রণাঙ্গণ
মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে দখলদার সেনা পিছু হটছে।
(রণাঙ্গন প্রতিনিধি) দেশের সর্বত্র আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক তৎপরতায় ব্যপক সাফল্যের খবর মুক্তিবাহিনী সূত্রে পাওয়া গেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের অভিযানে ব্যতিব্যস্ত হানাদার পাক সেনারা সামগ্রিক যুদ্ধ পরিস্থিতির মােড় ঘুরিয়ে দেবার জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তে গিয়ে উস্কানীমূলক সামরিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তি যােদ্ধাদের ব্যপক অভিযানের ফলে ময়মনসিংহ জেলার সাথে ঢাকার রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঢাকা এবং ময়মনসিংহের মধ্যবর্ত্তী বেগুনবাড়ী এবং মাসাখালীর দুটি রেলসেতু মুক্তিযােদ্ধারা উড়িয়ে দিয়েছেন। পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের এই খণ্ডে প্রায় এক মাইল রেললাইন মুক্তি যােদ্ধারা তুলে ফেলেছেন। ময়মনসিংহ জেলার টেলিফোন যােগাযােগ ব্যবস্থা আমাদের গেরিলারা অকেজো করে দিয়েছেন এবং এখানকার বিভিন্ন খণ্ডযুদ্ধে কম করেও পনেরজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। পাক সেনাদের একটি জীপে রাখা টাইম বােম বিস্ফোরিত হলে কয়েকজন পাক সেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের বােমার আঘাতে অন্ততঃ দশজন মুসলিম লীগকর্মী নিহত এবং তিরিশ জনের বেশী আহত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জু নদী বন্দরের কালিয়াবাজারে গত সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধাদের বােমার আঘাতে কমপক্ষে আটজন নিহত এবং কুড়িজনেরও বেশী আহত হয়েছে।
ফরিদপুরে শ্রীপুরা এলাকায় পাক সৈন্যদের ঘাটির উপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা কয়েকজন পাকসেনাকে নিহত করেছেন। বরিশাল জেলায় মুক্তিবাহিনীকে মুক্তাঞ্চল থেকে হটিয়ে দেবার পাক সামরিক অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। নােয়াখালী জেলার নতুন বাজারে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে সাতজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। চট্টগ্রামেও মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে এবং এখানে কয়েকটি সংঘর্ষে রাজাকারসহ পনেরজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। কুমিল্লা জেলার মালদানদী এবং কসবার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন মুক্ত। এইসব এলাকায় শত্রুবাহিনী বিমান আক্রমণ চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম রণাঙ্গনেও মুক্তিযােদ্ধারা ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছেন। গতমাসের শেষার্ধে মুক্তি যােদ্ধারা ন্যাশন্যাল শিপিং কর্পোরেশনের লালশীরা জাহাজটি ডুবিয়ে দিয়েছেন। সুন্দরবন এলাকায় দুটি বার্জ ডুবিয়ে দিয়েছেন। কুষ্টিয়া জেলার আমবাড়িয়াতে শত্রুবাহিনীর একটি গানবােটের ওপর আক্রমণ চালালে চল্লিশজন পাকসেনা নিহত হয়। এর আগে শত্রুসেনাবহী একটি লঞ্চ মুক্তি যােদ্ধাদের আক্রমণে ডুবে যায়। ফলে দশজন পাকসেনা নিহত হয়েছে। বরিশাল এবং খুলনার মধ্যে মালবাহী জাহাজ ‘সপ্তডিঙ্গা’ও মুক্তিযােদ্ধারা ডুবিয়ে দিয়েছেন। উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন ঈশ্বরদী এবং রাজশাহী মধ্যবর্তী অংশে মুক্তিযােদ্ধারা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইনের সাহায্যে একখানি শত্রুসেনাবাহী বিশেষ ট্রেন উড়িয়ে দিয়েছেন। গত ২২ তারিখে ডাের রাত্রে এই ঘটনা ঘটে।
মাইনের বিস্ফোরণের ফলে ইঞ্জিন এবং তৎসংলগ্ন বগিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের এই সাফল্যে পনেরজন পাক সেনা নিহত এবং আহত হয়েছে। রাজশাহী কুষ্টিয়ার বিভিন্ন অংশে মুক্তিযােদ্ধাদের অনুরূপ তৎপরতায় গতমাসের শেষার্ধে চারখানা শত্রু সেনাবাহী বিশেষ ট্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেড় শতাধিক শত্রুসেনা নিহত এবং বহু আহত হয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর জেলার জাবির দুয়ার, জলপাইতলা, অম্বরখালী এলাকায় শত্রু ঘাটিগুলাের ওপর আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী কুড়িজনেরও বেশী পাকসেনাকে নিহত এবং আহত করেছেন। মুক্তিযােদ্ধারা রংপুর জেলার লালমনিরহাট রেলওয়ে জংশনের সাথে মােগলহাট ষ্টেশনের যােগাযােগকারী রেললাইনের অধিকাংশই তুলে ফেলেছেন এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু ধ্বংস করে দিয়েছেন। অরনীর সাথে সারদহের টেলিফোন যােগযােগ ব্যবস্থাও মুক্তিযােদ্ধারা অকেজো করে দিয়েছেন। মুক্তিযােদ্ধাদের একটি গেরিলাদল দিনাজপুরের চিন্তামনে পাকসেনাদের ওপর মর্টারের আক্রমণ চালায় এবং এখানে তিনজন পাকসেনাকে নিহত এবং তিনজনকে আহত করেন। গত ২১ তারিখে এই জেলারই অমরখানা এবং জগদ্বল হাটের মধ্যবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কসেতুও মাইনের সাহায্যে উড়িয়ে দিয়েছেন। পাক সামরিক চক্রের অন্যতম শক্তি রাজাকার বাহিনীর অধিকাংশই এখন মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে মৃত্যুর আশংকায় আতংকিত হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করছে। কুষ্টিয়া এবং রাজশাহী থেকে অনুরূপ আত্মসমর্পনের খবর পাওয়া গেছে। নিজেদের অস্ত্রসহ রাজাকাররা আত্মসমর্পন করছে।
দেশ বাংলা ১:
২৪ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯