সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন মাহবুবর রহমান
তারিখঃ ৫-৯-১৯৭৩
জুনের চতুর্থ সপ্তাহে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ওসমানী মেজর জলিল কে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে সরিয়ে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কামান্ডিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান আমদের নতুন কমান্ডারকে সাথে নিয়ে বিমান থেকে নামলেন। আমরা তাকে দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম কিন্তু তিনি আমাদের এখানে নয় অন্যত্র বলদি হয়েছিলেন ।তার সাথে আমাদের জন্য একটি সারপ্রাইজও এসেছিলো। জুলাই এর প্রথম সপ্তাহে একটি গোপন সূত্রে জানা গিয়েছিলো যে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হতে পারে অপারেশন পরিচালনা করার জন্য। হঠাত করেই সংক্ষিপ্ত আদেশে ব্যাটেলিয়নটি তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ৫/৬ দিন এর যাত্রা শেষে ব্যাটেলিয়নটি মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালা নামক স্থানে এসে উপস্থিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ আর্মির প্রথম ব্রিগেড গঠিত হয়। ব্রিগেডটি মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনস্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে তার নামের অদ্যাক্ষর ‘জেড’অনুসারে এই ব্রিগেডের নামকরন করা হয় জেড ফোরস।
তেলঢালাতে ব্যাটেলিয়নটির শক্তির উৎস ছিলো ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে আসে ছাত্রদের নিয়ে।
উপযুক্ত প্রশিক্ষন গ্রহনের পর মেজর জিয়াউর রহমান ব্যাটেলিয়নসমুহ কে তাদের অপারেশনাল এরিয়া ভাগ করে দেন। ব্যাটেলিয়নগুলি তাদের অধিনস্ত এলাকাসমুহে ট্রেনিং চলাকালেই কিছু অপারেশন পরিচালনা করেছিলো। কিন্তু এরপর তারা ভিন্ন ধরনের অপারেশন করে বাহদুরাবাদ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ ও জামালপুরে এবং ভালো সুনাম অর্জন করে। রংপুরে এই ব্যাটেলিয়ন কিছু এলাকা দখল করে যেমন রৌমারি, উলিপুর ও চিলমারি যেগুলো পাক বাহিনী পরবর্তীতে আক্রমন করেও আর পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
কোদালকাঠি, হাজির চর ও রৌমারিতে পাক বাহিনী অসংখ্য লঞ্চ, স্পিডবোট এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ হারায়। ব্যাটেলিয়নের কাছে তাদের অনেক সৈন্যও নিহত হয়। এটি উল্ল্যেখ্য যে উপরোক্ত সময়ে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাতিত বাংলাদের আর্মির অন্য কোন ইউনিট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন এলাকা দখলে রাখতে পারেনি। অনেক সুপরিচিত ব্যাক্তি যেমন এজনা ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক যারে এডওয়ার্ড কেনিডি পাঠিয়েছিলেন তারা মুক্তি বাহিনীর তৈরি মুক্তাঞ্চল রৌমারি পরিদর্শন করতে আসেন যা ৩য় ইস্ট বেঙ্গল দ্বারা দখল করা হয়েছিলো এবংযা তখন পর্যন্ত মুক্ত ছিলো।তাদের দেখানো হয়েছিলো কিভাবে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয় তাদের অসীম সাহসী মুক্তি বাহিনীকে সাথে নিয়ে। তাদের আরো দেখানো হয়েছিলো কিভাবে এই ব্যাটেলিয়ন শত্রুদের কাছ থেকে এলাকা দখল করে, কিভাবে অস্ত্র সংগ্রহ ও মোটরচালিত লঞ্চ শত্রুদের কাছ থেকে দখল করে। ১ম ইস্ট বেঙ্গল এর মেজর জিয়াউদ্দিন এর সাক্ষাতকারও দেখানো হয় যেখানে মেজর জিয়াউদ্দিন রাওয়ালপিন্ডি থেকে তার পালিয়ে আসার কাহিনী বর্ণনা করেন।
সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের অপারেশনাল এরিয়া মিত্র বাহিনীর পরামর্শে জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে পরিবর্তন করা হয়। আবার ৩য় ইস্ট বেঙ্গল অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিছুদিন যাত্রার পর বাহিনীটি শিলং এসে পৌঁছে। এখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ব্যাটেলিয়নটি ছাতক এবং সুনামগঞ্জ আক্রমন করে দখল করবে। এরপর ব্যাটেলিয়ন শিলং ত্যাগ করে এবং পাথরঘাটা নামক স্থানে অবস্থা নেয়। পাথরঘাটায় কিছু আলোচনা ও পরিকল্পনার পর ব্যাটেলিয়ন কামান্ডার তার অধীনস্ত কোম্পানি কামান্ডারদের কিছু আদেশ প্রদান করেন। ‘এ ‘কোম্পানির কামান্ডার ক্যাপ্টেন মোঃ আতাহার হোসেন এবং ‘বি ‘কোম্পানির কামান্ডার মেজর আখতার হোসেনকে ছাতক আক্রমান করার নির্দেশ দেয়া হয়। ‘ডি ‘কোম্পানির কামান্ডার লেঃ নুরন্নবি খানকে তেলেব হয়ে ছাতকের দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়। ‘সি ‘কোম্পানির কামান্ডার মেজর মহসীন উদ্দিন আহমেদ কে বাংলাবাজার আক্রমন করে টেংরাটিলার দিকে অগ্রসর হতে বলা হয়।
সিলেটঃ
পরিকল্পনা অনুসারে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ ও বি কোম্পানিসহ ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার ছাতকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার পেছনে বিজয়নগর নামক এক স্থানে অবস্থান নেয় এবং এ ও বি কোম্পানি ছাতক অভিমুখে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে যতক্ষন না তারা ছাতক সিমেন্ট কারখানার সীমানা প্রাচীরের অতি সন্নিকটে পৌঁছে। কারখানার পূর্ব পাশের একটি টিলার ঢালে’বি ‘কোম্পানি তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করে।
১০৬ ও ৭৫ মিঃমিঃ রিকোয়েললেস রাইফেলের সাহায্যে তারা পাক বাহিনীর ৫ থেকে ৬ টি বাঙ্কার ধ্বংস করে। বাঙ্কার এর ভেতরে অবস্থান রত সৈন্যরা তখন বাইরে বেরিয়ে এসে ছোটাছুটি করতে শুরু করলে এলএমজি দিয়ে তাদের উপর গুলি করা হয় এবং এর ফলে বহু পাক সৈন্য নিহত হয়। আক্রমনে ফলে অস্ত্র ভর্তি পাক বাহিনীর একটি জলযান নদীতে ডুবে যায়। নদীর অপর পাশে পাক বাহিনীর অবস্থান ছিলো সু-সংহত। তারা সিলেট থেকে অতিরিক্ত সৈন্য ও কামান নিয়ে আসে। কামানের সাহায্যে তারা আমাদের দিকে চতুর্দিক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। টানা ছয়দিনের তীব্র যুদ্ধের পরে দুটি কোম্পানিকে বালিউড়া তে ফিরিয়ে নেয়া হয়।
টেংরাটিলাঃ
সি কোম্পানির কমান্ডার মেজর মহসিন উদ্দিন আহমেদ টেংরাটিলা আক্রমন করে দখল করেন। এরপর কোম্পানি কামান্ডার দোয়ারা বাজার আক্রমন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। আক্রমন করতে যাবার পথে তিনি তার কোম্পানিকে একটি নদী পার হতে আদেশ দেন। নদীর অপর পারে থাকা দালালেরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে পাক বাহিনীকে অবহিত করে। এর ফলে যখন আমাদের কোম্পানি নদী পার হচ্ছিলো পাক বাহিনী অতর্কিত চারদিক থেকে আমাদের আক্রমন করে। সৈন্যরা যখন নদীর মাঝামাঝি তখন পাক বাহিনীর এই আচমকা আক্রমনে তারা দিশে হারিয়ে ফেলে এবং আমরা সবাই আবার বাংলাবাজারে ফেরত যাই।
বাংলাদেশ আর্মির কমান্ডার নিন চিফ জেনারেল ওসমানির নির্দেশে এ ও সি কোম্পানিকে কালা বাজার ও টেংরাটিলা আক্রমন এবং দোয়ারা বাজারের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেয়া হয়। ‘এ’কোম্পানি কামান্ডার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড লেঃ মানজুর আহমেদ ও ‘ডি ‘কোম্পানি কামান্ডার লেঃ নুরন্নবি ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী নেওয়াজকে গোয়াইনঘাট হয়ে সিলেট অফিমুখে যাত্রা করতে বলা হয়। এই দুটি কোম্পানি মেজর শাফায়াত জামিলের অধীনে ছিলো। অবশেষে অক্টোবরের ৩য় সপ্তাহে এক গভীর রাতে পায়ে হেটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মেজর শাফায়ার জামিল তার দুটি কোম্পানি নিয়ে গোয়াইনঘাটে এসে উপসস্থিত হন। তিনি তার দলকে বিভিন্ন অবস্থান যেমন পুলিশ স্টেশন,সার্কেল অফিস, কৃষি অফিস সহ আরো স্থাপনা আক্রমনের দায়িত্ব ভাগ করে দেন। গোয়াইন ঘটের পাশে একটি নদী থাকায় এটি পার হতে আমাদের কিছু সময় লেগে যায়। স্থানীয় দালালেরা তখন আমাদের অবস্থান সম্পর্কে পাক বাহিনীকে অবহিত করে এর ফলে পাক বাহিনী আমাদের আক্রমন করে এবং এখানে পাক বাহিনীর সাথে আমাদের তিন দিন টানা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাক বাহিনীর অনেক সৈন্য মারা যায় এবং আমাদের পক্ষে ৪/৫ জন নিহত ও ৭/৮ জন আহত হয়।
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার রাধানগর টি এটেস্ট ও এরপর গোয়াইনঘাট দখল করার আদেশ আসে । মেজর শাফায়াত জামিল ‘এ ‘কোম্পানি কামান্ডার ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেনকে নয়ানগর প্রেরন করেন। ‘ডি ‘কোম্পানি ও ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টার লুনি ও প্রতাপপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করে। ৭ই ডিসেমম্বর মেজর শাফায়াত জামিল ছোট খেল ও দোয়ারি খেলে আক্রমন করেন এবং আক্রমনের ফলে ছোট খেল আমাদের নিয়ন্ত্রনে আসে এবং এই যুদ্ধে পাক বাহীনির অনেক সৈন্য নিহত হয় । আমরা প্রচুর পরিমানে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রেশন, ম্যাপ ইত্যাদি দখল করি। আমদের পক্ষে নায়েক মোশারফ হোসেন শহীদ হন এবং কামান্ডার মেজর শাফায়াত জামিল আহত হন। তাকে পরবর্তীতে শিলং এ চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। মেজর শাফায়াত জামিলের অনুপস্থিতিতে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন তার দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং ছোট খেল, দোয়ারি খেল ও রাধা নগর দখল করেন।
৮ই ডিসেম্বর গোয়াইন ঘাটও আমাদের আধীনে আসে এবং পাক বাহীনির ফেলে যাওয়া অনেক জিনিস আমরা দখল করি। ভারত সরকারের নির্দেশে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন গোয়াইন ঘাটের দখল বিএসএফ এর কাছে বুঝিয়ে দেন ও তার দুই কোম্পানি নিয়ে শালুটিকায় সিলেটের বিমানবন্দর দখল করার জন্য শালিতা বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। শালিতা বাড়িতে আগে থেকেই একজন কর্নেলের অধীনে দুই কোম্পানি মুক্তি বাহীনি ও এক কোম্পানি ভারতীয় পদাতিক সৈন্য অবস্থান করছিলো। ভারতীয় কর্নেলের নির্দেশে দুটি কোম্পানি ১০ ডিসেম্বর বিমানবন্দর আক্রমন করে। আক্রমনে ১৫ থেকে ২০ জন পাকসেনা খতম হয় এবং দুজন ধরা পরে। দুটি এল এম জি ও কয়েকটি রাইফেলও আমাদের হস্তগত হয়। এদিকে আমাদের পক্ষে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
১২ই ডিসেম্বর ‘এ ‘কোম্পানি ,’ডি ‘কোম্পানি ও এক কোম্পানি বিএসএফ কোম্পানীগঞ্জ আক্রমন করে ও এটি দখল করে। ‘বি’ ও ‘সি’ ‘কোম্পানি টেংরাটিলা দখল করার পর ছাতক দখল করে। ১৩ই ডিসেম্বর ‘এ’ ও ‘বি’ কোম্পানি তাদের অবশিষ্ট দুটি কোম্পানি ‘বি’ও ‘সি ’এর সাথে ছাতকে মিলিত হয় ।
১৫ই ডিসেম্বর মেজর শাফায়াত জামিল তার অধীনস্ত ৪টি কোম্পানি নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ আক্রমন করেন। বহু পাকসেনা এখানে নিহত হয় এবং অবশিষ্ট রা সিলেট পালিয়ে যায়।
১৬ ডিসেম্বরে এই ব্যাটেলিয়নের সাথে লামাগাজিতে পাক বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে আমরা ৬টি মর্টার ২ টি মেশিনগান ও বিপুল পরিমান গোলাবারুদ দখল করি।
১৭ই ডিসেম্বর আমরা পাক বাহিনীকে শালুটিকা অভিমুখে চালনা করি সেখানে বিমানবন্দরে তারা মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
মাহবুবুর রহমান
ক্যাপ্টেন
৩য় ইস্ট বেঙ্গল