You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদ
২৮-৯-১৯৭৩

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কর্নেল (বর্ত্মানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, জাতীয় সংসদ সদস্য, বিমান ও নৌবাহিনীর মন্ত্রী) এম এ জি ওসমানী বেনাপোল পরিদর্শন করতে আসেন। তিনি বেনাপোল পৌঁছে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন এবং আমার ব্যাটালিয়ন পুনর্গঠিত করার কথা বলেন এবং ৬০০ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করে নিতে বলেন। তাঁর নির্দেশমত আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন যুব শিবির থেকে প্রায় ৬০০ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ও ই-পি-আর বাছাই করে আমার ব্যাটালিয়নে নিয়ে নিই। উক্ত ই-পি-আর এবং তরুণদের বাছাই করার পর কর্নেল ওসমানী আমাকে মেঘালয় প্রদেশের তেলঢালা নামক জায়গায় যেতে বলেন। আমি পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে তেলঢালা চলে যাই। তেলঢালায় ১ম, ৩য় এবং ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের একত্রিত করা হয় এবং একটা ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডের নাম ছিল ‘জেড ফোর্স’। উক্ত ব্রিগেড ফোর্সের কমান্ডার হন মেজর জিয়াউর রহমান। এখানে ব্যাটালিয়নের নতুন রিক্রুট করা সৈন্যদেরও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়।

১৩ই জুলাই মেজর (বর্তমানে লেঃ কঃ) মঈনুল হোসেন চৌধুরী আমার ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত হন এবং আমার নিকট থেকে ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তাছাড়া আরো কয়েকজন অফিসারকে ব্যাটালিয়ন অফিসার নিযুক্ত করেন- তারা হলেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আব্দুল মান্নান, লেফটেন্যান্ট (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন আমাদের ব্যাটালিয়ন এ যোগদান করেন।

কামালপুর যুদ্ধঃ মোটামুটি ট্রেনিং এর পর প্রথম অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। ময়মনসিংহ জেলার কামালপুরে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিকে আঘাত করার পরিকল্পনা আমরা প্রথম নিই। কামালপুর এলাকার চতুর্দিক দিয়ে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে আমরা প্রথম ‘রেকি’করি।

২৮ জুলাই গভীর রাতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মোমতাজ, লেফটেন্যান্ট মান্নান, নায়েক সুবেদার আব্দুলহাইসহ আরও দু’জন সৈন্য ‘রেকি’করতে করতে কামালপুর শত্রুঘাঁটির ভিতর ঢুকে একটা বাঙ্কার এর মধ্যে উঁকি মারে। এমন সময় পাকিস্তানী দুজন সৈন্য অন্যদিক থেকে বাঙ্কারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন তাদের দেখে ফেলেন এবং তৎক্ষনাৎ তাদেরকে “হ্যান্ডস আপ” করতে বলেন। দু’জনের একজন “হ্যান্ডস আপ” করে। অপরজন না করাতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন লাফ দিয়ে উক্ত পাকিস্তানী সৈন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর যখন তারা বুঝতে পারে যে, তারা মুক্তিযোদ্ধার দ্বারা ঘেরাও তখন তারা পালানোর চেষ্টা করলে সুবেদার হাই তাদের উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন এবং হত্যা করে রাইফেল দুটি নিয়ে নিয়ে নেন। পরে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন সহ সবাই ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। এ ঘটনায় আমাদের সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত বেড়ে যায়। নায়েক সুবেদার আব্দুল হাইকে এজন্য বাংলাদেশ সরকার “বীর প্রতীক” উপাধীতে ভূষিত করেন।

৩১শে জুলাই ভোর সাড়ে তিনটার সময় দুই কোম্পানী সৈন্য (‘বি’কোম্পানী, যার কমান্ডার ছিলাম আমি নিজে এবং ‘ডি’কোম্পানী যার কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মোমতাজ ) নিয়ে কামালপুর বর্ডার আউট পোস্ট আক্রমণ করি। আমরা একটা ফিল্ড ব্যাটারির সাহায্য নিই। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ‘এ’কোম্পানীকে পাঠানো হয় উঠানীপাড়াতে (কামালপুর হতে ২ মাইল দক্ষিণে)। ‘এ’কোম্পানীকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল তারা ‘কাট অফ’পার্টিতে যেন যোগ দিতে পারে। এফ-ইউ-পি’তে যোগ দিতে পারে এফ-ইউ-পি’তে পৌঁছার পরই আর্টিলারী ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু এফ-ইউ-পি তে পৌঁছার পুর্বেই আমাদের পক্ষ থেকে আর্টিলারী গোলাগুলি শুরু হওয়ায় আমাদের সৈন্যরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এ সময় শত্রু পক্ষও আর্টিলারী ও ভারী মর্টারের সাহায্যে গোলাগুলি শুরু করে। তা সত্ত্বেও আমি এবং সালাহউদ্দিন আমাদের কোম্পানীদ্বয়কে একত্রীত করে শত্রুদের আক্রমণ করি এবং সম্মুখ দিকে অগ্রসর হই। দু’দিকেই আর্টিলারী ব্যবহার হওয়া স্তত্বেও আমরা ‘জয় বাংলা’ধ্বনি দিতে দিতে শত্রুর দিকে অগ্রসর হই। আমরা কাঁটাতার এবং মাইনফিল্ড অতিক্রম করে অগ্রসর হই এবং গোলাগুলি চলাকালীন সময়ের মধ্যেই শত্রুপক্ষের অর্ধেক জায়গা দখল করে নেই। ফলে শত্রুরা পিছনের দিকে হটে যায় এবং তাদের পূর্বস্থানে আর্টিলারী ও মর্টারের গোলাবর্ষন করতে থাকে। এ সময় ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন যিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে ‘ডি’কোম্পানীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, শত্রুর গুলিতে শহীদ হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর সৈনিকদের উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকেন এবং বার বার শত্রুপক্ষকে নির্মূল করার আকুল আহ্বান জানান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর মত দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন সৎসাহসী বীর ও আত্মত্যাগী যোদ্ধার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। যে কোন দেশের যে কোন জাতি গর্ববোধ করতে পারে তাঁর মত বীর যোদ্ধার বীরত্বের জন্য। একটু পরে আমি নিজেও শত্রুর মর্টারের গুলির আঘাতে আহত হই এবং আমাকে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার শরীরের পাঁচ জায়গায় মর্টারের গুলির টুকরো বিদ্ধ হয়। উভয় কোম্পানীতে কোন অফিসার ও অফিসার কমান্ডিং না থাকায় এবং ইতিমধ্যে যথেষ্ট সৈন্য হতাহত হওয়ায় আমাদের সৈন্যদের মনোবল সাময়িকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। ফলে তারা পিছিয়ে আসে। এই আক্রমণ এবং যুদ্ধে আমাদের পক্ষে একজন অফিসারসহ ৩১ জন যোদ্ধা শহীদ হন এবং দুইজন জুনিয়র কমিশন অফিসারসহ ৬৫ জন আহত হন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, শত্রুপক্ষের প্রায় ৫০ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয়। এই আক্রমণ যদিও পুরোপুরি সফলকাম হয়নি তবুও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা একটা স্মরনীয় আক্রমণ ছিল। এই যুদ্ধে এটা প্রমাণ হয় যে, বাঙ্গালী সৈন্যরা সম্মুখসমরে যথেষ্ট দক্ষতার অধিকারী এবং সাহসী। এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যদের দ্বারা কাঁটাতারের ঘেরা এবং মাইন বসানোকে উপেক্ষা করে আমাদের যোদ্ধারা যেভাবে অসীম সাহসিকতার সাথে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হন তা থেকেই প্রমানীত হয় যে, স্বল্পকালীন সাময়িক ট্রেনিং নেওয়া যুবকরাও অসীম বীরত্বের অধিকারী। এ যুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করায় নিম্নলিখিত কয়েকজনকে বাংলাদেশ সরকার বীরত্বের পুরস্কার দেনঃ (১) শহীদ ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম), (২) ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম) (৩) লেফটেন্যান্ট আব্দুল মান্নান (বীর বিক্রম), (৪) সিপাই আবদুল আজিজ (বীর বিক্রম) (৫) সিপাই গোলাম মোস্তফা কামাল (বীর বিক্রম) (৬) নায়েক সুবেদার আঃ হাই (বীর প্রতিক) (৭) নায়েক শফিকুর রহমান (বীর প্রতিক) (৮) শহীদ ল্যান্সনায়েক সিরাজুল ইসলাম (বীর প্রতিক), (৯) ল্যান্সনায়েক রবিউল্লাহ (বীর প্রতিক) (১০) ল্যান্সনায়েক তাজুল ইসলাম (বীর প্রতিক) (১১) সিপাই তারিকুল ইসলাম (বীর প্রতিক) (১২) সিপাই শফিউদ্দিন (বীর প্রতিক) (১৩) সিপাই সাইদুর রহমান (বীর প্রতিক)।

কিছুদিন পরই মেজর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কঃ) মোঃ জিয়াউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) বজলুল গনি পাটওয়ারী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন। মেজর জিয়াউদ্দিনকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত করা হয়। ৮ই সেপ্টেম্বর ‘ডি’কোম্পানী ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে কামালপুরের ১ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ঘাসিপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

১০ই সেপ্টেম্বর শত্রুপক্ষকে দুই কোম্পানী সৈন্য মর্টার নিয়ে ঘাষিপুর আক্রমণ করে। ‘ডি’কোম্পানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এ আক্রমণ প্রতিরোধ করে ও তাদের আক্রমণকে ব্যররথ করে দেয়। শত্রুপক্ষের প্রায় ৪০ জন সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষে তিনজন শহীদ এবং ৮ জন আহত হন। নায়েক সুবেদার মোজাম্মেল হক এবং ল্যান্স নায়েক ইউসুফ আলী পূর্বেও কয়েকটি যুদ্ধে বিরত্বের পরিচয় দেন। বাংলাদেশ সরকার তার বীরত্বের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধি প্রদান করেন। এর দুইদিন পর আরো দুইজন অফিসার আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন, তারা হলেন ফ্লাইং অফিসার আলী খান এবং ডাঃ (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট) মজিবর রহমান ফকির। লিয়াকত আলী খানকে ব্যাটালিয়নের এ্যাডজুটেন্ট নিযুক্ত করা হয়।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!