You dont have javascript enabled! Please enable it! জেড ফোর্সের অপারেশনসমূহঃ ১ম ইষ্ট বেঙ্গলের কামালপুর যুদ্ধ | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

সাক্ষাৎকারঃ মেজর আমিন আহমদ চৌধুরী
‘জেড’ ফোর্সের অপারেশনসমূহঃ ১ম ইষ্ট বেঙ্গলের কামালপুর যুদ্ধ

মুক্তি সংগ্রামে শত্রুর সাথে মুখোমুখি লড়াই শুরু করি আগষ্ট’৭১-এর পর থেকে। এর আগে আমরা ছিলাম ডিফেন্সে, আর শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমন করতো। বিলোনিয়া যুদ্ধের পর থেকে শত্রুরা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের ভূমিকা গ্রহন করে, আর আমরা আক্রমণকারীর। আমাদের ব্রিগেডের (‘জেড’ফোর্স) প্রথম আক্রমন পরিচালনা করেন মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মইনুল ইসলাম চৌধুরী। (১ম ইষ্ট বেঙ্গল) ডেলটা কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মমতাজ ও ব্রেভো কোম্পানী নিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজ এ আক্রমণের ব্যুহ রচনা করেন। আর ক্যাপ্টেন মাহবুব (পরে সিলেট রণাঙ্গনে শহীদ হন) কাট-অফ পার্টি নিয়ে ওঁৎ পেতে বসেন শত্রুর ডিফেন্সের পেছনে। আক্রমণ করাকালীন একটি বস্তুর প্রয়োজন হয় বেশী, তা হলো সিংহহৃদয়। ইংরেজীতে যাকে বলে লায়নহার্ট। ডিফেন্সে যারা থাকে, তারা বাংকারে থাকে, ফলে স্বভাবতই ছোট ছোত হাতিয়ার এমনকি ডাইরেক্ট আর্টিলারী শেল থেকে রক্ষা পায়। সে জন্যই সাধারনতঃ দেখা যায় যে, একটি ডিফেন্সকে আর্টিলারী থেকে শুরু করে ট্যাংক ও বিমান হামলা করে সেই ডিফেন্সকে তছনছ করে ফেলার পরেও মাত্র দুই-একজন সাহসী যোদ্ধা অকুতভয় মনবলে বলীয়ান হয়ে বাংকার থেকে সেই প্রচন্ড গোলাগুলির মাঝে মাথা নিচু করে মুখ থুবরে পড়ে না থেকে আক্রমণকারীর আক্রমণ সম্পুর্নরুপে ব্যার্থ করে দেয়। সকল প্রকার সুষ্ঠ আক্রমণই ব্যর্থ হয়ে যায় যদি পূর্বাহ্নে পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হয়। আর সুষ্ঠ পরিকল্পনা নেওা তখনি নেওা সম্ভব হয় যখন কমান্ডার নিজে চুপি চুপি শত্রুশিবির দেখে আসে। মিলিটারী ভাষায় এই চুপি চুপি দেখে আসার নাম হচ্ছে রেকি পেট্রোলিং।বাংলা মায়ের দামাল ছেলে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মমতাজ ছিলেন এক অভূতপূর্ব ব্যতিক্রম, অনন্যসাধারণ সৈনিক- পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন- যোগ দেওয়ার পর থেকে শত্রুর উপর প্রচন্ড আঘাত হানার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন।

ময়মনসিংহের কামালউর বি-ও-পি ছিল শত্রুদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি, কারন জল ও স্তল উভয় পথেই কামালপুর – ময়মংসিংহ-ঢাকা সড়কের প্রবেশদ্বার ছিল এ কালামপুর। তাই শত্রুরা এখানে বাংকারগূলো অত্যন্ত মজবুত করে তৈরী করে। বাংলারের প্রথম আস্তরে মাতি ও তিনের দেয়াল, তারপর ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট ব্যবধানে রেলের লোহার বীম। এই একই প্রকার ব্যাবধানে পাকা সিমেন্টের আস্তর। বাংলারের ওভারহেড কাভারের বেলায়ও একই প্রকার প্রস্তুতি নেয়া হতো- প্রত্যেকতি বাংকারই প্রায় ঘরের মত উঁচু, অন্যদিকে সমস্ত ডিফেন্স টানেলের মারফত যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। এদিকে মাইন, বিবিট্রাপ ও বাঁশের কঞ্চি সমস্ত ডিফেন্সটিকে দুর্ভেদ্য দুর্গের মত করে রেখেছিল। পরপর দুদিন রেকি করার পরেও সালাউদ্দীন স্বচক্ষে শত্রুশিবির দেখার জন্য লেঃ মান্নানকে সাথে করে তৃতীয়বারের মত রেকি পেট্রোলিং নিয়ে নিজে নিজে শতুশিবিরের দিকে গেলেন। বি-ও-পি’র কাছে পৌছে জমির আলীর উপর লেঃ মান্নান, সুবেদাও হাসিম, নায়েক শফি, ও দলের অন্যান্য সবাইকে রেখে শুধু সুবেদার হাইকে সঙ্গে নিয়ে শত্রুর বাংকারগুলো রেকি করতে গেলেন। বলাবাহুল্য, পাকিস্তানীরা রাত্রিতে সব সময় সেকেন্ড দিফেন্সে চলে যেত। কামালপুর রণাঙ্গনে শত্রুরা সাধারনতঃ দিনের বেলায় অনেক এলাকা জুড়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকত, কিন্তু রাত্রিবেলায় দূরের বাংকারগুলো ছেড়ে দিয়ে ছোট অথচ ঘন ডিফেন্সে চলে যেত। খালি বাংকারগুলি দেখে সালাউদ্দীন ও হাই আরো ভিতরে চলে গেলেন। এমতাবস্থায় দুজন শত্রুসেনা সম্ভবতঃ পেট্রোলিং করে ফিরে আসার সময় এদের দুজনের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। একশত পাঁচ পাউন্ড ওজন আর ৫’-৫” উচ্চতা বিশিষ্ট ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মুহুর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল লম্বা খানসেনাদের উপর, যার হাতে ৩০৩ রাইফেল। অন্ধকারে খানসেনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে “আমি খালেদ” বলে নিজেকে সঙ্গীর কবল থেকে ছারাতে গিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারল সে। আসলে তারা মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। মুহুর্তের মধ্যে খানসেনা সালাউদ্দীনের হালকা দেহ মাটিতে ফেলে দিয়ে গলা টিপতে শুরু করল। সালাউদ্দীন ‘মান্নান’বলে চিৎকার করে উঠলেন। মান্নান ছুটে এসে ষ্টেন ধরে জিজ্ঞেস করলো “উপরে কে?” সালাউদ্দীন গোংড়ানীর স্বরে বললো “উপরে তো ঐ শালা”। লেঃ মান্নান গাব গাছের নিচে তারাতারি পজিশন নিলেন। এদিকে সুবেদার হাইকে ‘হ্যান্ডস আপ’বলার সাথে সাথে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আগাহত করে খানসেনার জি-থ্রি রাইফেল কেড়ে নিলেন। কিন্তু খানসেনা মুহুর্তের মধ্যে পেছনের বাংকারে ঢুকে পড়লো। আর নায়েক শফি, যে এতক্ষন ইতস্ততঃ করছিল গুলি করবে কি করবে না (কেননা ঘুটঘুটে অন্ধকারে কার গায়ে গুলি লাগে বলা মুশকিল), মুহুর্তের মধ্যে ধাবমান শত্রুর দিকে গুলি ছুড়ল। সম্ভবতঃ অন্ধকারে ঠাহর করতে পারেনি বলে বাঁ পাশের দালানে গিয়ে লাগে। সংগে সংগে হাই বাংকার লক্ষ্য করে ষ্টেনের এক ম্যাগাজিন গুলি ছুড়ল। গুলি ছুড়ে জি-থ্রি রাইফেলসহ সালাউদ্দীনের দিকে এগিয়ে এলো। গাবগাছের পাশ দিয়ে যাবার সময় মান্নান আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো – কে? ত্বতিত বেগে ‘আমি হাই’বলে সালাউদ্দীনের উপরে অবস্থানরত খান সেনাকে ষ্টেনের ব্যালে দিয়ে গুঁতো দিল। উপরের লোকটি সালাউদ্দীনকে ফেলে দৌড়াতে শুরু করল। সুবেদার হাই ওকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। অতঃপর রাইফেল দুতি নিয়ে ওরা ত্বরিত দেগে শত্রু শিবির ত্যাগ করে।

নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসে সালাউদ্দীনের সাহস গেল আরও বেড়ে। এ রেকী পেট্রলিং থেকে দুটি জিনিশ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাহলো, সুবেদার হাই ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের অদম্য সাহস ও অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। কিন্তু এতে আবার একটি গুরুত্বপূর্ন গোপনীয়তা প্রকাশ পায় যে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আসন্ন, ফলে তারাতারি শত্রুরা তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে ফেললো, তাতে করে কামালপুরে পাকবাহিনীর ৩১-বেলুচ ব্যাটালিয়নের সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ালো দুই কোম্পানীতে (রাজাকার ছাড়া)। দুদিন পর ৩০-৩১শে জুলাই প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল (সিনিয়র টাইগার) রাতের আধারে রওনা হলো। প্রথমে সালাউদ্দীনের ডেল্টা কোম্পানী, ফলো আপ কোম্পানী হলো ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্রাভো, যার পিছে হলো ব্যাটালিয়ন ‘আর’গ্রুপ আর এই ‘আর’গ্রুপে ছিলেন মেজর (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) মঈন এবং তার সাথে ছিলেন কর্নেল (বর্তমানে মেজর জেনারেল) জিয়াউর রহমান। সম্ভবতঃ ব্রিগেডের প্রথম এটাক সরেজমিনে তদারক করার জন্য কর্নেল জিয়া নিজেও এটাকিং ট্রুপসের সাথে রওনা হন। আক্রমনের ওয়াচ আওয়ার ছিল ৩০/৩১শে জুলাই-এর রাত ৩-৩০ মিনিট। কিন্তু গাইডের অভাবে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল এফ-ইউ-পি’তে সময়মত পৌঁছাতে পারেনি। ফলে ৩-৩০ মিনিটের সময় টাইমপ্রোগ্রাম মোতাবেক আমাদের নিজস্ব আর্টিলারী ফায়ার যখন শুরু হয় (ফায়ারের সংকেতধ্বনি ছিল হিস করে ওয়ারলেসের উপর শব্দ করা) তখনও আমাদের ছেলেরা এফ-ইউ-পি’তে পৌছার জন্য প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। কাদামাটিতে এতগুলো লকের এই দৌড়াদৌড়ির ফলে যথেষ্ট শব্দ হয়, তাতে করে দুশমনের পক্ষে আক্রমণের ডাইরেকশন নির্ধারন করা একেবারেই সহজ হয় এবং নিমিষের মধ্যে তাদের আর্টিলারী ফায়ার এসে পড়তে থাকে। এদিকে প্লাটুন পর্যায়ে ডেপথ (টু-আপ) হওয়ার ফলে লোক আগে-পিছে হয়ে যায়। ফলে কমান্ড কন্ট্রোল কায়েম করা মুশকিল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এসেম্বেলি এরিয়া থেকে পূর্ব নির্ধারিত এফ-ইউ-পি’তে আসার মাঝপথে আমাদের নিজেস্ব আর্টিলারী ফায়ার শুরু হওয়াতে প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল তৎক্ষণাৎ সেই অবস্থাতেই কোনক্রমে ফর্ম-আপ হতে থাকে। ফলে সে কি চিৎকার আর হট্টগোল। আবার ডাইরেকশনের অভাবে এডভান্স করাকালীন একে অন্যের উপর চড়ে বসে। আর অপেক্ষাকৃত নিচু আর কর্দামাক্ত জমির উপর আসা সাথে সাথে পাকিস্তানী ও আমাদের যুগ্ন আর্তিলারী ক্রস-ফায়ারিং-এর নিচে আসার ফলে আমাদের বেশকিছু ছেলে হতাহত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ওয়ারলেস সেট জ্যাম হওয়াতে সংযোগ সম্পূর্নরুপে বিচ্ছিন্ন হয়। তাতে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছায়। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল হাটবাজার বসেছে আর নীলকর আদায়কারী সাহেবদের দেখে কে কোথায় পালাবে পথ পাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রথমে ইষ্ট বেঙ্গলের আক্রমনের ব্যুহ রচনা করা আদৌ সম্ভব ছিলো না। কারন, এটাকিং ট্রুপস যদি ঠিকমত ফর্ম-আপ না হতে পারে তবে আমাদের পক্ষে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠেনা। ১৯৬৫ সনের যুদ্ধে বার্কি সেকটর বিআরবি’র ওপারে ভারতের এক দিভিশন সৈন্য যখন ফর্ম-আপ হচ্ছিল তদানীন্তন পাকিস্তান তিনটি মাত্র ট্যাংক আচম্বিতে সে সৈন্যদলের উপর হামলা চালায়। ফলে, ভারতীয় পালিয়ে যায়। যুদ্ধের ময়দানে এ ঘটনা অহরহ ঘটছে এবং ঘটবে। এদিকে কর্নেল জিয়াউর রহমান বাঘের মত গর্জে উঠলেন, ‘কাম অন, এ্যাট এনি কষ্ট উই উইল লাঞ্চ দই এ্যাটাক’। মেজর মঈন (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) ওয়ারলেস ছেড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন। আর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন ও হাফিজ এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। একদিকে ইষ্ট বেঙ্গল প্রসিডিউরের চামড়া পর্যন্ত তুলে ফেলছে, অন্যদিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মেগাফোনে বাংলা-ইংরেজী-উর্দুতে মিশিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল সৈন্যদলকে। কারূর বা কলার ধরে লাইনে সোজা করে আগের দিকে (টারগেটমুখী)মুখ করে দিচ্ছে, আর কাউকে বা হাফিজ ষ্টেনের বাঁট দিয়ে মারছে। মোগল-রাজপুতের প্রথম যুদ্ধে আশিটি যুদ্ধে বিজয়ী রানা সংগ্রাম সিংহের বিপুল রণাভিঙ্গ সৈন্যবাহিনীকে দেখে আকারে ছোট মোগল বাহিনী ভড়কে গিয়েছিল যুদ্ধের প্রারম্ভেই। কিন্তু ভেলকিবাজির মত বাবর সে সৈন্যবাহিনীকে বাগে এনে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করে শেষপর্যন্ত জয়ী হন। তাই সামরিক নেতা হিসাবে ইতিহাসে বাবরের স্থান অতি উঁচুতে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন ও হাফিজের কৃতিত্ব বুঝি সেখানেই। মাঝে বিশৃঙ্খলার মাঝে শুধুমাত্র মনের জোর ও অদম্য সাহসে বলীয়ান হয়ে সালাউদ্দীন ও হাফিজ প্রতিবন্ধকার ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজ নিজ কোম্পানীকে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত করতে সক্ষম হন এবং নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আক্রমণ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন। যুদ্ধের ময়দানে ফলাফলটা সকল সবকিছুর পরিমাপক নয়, বরং ঘটনাটি কিভাবে সংঘটিত হলো সেটাই সবচেয়ে লক্ষণীয়।

দ্বিতীয় মহাসমরে মন্টগোমারীর কাছে রোমেল চরমভাবে মার খেলেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস, মাইলের পর মাইল পশ্চাদপশারণ অভিয়ান অব্যাহত রাখতে হয়েছে রোমেলকে সাহারার দুস্তর মরুর পথে পথে। অথচ মন্টগোমারীর বিজয়াভেযানের চেয়ে রোমেলের সেই পশ্চাদভিযানই সকলের মনে অণুপ্রেরণা যোগায়। তাই বুঝি রোমেল শুধুমাত্র রোমেলই।

এফ-ইউ-পি’র চরম বিশৃঙ্খলা থেকে সামান্য রেহাই পেয়ে প্রথম বেঙ্গল সবেমাত্র অগ্রসর হয়েছে অম্নি পাকিস্তানী আর্টিলারী সাল্ভো ফায়ার এসে পড়লে, সংগে সংগে হতোদম্য সৈনরা মাতিতে শুয়ে পড়ল – শেষ মুহুর্তে বুঝি আক্রমণ করা সম্ভব হলো না ধেখে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একদিকে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির মান-ইজ্জতের প্রশ্ন, অন্যদিকে দুশো ছেলের জীবন। সালাউদ্দীন তার “ক্ষ্যাপা, দুর্বাসা ছিন্নমস্তা চণ্ডী-রনদা সর্বনাশী, জাহান্নামের আগুনে বসে হাসছে পুষ্পের হাসি” – মারছে লাথির পর লাথি। কারো বা কলার চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল – ‘বেশরম, বেগায়রত, শালা নিমকহারামির দল – আগে বাড়ো।’আবার সৈন্যদলের মন চাংগা করার জন্য নিজের অবস্থান জাহির হয়ে যাবে জেনেও পাকবাহিনীকে লক্ষ্য করে মেগাফোনে উর্দুতে বলছিল, ‘আভিতক ওয়াকত হায়, শালালোক সারেন্ডার করো। নেহীতো জিন্দা নেহি ছাড়েংগা।’তার পরের ইতিহাস প্রতিতি বাঙ্গালীর গৌরবের ইতিহাস। এ যেন শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, মুক্তিকামী মানুষের প্রালবন্যার ইতিহাস। বাঙ্গালী সৈন্যরা তখন ছুটছে ঝড়ের মত করতালি দিয়ে স্বর্গমর্ত্য করতলে। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালার মত প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল মুহুর্তের মধ্যে ভাসিয়ে দিল পাকবাহিনীর ডিফেন্সের প্রথম সারির বাংকারগুলো। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত গুরুগর্জন করে সিনিয়র টাইগার ‘জয় বাংলা’আর ‘আকবর’ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তুললো যুদ্ধের ময়দানকে। বাংকার অতিক্রম করে বিশ-পঁচিশটা ছেলে কমিউনিতি সেন্টারে ঢুকে পড়লো। তাদের মাত্র দুজন আহত অবস্থায় ফেরত আসতে পেরেছিল আর বাকি সবাই হাতাহাতি যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করে। প্রচন্ডভাবে তখন হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে। বাঘের থাবাতে যত্রতত্র ভূপাতিত পাকসৈন্যরা। পিছনে তখন আমাদের পক্ষের লাশা আসা শুরু হয়ে গেছে। কর্নেল জিয়া তখন বলছেন, “আই উইল একসেপ্ট নাইনটি ফাইভ পারসেন্ট ক্যাজুয়েলটি বাট …। দেম আউট মঈন।” আহত ক্ষতবিক্ষত জোয়ানরা বলছে, “স্যার-নিয়ে এলেন কেন? আর সামান্য বাকী- কি হত, আমি না হয় মরে যেতাম।” গর্বে বুক ফুলে উঠছিলো। পিছনের উঁচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকেরাও বুঝতে পারছিলেন বাঙ্গালীরা শুধু বসে বসে (এমনকি না খেয়ে) কবিতা লিখে কিংবা গাল-গল্প করে আর শ্লোগান দিয়ে ভাবালুতার মাঝে দিন কাটায় না। যুদ্ধও করতে জানে বৈকি। আজকে শুধু আফসোস হচ্ছে যে, আজকের পেপার-টাইগার যদি সেদিন যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন তবে সম্ভবত আজ আর তারা আমাদেরকে ‘খোদার খাসী’বলার দুঃসাহস করতেন না। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের গায়ে তখনও সেই রিলিফের সাদা শার্টটা ছিল। মহানগরীর নিউ মার্কেটে গিয়ে মার্কেতিং করার অবসর তার ছিল না, না ছিল সংগতি কিংবা তেমন নীচু মনোবৃত্তি। তবে হ্যাঁ, বন্য পশুদের মত আমরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছি। তাই বুঝি লুঙ্গি মাল্কোচা বেঁধে সিভিল অফিসার তৌফিক এলাহি যশোর রণাঙ্গনকে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।

এদিকে মাইন-ফিল্ডে ফেঁসে যাওয়া সুবেদার হাই-এর প্লাটুনের ডানে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন বুঝতে পারলেন যে, শত্রুরা মাইন-ফিল্ডের পেছনের বাংকারগুলো ছেড়ে দিয়ে পেছনে সেকেন্ড লাইনে সরে গিয়ে কাউন্টার এটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মেগাফোনে হাইকে প্লাটুন নিয়ে ডানে যেতে বলেলেন। প্রথম আক্রমণ শুরুকালে সুবেদার হাই-এর লোকসংখ্যা ছিল ৪০ জন। কিন্তু লক্ষ্যে পৌছা পর্যন্ত সংখ্যা দাড়াল ১৫-২০ জনে। এদিকে মাইনের আঘাতে নায়েক শফির হাত উড়ে গেল আর ধারমান শত্রুদের পিছু নেওয়াকালে জোয়ানরা বারবার সালাউদ্দীনকে অনুরোধ করলো, “স্যার, পজিশনে যান” (মাটিতে শুয়ে পড়া)। সালাউদ্দীন ধমকে উঠলো, “বেটা-স্যার করে চিৎকার করিস না, শত্রুরা আমার অবস্থান টের পেয়ে যাবে। চিন্তা করিস না তুই বেটা আমার কাছে এসে দাঁড়া, গুলি লাগবে না, ইয়াহিয়া খান আজও আমার জন্য গুলি বানাতে পারেনি।” দু’দিকে বৃষ্টির মত গুলির মাঝে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাই বুঝি আজও ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেঁদে কেঁদে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের প্রাণপ্রিয় সালাউদ্দিনকে। দ্বিতীয়বার মেগাফোনে ‘হাই’বলার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের সামনে ২/৩টি বোমা এসে পড়লো। মুহুর্তের মধ্যে সালাউদ্দীন ধরাশয়ী হলেন। তার দেহটা প্রথমে বামে, পরে আধা ডানে ও শেষে ধরাম করে পেছনের দিকে পড়ে গেল। আশেপাশের জোয়ানরা ছুটে আসে, ‘স্যার, কলেমা পড়েন’, কিন্তু বাংলার একান্ত গৌরব সালাউদ্দীন উত্তর দিল, “আমার কলেমা পড়ার দরকার নেই। খোদার কসম, যে পিছনে হটবি তাকে গুলি করবো।” তারপর বিড় বিড় করে আবার বলে উঠলো, “মরতে হয় এদেরকে মেরে মর – বাংলাদেশের মাটিতে মর।’এমন মরণ দুনিয়ার ইতিহাসে যে বিরল, এ মৃত্যুতে আনন্দ আছে, গর্ব আছে। উঁচু মাটির টিবিতে পড়ে থাকা সালাউদ্দীনের লাশটা ২/৩ জন জোয়ান শত্রুর এলাকা থেকে টেনে আনতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সকলেই মৃত্যুবরণ করে। পরিশেষে একটি বিহারী ছেলে ৮ টি গুলি খেয়েও শেষবারের মত চেষ্টা করে নিজে গুরতরভাবে আহত হয় এবং লাশটি আনতে ব্যর্থ হয়। সালাউদ্দীনের গায়ে তখনো সেই সাদা শার্টটা ছিলো, যা তার খুলে ফেলার কথা ছিল, কারন সাদা শার্ট রাত্রিবালায় বেশী দেখা যায়। শেষপর্যন্ত ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের ঘড়ি, ষ্টেন ও অন্যান্য কাগজ নিয়ে আসা হয়।

ওদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজ বেঁচে গেলেন অলৌকিকভাবে। হাতের স্টেন তোপের মুখে উড়ে গেলেও সামান্য আহতও হয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার বেঁচে গেলেন, কিন্তু ৬০০ গজ পিছনে এফ-ইউ-পি তত্বাবধানে কর্মরত লে: মান্নান ঊরুতে গুলি খেয়ে গুরুতরভাবে আহত হলেন, যদিও বা একই জায়গায় একইভাবে ফ্লায়িং অফিসার লিয়াকতও শুয়ে ছিলেন। অন্যদিকে আহতও ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধারকল্পে ল্যান্স নায়েক রবিউল ছুটল শত্রু অভিমুখে। কয়েক কদম যাওয়ার পর দুই হাতেই গুলি এসে লাগলো, তথাপি তার প্রানপ্রিয় তথা বাংলাদেশের অমুল্য রত্ন ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধার করার সঙ্কল্প থেকে এতটুকু টলাতে পারেনি। যথাস্থানে পৌঁছে দেখে হাফিজকে অন্য কেউ নিয়ে গেছে। পড়ে থাকা অয়ারলেস অ রকেট লাঞ্চার উঠাবার সময় রবিউলের বুকে গুলি লাগলো। রবিউল মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। পাশের জোয়ান সাহাজ্যের ভয়ে পাশ কেটে চলে গেল। রাগে-দুঃখে রবিউল গ্রেনেডটা হাতে নিয়ে (উদ্দেশ্য, বন্দী হবে না) জীবনের আশা ত্যাগ করে নিকটবর্তী আখক্ষেতের দিকে দিলো ভোঁ দৌড়।বৃষ্টির মত শত্রুর গুলি আসছিল। কিন্তু আশ্চর্য, রবিউলের গায়ে লাগলো না। কোনমতে টেনে হিঁচড়ে আখক্ষেতে পৌঁছুতেই রবিউলের প্রতীতি জন্মালো সে সহজে মরছে না, আর অন্যের সাহায্য ব্যতিতই সে বাঁচতে পারবে। বাঁ হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ডান হাতের হাড়টি বের হয়ে আছে। নাকে মুখে রক্তের ছোপ। এ অবস্থায় পালিয়ে যেতে দেখে এগিয়ে এসেছিল গ্রামের গৃহবধুরা, যদিও গৃহস্বামীরা প্রত্যাশী নয়। তাই গৃহবধূরা দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। নিজের সাথি যখন মুখ ফিরিয়ে চলে গেল তখন সে আর কারো সাহায্য প্রত্যাশী নয়। তাই গৃহবধূদের হাত ছাড়িয়ে সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলো কিন্তু পরের ইতিহাস আজো তার কাছে ঝাপসা হয়ে আছে। তার বিশ্বাস দুই রমনীর কাঁধে ভর দিয়ে সে এফ-ইউ-পি এরিয়া পর্যন্ত পৌঁছবে। এদিকে সালাউদ্দীনের মৃত্যুর পর আমাদের সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও সেই অবস্থায় ছোট ছোট গ্রুপে ওরা শত্রুর বাঙ্কারগুলোর উপর আঘাতের পর আঘাত হান্তে থাকে। বেলা তখন ৭টা বাজে। অযথা লোকক্ষয় না করে উইথড্র করে শ্রেয় জেনেও মেজর (বর্তমানে লে: কর্নেল) মঈন তার সৈন্যদলকে কিছুতেই পশ্চাদপসারন করাতে পারছিলেন না। আমাদের আর শত্রুর লাশে কমিউনিটি সেন্টার ভরে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বেলা সাড়ে কিংবা নিখোঁজ আর দুইজন অফিসারসহ ৬৬ জন আহত হয়। শত্রুদের লাশ তিনটা ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যেতে আমাদের গ্রামের লোকেরা দেখেছে। পরদিন হেলিকপ্টারে পাক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা, সম্ভবত জি-ও-সি আসেন কামালপুর পরিদর্শন করতে। বলাবাহুল্য,ওইদিনই পাক বেতারে কামালপুর যুদ্ধের ভয়াবহ বর্ননা করতে গিয়ে বলা হয় যে প্রায় ৪০০ দুষ্কৃতিকারী নিহত হয়েছে। এক অপারেশনে এত বড়সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী নিহত হওয়ার সংবাদ ইয়াহিয়ার বেতারে আর কখনো প্রচার করা হয়নি।

ফলাফলঃ ব্যাংকারে বসে থাকা খান সেনাদের মনে ভীতি সঞ্চার করাই এ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সাফল্য। এ যুদ্ধে প্রমাণিত হলো বাঙালীরা দূর থেকে আর পালিয়ে যাবে না বরং ব্যাংকার থেকে খান সেনা তাড়ানোই তাদের উদেশ্য। তাই বুঝি এই আক্রমণের পর থেকে খান সেনারা ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা কিংবা কামালপুরের নাম শুনলেই আঁতকে উঠতো। তখনকার দিনে পাক শিবিরে বন্দী মেজর আজিজের ভাষায় বলতে হয় পাকিস্তানীদের নিজেদের মতে কামালপুর হলো পাকসনৈদের মরনঘাঁটি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আজিকে জিজ্ঞাসা করা হতো, “হয়ার ইজ ধানিয়া কামালপুর কিংবা হয়ার ইজ ইউর ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট?”। কথা প্রসংগে সেই জুলাই-আগষ্ট (১৯৭১) মাসে পাক অফিসাররা কখনও বা হঠাত বলে ফেলতো, “ইওর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইজ লাইক রিয়াল টাইগার্স।” আক্রমণটি ব্যর্থ হলেও এর চরম সাফল্য এ উক্তির মাঝেই নিহিত আছে। তাই বুঝি পরবর্তীকালে বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে মেজর আজিজ শত দুঃখ কষ্টকে অবনত মস্তকে মেনে নিয়ে যুগ সৃষ্টিকারী কামালপুর রণাঙ্গনে যোগ দেন।