতো তেমন কোন ফসলের ক্ষেত, উঁচু ভূমি অথবা বন-জঙ্গল ছিলোনা। পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড় থেকে আমি যুদ্ধ পরিচালনা করছিলাম। ফাঁড়িটি থেকে এর দূরত্ব ছিল আটশ গজের মতো। সেখান আমি থেকে লক্ষস্থলের অনেক কিছুই দেখতে পারছিলাম। অয়ারলেসে মাহফুজ আমার সাথে যোগাযোগ রাখছিল। আমাদের বাহিনী কভার দেওয়ার জন্য কামানসহ ভারতীয় গোলন্দাজবাহিনীর একজন পর্যবেক্ষকও আমার সাথে ছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার আগে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়।কামানের গোলাবর্ষণ শেষ হলে আমাদের বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। এসময় শত্রুরাও প্রচণ্ড বেগে গুলিবর্ষণ শুরু করে।ফাঁড়ির ডান এবং বাম পার্শ্ব থেকেই একটি করে মেশিনগান আমাদের কোম্পানীকে যথেষ্ট বিপাকে ফেলে দেয়।দুর্ভাগ্যক্রমে মাহফুজের একমাত্র অয়ারলেস সেটটিও বিকল হয়ে পড়ে। একটির বেশী দেবার মত মজুত কোন সেট আমাদের ছিলোনা। অয়ারলেস সেট নষ্ট হতেই মাহফুজ তার প্লাটুনের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে এবং আমারওমাহফুজের মধ্যকার সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরেই শুভপুর সেতুর দিক থেকে পাকিস্তানীদের কামানের গোলা আমাদের উপর এসে পড়তে থাকে।এদিকে কবেরহাট এলাকা থেকে আরও শত্রুসৈন্য দ্রুত চম্পকনগরে এসে পৌঁছায়।

কামানের গোলা, বিশেষ করে এয়ারবাস্ট শেল বিস্ফোরণের ফলে আমাদের কোম্পানীর পক্ষে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিলনা। পাকিস্তানী মেশিনগানগুলোর অবস্থান জানার জন্য আমি মাহফুজের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করি।অবস্থান জানতে পারলে ভারতীয় কামান থেকে মেশিনগানের উপর গোলাবর্ষণ করা যেতো।আমাদের অবস্থান থেকে আমি কিংবা গোলন্দাজ পর্যবেক্ষক কেউই মেশিনগানগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ায় আমাদের সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

এই পরিস্থিতিতে কোম্পানীকে আরও এগিয়ে যেতে আত্মহত্যারই শামিল ছিল।

বল্লভপুর এলাকাতেও আমাদের কোম্পানী কমান্ডারকে শুরুতেই থমকে পড়তে হয়। তার দুটি প্লাটুন লক্ষ্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, কিন্ত প্লাটুন কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য তার হাতে কোন অয়ারলেস সেট ছিলোনা। প্লাটুন দুটির সন্ধান লাভের জন্য তখন সে বার্তাবাহক পাঠায়। তাদের খুজে পাওয়া গিয়েছিলো বটে, কিন্ত তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিনের আলো ফুটতেই পাকিস্তানীরা আমাদের দেখে ফেলে এবং তাদের কামানগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে।

এই দুটি আক্রমনেই একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা অভাবে সফল হতে পারিনি।কোম্পানী কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য আমার কাছে অয়ারলেস সেট ছিল অপ্রতুল আর প্লাটুন কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য কোম্পানী কমান্ডারদের কোন অয়ারলেস সেট ছিলোনা।নিজের প্লাটুনগুলোর সাথে সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকলে কোন কোম্পানী কমান্ডারের পক্ষে রাত্রে এধরণের আক্রমণ চালানো বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে।
সাময়িকভাবে আমরা ব্যর্থ হলেও এ দুটো প্রচেষ্টার ফলে আমরা বুঝতে পারি আমাদের সেনারা যুদ্ধের জন্য উল্লেখযোগ্য দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। যথাযথভাবে পরিকল্পনা নেয়া হলে এবং যোগাযোগের সরঞ্জামও ভারী অস্ত্র শস্ত্রের সাহায্য পাওয়া গেলো, আমাদের বিশ্বাস ,নিশ্চয়ই আমরা জয়ী হতে পারবো।

যুদ্ধের তখন ছয় মাস চলছে। এসময়ে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো ঘটনা ঘটে। এগুলো পরোক্ষভাবে আমাদের স্বাধীনটা যুদ্ধের ওপর প্রভাব নতুন বিস্তার করে।ঘটনাগুলির একটি হচ্ছে ভারতও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি সাক্ষর। চুক্তি অনুযায়ী দুদেশ কোন সংকটও বহিঃশত্রুর আক্রমণের মুখে পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসবে বলে অঙ্গীকার করে। চুক্তি সাক্ষরের পর আমাদের সাহায্য করার ব্যাপারে ভারত আরও বলিষ্ঠ ভুমিকা গ্রহণ করে। ভারতের সরকার এবং জনগণ বুঝতে পারে বাংলাদেশ প্রশ্নে তারা যে পদক্ষেপ সে ব্যাপারে এখন তারা একা নয়। অচিরেই এই প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রভাবে ভারতে এবং বাংলাদেশে বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ভারত এতদিন পর্যন্ত খুব সন্তর্পণে এবং সাবধানে এগিয়ে চলছিলো। চুক্তির পর আমাদেরকে সর্বাত্মক সাহায্যের ব্যাপারে তার সমস্ত দ্বিধাদ্বন্ধ কেটে যায়।

এদিকে দুপক্ষের যুদ্ধের পরিকল্পনা আরও ব্যাপকতর হয়ে উঠে। গেরিলাদের মধ্যে যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়। প্রতিদিনই সড়কও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ চলতে থাকে। প্রকাশ্য দিনের বেলাতেও হামলাও অ্যামবুশ শুরু হয়ে যায়। ভারতীয়ও পাকিস্তানীদের উভয় পক্ষের কামানের গর্জনে সীমান্ত এলাকা হয়ে উঠে চরম উত্তেজনাময়।

এদিকে ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের ন্যাগাল্যান্ডে বাংলাদেশী পাইলটরা ট্রেনিং শুরু করে। গোড়াপত্তন হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর। প্রায়ই একই সময় পাকিস্তানী নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা ৪৫ জন নৌসেনা নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীরও গোড়াপত্তন হয়। সেপ্টেম্বরে আমরা দুটি নৌযানও সংগ্রহ করি। এম-ভি পলাশ এবং এম-পি পদ্মা নামের জাহাজ দুটি ছিল কলকাতা পোর্ট কমিশনারের। প্রায়৩৮ লাখ টাকা খরচ করে এগুলো যুদ্ধের উপযোগী করে তোলা হয়। প্রতিটি নৌযানে দুটি করে ৪০ মিলিমিটার কামান( এল-৬০) বসানো হয়।

অক্টোবরের মধ্যে দুটি জাহাজই অভিযান শুরু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠে। ‘’অপারেশন হট প্যান্টস’’ সাংকেতিক নামে শুরু হয় অভিযান, যার লক্ষ্য ছিল খুলনাও মংলা এলাকায় শত্রুপক্ষের নৌযানের উপর আঘাত হানা এবং পসুর নদীর মোহনায় মাইন স্থাপন করা।

হতবুদ্ধি ইয়াহিয়া

অক্টোবর থেকে গেরিলাদের তৎপরতা সম্পর্কে উৎসাহব্যঞ্জক খবর পেতে থাকি। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে পণ্যসামগ্রী বাইরে প্রেরণ এবং বাইরে থেকে সামরিক সরঞ্জাম ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসা অব্যাহত গতিতেই চলতে থাকে।বাইরের যেসব মালামাল আসতো সেগুলো আবার যথারীতি দেশের ভেতর বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাচ্ছিলো। নৌবাহিনীর ডুবুরীদের সাফল্যজনক তৎপরতা সত্ত্বেও নৌ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে আমরা বিশেষ সফলতা লাভ করতে পারিনি। বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বেশ কতগুলো কারণে দেখা যায় পাকিস্তান সরকার তার নৌযোগাযোগ মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে চালু রাখতে সমর্থ হয়েছিলো।

(ক) বিদেশী শিপিং কোম্পানীগুলিকে পাকিস্তান সরকার যেকোনো সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় ক্ষতিপূরণ দানের প্রস্তাব করেছিলো।
(খ) অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলোকে মোটামুটি ব্যাপকভাবে সশস্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সহ নৌযানগুলোর চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।
(গ) উপকূল এলাকা এবং সামুদ্রিক বন্দরগুলোতে গানবোটের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়।
(ঘ) শত্রুরা নৌ কমান্ডোদের কার্যপদ্ধতি জেনে যাওয়ায় তারা পর্যাপ্ত রক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করে।

পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমরা বেশি করে নৌকমান্ডো নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেই। আমরা আরও যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করি সেগুলো ছিলঃ

(ক) আই ডব্লিও টি এ জাহাজগুলোতে ক্রু হিসেবে নৌকমান্ডো নিয়োগ করা।
(খ) নদীর তীর এবং সাগরের উপকূল থেকে সুবিধাজনক দূরপাল্লার হাতিয়ারের সাহায্যে নৌযানগুলোর উপর সরাসরি আক্রমণ চালানো এবং
(গ) এতদঞ্চলের আবহাওয়াগত কারণে সকাল সন্ধায় সৃষ্ট মৌসুমি কুয়াশার সুযোগ নিয়ে লিমপেট মাইন দ্বারা পাকিস্তানী জাহাজগুলোকে ধ্বংস করা।

১২ই অক্টোবর ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষায় ‘ জাতীয় জীবনের এই ভয়াবহ মুহূর্তে আল্লাহও ইসলামের নামে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার পিছনে ঐক্যবদ্ধ হতে বললেন। বিরস, গম্ভীর, মাদালস কণ্ঠে তিনি বললেনঃ-

(ক) পাকিস্তানের সমগ্র সীমান্ত বরাবর ভারত ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে।
(খ) ট্যাংক, গোলন্দাজ ইউনিট এবং বিমানবাহিনীকে পাক সীমান্তের কাছে এনে জড়ো করা হয়েছে(তার জিজ্ঞাসা ‘এসবের অর্থ কি?’) এবং
(গ) চট্টগ্রামও মংলা বন্দরে নৌবাহিনীর ডুবুরীদের হামলা হয়েছে। সড়ক, রেলপথও সেতু ধ্বংস করা হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।

ইয়াহিয়ার এই বিশেষ বক্তৃতায় বিশেষ কয়েকটি দিক লক্ষণীয়। সবকিছুর জন্য তিনি ভারতকেই দোষারোপ করেছেন এবং সচেতনভাবে মুক্তিবাহিনীর কথা এড়িয়ে গেছেন।

এতে পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, তিনি যুদ্ধ করার একটি অজুহাত খুঁজছেন। এক বদ্ধ উন্মাদ যে মুক্তিবাহিনীর আঘাতে ক্ষত বিক্ষত, ক্রোধোন্মত্ত তার কথায় সেটাই প্রমাণিত হল। ততদিনে তাকে আমরা আরও নির্মম আঘাত হানার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি।

জুলাই মাস থেকে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার তেল ।সংরক্ষণাগারে একটা আক্রমণ চালানোর জন্য আমরা পরিকল্পনা করছিলাম। একাজের জন্য বিশেষভাবে বাছাই করা ছেলেকে আলাদাভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়। কিন্ত উপরোক্ত হাতিয়ার না পাওয়ায় অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। পাকিস্তান বিমানের জন্য উচ্চদাহ্য শক্তি সম্পন্ন জ্বালানি ভর্তি ট্যাংকগুলো ছিল প্রধান আকর্ষণ। ১৬ই অক্টোবর ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণপরিষদ সদস্য মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে বিশেষ দলকে উক্ত তেল সংরক্ষণাগারে আক্রমণের জন্য পাঠানো হয়। আক্রমণের আগের রাতে শত্রুরা কিভাবে যেন শহরে গেরিলা দলের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়।চট্টগ্রামে তারা যেখানে উঠেছিলো পাকিস্তানীরা সে এলাকা ঘিরে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে একটি ড্রেনের ভেতর দিয়ে আমাদের পুরো দলটি আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। কিন্ত তাদের অস্ত্রশস্ত্র খোয়া যায়। ফলে পরিকল্পনা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

ওদিকে ইয়াহিয়া খান ভারত আক্রমণের একটি যথাযথ অজুহাত খুঁজছিলেন।তিনি ভেবেছিলেন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে একটি মারাত্মক আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সমস্যা থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যাবে। তার সমর অধিনায়করাও সে ধরনের একটি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সৈয়দপুরে এক জনসমাবেশে পাকিস্তানী ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেঃ জেনারেল নিয়াজী ঘোষণা করলেন, উভয় ফ্রন্টের পরবর্তী যুদ্ধ ভারতের মাটিতে হবে।নিয়াজীর মুখ থেকে কথাটা বোধহয় বেফাঁস বেরিয়ে পড়েছিলো- কারণ ইয়াহিয়া খান তখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে যুদ্ধের কথা বলেননি। কিন্ত না বললে কি হবে ২০ এবং ২২শে অক্টোবর পাকিস্তানীরা সীমান্ত থেকে ভারতের অভ্যন্তরে কমলপুর গ্রামের উপর গোলাবর্ষণ করলো। যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানী উস্কানিমূলক তৎপরতায় বহুসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং আহত হল। একদিন পর ২৩ অক্টোবর পাকবাহিনী পশ্চিম ফ্রন্টের সম্ভাব্য রণাঙ্গনগুলোতে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে।

অঘোষিত যুদ্ধ শুরু

নভেম্বর নাগাদ ভারতের তিনটি কোরের অধীনে সাতটি পদাতিক ডিভিশন যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কুম্ভীগ্রামের ঘাঁটি পুনরায় চালু করা হয় এবং নৌবাহিনীর ইস্টার্ন ফ্লীটকে সক্রিয় করা হয়। যেকোনো আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তাদের ব্যাপক পরিকল্পনা তখন চূড়ান্ত।

ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তানের সকল দুষ্কর্মের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। এসময়ই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বেলুনিয়া পুনর্দখল করার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। একই সঙ্গে অন্যান্য সেক্টরেও অনুরূপ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বেলুনিয়া ৫ই নভেম্বর আক্রমণের(ডি-ডে) নির্ধারিত হয়।

কিন্ত ৪ঠা নভেম্বর এক মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা সকলেই বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা সেদিন রাত সাড়ে৮টায় মারা যান। বেলুনিয়া অভিযানে তিনটি কোম্পানীকে তার নেতৃত্বে রাখার পরিকল্পনা ছিল। অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে সৈন্যরা তাকে ভালোবাসতো, প্রশংসা করতো। আমি নিজেও দেখেছি কি নির্ভীকভাবে রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী এলাকায় তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।এরুপ একজন অফিসারকে দেখলাম তাঁর ক্যাম্পের মধ্যে পড়ে আছেন, প্রাণহীন নিস্পন্দ। জায়গাটি রক্তে ভেসে গেছে, মাথার খুলী ছিন্নভিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে চারদিকে ছড়ানো।কয়েক মিনিট আগেও তিনি তাঁর সৈন্যদের সাথে কথা বলেছেন, পরের দিনের অভিযান সম্পর্কে কয়েকটি চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। যতদূর জানা যায়,বাড়ি থেকে তাঁর খুব খারাপ খবর এসেছিলো। বিগত কয়েকমাস ধরে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে যুদ্ধ করছিলাম।অনিশ্চয়তাও হতাশায় মনোবল ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কিছু লোকের পক্ষে। আমার সেক্টরে বাড়িঘর নিয়ে কিংবা পারিবারিক কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম। খুবই নিষ্ঠুর আদেশ সন্দেহ নেই, কিন্ত সৈনিকগণের উপর খারাপ আবেগ সৃষ্টি করতে পারে এমন ধরণের কথাবার্তা থেকে বিরত রাখার জন্যই এটা করতে হয়েছিলো। আমাদের দুর্ভাগ্য৪ঠা নভেম্বর রাত সাড়ে৮ টায় ক্যাপ্টেন শামসুল হুদাকে তার বিছানায় বসে কি যেন চিন্তা করতে দেখা যায়।সীমাহীন এক অবসাদ তাকে পেয়ে বসেছিল।একসময় আপনার অজান্তেই তিনি স্টেনগান হাতে তুলে নিয়ে নলটি নিজের চিবুকে ঠেকান।তারপর যন্ত্রচালিতের মত ট্রিগার চালান।

বেলুনিয়া অভিযান নিয়ে আমি তখন ভারতীয় বিগ্রেড কমান্ডারের সাথে আলোচনা করছিলাম।খবর পেয়ে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি।কিন্ত কঠিন বাস্তবতাকে একসময় স্বীকার করে নিতেই হল।আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামীকালই অভিযান শুরু হবে।পুরো একটা জাতির ঘোর দুর্দিনে ব্যক্তিজীবনের ট্রাজেডিগুলো আমরা শুধু মনে মনে রাখতে পেরেছি, আর কিছু করতে পারিনি সেদিন।

নিয়মিত পদাতিক বাহিনী এবং মিলিশিয়া নিয়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানের শক্তি ছিল দুই ব্যাটালিয়নের মত।ব্যাটালিয়ন ছিল উত্তর অংশ এবং বাকি অংশ ছিল দক্ষিণভাগে।শক্তিশালী ব্যাংকার তৈরি করে এবং বেশ বিস্তৃত এলাকাজুড়ে মাইন পেতে তারা অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। এসমস্ত অবস্থান সম্পর্কে সন্ধান না নিয়ে আক্রমণ চালালে অহেতুক লোকক্ষয় হতে পারে। কোনভাবে উত্তর অংশের শত্রুদলকে বাকী অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচ্ছিন্ন অংশের সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করতে পারলে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। আত্মসমর্পণ না করলেও কয়েকদিনের মধ্যে তাদের নির্মূল করা সম্ভব হবে। আমরা তাই সিদ্ধান্ত নেই উত্তরের এবং দক্ষিণের মাঝামাঝি কোন স্থানে অতি সন্তর্পণে রাত্রির অন্ধকারে নিঃশব্দে অবস্থান গ্রহণ করবো। ট্রেঞ্চ এবং ব্যাংকার গড়ে তুলবো রাতারাতি। এবং পরদিন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লেই পাকিস্তানীরা দেখতে পাবে তাদের উত্তরের অংশ দক্ষিণের বাহিনী থেকে হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন। মাঝখানে বসে আছে তাদের যমদূত মুক্তিসেনারা।

নভেম্বর ৪ তারিখ। অন্ধকার এবং শীতের রাত।কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ক্যাম্প ছেড়ে বেলনিয়া অভিযানে এগিয়ে চলে মুক্তিসেনাদের দল।সৈন্যদের দীর্ঘসারি যাত্রা শুরু করতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।বৃষ্টির সাথে বাতাসের বেগও বেড়ে যায়। হাড়কাঁপানো শিতে আমাদের ঠোঁট কাঁপছিলো। আমরা পশ্চিমদিকে এগিয়ে চলি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কষ্ট হলেও বস্তুত আমাদের সুবিধাও ছিল যথেষ্ট। আবহাওয়া খারাপ দেখে সে রাতে শত্রুদের টহলদাররা আর বাইরে বেরোয়নি।তারা ধারণাও করতে পারেনি এই রাতটিকেই আমরা বেছে নেবো।দমকা বাতাসের গর্জনে আমাদের চলাফেরা এবং ট্রেঞ্চ খোঁড়ার আওয়াজ তলিয়ে যাচ্ছিলো। ভোর হতে না হতেই আমাদের সবগুলো কোম্পানী যার যার জায়গায় পৌঁছে প্রতিরক্ষামূলক ট্রেঞ্চে অবস্থান গ্রহণ করে। আমরা তখন শীতে প্রায় জমে যাচ্ছিলাম। কিন্ত একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গিয়েই পরিষ্কার সূর্যালোক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

দেরি না করে আমরা শরণার্থী শিবির এবং গ্রাম থেকে লোক নিয়ে সাজ সরঞ্জাম বহনের ব্যবস্থা করি। যানবাহন চলাচলের জন্য পাহাড় এবং ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে চার মাইল দীর্ঘ রাস্তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হয়।হাজার হাজার লোক স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিন রাত কাজ করে চলে। তিনদিনের মাথায় রাস্তাটি যানবাহন চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠে। আমাদের সাহায্য করার জন্য বেসামরিক লোকদের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া লক্ষ্য করি। ফলে আমাদের মনোবল বেড়ে যায় বহুগুণ।

একজন অধ্যাপক ব্যাংকারের জন্য সি, আই সিটের বোঝা মাথায় বহন করে চার মাইল পথ অতিক্রম করে টিনগুলো যথাস্থানে নামিয়েই আবার তিনি পেছন দিকে দৌড়ে গেছেন আরেকটা বোঝা আনতে। ছয় বছরের একটি ছেলেকে দিয়ে কোন কাজ করানো হবেনা বলাতে সে সেদিন কেঁদে ফেলেছিল।

আমাদের অবস্থান গ্রহণ করায় শত্রুদের মধ্যে তেমন কোন ত্বরিত প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। তার হয়ত ভেবেএটাওমুক্তিফৌজের অ্যামবুশ ধরণের কিছু একটা হবে তারা মুক্তিবাহিনীকে হঠিয়ে দেওয়ার জন্য একটা কোম্পানী পাঠায়। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে ২৯ জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং অন্যরা উপায়ান্তর না দেখে পালিয়ে যায়। এমনকি তারা লাশগুলোও নিতে পারেনি ৭ই নভেম্বর ২টি সাবর জেট সারাদিন আমাদের অবস্থানের উপর স্টাপিং করে। এতে আমাদের টিন বহনকারী একজন বেসামরিক লোক নিহত হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার শত্রুরা তেমন ব্যাপক আক্রমণ করতে আসছিলনা। তাছাড়া, উত্তর অংশে পাকিস্তানীদের আমরা যেভাবে ঘিরে ফেলেছিলাম সেখান থেকে তাদের মুক্ত করারও তেমন কোন চেষ্টাও করছিলোনা আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম পাকিস্তানীরা এতদিনের আক্রমণাত্মক ব্যবস্থার পরিবর্তে এখন আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এসময়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানীদের একটি অয়ারলেস বার্তা ইন্টারসেপ্ট করি। সেটা ছিল,’’ বেলুনিয়া থেকে নিজেরাই পালাবার ব্যবস্থা কর।‘’

কয়েকজন শত্রুসেনা আমাদের ব্যূহ ভেদ করে পালানোরও চেষ্টা করেছিল কিন্ত তারা আমাদের গুলিতে নিহত হয়। ১১ই নভেম্বরের মধ্যে আমরা অবশিষ্ট শত্রুসেনাকে ধ্বংস করে ফেলি। বেশকিছু পাকিস্তানী আমাদের হাতে বন্দী হয়।

যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুর্ভাগ্যের কথা জানতে পারি। সর্বত্রই শত্রুসৈন্যদের একটা সাধারণ অভিযোগ ছিল যে, অফিসাররা তাদের সাথে ফ্রন্টলাইনে থাকতো না। শুধু গোলাগুলি ছাড়া অন্যসব কিছুরই অভিযোগ ছিল।তাদের তিক্ত অভিযোগঃ “মনকি খাদ্যের জন্যও আমাদের ব্যবস্থা করতে বলা হতো।” প্রতিটি সেক্টরে যুদ্ধবন্দীর কাছে এবং মৃত সৈনিকদের পকেটে অনেক চিঠি পাওয়া গেছে। এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের বাবা, মা, আত্মীয়স্বজনদের কাছে লেখা। এসব চিঠিতে তাদের করুণ অবস্থা এবং প্রতিটি স্তরে শৃঙ্খলার কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার এক করুণ চিত্র পাওয়া যায়। এই ছিল তাদের সাফল্য- মাসে পর মাস দস্যুবৃত্তি,পাশবিক অত্যাচার এবং যাবতীয় জঘন্য অপরাধের উপযুক্ত পুরষ্কার। একজন সিপাই তার বাবাকে লিখেছেঃগতমাসে এগারোশত টাকা পাঠিয়েছি, বোধহয় পেয়েছেন। দুদিন যাবৎ এক অজ্ঞাতস্থান অভিমুখে আমরা চলেছি। গতকাল মুক্তিবাহিনীর হামলার মুখে পড়েছিলাম।এতে আমাদের প্লাটুনের দুজন মারা গেছে। এর আগে খালের পানিতে পড়েও একজন মারা যায়। এখানে ভীষণ বৃষ্টি হয়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু বড় বড় নদী আর পুকুর।

লোকজন ভয়ে আমাদের কাছে ঘেঁষতে চাননা। গ্রাম থেকে আমরা খাবার সংগ্রহ করি, কিন্ত এর জন্য কোন দাম দেইনা। আমাদের অফিসাররাও কোন দাম দেয়না। আমরা এখন একটি গ্রামে বিশ্রাম নিচ্ছি। কালসকালেই আবার রওনা হতে হবে। রাতে চলাফেরা করতে পারিনা। এখানে অনেক মুক্তিফৌজ। আমি পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী হওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।‘’

পরেরদিন ভোরই মুক্তিবাহিনী এই প্লাটুনটি অ্যামবুশ করে। ফলে দলের আরও দশজন সৈন্য মারা যায়।নিহত একজনের পকেটেই চিঠিটি পাওয়া গিয়েছিলো।

আমরা বেলুনিয়া অভিযানের আয়োজন করেছিলাম ৪ঠা নভেম্বর। অর্থাৎ এই তারিখ থেকেই সীমিত এবং স্থানীয় পর্যায়ে হলেও ভারতীয়রা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। আর ৫ই নভেম্বর শুরু হয়ে যায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার অঘোষিত যুদ্ধ।

যুদ্ধ পরিকল্পনা

নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই আমরা বেলুনিয়া থেকে শত্রু বিতাড়িত করি। পাকিস্তান রেডিও অবশ্য তখনও বেলুনিয়া তাদের দখলে আছে বলে সমানে প্রচার করে চলেছিল। পাকিস্তান কতৃপক্ষ একদিকে মিথ্যা প্রচার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিলো অপরদিকে ঢাকা- চট্টগ্রাম রোডের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ কেন্দ্র ফেণী থেকে ক্রমান্বয়ে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো।

২১ নভেম্বর ঢাকা থেকে এপি প্রতিনিধি এক বার্তায় বলেন, পাকবাহিনী এবং মুক্তিফৌজের মধ্যে মরনপ্রান লড়াই শুরু হয়েছে।এই লড়াইয়ে পাকিস্তানীদের যে শক্তিক্ষয় হচ্ছে তাতে ভারতের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তারা যে কি করবে বোঝা যাচ্ছেনা। ঢাকা- চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরে গেরিলাদের হামলায় পর্যুদস্ত পাকিস্তানীরা দিশেহারা। এসময়ে মুক্তিফৌজ অন্তত সাতটি থানার উপর আক্রমণ চালিয়ে থানাগুলোকে মুক্ত করেছে।দেশের অধিকাংশ স্থানে মুক্তিবাহিনী বিদ্যুৎ সরবরাহ চরমভাবে ব্যাহত করেছে। বন্দরে কাজকর্ম বন্ধ। শিল্প-কারখানার শ্রমিকেরা যে যার বাড়ির পথ ধরেছে। বিস্তীর্ণ পল্লী অঞ্চল তখন মুক্তিফৌজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সেখানে তারা নিজেদের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। রাজাকার এবং দালালদের বিচার শুরু হয়ে গেছে। মুক্তিফৌজের দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি অভিযানের তীব্রতায় ইয়াহিয়া খান এবং নিয়াজি বেসামাল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হচ্ছিল, প্রতিমুহূর্তে লোকক্ষয়ের সংখ্যা বাড়ছিলো।কিন্ত এখানেই শেষ নয়, পূর্ব পাকিস্তান শিগগিরই হাতছাড়া হয়ে যাবে, এই আশংকায় তারা ভীতও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে।আর এই আশংকা সত্য হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উৎকৃষ্ট কয়েকটি ডিভিশন তাদের হারাতে হবে দীর্ঘদিনের জন্য।

ইতিমধ্যেই পাকিস্তান কয়েকবারই পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতের আকাশসীমা লংঘন করে।পূর্ব ফ্রন্টে নিয়াজি দুঃসাহসিক একটা কিছু করে তার সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা ২১ই নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটের নিকটবর্তী ভারতীয় বয়রা গ্রামে হত্যা চালায়। ট্যাংক,কামান, জঙ্গিবাহিনী তাদের সহযোগিতা করেছিল।এতে কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য নিহত। তবে বেশী মারা যায় বেসামরিক ব্যক্তিরাই বিপুল সংখ্যক লোক আহতও হয়। ভারতের মাটিতেই যুদ্ধ হবে নিয়াজি বোধহয় তার এই দম্ভের যথার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারতীয় এলাকায় অনুপ্রবেশের অনুমতিও তিনি নিশ্চয়ই ইয়াহিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এর খেসারতও তাকে হাতে হাতে পেতে হয়।ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণে তারা শুধু পেছনেই হটে আসেনা, ১৩টি শেফি ট্যাংক এবং৩টি সাবর জেটকে এই সীমিত যুদ্ধে হারিয়ে ফিরে আসতে হয় নিজ এলাকায়। দুজন পাকিস্তানী পাইলট বন্দী হয় ভারতের হাতে।

এসব উস্কানিতেও মিসেস গান্ধী ছিলেন স্থির।পাকিস্তানের কামানের গোলায় ভারতের বেসামরিক লোক হতাহত হচ্ছিলো। বিষয়সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ছিল প্রচুর।তা সত্ত্বেও ভারত সরকার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল তিব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। মিসেস গান্ধী অবশ্য আশা করেছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বৃহৎ শক্তির সুমতি হবে। তারা ইচ্ছা করলে ইয়াহিয়াকে দিয়ে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ করিয়ে সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান করাতে পারবেন।

২১ই নভেম্বর পাকিস্তান সমূহ বিপদ টের পেয়ে জাতিসংঘে এক নালিশ দায়ের করে বসে। তার বক্তব্য, ভারতীয় সেনাবাহিনী ১২টি ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের চারটি সেক্টর আক্রমণ শুরু করেছে। একইদিন ইয়াহিয়া সারা পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা জারি করেন।এর চারদিন পর অর্থাৎ ২৫নভেম্বর পাকিস্তান সফররত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন চীনা প্রতিনিধি দলের ভোজসভায় ইয়াহিয়া বক্তৃতাচ্ছলে জানিয়ে দেন যে, হয়ত দিন দশেকের মধ্যে আমাকে আর এখানে নাও পাওয়া যেতে পারে কারণ সম্ভবত আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে।

২৭ নভেম্বর পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনী পশ্চিম দিনাজপুরের ভারতীয় শহর বালুরঘাটের প্রচণ্ড হামলা চালায়। কামানের গোলার ছত্রছায়ায় এক বিগ্রেড পাকসেনা হিলিতে ভারতীয় অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে ট্যাংক বহরও ছিল। প্রথম দফায় পাকিস্তানীদের৮০ জন্য সৈন্য ও চারটি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়। পরেরদিন দ্বিতীয় দফা হামলার সময় তিনটি পাকিস্তানী ট্যাংক আটক করা হয় এবং তাদের বহু সংখ্যক সৈন্য প্রাণ হারায়। ভারতীয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক।এবার ভারতীয়রা প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসে বিপুল শক্তিতে।তারা আন্তর্জাতিক সীমারেখা পার হয়ে বাংলাদেশের ভেতর কয়েক মাইল ঢুকে পড়ে। ভারত সরকার আগেই তার সৈন্যদের সীমান্ত এলাকায় সীমিত আকারে অভিযান পরিচালনার আদেশ দিয়ে রেখেছিলেন। নির্দেশ ছিল, সীমান্তের ওপার থেকে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার হুমকি দেখা দিলে সৈন্যরা তা নির্মূল করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে। ভারত তখন শুধু তার সীমান্ত রক্ষাই নয়, প্রয়োজন দেখা দিলে সমুচিত প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রস্তত।

পরিস্থিতি বিস্ফোরণোম্মুখ হয়ে উঠলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রস্তাব দেন যে, ভারতও পাকিস্তান দুই পক্ষকেই সীমান্ত এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে দিতে হবে। ইয়াহিয়া খান বাহ্যত প্রস্তাবে সম্মতি জানান।অপরপক্ষে ভারত এই শর্তে সম্মত হয় যে, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানকে তার সৈন্যদের সরিয়ে দিতে হবে। সকল সমসসার মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর কার্যকলাপ এবং এদেরকে সরিয়ে না নিলে এই অঞ্চলে শান্তি আসবেনা। এইসব প্রস্তাব যখন আদান-প্রদান হচ্ছিল পাকিস্তান তখন পশ্চিম ফ্রন্টে রাতের অন্ধকারে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটিস্থানে সৈন্যসমাবেশ করে। এ ঘটনা ১লা ও ২রা ডিসেম্বর।২রা ডিসেম্বরেই পাকিস্তান সংঘর্ষের বিস্তৃতি ঘটানোর অসৎ উদ্দেশ্যে মরিয়া হয়ে আগরতলার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গোলাবর্ষণ করে। এদিন নয়াদিল্লী কংগ্রেস কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতাকালে মিসেস গান্ধী স্পষ্ট কণ্ঠে ঘোষণা করেন, তথাকথিত বৃহৎ শক্তি যেভাবে চাইবে সেইভাবে কাজ করার দিনশেষ হয়ে গেছে। ভারতের স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয় সেইদিকে দৃষ্টি রেখে আজ আমাদের কাজ করতে হবে।

অক্টোবর মাসেই জম্বুকাশ্মীরের পুঞ্চ সেক্টরে পাকিস্তানীদের প্রথম যুদ্ধপ্রস্তুতি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের সমর প্রস্তুতি এবং তৎসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থার ক্রম অবনতি এবং কোটি কোটি বাঙ্গালীর দুর্দশার প্রতি বৃহৎ শক্তিগুলোর উদাসীনতা লক্ষ্য করে ভারত সরকার তখনই তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সম্ভাব্য আপৎকালে জন্য পুরোপুরি হুঁশিয়ার থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তান এর আগে তিনবার ভারয়ত আক্রমণ করেছে সেকথা ইন্দিরা গান্ধী ভুলে যাননি।

ভারতের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধে পাকিস্তান পশ্চিম ফ্রন্টে প্রথমে অভিযানেই রাজনৈতিক এবং রণকৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ যতদূর সম্ভব বেশী এলাকা দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলো।পাকিস্তানের মূল পরিকল্পনায় ছিল, একটি সাঁজোয়া ডিভিশন এবং দুইটি পদাতিক ডিভিশন এগিয়ে নিয়ে ভারতের উপর হামলা চালাবে।দরকার হলে আক্রমণকারী ডিভিশনগুলোর শক্তি বৃদ্ধির জন্য আরও পদাতিকও সাঁজোয়া বাহিনীর সৈন্য পাঠানো হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত বাকী অংশের পাকসেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল সমস্ত ভারতীয় বাহিনীকে স্থানীয়ভাবে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে ব্যস্ত রাখা।ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে অনেকগুলো প্রলুব্ধ হামলার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানীরা আশা করেছিল এইসব প্রলুব্ধ হামলায় বিভ্রান্ত হয়ে ভারত তার সেনাবাহিনীকে বিশেষ করে সেনাবাহিনীর শক্তিশালী রিজার্ভ বাহিনীকে মূল রণাঙ্গন থেকে অন্যক্ষেত্রে নিয়জিত করে ফেলবে। ফলে, পাকিস্তানের মূল আক্রমণকারী বাহিনীর পক্ষে অতি সহজে এবং স্বল্প প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনা এবং জয়লাভ করা সম্ভব হবে।

এই লক্ষ্য সামনে রেখে পাকিস্তান তার ১২ পদাতিক ডিভিশনের উপর পুঞ্চ এলাকা দখল করার দায়িত্ব অর্পণ করে। পাকিস্তান আশা করেছিলো, পুঞ্চ এলাকায় হামলা চালালে জম্বুও কাশ্মীরে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনী এ এলাকাতে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়বে ফলে তার আর চেনাব নদীর দক্ষিণে সুযোগ পাবেনা। সেই ফাঁকে পাকিস্তান চেনাব নদীর দক্ষিণে মূল হামলা চালিয়ে সফল হবে।এখানে উল্লেখযোগ্য, পাকিস্তানের এই ডিভিশনটি কাশ্মীরেই অবস্থান করছিল এবং অধিকাংশ কাশ্মীরেই লোক।

পাকিস্তান আরো পরিকল্পনা করছিলো যে, রাভি নদী বরাবর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যূহ গঠন করে তারা নওশের রাজৈরি এলাকা দখল করে ফেলবে। একাজের দায়িত্ব দেওয়া হল গুজরাটে অবস্থিত২৩ পদাতিক ডিভিশনকে।

১নম্বর করের উপর দায়িত্ব দেওয়া হল সাকারগড় এলাকায় ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার। প্রলুব্ধকারী হামলা চালিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে ঐ এলাক্য যুদ্ধে নামাবার পরিকল্পনা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল আসল আক্রমণকারী এলাকা সম্পর্কে যেন ভারত কিছুই বুঝে উঠতে না পারে।

লাহোর এবং কাসুর সোলেমনকি এলাকায় ৪নম্বর কোরকে ইরাবতী এবং গ্র্যান্ড ট্যাংক রোডের মধ্যবর্তী চানগানওয়ালা নালা পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল রক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। রহিম ইয়ার খান এবং করাচী সহ কচ্ছের রানের মধ্যবর্তী এলাকা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয় ১৮ পদাতিক ডিভিশনের উপর।

ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভূখণ্ড বিশেষ করে জম্বু কাশ্মীর সেক্টরের বেশকিছু এলাকা প্রথমেই দখল করে ফেলতে। যুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের কোন জায়গা খোয়া গেলে ভবিষ্যতে তা উদ্ধারের জন্য পশ্চিমাঞ্চলের এই দখলকৃত জায়গার বিনিময়েও দর কষাকষি করতে পারবেন, এই ছিল তার আশা।

লক্ষ্য অর্জনের জন্য পশ্চিমাঞ্চলে তাকে প্রথমেই আক্রমণাত্মক ভুমিকা নিতে হবে এবং পূর্বাঞ্চলে জেনারেল নিয়াজিকে রাখা হবে আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা ।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার ইস্টার্ন কমান্ড অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য সীমিত সংখ্যক আক্রমণাত্মক অভিযান সহ প্রধানত আত্মরক্ষামূলক তৎপরতার ভিত্তিতে একটি পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলো। গুটিকয়েক আক্রমণাত্মক অভিযানের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো শুধু যুদ্ধটাকে ভারতের মাটিতে গড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিও অন্যান্য সুযোগসুবিধা সীমান্ত রেখার যত কাছে অবস্থান দেয়া যায় ততদুর পর্যন্ত এলাকা নিয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়।

ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার যতগুলো পথ রয়েছে সেই সবগুলো পথেই এই ধরনের সুদৃঢ় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং যোগাযোগ কেন্দ্র যেমন-চট্টগ্রাম, ফেনী, লাকসাম, চাঁদপুর, কুমিল্লা, আখাউড়া, দাউদকান্দি, ভৈরব, ঢাকা, খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ, এবং বগুড়ার চারপাশে চূড়ান্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। যেকোনো মূল্যে ঢাকাকে রক্ষা করাই ছিল পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

এই ধরণের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে পাল্টা আঘাত(কাউন্টার অ্যাটাক) হানার জন্যেও প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের বিস্তারিত এই রণপরিকল্পনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফরকালে অনুমোদন করেছিলেন। পরিকল্পনা প্রধান লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধারা যাতে কোন শহর দখল না করে সেখানে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে। কারণ এটা করতে পারলে তারা বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করবে। পাকিস্তানীরা অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলোতে তিন-চার সপ্তাহ চলার মত গোলাগুলি, রসদপত্র রাখার এবং পশ্চাৎপদবর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থানসমূহে পর্যাপ্ত পরিমাণে রসদ রাখার ব্যবস্থাও করে। অগ্রবর্তী ঘাঁটি রক্ষা করা দুষ্কর হয়ে পরলে সেখান থেকে যোগাযোগ কেন্দ্র কিংবা গুরুত্বপূর্ণ শহরে পশ্চাৎপসরন করে সেসব স্থান রক্ষা করার জন্য লড়াই করে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

কয়েকমাস ধরে পাকসেনা বাহিনী এসব প্রতিরক্ষাবাহিনীর ঘাঁটির সকল ব্যবস্থা নিয়ে বেশ তৎপর ছিল ।তারা হাজার হাজার কংক্রিটের বাংকার এবং পিলবক্স নির্মাণ করে। ট্যাংক চলাচল ঠেকানোর জন্য সম্ভাব্য পথগুলোতে গভীর নালা কেটে রাখে।

এব্যাপারে পাকিস্তানীদের অর্থের কোন অভাব ছিল না। শরণার্থী সাহায্যও পুনর্বাসন কর্মসূচীর নাম করে ইয়াহিয়া খান বেশ মোটা অংকের অর্থ জোগাড় করেছিলেন।আসলে ভারত থেকে তখনও কোন শরণার্থী ফিরে আসেনি। অল্পসংখ্যক যারা এসেছিলো তারাও সেনাবাহিনীর তথাকথিত অভ্যর্থনা কেন্দ্রে ফিরে আসেনি। তারা জেপথে ভারত গিয়েছিলো সেই গোপন পথেই ফিরে এসেছে। মাঝ থেকে শরণার্থীদের জন্য পাওয়া পুরো টাকাটাই প্রতিরক্ষা বাজেটের অংশ হিসেবে নিয়াজীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। বেলুনিয়ার একটিমাত্র ট্যাংক বিরোধী নালা তৈরি করতে পাকিস্তানীরা প্রায় ২০ লক্ষ টাকা খরচ করে।

অপরপক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিম ফ্রন্টে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা এবং পূর্ব ফ্রন্টে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশ মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।অবশ্য পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতীয় সেনাবাহিনী অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগে কোন কোন সেক্টরে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যতদূর সম্ভব অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনাও গ্রহণ করে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক উদ্দেশ্যও লক্ষ্য নিম্নরূপঃ

(১) যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে(সর্বাধিক তিন সপ্তাহের মধ্যে) মুক্তিফৌজের সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন করা।
(২) চীন দেশের দিক থেকে সম্ভাব্য হামলার বিরুদ্ধে ভারতের উত্তর সীমান্ত রক্ষা।
(৩) আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সংহতি রক্ষা করা
(৪) নাগাল্যান্ড, মনিপুর , মিজোরাম এলাকায় বিদ্রোহাত্নক তৎপরতা দমন করা

এই কাজ গুলো মোটেই সহজসাধ্য ছিল না।বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি দ্রুত সৈন্য চলাচলের জন্য অনুপযুক্ত। পুরো দেশ জুরে রয়েছে নদীনালা, খালবিল। এগুলোর জন্য যেকোনো বাহিনীর অভিযান ব্যাহত হতে বাধ্য।

এইসব প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক অবস্থানের মূল্যায়ন করে বাংলাদেশকে পৃথক চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এইসব সেক্টরে ভারতও পাকিস্তানের অবস্থান ছিল নিম্নরূপঃ

১। উত্তরপশ্চিম সেক্টরঃ যমুনার পশ্চিমও পদ্মার উত্তর অঞ্চল এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সেক্টরের আওতাধীন জেলাগুলো ছিল রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী এবং পাবনা। সেক্টরের হেডকোয়াটার স্থাপন করেছিলো নাটোরে। এই সেক্তরে সর্বত্র এবং বিশেষ করে ঠাকুরগাঁ, দিনাজপুর, হিলিও রংপুরে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিলো।

পাকিস্তানের ১৬ ডিভিশনের মোকাবেলায় ভারত তার ৩৩ কোরের(লে. জেনারেল থাপা) অধীনে দুটি মাউন্টেন ডিভিশনকে নিয়োজিত করে। এই ডিভিশনগুলোর সহায়ক হিসেবে নিয়োজিত ছিল ডিভিশনাল গোলন্দাজ বাহিনী, একটি মাঝারি ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং হালকা উভয়চর ট্যাংকের(পি টি ৭৬) আর এক্তি রেজিমেন্ট। ভারতীয় ডিভিশনালগুলো ছিল উত্তরে কুচবিহার জেলায়৬ মাউন্টেন ডিভিশন, বালুরঘাট এলাকায় ২০ মাউন্টেন ডিভিশন এবং শিলিগুড়ি এলাকায় ৭১ বিগ্রেড। বাংলাদেশে অভিজানের দায়িত্ব পালন ছাড়াও ৩৩ কোরকে সিকিমও ভুটানের মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য চীনা আগ্রাসন প্রতিহত করার দায়িত্ব ছিল।

২। পশ্চিম সেক্টরঃ পদ্মার দক্ষিণ এবং পশ্চিম এলাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের জেলাগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল এবং পটুয়াখালী। এই সেক্টরের মেজর জেনারেল এম, এইচ আনসারীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯ পদাতিক ডিভিশন মোতায়েন করা হয়। এই সেক্টরের হেডকোয়াটার ছিল যশোরে।
পাকিস্তানী ৯পদাতিক বাহিনীর মোকাবেলায় ভারতীয় পক্ষে ছিল জেনারেল রায়’নার কমান্ডে নবগঠিত ২কোর। এই কোরের আওতায় দুটি ডিভিশন ছিল মেজর জেনারেল দলবির সিং এর নেতৃত্বে ৯ পদাতিক ডিভিশন এবং মেজর জেনারেল মহিন্দর সিংবারার নেতৃত্বে ৪ মাউন্টেন ডিভিশন। জেনারেল রায়’নার সহয়তায় আরও ছিল দুটি ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং ডিভিশনের সহায়ক গোলন্দাজ বাহিনী।

৩। উত্তর সেক্টরঃ এই সেক্টর গঠিত হয়েছিলো ময়মনসিংহ, ঢাকা জেলার কিছু অংশ নিয়ে পাকিস্তানীদের পক্ষে এই সেক্টরের দায়িত্ব ছিল বিগ্রেডিয়ার এ কাদেরের নেতৃত্বে ৯৩ বিগ্রেড এবং এর আওতায় ৩১বালুচও ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট,আধা সামরিক বাহিনী(নবগঠিত ইপিসিএপি এর দুটি উইং)কয়েকটি মুজাহিদ ইউনিট এবং একটি মর্টার ইউনিট। এই এলাকার উত্তরাংশ পাকিস্তানীদের প্রধান শক্তি ছিল লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট। এদেরকে ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছিলো। উল্লেখ্য যে, সুলতান মাহমুদই ছিল সবচেয়ে বেশী বাঙ্গালী হত্যার হোতা।কমলপুর- খকশীগঞ্জ- জামালপুর এবং হাতিবান্ধা শেরপুর, জামালপুর বরাবর যে এলাকা যে এলাকা রয়েছে তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিল এই রেজিমেন্টের উপর।এছাড়া দালু- হালুয়াঘাট- ময়মনসিংহ বরাবর এলাকার দায়িত্ব এরা পালন করতো।

এই সেক্টরের বিপরীতে ভারতের মেঘালয় এলাকায় ছিল ১০১ কমুনিকেশন জোন। এই জোনের আওতাধীন ভারতীয় সৈন্যরা আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড ,মিজোরাম এলাকায় দায়িত্ব পালনরত সৈন্যদের চলাচল ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদান করতো। এই এলাকায় ভারতীয়দের যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না থাকায় বিরাট বাহিনীর পক্ষে এখানে দীর্ঘস্থায়ী তৎপরতা চালানো সম্ভব ছিল না। তাই এই সেক্টরে ভারতীয় সৈন্য ছিল সীমিত। এলাকাটির প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় মেজর জেনারেল গুরুবক্স সিং। তার অধীনে ছিল বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিংক্লেয়ারের নেতৃত্বে ৯৫ মাউন্টেন বিগ্রেড গ্রুপ এবং ২৩ পদাতিক ডিভিশন থেকে আনীত একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন। এখানে ভারতীয় বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে কাদের সিদ্দিকির নেতৃত্বে টাঙ্গাইল এলাকার সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা।

৪।ইস্টার্ন সেক্টরঃ মেঘনার পূর্ব পাশের এলাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের জেলাগুলো হচ্ছে সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাকিস্তান এই সেক্টরে তাদের ১৪ ডিভিশন এবং অস্থায়ী ৩৯ ডিভিশন মোতায়েন করেছিলো। মেজর জেনারেল আবদুল মজিদের নেতৃত্বে ১৪ ডিভিশনের সৈন্যরা কুমিল্লা পর্যন্ত এলাকার দায়িত্বে ছিল। ২০২ বিগ্রেড সিলেট,২৭ বিগ্রেড ব্রাহ্মণবাড়িয়াও আখাউড়া, ১১৭ বিগ্রেড কুমিল্লা,৩১৩ বিগ্রেড ব্রাহ্মণবাড়িয়া উত্তরাঞ্চলও মৌলভীবাজার এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। ৫৩ পদাতিক বিগ্রেড ছিল লাকসামও ফেনীর দায়িত্বে।

চট্টগ্রামও কক্সবাজার এলাকার দায়িত্বে ছিল ৩৯ পদাতিক ডিভিশন। কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল রহিম খান।

ভারতের পক্ষে এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিল লে. জেনারেল সগত সিং এর নেতৃত্বাধীন ৪র্থ কোর। তার অধীনে ছিল মেজর জেনারেল কৃষ্ণরাও এর অধীনে ৮ম মাউন্টেন ডিভিশন, মেজর জেনারেল গজভালেস এর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন এবং মেজর জেনারেল আর, ডি, হিরার অধীনে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন। বাংলাদেশের ৮টি ব্যাটালিয়ন এবং আমাদের ১ থেকে৫ নম্বর সেক্টরের সকল ট্রুপসকে সগত সিং এর অধীনে ন্যাস্ত করা হয়েছিলো। অভিযান সংক্রান্ত দায়িত্ব ছাড়াও ৪র্থ কোরের উপর আগরতলা শহর, বিমান ঘাঁটিএবং ঐ এলাকার বিমান বাহিনীর সকল প্রতিষ্ঠান রক্ষার ভার ছিল।

প্রাথমিক অবস্থায় বাংলাদেশ পাকিস্তানী ডিভিশনের ১৪ টি ডিভিশনের কেবল ৪টি পদাতিক ডিভিশন ছিল। ২৮ মার্চের মধ্যে ৯ এবং ১৬ ডিভিশন দুটি এখানে চলে আসে।এরপর বাংলাদেশে আরও তারা দুটি ডিভিশন গড়ে তোলে। এই দুটি ছিল ৩৬ এবং ৩৯অস্থায়ী ডিভিশন। ১৯৭১ এর অক্টোবরের মধ্যে পাকিস্তান এখানকার তার সবগুলো ডিভিশন পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন করে। ডিভিশনগুলোর সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ছিল গোলন্দাজও ভারী মর্টার বহরও ট্যাংক বহর। আমেরিকান শেফি ট্যাংক ছিল ৬০ টি। বিমানবাহিনীতে ছিল ২০খানি এফ-৮৬ সাবর জেট এবং নৌবাহিনীতে ছিল অজ্ঞাত সংখ্যক গানবোট এবং অন্যান্য উপকূলীয় নৌযান।

এর মোকাবিলায় ভারত তার ৭ পদাতিক ডিভিশনকে এই এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য নিয়োজিত করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রন্টে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং চীন সীমান্তে সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সৈন্য নিয়োজিত করার পর বাংলাদেশে যুদ্ধ চালনার জন্য ভারতের হাতে এই ৭টি পদাতিক ডিভিশন ছাড়া আর কোন নিয়মিত ফোর্স ছিল না। এইগুলোর মধ্যে ৬টি ছিল পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন এবং ২ টি স্বতন্ত্র পদাতিক বিগ্রেড। ডিভিশনগুলোকে যুদ্ধে পূর্ণ সহায়তার জন্য ছিল হালকা এবং মাঝারি পাল্লার গোলন্দাজ বহর, পিটি-৭৬ ধরণের উভচর ট্যাংকের দুটি রেজিমেন্ট এবং টি- ৫৪ ধরণের একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট। এছাড়া ৩টি সতন্ত্র ট্যাংক স্কোয়াড্রন এবং দ্রুত চলাচলে সক্ষম( মেকানাইজড) ব্যাটালিয়নকে যুদ্ধের জন্য নিয়োজিত করা হয়।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর ৭টি জঙ্গি বোমারু বিমানের স্কোয়াড্রন এই এলাকার জন্যে নিয়োজিত করা হয় । এছাড়া ছিল সৈন্য পরিবহনের জন্য কিছু সংখ্যক হেলিকপ্টার।বিমানবাহিনী জাহাজ আই, এন এস ভীক্রান্ত সহ ইস্টার্ন ফ্লীট ছিল এই অঞ্চলের সমুদ্রে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। বাংলাদেশের উপকূলের অদূরবর্তী সমগ্র সাগর এলাকা অবরোধের দায়িত্ব ছিল এই ইস্টার্ন ফ্লীটের উপর ন্যাস্ত। যুদ্ধ যদি শুরু হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে সৈন্য কিংবা সরঞ্জাম নিয়ে আসা নিয়াজির পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবেনা।

এটা সাধারণ মাপকাঠি হিসাবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যেকোনো আক্রমণ পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করতে হলে প্রতিটি আত্মরক্ষাকারী সৈনিকের বিরুদ্ধে তিনজন আক্রমণকারী নিয়োগ করতে হবে। পূর্বাঞ্চলে ভারত কিন্ত সে অনুপাতে পাকিস্তানের চাইতে শক্তিশালী ছিল না। অনুপাত যেখানে ৩:১হওয়া দরকার ছিল সেখানে ভারতও পাকিস্তানের অনুপাত ছিল ২:১। কিন্ত ইস্টার্ন লে. জেনারেল অরোরা যে ৭টি ডিভিশন পেয়েছিলেন তার চাইতে আর বেশী সৈনিক পাওয়ার আর কোন আশাই তিনি করতে পারতেন না এবং এই বাহিনী দিয়েই তাকে আরাধ্য কাজ সমাধা করতে হবে। এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

তবে জেনারেল অরোরার আস্থা ছিল জয়ী তিনি হবেনই। বাংলাদেশের সমগ্র বাহিনী তার সহযোগিতায় প্রস্তুত ছিল। এর মধ্যে নিয়মিত বিগ্রেডগুলো ছিল কে ফোর্স, এস ফোর্স, জেড ফোর্স। ৯ সেক্টরের ২০ হাজার বাঙ্গালী সেক্টর ট্রপস অস্ত্র হাতে প্রস্তুত। এক লাখ গেরিলা সর্বত্র শত্রুকে তখন সর্বত্র তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল।সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ভারত- বাংলাদেশ যৌথবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য প্রদানের জন্য তৈরি হয়েছিলো। ইয়াহিয়া কিংবা নিয়াজির জন্য তাদের অন্তরে করুণার অবশিষ্ট লেশমাত্র ছিল না। যুদ্ধ শুরু হয়ার অনেক আগেই এই ঘৃণা পাকিস্তানের পরাজয় একরূপে নিশ্চিত করে রেখেছিল।

জনসমর্থনের উপর ভিত্তি করেই প্রধানত ভারতের বিজয় নিরূপণ করা হয়েছিলো। জনসাধারণের একটি বিশাল অংশ ততদিনে রাইফেল, এল এমজি স্টেনগান ইত্যাদি চালানো কিংবা গ্রেনেড নিক্ষেপের কায়দা কানুন শিখে ফেলেছিল। শত্রুপক্ষের খবরাখবর সংগ্রহ করা এবং প্রায় সকল ধরণের অস্ত্রের পরিচিতি সম্পর্কে তারা মোটামুটি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলো। কোন অস্ত্রটি কোন দেশের তৈরি তাও অনেকে বলতে পারতো। আমার ২ নম্বর সেক্টরের আট বছরের একটি ছেলে প্রায় প্রতিটি টহলদের পার্টির সাথেই স্কাউট হিসেবে কাজ করতো। দিনের বেলায় সে একাই চলে যেত শত্রুর সবকিছু দেখে আসার জন্য। ফিল্ড ম্যাপের উপর আঙুল দিয়ে সে আমাদের বুঝাতঃ এই হচ্ছে বল্লভপুর গ্রাম স্যার। এখানে আছে বড় একটা পুকুর। মেশিনগানটি বসানো আছে এখানে। এখানে মাইন লাগানো আছে। কিন্ত গরু বাছুর এখান দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি কিছুই হয়নি। তাই নিশ্চয় ওটা ভুয়া মাইনক্ষেত্র। এই যে এখানে একটা স্কুল বিল্ডিং, সেখানে অফিসাররা থাকে। এইভাবে যুদ্ধের এলাকার সবকিছু সে আমাদের বুঝিয়ে দিতো।

বিভিন্ন অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট বিবেচনা করে জেনারেল অরোরা তার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন। প্রধান লক্ষ্য ছিল যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা মুক্ত করা। শত্রুর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলো এড়িয়ে এবং যোগাযোগও সরবরাহ লাইন দখল করে দ্রুত গতিতে ঢাকা দখল করাই ছিল মূল পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।

ঢাকা একবার মুক্ত হয়ে গেলেই শত্রুর বিচ্ছিন্ন অবস্থানগুলো আপনা আপনি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। তাহলে অত্যন্ত ধীরে সুস্থে এইসব এড়িয়ে যাওয়া অবস্থানগুলো ধ্বংস করা যাবে।

প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ যুদ্ধের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে হলে এটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, ঢাকাকে আসল লক্ষ্যবস্ত হিসাবে যুদ্ধ চালাতে হবে এবং অন্যান্য লক্ষ্যবস্ত নির্ধারণ করতে হবে প্রাকৃতিক সেক্টর হিসেবে আলাদাভাবে।

উত্তর- পশ্চিম সেক্টরে বগুড়া ছিল প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র। সিধান্ত নেয়া হয় যে, এই সেক্টরের সকল জায়গায় শত্রু সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে শেষ করতে হবে তবে প্রধান অভিযান ঘোড়াঘাট ও গোবিন্দগঞ্জ হয়ে বগুড়া মুক্ত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে।

পশ্চিম সেক্টরে যশোর ছিল প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্র। ঝিনাইদহ- মাগুরা- ফরিদপুর হয়ে ঢাকার সাথে এর সংযোগ। তাই ঝিনাইদহ এবং মাগুরা দখল করতে পারে যশোরে পাকিস্তানীরা বিপদে পড়বে এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে দ্রুত ঢাকা অভিমুখে যুদ্ধাভিযান চালানো সম্ভব হবে।তাই মূল হামলা ঝিনাইদহ- মাগুরা দখলের উদ্দেশ্যে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্যে যশোরের দিকে একটি আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

উত্তর সেক্টরের মিত্র বাহিনীর একটি বিগ্রেডকে জামালপুর- টাঙ্গাইল সড়ক ঢাকার অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।

পূর্ব সেক্টরে লক্ষ্য রাখতে হবে, ঢাকা যেন চট্টগ্রাম কিংবা কুমিল্লা থেকে কোন সাহায্য পেতে না পারে। মেঘনা নদী বরাবর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্থাৎ চাঁদপুর, দাউদকান্দি এবং আশুগঞ্জ দখল করতে পারলেই এই উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব। প্রথম অবস্থায় কুমিল্লা, গ্যারিসন এড়িয়ে গেলেও চলবে।

ঢাকা মুক্ত করার লক্ষ্যে দাউদকান্দি থেকে ভৈরব পর্যন্ত মেঘনা নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং জামালপুর- টাঙ্গাইল অক্ষ বরাবর অগ্রসররত দলটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে রাজধানীর অভিমুখে যুদ্ধাভিযান পরিকল্পনার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে পড়ে।

পশ্চিম সেক্টরে অগ্রসরমান কলামের জন্য গোয়ালন্দঘাট দিয়ে পদ্মা পার হওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। বিশাল এই নদীটি পার হওয়ার ব্যবস্থা আগে থাকতেই করে রাখতে হবে।

চট্টগ্রাম অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সময় আমার সঙ্গে নিজস্ব এক বিগ্রেড সেক্টর ট্রুপস ছাড়াও ভারতীয় দুটি বাহিনীর ব্যাটালিয়ন এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন ছিল। এই সব সেনা নিয়ে গঠিত হয় বিচিত্র একবাহিনী যার নাম দেয়া হয় ‘কিলোফোর্স’’ আমাদের পথ ছিল সবচাইতে দীর্ঘতম অথচ যানবাহনের সংখ্যা ছিল সবচাইতে কম। ফিল্ড আর্টিলারী আমাদের সহায়তায় ছিল বটে, তবে কোন ট্যাংক কিংবা অন্য কোন প্রকার সাহায্যকারী ইউনিট ছিল না। এই সেক্টরে আমি ইতিমধ্যেই শত্রুর পশ্চাৎভাগে দুটি নিয়মিত কোম্পানী পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার একটি কোম্পানী মীরেশ্বরাই এলাকা এবং ফটিকছড়ি এলাকায় নিরাপদে ঘাঁটি স্থাপন করে বসেছিল। সমগ্র বেলুনিয়া অঞ্চল কয়েকদিন আগে থেকেই শত্রুমুক্ত হয়েছিলো। ফেনী মুক্ত করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি চূড়ান্ত। ১৯৭১ এর ২রা ডিসেম্বরের কথা বলছি। পরেরদিন মিসেস গান্ধী এক জনসভায় বক্তৃতা দিবেন। আমরা অনেকেই আশা করছিলাম এই সভায় হয়তো তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ঘোষণা করবেন।

স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াই

বেলুনিয়ায় আমার অগ্রবর্তী কমান্ড পোস্টের দিকে জিপ চালিয়ে এগিয়ে যাই। ধুলায় আচ্ছন্ন পথ। দুই পাশে সোনালী ফসলের মাঠ। ধান কাটা মৌসুম এসে গেছে।

অন্যান্য দিনের মতই সূর্য ডুবে গেল। তারপর সমস্ত এলাকা পূর্ণ চাঁদের আলোয় ভরে উঠে।পথের পাশে একটি টহলদার দলকে ব্রিফিং দেয়া হচ্ছিলো।অল্প দুরেই আমাদের মেশিনগানের আওয়াজ শোনা যায়। ফাঁকে ফাঁকে পাকিস্তানী মেশিনগান,….. কখনও বা আর্টিলারী শেল শুরু হয়। সবকিছুই নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা….. বাংলাদেশের হয়ত সব ফ্রন্টেই তা ঘটেছিলো প্রতিদিন।

মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সেদিন কলকাতার এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিলেন। তাঁর নয়াদিল্লী ফিরে যাবার কোন তাড়াহুড়োই ছিল না।

জেনারেল অরোরার ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়াটারে আর একটা কর্মব্যস্ত দিনের অবসান ঘটলো। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর বাইরে তাই ইস্টার্ন কমান্ডের কেউ কোন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ বা সিদ্ধান্ত পাওয়ার আশা করছিলো না। ওদিকে ইয়াহিয়া খান তখন ইসলামাবাদে।দশদিনের মধ্যে তিনি যুদ্ধ করার যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তা শেষ হতে আরও দুইদিন বাকী।

ভারতের সমস্ত অগ্রবর্তী বিমান ঘাঁটিসমূহের যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিলো। তবে বিমানঘাঁটিগুলোতে যুদ্ধের সবগুলো বিমান তখন পর্যন্ত পৌঁছেনি। ভারতীয় নৌবাহিনীর ইস্টার্ন ফ্লীট এবং ওয়েস্টার্ন ফ্লীট তখন পর্যন্ত শান্তিকালীন ঘাঁটিতে অবস্থান করছিলো।

পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত সাবমেরিন ৩১১ ফুট দীর্ঘ পি-এন-এস গাজী এগিয়ে চলল ভারতের নৌঘাঁটি বিশাখাপত্তমের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল ভারতের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘ভীক্রান্ত’ কে টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দেয়া। ৩রা ডিসেম্বর। শুক্রবার।ভারতীয় সময় বিকাল ৫ টা ৪৭ মিনিটে পাকিস্তানী বিমানবাহিনী অতর্কিতে ভারতের ৭টি ঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়। রাত সাড়ে আটটায় জম্বু এবং কাশ্মীরে দক্ষিণ-পশ্চিম ছাম্ব এবং পুঞ্চ সেক্টরে ব্যাপক আক্রমণ অভিযান শুরু করে।

এই ধরণের পরিস্থিতির জন্য ভারত পুরো প্রস্তুত ছিল। মিসেস গান্ধী দ্রুত রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং ঐ রাতে ১২টা ৩০ মিনিট জাতির উদ্দেশ্য প্রদত্ত ভাষণে সকলকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি হওয়ার আহবান জানালেন। ততক্ষণে জেনারেল অরোরাও আক্রমণের নির্দেশ পেয়ে যান। ভারতীয় নৌবাহিনী ইতিমধ্যেই সফল অভিযান শুরু করে দিয়েছিলো। বিশাখাপত্তম উপকূলের মাত্র কয়েক মাইল দূরে ভারতীয় ডেস্টায়ার ‘আই এন এস রাজপুত’ পাকিস্তানী সাবমেরিন গাজীর সন্ধান পেয়ে যায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ‘রাজপুতের ডেপথ চার্জে পাকিস্তানের সাবমেরিন গাজী টুকরো টুকরো হয়ে সাগর গর্ভে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। একই সঙ্গে অন্যদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে বাংলাদেশ সীমারেখায় অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করলো। ইস্টার্ন ফ্লীটও দ্রুত লক্ষ্যস্থল অভিমুখে অগ্রসর হল। ভারতীয় বিমানবাহিনী কিছুক্ষণ আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সবগুলো বিমান ঘাঁটি এবং রাডার কেন্দ্রের উপর আঘাত হেনে চলছিলো। রাত ৩টায় ভারতীয় বিমানগুলো ঢাকা ও কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিগুলোর প্রথম হামলা শুরু করে। ইতিহাসের আর একটি মহান স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের সুচনা হল।

যুদ্ধের প্রথমদিনে সকল রণাঙ্গনে পাকিস্তানীরা মরণপণ শক্তিতে আক্রমণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলো। বেলা ১০টার মধ্যে ভীক্রান্ত তার নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ৬টি ‘সী হক’ বিমান চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যস্থলগুলোতে আঘাত হানার জন্য ডেক উড়ে গেলো।

পূর্ব সেক্টর অর্থাৎ মেঘনা নদীর পূর্ব দিকের অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যদের ধ্বংস করার দায়িত্ব ভারতীয় ৪র্থ কোরের উপর ন্যস্ত ছিল।এই সেক্টরে প্রধান সড়কপথে রণকৌশলগত প্রতিবন্ধকতা ছিল দুটি স্থানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং লাকসামে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া দহল করতে পারলে পূর্ব সেক্টরের সকল পাকিস্তানী সৈন্য বিশেষকরে সিলেটও মৌলভীবাজারের সৈন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে বাধ্য। একই সঙ্গে লাকসাম আমাদের দখলে এলে কুমিল্লা গ্যারিসন থেকে চট্টগ্রামও ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। চাঁদপুরও ফেনী দখলের দায়িত্ব ছিল ৪র্থ কোরের উপর। যুদ্ধ শেষ হওয়ার ১০দিনের মধ্যেই এই স্থান দখল করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। একই সঙ্গে উত্তরে শমসেরনগর বিমানঘাঁটি, মৌলভীবাজার এবং সিলেটও মুক্ত করার দায়িত্ব এই কোরের উপর ছিল। ৪র্থ কোরের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ঢাকা মুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল না। সে অনুসারে কোর কমান্ডার সগত সিং ৮ মাউন্টেন ডিভিশনকে শমসেরনগর বিমানঘাঁটি, মৌলভীবাজার এবং সিলেট শহর মুক্ত করার নির্দেশ দেন। করিমগঞ্জের নিকট সীমান্ত অতিক্রম করে ৮ম মাউন্টেন ডিভিশনের কলাম সিলেটের দিকে এবং অন্য একটি মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। শমসেরনগর বিমানঘাঁটি মুক্ত হয় প্রথম দিনেই। পাকিস্তানীরা অবস্থা বেগতিক দেখে এই অঞ্চলের অধিকাংশ সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে পশ্চাদপসরন করতে থাকে।

এই কোরের ৫৭তম ডিভিশনকে আগরতলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর আখাউড়া মুক্ত করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে অগ্রসর হওয়ার পথে নির্দেশ দেয়া হয়। কুমিল্লা এবং ময়নামতি মুক্ত করার কাজে নিযুক্ত ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনকে সাহায্য করাও ৫৭ ডিভিশনের দায়িত্ব ছিল। তারপর মেঘনা নদীর তীরে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র চাঁদপুর এবং দাউদকান্দি মুক্ত করার লক্ষ্যে যুদ্ধভিযান চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশও এই ডিভিশনকে দেয়া হয়।

এই সেক্টরে দক্ষিণে ফেনী শহর থেকে পাকিস্তানীরা সন্তর্পণে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে আমার বাহিনী শহরটিতে প্রবেশ করে। ফেনী আমাদের হাতে চলে আসায় চট্টগ্রাম পাকিস্তানীদের সাথে দেশের অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এসময় কুমিল্লাও লাকসাম এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়।

আমার সেক্টরে ফেনী এবং বেলুনিয়া এলাকা সম্পূর্ণ শত্রু মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তানীরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে লাকসামের দিকে পশ্চাদপসরন করে। এটাই হচ্ছে একমাত্র এলাকা( অর্থাৎ চট্টগ্রাম সেক্টর) যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোন নিয়মিত পুরো বিগ্রেড নিয়োজিত হয়নি। এখানে অভিযান চলেছে আমার তিন ব্যাটালিয়ন সেক্টর ট্রপস ( যার মধ্যে থেকে ২ কোম্পানী ইতিপূর্বেই চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হয়েছিলো) এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়নের শক্তির উপর নির্ভর করে।

বেলুনিয়াও ফেনীতে আমাদের হাতে চরম মার খাওয়ার পর ৫৩ বিগ্রেডসহ ১৫ বালুচ রেজিমেন্ট ৬ডিসেম্বর লাকসামের দিকে পলায়ন করেছিলো। ৬ডিসেম্বর আমরা ফেনী মুক্ত করে চট্টগ্রামের পথে অগ্রসর হই। সামনে আমাদের ৬৫ মাইল পথ। শুভপুরের কয়েক মাইল দক্ষিণে ধুমঘাট রেল সেতুটি দখল এবং রক্ষা করার জন্য আমি সাথে সাথেই দুই প্লাটুনকে পাঠিয়ে দেই ধুমঘাটের দিকে। চট্টগ্রামের পথে অগ্রসররমান আমাদের মূলবাহিনীতে ছিল আমার সেক্টরের তিনটি নিয়মিত বাহিনী এবং বাংলাদেশের একটি কামান বহর নাম ছিল মুজিব ব্যাটারী।(শেখ মুজিবর রহমানের নাম অনুসারে)।ভারতীয় বাহিনীতে ছিল ২য় রাজপুত ব্যাটালিয়ন, বি এস এফের গোলন্দাজ রেজিমেন্ট। এই সেক্টরে বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে আমি এবং ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার আনন্দ সরুপ ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য করে চলছিলাম। আগেই বলা হয়েছে আমাদের যৌথ বাহিনীর নাম’কিলো ফোর্স’ ।

ফেনী থেকে রওনা হওয়ার পথে পাকিস্তানের ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের সৈন্যদের মোকাবিলা হবে বলে আমরা জানতাম। পাকিস্তানী এই ডিভিশনের সাথে কামানও সাঁজোয়া বহর ছিল। আমার কিংবা ভারতীয় বাহিনীর সাথে ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না।এই কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনী একটু সতর্কটার সাথে অগ্রসর হচ্ছিলো। একই সঙ্গে একটি বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নকে চট্টগ্রাম পাহাড়ের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয় হাটহাজারী এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান গ্রহণ করার জন্য। এই জায়গাটি বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কয়েক মাইল উত্তরে। আর আমরা মূল বাহিনী মহাসড়ক পথে চট্টগ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে এগিয়ে চললাম।

চট্টগ্রাম অগ্রাভিযান আমরা ছাগলনাইয়া মুক্ত করার পর ৭ নভেম্বর ফেনী নদীর উপর স্মরণীয় শুভপুর সেতুর কাছে পৌঁছো। চট্টগ্রামের পথে আমাদের সামনে হচ্ছে এটিই হচ্ছে সর্বশেষ বাধা।অবশ্য এরপরও কয়েকটি ছোটখাটো সেতু রয়েছে। শুভপুর সেতুর কাছে গিয়ে দেখি পাকিস্তানীরা সুদীর্ঘ সেতুর দুটি স্পান সম্পূর্ণ ধ্বংস করে গেছে। আমরা আরো খবর পাই যে তারা ৮ মাইল দূরে মিরেশ্বরাই গিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলেছে।

তৎক্ষণাৎ ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের ডাকা হয়। তারা যৌথবাহিনী যানবাহনও ভারী অস্ত্রশস্ত্র পার করার জন্য ফেনী নদীতে একটি প্লাটুন ব্রিজ তৈরি করার কাজে লেগে যায়। কিন্ত নতুন সেতুর জন্য আমরা অপেক্ষা না করে আমার সৈন্যদলের একটি অংশ নিয়ে আমি ৮ ডিসেম্বর বিকেলে নৌকাযোগে নদী পার হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হই। স্বল্পতম সময়ে কবেরহাটে আমরা সেক্টর হেডকোয়াটার স্থাপন করে আমরা জোরারগঞ্জ পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করি। ভারতের বিগ্রেড কমান্ডারও কবেরহাট পৌঁছে যান। আমার এলাকায় যুদ্ধের জন্য রসদ সংগ্রহই ছিল বড় সমস্যা। আমাদের খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের জন্য পুরোপুরি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর উপর নির্ভর করতে হচ্ছিলো। এগুলোর জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আবার তাদের পেছনের ঘাঁটির উপর নির্ভর করতে হতো।এই ঘাঁটি ছিল শুভপুর থেকে প্রায়৫০ মাইল দূরে। এই পথটুকুর অধিকাংশ ছিল আবার ভীষণ খারাপ। তাই আমাদের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থায় মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিলো। হয়ত এই কারণেই আমার সঙ্গের ভারতীয় ব্যাটালিয়নগুলো সাবধানে এগুতে চাইছিলো। ভারতীয় কমান্ডার যুদ্ধের সরঞ্জাম এবং রসদের সরবরাহ সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বেশিদূর অগ্রসর হতে চাইছিলো না। এদিকে শত্রুরা শুভপুর সেতু ধ্বংস করে আমাদের আরও সংকটে ফেলে দিয়েছিলো। এই প্রতিকূলতা অবস্থা সত্ত্বেও আমরা বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। জাতিসংঘে আমাদের জন্য ক্ষতিকারক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং পাকিস্তানের অনুকূলে মার্কিন ৭ম নৌবহরের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পূর্বেই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় আমাদের চট্টগ্রাম পৌঁছতে হবে।

ইতিপূর্বেই আমি মিরেরশ্বরাইয়ের নিকট গেরিলা তৎপরতায় লিপ্ত আমার নিয়মিত কোম্পানী এবং মিরেশ্বরাইও সীতাকুণ্ড এলাকার সকল গেরিলা গ্রুপকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম যে, তারা যেন শত্রুর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। ৯ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে প্রতিটি গেরিলা দল মহাসড়ক অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে তাঁরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সড়কের দিকে আসছিলো এবং এতে করে ২০ মাইল দীর্ঘ এবং১০ মাইল প্রস্থ জুড়ে এলাকায় এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো যে, মনে হচ্ছিলো মুক্তিবাহিনীর পুরো একটি কোরই বোধহয় আক্রমণ চালিয়েছে। সেই রাতেই পাকিস্তানীরা পশ্চাদপসারণের আদেশের জন্য অপেক্ষা না করেই পেছনের দিকে পালিয়ে যায়।

এদিকে আমরা যখন একটি জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছিলাম আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে তখন চলছিল আরেক খেলা কিছু আমাদের সমর্থনে আবার কিছু ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। ৫ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে অবিলম্বে যে যুদ্ধবিরতির জন্য যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো দেয়। পাকিস্তান যখন হেরে যাচ্ছিলো সেই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি মানা হলে ইসলামাবাদেরই তাতে সুবিধা হতো, আর আমরা যেটুকু অর্জন করেছিলাম তাও হারাতাম।

এরপরের দিন অর্থাৎ ৬ই ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা করলে তা মুক্তিযোদ্ধাদের এবং বাংলাদেশের জনগণের মনোবল বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানের বন্দীশালায় আটক শেখ মুজিবর রহমানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে সেদিন মিসেস গান্ধী বলেছিলেন, এই নবজাত রাষ্ট্রের যিনি জনক বর্তমান মুহূর্তে আমাদের সমস্ত চিন্তা তাঁকেই কেন্দ্র করে।

৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সৈন্য প্রত্যাহারের একটি প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ হয়েছিল। প্রস্তাবটির উদ্যোক্তা ছিল মার্কিন সরকার। বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়েছিলো। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের। ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং অন্য ৮টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।

সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রস্তাব গ্রহণের বিষয়টি আমাদের কাছে তেমন বিস্ময়কর কিছু ছিল না। এতে এমন কিছু ঘটেনি যা আমাদের লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে। ভারত, পাকিস্তান কিংবা এই মহতী জাতি সংস্থার অন্যান্য সদস্য হয়ত এই প্রস্তাব মানতে বাধ্য। কিন্ত আমরা তখনও জাতিসংঘের সদস্য নই। বরং আমাদের এই লক্ষ্য ছিল অত্যন্ত পবিত্র আর সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম।এমনকি এসময় যদি ৭ম নৌবহর পাকিস্তানের সহায়তার জন্য যেকোনোভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তো তবুও আমরা এই মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতাম। ৭ম নৌবহরের যুদ্ধে যোগদানের ফলে হয়তো বাংলার আরও অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাতো। কিন্ত মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ এ দুটোর কোনটিই তখন এদেশের মানুষের অজানা কিছু নয়। পাকিস্তানের জন্যে এই যুদ্ধ ছিল নিছক জয় এবং পরাজয়ের। কিন্ত আমাদের জন্যে এই যুদ্ধ ছিল জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার মরনপ্রান সংগ্রাম, অন্যথায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার। এযুদ্ধ আমাদের দেবে গৌরবময় জীবনের সন্ধান নতুবা মৃত্যু।

ভারতের চীফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এসএইসএফ মানকেশ যুদ্ধের এক নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন ৮ই ডিসেম্বর থেকে। যৌথবাহিনীর সাফল্যে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি এক সময়োচিত মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ( সাইকোলজিক্যাল ওয়ার) শুরু করেন। তাঁর ভাষণ পর্যায়ক্রমে বেতারে প্রচারিত হতে থাকে। অন্যদিকে এই ভাষণ প্রচারপত্রের মাধ্যমে বিমানের সহয়তায় পাকিস্তানী অবস্থানসমূহের উপর বিলি করা হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অফিসারও জওয়ানদের মানকেশ তার বার্তায় সরাসরি বলেন, অস্ত্র সংবরণ করো, নইলে মৃত্যু অবধারিত। যৌথবাহিনী তোমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। তোমাদের বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস ও নিয়ে আর কোন সাহায্য পাবেনা। বন্দরগুলোও এখন অবরুদ্ধ, তাই বাইরে থেকে কোন সাহায্য পাওয়ার আশা বৃথা।মুক্তিবাহিনী এবং জনগণ প্রতিশোধ নিতে উদ্যত। তোমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে।সেই সাথে তিনি তাদের এই আশ্বাসও দেন সময় থাকতে অস্ত্র সংবরণ করলে তোমাদের সৈনিকদের যোগ্য মর্যাদা দেয়া হবে।

মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করে আসছিলো।১০ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিনিয়র কমান্ডারের অধীনে ভারত এবং বাংলাদেশ বাহিনীর যৌথ কমান্ড গড়ে তোলা হয়।

এই দিনই(১০ই ডিসেম্বর) ঢাকা রেডিওর ট্রান্সমিটারের উপর সরাসরি এক বিমান হামলায় বেতার প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।ভীক্রান্তের বিমানবহর তখন চট্টগ্রাম পোর্ট বিমানবন্দরও সামরিক দিক দিয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য কেন্দ্রের উপর সমানে আক্রমণ যাচ্ছিলো।

মার্কিন ৭ম নৌবহরের টাস্কফোর্স ইতিমধ্যেই মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে দ্রুত বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। মার্কিনী এই বহরে ছিল পারমাণবিক শক্তি চালিত বিশাল বিমানবাহী জাহাজ’ এন্টারপ্রইজ’ এবং আরও ৬টি যুদ্ধজাহাজ। এব্যাপারে মার্কিন সরকারের অজুহাত ছিল বাংলাদেশে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার জন্যই ৭ম নৌবহরকে এই অঞ্চলে আনা হচ্ছে। এই যুক্তি মার্কিন জনসাধারণের কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিল না, কারণ আমাদের যৌথ কমান্ড ১১ই ডিসেম্বর থেকে বিমান হামলা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে ঢাকা বিমানবন্দর মেরামতের সুযোগ করে দেয়। যাতে আন্তর্জাতিক পথের বিমানগুলোতে বিদেশী নাগরিকরা ঢাকা ত্যাগ করতে পারেন। কিন্ত মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে এসময়ে ঢাকা ত্যাগের তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায়নি।

ততক্ষণে যুদ্ধ সম্পর্কে সবাই স্পষ্ট ধারণা করতে পারছিলো। যৌথবাহিনীর সাফল্যের সাথে মেঘনা নদীর অপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের পর সামরিক বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে ঢাকার পতন ঘটবে। নিয়াজি অবশ্য তখনো নিরাপদে ঢাকায় বসে হুংকার দিচ্ছিলেন প্রতি ইঞ্চি জায়গার জন্য একটি প্রাণ বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব।রাও ফরমান আলী কিন্ত ঠিকই বুঝেছিলেন খেলা শেষ। বাংলাদেশে পাকিস্তানীরা যে জঘন্য অপরাধ করেছিলো অপারেশন জেনোসাইডের অন্যতম স্থপতি ফরমান আলী সে বিষয়ে পুরো সচেতন হয়ে পড়ছিলেন। পরাজয় তখন অবশ্যম্ভাবী। মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে ১১ই ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক আবেদন জানান। ফরমান আলী এখানকার পাকিস্তানী সকল পাকিস্তানীকে অপসারণের ব্যবস্থা করারও অনুরোধ জানান। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান জাতিসংঘকে জানিয়ে দেন ফরমান আলীর প্রস্তাব অনুমোদিত।ইয়াহিয়ার তখনো আশা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসবে। নিয়াজীকে তিনি আরেকটু অপেক্ষা করার নির্দেশ দেন।

চীন বোধহয় একা অজুহাতের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আর ৪ঠা ডিসেম্বর মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে।

চট্টগ্রাম সেক্টরে আমাদের সকল সৈন্য ৯ই ডিসেম্বর বিকালের মধ্যে শুভপুর সেতু বরাবর ফেনী নদী পার হয়ে যায়। সামনে শত্রুরা কোথায় কি অবস্থায় আছে পর্যবেক্ষণের জন্য আমরা যথারীতি টহল দল আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।পাকিস্তানীরা মিরেশ্বরাই ছেড়ে যাচ্ছে বলে একজন গেরিলা বেস কমান্ডার আমাকে খবর দেয়। মিরেরশ্বরাই থেকে১৫ মাইল দূরে গিয়ে সীতাকুণ্ডুতে তারা নাকি নতুনভাবে অবস্থান গ্রহন করে।আমি সাথে সাথে মিরেরশ্বরাই দখল করার জন্য একটি ব্যাটালিয়ন পাঠিয়ে দেই। তখনো আমাদের কোন যানবাহন ফেনী নদী পার হতে পারেনি।ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের তাই পায়ে হেঁটেই অগ্রসর হতে হচ্ছিলো। ভারী অস্ত্রশস্ত্রও মালামাল নেওয়ার জন্য কয়েকটি রিকশাও গরুর গাড়ি জোগাড় করা হয়।

বিকালে আমি পরিষদ সদস্য মোশারফ হোসেনকে নিয়ে একখানি রিকশায় মিরেরশ্বরাইয়ের দিকে যাত্রা শুরু করি। আমাদের ব্যাটালিয়নও তখন একই দিকে মার্চ করে যাচ্ছিলো। পথে তাদের পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাই। অবশ্য এইভাবে একা সামনে এগিয়ে যাওয়া ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পাকিস্তানীরা ঠিক কোথাও রয়েছে কিনা তখনো আমরা তা জানতাম না। তারা সকলে মিরেরশ্বরাই ত্যাগ করেছিলো কিনা তাও জানা ছিল না। তারা সকলে মিরেরশ্বরাই ত্যাগ করেছে কিনা তারও নিশ্চয়তা ছিল না। তবু আমি মিরেরশ্বরাই ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে দেখি একটু আগে শত্রুসেনারা সে স্থান ছেড়ে চলে গেছে। স্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তা মিরেরশ্বরাই হাইস্কুল ভবনে আমার সাথে একত্র হলেন। পাকিস্তানীরা আবার রাতে ফিরে আসতে পারে বলে তার আশংকা করছিলেন। আমাদের তখন অত্যন্ত দ্রুত চট্টগ্রাম দখল করা দরকার। তাই মিরেরশ্বরাইতে আমরা দ্রুত প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তুললাম। এপ্রিলও মে মাসে এই অঞ্চলেই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। তাই পুরো এলাকাটি আমার এবং আমার অধিকাংশ সৈন্যেও ছিল সুপরিচিত। মিরেরশ্বরাইতে আমরা বেসামরিক প্রশাসন চালু করি। কবেরহাটে অবস্থানরত ভারতীয় বিগ্রেডিয়ার আনন্দ সরুপকে আমরা নতুন অবস্থানের কথা জানিয়ে তাকে সত্বর এখানে চলে আসার অনুরোধ জানাই।চট্টগ্রামের পথে শত্রুসেনার সঠিক অবস্থান জানার জন্য একটি টহলদার দল পাঠিয়ে দেই মিরেরশ্বরাই থেকে সীতাকুণ্ডের দিকে। ভোরেই আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। তাই মিরেরশ্বরাই হাইস্কুলে সে রাতটা কাটালাম।

পরেরদিন স্বল্পদৈর্ঘ্য সংঘর্ষের পরই সীতাকুণ্ডে শত্রুদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।সীতাকুণ্ড অতিক্রম করার পর ১৩ই ডিসেম্বর কুমিরায় পৌঁছে আমরা পাকিস্তানীদের শক্তিশালী ঘাঁটির সম্মুখীন হই। ভূমি বৈশিষ্ট্যের কারণে এই জায়গাটি শত্রুদের যথেষ্ট অনুকূলে ছিল। পশ্চিমে সাগর এবং পূর্বে উঁচু পাহাড়ের মধ্যবর্তী সরু এলাকা জুড়ে পাকিস্তানীদের সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে বসেছিল। সড়কের একস্থানে গভীর খালের উপর সেতুটি তারা ধ্বংস করে দিয়েছিলো। রাস্তার উপর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উঁচু পাহাড়ে যক্ষ্মা হাসপাতালের কাছে ছিল তাদের মূল প্রতিরক্ষাঘাঁটি। পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা উভয়পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। আমাদের কয়েকজন সংঘর্ষে হতাহত হলেও পরদিন সকালের মধ্যে আমরা পূর্বদিকে অগ্রসর হতে সক্ষম হই। বেসামরিক জনগণ শত্রুসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের খবরাখবর দিচ্ছিলো।সংবাদ অনুযায়ী সঠিক লক্ষ্যস্থলের কামান দেগে ওদের ঘায়েল করেছিলাম। ১৪ই ডিসেম্বর ভোর রাত ৩তার মধ্যে আমরা কুমিরা পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করে ফেলি।চট্টগ্রাম এখন মাত্র ১২ মাইল দূরে। কুমিরা মুক্ত হওয়ার মাত্র ৩ঘণ্টার মধ্যে আমাদের যানবাহন এবং কামানগুলো ভাঙ্গা সেতু এড়িয়ে খাল পার হতে শুরু করে। কয়েক হাজার নারী, পুরুষ, শিশু ভাঙ্গা সেতুর কাছে জমায়েত হয়ে আমাদের সাহায্য করছিলো। একদল খালের পাড় কেটে ডাইবারসন রোডের ব্যবস্থা করেছিলো। অন্যদল আবার গাছ, পাথর, মাটি যা পাচ্ছিলো তাই দিয়ে খাল ভরে ফেলার চেষ্টা করছিলো। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম। এই সময় এক বৃদ্ধা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবা চিন্তা করোনা। এই কাজ আমরাই পারবো। দ্যাকো তোমাদের মালপত্র আর গাড়িঘোড়া কিভাবে পার করার বন্দোবস্ত করছি। দরকার হলে আমরা সবাই খালে শুয়ে পড়বো। আর তার উপর দিয়ে তমাদের গাড়ি পার করার ব্যবস্থা করবো। দেরি করোনা বাবা। প্রত্যেক মুহূর্তে তারা আমাদের লোক মারছে। বৃদ্ধা একটু থামলেন। তার দুই চোখ পানিতে ভরে গেছে। বৃদ্ধা বললেন, তোমরা জানোনা, কিছুদিন আগে ঈদের সময় চাটগাঁয়ে একটি লোকাল ট্রেন থামিয়ে তারা সকল বাঙ্গালী যাত্রীকে খুন করেছে।প্রায় একহাজার হবে।দা, চুরি এসব দিয়ে মেরেছে। আমার মেয়ে আর নাতিনাতনিও ছিল। আর বলতে পারবোনা। তোমরা এগিয়ে যাও, তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাও। তিনি আমাকে প্রায় ঠেলে দিয়ে আবার কাজে ফিরে গেলেন।আমিও পাকিস্তানীদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছিলাম। তবে, চট্টগ্রামের যে সর্বশেষ খবর আমি পেয়েছিলাম তা ছিল আরও ভয়াবহ। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করছিলো চট্টগ্রাম শহরে কয়েক হাজার বাঙ্গালিকে নির্বিচারে হত্যা করতে। এটা ছিল তাদের শেষ মরণকামড়।

ততোক্ষণে বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌবহরের অনুপ্রবেশে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছিলো। চট্টগ্রামের কোন সমুদ্র উপকূলে টাস্কফোর্সের মার্কিন বাহিনী অবতরণ করতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছিলো। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা চট্টগ্রাম মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেই। সেই উদ্দেশ্যে ভারতের ২৩ ডিভিশনের ৮৩ বিগ্রেড লাকসাম থেকে দ্রুত যাত্রা শুরু করে এবং কুমিরার কাছে আমাদের সাথে যোগ দেয়। অন্যদিকে ভারতের বিমানবাহিনী ও ইস্টার্ন ফ্লীট পাকিস্তানী অবস্থানগুলোর উপর অবিরত গোলাবর্ষণ করে চলছিলো। এখানকার পাকাবাহিনীকে ধ্বংস করা এবং পোর্ট অচল করে দেওয়ার জন্যই এই আক্রমণ চলছিলো। বোমার আঘাতে জ্বালানি তেলের ট্যাংকগুলো কয়েকদিন ধরে জ্বলছিল। ক্ষতিগ্রস্ত এবং নিমজ্জিত জাহাজের সংখ্যাও ছিল প্রচুর।ডুবন্ত চ্যানেল প্রায় পুরোপুরি বন্ধ। পোর্টের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ব্যাপক। ৫০০ এবং১০০ পাউন্ড বোমার গর্তগুলো ভরাট এবং ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে পরে সময় লেগেছিল এক বছরেরও বেশী।

মুক্তিযোদ্ধারা খবর নিয়ে এলো যে, কিছু পাকিস্তানী অফিসার ও সৈন্য কক্সবাজার হয়ে পালাবার স্থলপথে পালাবার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ আবার জাহাজে করে কেটে পড়ার চেষ্টা করছে। কয়েকটি পাকিস্তানী জাহাজকে বিদেশী জাহাজের মত রং লাগিয়ে এবং বিদেশী পতাকা উড়িয়ে ছদ্মবেশে পালানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এই খবর ভারতের ইস্টার্ন ফ্লীটকে পাঠালে ইস্টার্ন ফ্লীট সতর্ক হয়ে যায়। ছদ্মবেশে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি পাকিস্তানী জাহাজ ভীক্রান্ত এর গোলায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বার্মা দিয়ে পাকিস্তানীদের পালাবার চেষ্টা বন্ধ করার জন্য এসময়ে কক্সবাজারে একটি অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে রোম ফোর্স নামে এক নতুন বাহিনীর সৃষ্টি হয়। এই বাহিনীতে ছিল ভারতের১/২ গুর্খা রাইফেলস এবং ১১বিহার রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানী। মর্টার সজ্জিত এই বাহিনী ভারতের একখানি সওদাগরী জাহাজে ১৪ই ডিসেম্বর কক্সবাজার উপকূলে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় রোম ফোর্স তীরে অবতরণ করে। কিন্ত ঐ এলাকায় কোন পাকিস্তানীকে অবশ্য তারা পায়নি।

১৫ই ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তান চীফ অফ আর্মি স্টাফ থেকে নিয়াজী শেষ নির্দেশ লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ আত্মসমর্পণের যে শর্ত দিয়েছেন তা যুদ্ধবিরতির জন্য গ্রহণ করা যেতে পারে বলে এতে নিয়াজীকে পরামর্শ দেয়া হয়। এই রাতেই দুটার মধ্যে বাংলাদেশের যেসব স্থানে পাকিস্তানী সেনাদল অবস্থান করছিলো নিয়াজী তাদেকে ওয়্যারলেস যুদ্ধবিরতি পালন এবং যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ জারি করেন।

রাত শেষ হয়ে আসে। ১৬ই ডিসেম্বর শেষরাতের দিকে ভারতীয় ৯৫ মাউন্টেন বিগ্রেডে নিয়োজিত বিগ্রেডিয়ার ক্রেয়ার নিয়াজীর হেডকোয়াটারের একটি ম্যাসেজ ইন্টারসেপট করেন। এই বার্তায় ভোর ৫টা থেকে নিয়াজী তার সকল সেনাদলকে যুদ্ধবিরতি পালন করতে বলেছিলেন। ক্লেয়ার সাথে সাথে এই অয়ারলেস বার্তার কথা জেনারেল নাগরাকে জানিয়ে দেন পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর বিগ্রেড কমান্ডার এবং ডিভিশনাল কমান্ডার মিরপুর ব্রিজের কাছে দ্বিতীয় ছত্রী ব্যাটালিয়ন যেখানে অবস্থান করছিলো সেখানে পৌঁছান। সেখানে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় প্যারা ব্যাটালিয়ন বাহিনীর থেকে তারা জানতে পারলেন যে, ভোর ৫টার পর ব্রিজের কাছে আর গোলাগুলি হয়নি। এরপর জেনারেল নাগরা তাঁর একজন এডিসি এবং ভারতীয় ছত্রী ব্যাটালিয়নএরন একজন অফিসারকে শ্বেত পতাকাবাহী জিপে করে ব্রিজের অপর পাড়ে পাঠিয়ে দেন। তখন বেলা ৯টা। জীপের আরোহীরা জেনারেল নিয়াজীর উদ্দেশ্যে লেখা জেনারেল নাগরার একটি বার্তা বহন করছিলেন। রণক্ষেত্রের করোতার পরিবর্তে বার্তাটিতে নাটকীয়তাই ছিল একটু বেশি। জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এবং জেনারেল নাগরা দুজন ছিলে ব্যক্তিগত জীবনে পরিচিত সম্ভবত তাই বার্তাটিতে ছিল নরমের সুর। প্রিয় আবদুল্লাহ আমি এসে পড়েছি। তোমার সব বাহাদুরি আর খেলা শেষ। আমার কাছে এখন আত্মসমর্পণ করবে, এই আমার উপদেশ। পাকিস্তানের জন্য সত্যই তখন সকল খেলা শেষ।নিজ বাহিনীর প্রতি যুদ্ধবিরতি এবং আত্মসমর্পণ করার যে নির্দেশ নিয়াজী জারি করেছিলেন, ১৬ই ডিসেম্বর সকালেই তা ভারত সরকারকে জানিয়ে দেয়ার জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন সামরিক এটচিকে অনুরোধ করেন। তার অনুরোধ যথারীতি ভারতে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে জানানো হয়।

চট্টগ্রাম এলাকায় আমরা তখন কুমিরার দক্ষিণে আরও কয়েকস্থানে শত্রুমুক্ত করে ফেলেছি। আমাদের যাত্রা বিলম্বিত করার উদ্দেশ্যে এসব জায়গায় কিছু কিছু পাকিস্তানী সৈন্য অবস্থান করছিলো। পথের সকল বাধা পরাভূত করে ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা ভাটিয়ারীর শক্তিশালী ঘাঁটির সম্মুখীন হই। এখান থেকে ফৌজদারহাট এলাকা পর্যন্ত পাকিস্তানীরা দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। এখানে তাদের অধিকাংশ সৈন্য এবং সমরাস্ত্র এনে মোতায়েন করছিলো।আমাদের লক্ষ্য ছিল কিভাবে এই কমপ্লেক্স আমরা ধ্বংস করতে পারি। যুদ্ধ করতে করতে ওরা যদি চট্টগ্রাম শহরে মধ্য দিয়ে গিয়ে অবস্থান করতে পারে তাহলে আমরা পড়বো বিপদে। বাড়িঘর অধ্যুষিত এলাকায় যুদ্ধ গেলে প্রতিটি বাড়িই আত্মরক্ষাকারীর আড়াল হিসেবে কাজে লাগাতে পারবে। সেই পরিস্থিতিতে শহরের মধ্যে পা বাড়ানো আমাদের জন্য দুরুহ হয়ে পড়বে।

তাই ফৌজদারহাট এবং চট্টগ্রামের মাঝখানে শত্রুদের অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেই।উদ্দেশ্য ছিল ভাটিয়ারী এবং ফৌজদারহাটে অবস্থান গ্রহণকারী সৈন্যরা যেন পেছনে গিয়ে শহরে প্রবেশ করতে না পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রু বাহিনীর পেছনে আমাদের সৈন্যরা তাদের পশ্চাদপসরনের পথ রুদ্ধ করে রাখবে এবং সামনে থেকে আমাদের অবশিষ্ট অংশ আক্রমণ চালাবে। অভিযানের এই পদ্ধতি কতটা ‘’ঘাড়ে ধরে মুখে আঘাত করার মত’’ বলা যেতে পারে। সেই অনুসারে ভারতের ৮৩ বিগ্রেডের দুটি ব্যাটালিয়ন ২রাজপুত এবং ৩ ডোগরাকে পেছনের পথ বন্ধ করে দেয়ার জন্য পাঠানো হয়। ভারতের তৃতীয় আরেকটি ব্যাটালিয়ন সম্মুখ সমরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ব্যাটালিয়নের সাথে যোগ দেয়।পূর্বোক্ত ব্যাটালিয়ন দুটি রাতের আঁধারে সড়ক থেকে প্রায় ১৫ মাইল পূর্ব দিক দিয়ে পাহাড়ী রাস্তা ধরে ফৌজদারহাটের কিছুটা দক্ষিণে গিয়ে আবার সড়কে উঠবে এবং সেখানে রাস্তা বন্ধ করে অবস্থান গ্রহণ করবে এই ছিল তাদের প্রতি নির্দেশ।পাহাড়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান এই দলের মালামাল বহনের জন্য প্রায় ১২০০ বেসামরিক লোক জোগাড় করা হয়। প্রয়োজনীয় সব জিনিসই এই বাহিনীর সাথে থাকবে যাতে তারা অন্তত ৪দিন চলতে পারে। খাদ্যদ্রব্য, গোলাবারুদ, ট্যাংক বিধ্বংসী কামান, মর্টার, মাটি খননের সরঞ্জাম, রান্নার উনুন এবং অন্যান্য তৈজসপত্র এ দুটি ব্যাটালিয়নের জন্য যাকিছু প্রয়োজন সবই বহন করতে হবে। এছাড়া বেসামরিক লোক যারা যাবে তাদের খাদ্য এবং কিছু জ্বালানি কাঠও সঙ্গে থাকবে।

১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার কিছু আগেই ব্যাটালিয়ন দুটি পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করে। স্থানীয় কিছু কিছু লোক আগে চলে যেতে থাকে গাইড হিসেবে। এই অভিযানের সাফল্যের উপরই চট্টগ্রামে আমাদের চূড়ান্ত লড়াইয়ের ফলাফল নির্ভর করছে।

ইতিমধ্যে আমার নির্দেশে মিরেরশ্বরাই এবংসীতাকুণ্ড এলাকায় প্রায় ২০০০ সৈন্য একত্র হয়ে কয়েকটি নির্ধারিত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে।যথাসময়ে তারাও লড়াইয়ে যোগ দেবে। শহর এলাকা সম্পর্কে ভালোভাবে জানে বলে রাস্তায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তারা খুব কাজে লাগবে।তাদেরকে একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখলাম।

ভাটিয়ারীতে ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমরা পাকিস্তানীদের প্রথম রক্ষাব্যূহের উপর আক্রমণ চালাই। দুটি কোম্পানীর এই আক্রমণ ওরা প্রতিহত করে দেয়, আমাদের পক্ষে হতাহত হয় ২ জন। ১৬ই ডিসেম্বর অগ্রবর্তী দলটি শত্রুর পেছনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করার পরই আমাদের আসল আক্রমণ শুরু হবে। তাই আমরা পরেরদিন হামলা চালাবার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করি।
ঢাকার অদূরে ভারতীয় জেঃ নাগরা যে দুজন অফিসার জেঃ নিয়াজীর কাছে পাঠিয়েছিলেন তার ২ ঘণ্টার পর ১১টার দিকে ফিরে আসে। তাদের জীপের পেছনে একখানি গাড়িতে করে আসেন পাকিস্তানের ৩৬ ডিভিশনের জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ। জেনারেল নিয়াজীর সরকারী প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসিয়মর্পণের প্রস্তাব নিয়ে আসেন।এরপর নাগরা এবং আরও কয়েকজন অফিসারকে জামসেদের হেডকোয়াটারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকেতারা নিয়াজীর অফিসে যাওয়ার প্রাক্কালে কলকাতাস্থ ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়াটার এবং ৪র্থ কোরের হেডকোয়াটারের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যথারীতি খবর পাঠিয়ে দেন।এর আগে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নিয়াজী অয়ারলেসযোগে মানেকেশকে আত্মসমর্পণের মেয়াদ আরও ৬ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি আরো অনুরোধ করেন যে, আত্মসমর্পণের শর্তাবলী নির্ধারণ করার জন্য তিনি যেন একজন ভারতীয় সিনিয়র সামরিক অফিসারকে ঢাকা পাঠিয়ে দেন।

এতসব ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। আমরা ভাটিয়ারীতে তখন যুদ্ধে লিপ্ত। আমদের অগ্রবর্তী দল সাফল্যের সঙ্গে পাহাড়ী পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো। কথা ছিল ১৬ই ডিসেম্বর কোন একসময়ে তারা শত্রুর পেছনের দিকে রাস্তা বন্ধ করে অয়ারলেসযোগে সে খবর আমাদেরকে জানিয়ে দেবে। আমরা সবাই তাদের খবর শোনার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলাম।

নাগরার কাছ থেকে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের কথা জানতে পেরে জেনারেল অরোরা তার চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবলকে বিমানযোগে ঢাকা পাঠিয়ে দেন। ততক্ষণ মিরপুর যৌথবাহিনী ব্রিজ পার হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করে। এসময়ে নগরীর রাস্তাঘাট ছিল জনমানবশূন্য।

মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সৈন্যদের রাজধানীতে প্রবেশের খবর দাবানলের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লাসের জোয়ারে ঢাকার লক্ষ লক্ষ লোক নেমে আসে রাস্তায়। জনমানবহীন নিঃশব্দ নগরী মুহূর্তে ভরে উঠে মানুষের বিজয় উল্লাসে। ওরা এসেছে এই বাণী উচ্চারিত হতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধ্বনি উঠে জয় বাংলা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যৌথবাহিনীর জন্য মানুষ এগিয়ে আসে ফুলের ডালি হৃদয়ের গভীর আর ভালবাসা নিয়ে।

ঢাকায় সেদিন একদিকে চলছিল মানুষের বিজয় মিছিল। তারই পাশাপাশি ছিল পরাজিত পাকিস্তানীদের পলায়নের হাস্যকর দৃশ্য।কিন্ত মানুষ যে কত জিঘাংসা পরায়ণ হতে পারে পাকিস্তানীরা তার এক নতুন নজীর সৃষ্টি করেছিলো। পালিয়ে জাবার সেই মুহূর্তেও পাকিস্তানীরা বিভিন্ন নিরীহ মানুষের উপর এলোপাতাডি গুলি চালায়। ফলে বহু নিরীহ বাঙ্গালী হতাহত হন।

আত্মসমর্পণের একটা খসড়া দলিলসহ জেনারেল জ্যাকব বেলা ১টায় জেনারেল অরোরার হেডকোয়াটার থেকে ঢাকা এসে অবতরণ করলেন। বেলা ২টা ৫০ মিনিটে জেনারেল অরোরা তার সৈনিক জীবনের সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত বার্তা পেয়ে গেলেন। জীবনের খুব কম সংখ্যক সেনানায়কই এমন বার্তা পেয়েছেন। বার্তাটি ছিল, নিয়াজীতার সেনাবাহিনীর সকলকে নিয়ে আত্মসমর্পণে রাজী হয়েছেন এবং আত্মসমর্পণ দলিলেও স্বাক্ষর করেছেন।পশ্চিম সেক্টরে পাকিস্তানী ৯ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনসারীর আত্মসমর্পণ পর্ব ততক্ষণে সাঙ্গ হয়েছে। বিকাল ৩টার মধ্যে মুক্তিবাহিনীর শত শত তরুণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি বিগ্রেড বিজয়ীর বেশে রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য জেনারেল অরোরা তার বিমানও নৌবাহিনীর চীফ অব স্টাফকে নিয়ে একটু পরেই ঢাকায় অবতরণ করলেন।

আমার বিশ্বস্ত জেসিও সুবেদার আজিজ এবং ১৫ বছরের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা এতসব ঘটনার কিছুই অবহিত ছিল না।পাকিস্তানীদের একটি খালের অপর পাড়ে হঠিয়ে পুনরায় আক্রমণ পরিচালনার জন্য অবস্থান গ্রহণ করছিলো। অল্প বয়স্ক ছেলেটি কাছেরই এক গ্রামের। তাঁর গ্রাম আগেই শত্রুমুক্ত হয়েছে। মা-বাবার সাথে দেখা করার জন্য ১৫ই ডিসেম্বর তাকে ১২ ঘণ্টার জন্য ছুটি দিয়েছিলাম। কিন্ত সে প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলো, না স্যার। চট্টগ্রাম মুক্ত করার পরই আমি বাড়ি ফিরবো। কয়েকদিন বা আর লাগবে। আত্মসমর্পণের জন্য জেনারেল নিয়াজীর নির্দেশ তখনো তার সকল সেনাদলের কাছে পৌঁছেনি। আমরা জানতাম না যে, বেলা ৪টা৩১মিনিটে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৬মাইল দূরে মহাসড়কের উপর ভাটিয়ারী দখলের জন্য আমরা তখন লড়াই করছি। আক্রমণ চালাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানী। ঘড়িতে তখন বেলা ৪টা ৩০মিনিট। ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় অস্ত্রের গর্জন থেমে গেছে। নিয়াজী এবং অরোরা হয়তো কলম হাতে নিয়ে আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করছেন। নিয়তির নির্মম পরিহাস। ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকা থেকে ১৬০ মাইল দূরে পাকিস্তানীদের একটি কামানের গোলা আমার অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধা এই কোম্পানীর মাঝখানে এসে পড়লো। সুবেদার আজিজ এবং ১৫ বছরের সেই ছেলেটি দুজনে গোলার আঘাতে আহত হলো। আস্তে আস্তে পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেলো, সেই সাথে বাতাসে মিলিয়ে গেলো তাদের শেষ নিঃশ্বাস। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ধীরে, ধীরে। একজন পাকিস্তানী মেজর ভাটিয়ারীর ভাঙ্গা ব্রিজের মুখে এসে দাঁড়ালো। হাতে তার সাদা পতাকা। তারা নিয়াজীর নির্দেশ পেয়ে গেছে, এখন আত্মসমর্পণ করতে চায়।

পরিশেষ

রণাঙ্গনে এবার নেমে আসে প্রশান্ত নীরবতা।

রাইফেল, মেশিনগান, মর্টার,কামানের গোলাগুলির শব্দ থেমে যায়।থেমে যায় আহতের কান্না,মুমূর্ষের করুণ আর্তনাদ।নতুন এক রাত্রির প্রহর আসে কোন এক হারানো অতীতের স্বপ্ন নিয়ে। এমনি সুন্দরের স্বপ্নে আহবান কাল ধরে মানুষের সংগ্রাম চলেছে।

ভাটিয়ারীতে মহাসড়কের উপর সেতুটি পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে দিয়েছিলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর স্বেচ্ছাসেবক ১৬ই ডিসেম্বর সারারাত ধরে কাজ করলো ভাটিয়ারীর খালের মধ্যদিয়ে একটা বিকল্প রাস্তা তৈরি করতে। রাতেই আমরা সমস্ত সৈন্য এবং গেরিলাদের চট্টগ্রাম শহরে এবং চট্টগ্রামও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকা নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেই। ফেনীর অংশবিশেষ সহ শুভপুর পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণভার আমরা আগেই নিয়েছিলাম। আমার সম্পূর্ণ বাহিনীকে পরদিন খুব সকাল বেলায়ই চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণের নির্দেশ দিলাম। একটি ব্যাটালিয়নকে অবশ্য রাতেই খাল পার হয়ে শহরের অভিমুখে যতদূর সম্ভব এগিয়ে অবস্থান গ্রহণ করতে পাঠিয়ে দেই।

শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সার্কিট হাউসকে আমরা হেডকোয়াটার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্দেশ দেয়া হলো পোর্ট এলাকায় নৌবাহিনীর হেডকোয়াটার এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে আত্মসমর্পণের জন্য জমায়েত হতে। পাকিস্তানী বন্দীদের দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর ন্যস্ত হয়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ১৬১ জন অফিসার, ৩০৫ জন জেসিও এবং নৌও বিমানবাহিনীর সমপর্যায়ের লোক এবন তিন বাহিনীর ৮৬১৮ জন্য সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।

১৭ই ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত বিকল্প রাস্তার কাজ সম্পন্ন হলো না। ফলে তখন পর্যন্ত সে স্থান দিয়ে গাড়ী পার করাও সম্ভব ছিল না। আমি পুলের এপারে গাড়ী থেকে নেমে পড়লাম একটি ছোট প্যাকেট হাতে নিয়ে। তারপর একটি লাঠিতে ভর দিয়ে খাল পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। দুদিন আগে কুমিরার যুদ্ধে আহত হওয়ায় আমাকে লাঠিতে ভর দিয়ে বেশ খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছিলো।

পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে লোকজন তখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। তা সত্ত্বেও কিছু লোক আমাদের এগিয়ে নেয়ার জন্য ভাটিয়ারীর ভাঙ্গা সেতু পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলো। আমি আমার এক বন্ধুর গাড়ীতে উঠে বসলাম। গাড়ী সোজা ছুটে চলল সোজা সার্কিট হাউসের দিকে।

অগণিত নারীপুরুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। পথের দুই দাঁড়িয়ে তারা হাত তুলে যৌথবাহিনীর সৈন্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাচ্ছিল।জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। কেউ কেউ বোধহয় তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি সত্যিই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে তারা সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখছিল। পাকিস্তানিদের তখন অস্ত্র সংবরণের পালা। বাস ও ট্রাকে করে তারা দ্রুত ছুটে পালাচ্ছিল নৌবাহিনীর হেড কোয়াটার এবং ক্যান্টমেন্টের দিকে।

সার্কিট হাউসে তখন বহু লোক জমা হয়ে গেছে। জনতার ভিড় ঠেলে আমি এগিয়ে যাই। যুদ্ধের এই কয়মাসে আবার দাঁড়ি বেশ বড় হয়ে যাওয়ায় অনেক বন্ধু এবং পরিচিত জনি আমাকে চিনতে পারলো না।

এমনি এক সুন্দর মুহূর্তের জন্য সযত্নে এই প্যাকেটটি সাথে রেখেছি দীর্ঘ নয়মাস। এবার ওটাকে খুলে ফেললাম। সুন্দর করে ভাঁজ করা বাংলাদেশের পতাকাটি একটি কিশোর ছেলের হাতে দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলাম সার্কিট হাউসের ছাদে। সেখানে তখনও পাকিস্তানী পতাকা উড়ছিলো। ছেলেটি পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিচে। সেখানে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতীক জাতীয় পতাকা।সে সময় হাজার হাজার মানুষ দৌড়ে আসছে সার্কিট হাউসের দিকে। সমস্ত এলাকা ভরে গেছে মানুষের ভিড়ে।পতাকা উত্তোলনের সময় মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয় উত্তাল জনসমুদ্র সেই অবিস্মরণীয় সেই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য। তারপর বাতাসে দোলা লাগে, উড়তে থাকে নতুন পতাকা। নিস্তব্ধ জনতা উদ্বেলিত হয়ে উঠে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সেই জন সমুদ্রে উঠে জয়ধ্বনি জয় বাংলা।

পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী ধ্বংসের পথযাত্রী একটা জাতি পেয়ে গেলো স্বাধীনতা। দুঃস্বপ্নের রাতের শেষে সেই পতাকার রক্তিম সূর্য বাংলার মানুষের জন্য নিয়ে এলো নতুন আশার বাণী। সমস্ত পৃথিবীতে সে বিজয়ের বার্তা পৌঁছে দিতে যেন মানুষ একযোগে মুহুর্মুহু ধ্বনি দিতে থাকে জয় বাংলা। খুলে গেলো সমস্ত আবদ্ধ দুয়ার। বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো বেরিয়ে আসে সকল মানুষ। দীর্ঘদিনের দুঃসহ যন্ত্রণা শেষে তারা উপভোগ করতে চাইলো উষ্ণ সূর্যালোক, মুক্ত বাতাস, সুন্দর সম্ভবনাময় নতুন স্বাধীনতা। ভয়াবহ গণহত্যার মধ্য দিয়ে তারা বেঁচে থেকে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে পারছে একথা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তবুও সেই সব মানুষ বেঁচে আছে। মেঘমুক্ত নীল আকাশের নিচে সোনালী সূর্যের আলোকে মানুষ চেয়ে থাকে নতুন পতাকার দিকে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকাকে অভিবাদন জানিয়ে আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণের জন্য, অবাক বিস্ময়ে। ভুলে গেলাম আমার চারপাশের উত্তাল জনসমদ্রের কথা।তখন ৯টা ১৫ মিনিট, ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি ঘরে বিভিন্ন আকারের নতুন জাতীয় পতাকা শোভা পেতে লাগলো। শুধু ঘরের ছাদই নয়, গাছপালা, লাইটপোস্ট, দোকানপাট যেখানেই সম্ভব সেখানে মানুষ উড়ালো নতুন পতাকা। উৎসবের সাড়া পড়ে গেলো সমস্ত শহরে। যুদ্ধের নয়মাস এমনি একটা সুন্দর মুহূর্তের জন্যপ্রতিটি বাঙ্গালীর ঘরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো বাংলাদেশের পতাকা। ধরা পড়ে অনেকে আবার পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবচাইতে বেদনাময় ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে হয়তো সাময়িকভাবে। এই নিষ্ঠুর ঘটনা ছিল অবিশ্বাস্য, আর তাই হয়তো এখানে কান্নার ভাষা হারিয়ে গিয়েছিলো। বিকৃত বিকারগ্রস্ত, রক্তলিপ্সু পাকিস্তানীরা নিরীহ নারীপুরুষ এবং শিশুহত্যার নৃশংসতায় হিটলারের নাৎসী বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির পক্ষ অবলম্বনকারী দুটি সরকার ছাড়া আর সমস্ত পৃথিবীর সরকার একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছিলো হিটলারের গণহত্যার বিরুদ্ধে। অথচ, বাংলাদেশে পাকিস্তানীরা যখন গণহত্যা চালালো তখন এইসব সরকারের কয়েকটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে না গিয়ে বরং ইয়াহিয়াকে গণহত্যায় সহায়তা করলো। একটা কঠিন সত্য পৃথিবীর মানুষের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ক্রমান্বয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেকেরই নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। তাদের মুখে মানবতার বুলি আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বিজয়ের মধ্য দিয়ে নয় মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটলো। বাংলার মানুষ আবার তাঁর ভাগ্য নিয়ন্ত্রনের অধিকার অর্জন করলো। পথে-প্রান্তরে পর্বতাঞ্চলে নদনদী খালে বিলে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে বাঙ্গালী আবার নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। ছায়ার মতো অনুসারী মৃত্যুর ভয়ে আর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হবেনা আর। রাতের অন্ধকারে প্রতিটি অচেনা শব্দ মৃত্যুর অশুভ পদধ্বনি আসবে না। চারদিকে আনন্দ আর উল্লাসের ঢেউ। ২৫ মার্চের সে ভয়াবহ রাতের পর এই প্রথম মহিলারা নির্ভয়ে বেরুতে পারলো। ঘরের বাইরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে ছুটে চলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে।মার্চ করে চলেছে মুক্তিবাহিনী। পথের দুই পাশের উচ্ছ্বসিত জনতা তাদের জানাচ্ছে প্রাণঢালা অভিনন্দন।সুখী মানুষের আনন্দ কোলাহলের এক অভূতপূর্ব সমাবেশ।মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছে কেউ কেউ। অনেকে গাইছে গান।নির্মল হাসিতে যেন সমস্ত মানুষের রূপ উদ্ভাসিত। কারো চোখে ছিল সুখের অশ্রুজল। একজন আনন্দের আতিশয্যে বাঁধ ভাঙ্গা চোখের জল সামলাতে গিয়ে শাড়ীর আঁচল কামড়ে রেখেছেন দৃঢ়ভাবে। কাছে কোথাও মাইকে বাজছিল অতিপ্রিয় সেই গান ‘’ মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।‘’ এমনি অনেক ফুলের মতো জীবনকে হয়তো আমরা যুদ্ধ করে বাঁচাতে পেরেছি। আবার অনেককেই বাঁচাতে পারিনি। আমার মনে হলো সেইসব শহীদের কথা, যারা নিজদেশে বন্দীর মতো জীবনযাপন করছিলো। পাকিস্তানীরা এদেশকে পরিণত করেছিলো বন্দীশালায়। যেখানে তারা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষকে। সেই বন্দীশালায় পাকিস্তানীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত অসংখ্য মানুষের ত্যাগ আর গভীর জীবনবেদনা ছিল এত মহান যে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আমি অনুচ্চ স্বরে বললামঃ

‘’…… এবং শান্তি আর যুদ্ধ নয়-
তোমাদের বিদেহী আত্মার জন্য
চাই শুধু শান্তি যুদ্ধ নয়।
এই বন্দীশালা, এখানেই ছিল
তোমাদের তীর্থের জীবন।‘’

ইতিহাসে এই মর্মান্তিক নাটকের যবনিকাপাত সে কি বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত নাকি শোকের বেদনায় আপ্লুত? অথবা সেখানে ঘটেছে বিজয় আর বেদনার অপূর্ব সংমিশ্রণ? এই নির্মমও অচিন্তনীয় গণহত্যাকে কি পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীর ইতিহাস বদলের অমোঘ বিধান বলেই সমস্ত দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবে?

সার্কিট হাউসের সামনে সবুজলনে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম সেই বিষাদময় সমস্ত ঘটনার কথা। যুদ্ধের নয়মাসের শহীদের কথা আবার মনে পড়লো। পাকিস্তানীরা এদের হত্যা করলো গ্রামে গঞ্জে, নগরে-বন্দরে, শহরে- মসজিদ –মন্দিরে।অনেকেই ধরে নিয়েছিলো আরো নিষ্ঠুরভাবে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করার জন্য। বাংলার এই অসহায় মানুষগুলো আর কোনদিনই ফিরে আসবেনা। কিন্ত পাকিস্তানীরা যখনই এদেরকে বেঁধে নিয়ে যেতো হত্যা করার উদ্দেশ্যে সেই মুহূর্তে এইসব অসহায় মানুষ কি ভাবতো কে জানে? তাঁদের আপনজনই বা কি গভীর মর্মবেদনায় ভেঙ্গে পড়তো চিরবিদায়ের সেই মুহূর্তে? এইসব মানুষকে যখন পাকিস্তানীরা লাইনে দাঁড়িয়ে হত্যা করতো, রাস্তায় টেনে নিয়ে যেতো জীপের নিচে বেঁধে বেয়োনেট আর রাইফেলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতো তখন মৃত্যুপথ যাত্রী সেই সব মানুষ কি ভাবতো আমরা কোনদিন তা জানবো না। নিষ্পাপ শিশু, অবলা নারী অসহায় বৃদ্ধ কেউই সেদিন রক্ষা পায়নি পাকিস্তানীদের হাত থেকে।

সেই সব প্রাণের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। আমার চিন্তায় বাধা পড়লো। একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন আমার দিকে। যুদ্ধে তাঁর ছেলে হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। মুখে তার হাসি নেই, নেই অশ্রুজল। তিনি শান্ত, অতিশান্ত। আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি গভীর প্রশান্তিতে চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ।
মানব হৃদয়ের সেই অব্যক্ত বেদনা কেউ কোন দিন বুঝতে পারবে না।

*একাত্তরের মার্চে রফিক-উল-ইসলাম সাবেক ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন পদে সেক্টর এডজুট্যেন্টের দায়িত্বপালন করছিলেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!