১১ নং সেক্টরের আরও যুদ্ধ বিবরণ*
মেজর তাহের আগষ্ট মাসে ১১ নং সেক্টরে আসেন। কিন্তু এর আগে বিখ্যাত পাকবাহিনীর কামালপুর বাংকারে সদাসর্বদা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঘাত হানতে থাকে অল্প সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত অথচ গভীর মনোবলের ভিত্তিতে গঠিত বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। এখানে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সময়ে ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের জুনিয়ার অফিসাররাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। এসময়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর শত্রুশিবিরে ছোটখাট গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে কিছু কিছু করে পাক-সৈন্য হত্যা করে দস্যুদের সদা ব্যতিব্যস্ত এবং সন্ত্রাসের মধ্যে রাখতো। এই সময় বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধক্ষেত্রে আর একটি অমর নাম শহীদ সালাউদ্দিন কামালপুর রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া অন্যানোর মধ্যে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেঃ মান্নান এবং মুক্তিফৌজ কমান্ডারদের মধ্যে যারা নির্দিষ্ট ভূমিকা রাখেন, তারা হচ্ছেন কমান্ডার মুক্তা, কমান্ডার হেলাল, কমান্ডার পান্না, কমান্ডার ফয়েজুর। এর মধ্যে হেলাল কোম্পানীর একটি দিক রয়েছে। সেটা হল পাক-বাহিনীর কামালপুর বাংকারে এই শক্তিশালী পাক – ঘাঁটিটিকে ১১ নং সেক্টর থেকে মোট ১৮ বার ছোট – বড় আক্রমণ করা হয়েছে। তার মধ্যে হেলাল কোম্পানি মোট ১৪ টি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে এবং ৪ ঠা ডিসেম্বর কামালপুর মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কোম্পানী এখানে যুদ্ধরত অবস্থায় ছিল।
একদিন,সম্ভবতঃ ২৪ শে জুলাই তারিখে,ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’জন জুনিয়র অফিসার ক্যাপ্টেন শহীদ সালাউদ্দিন ও লেঃ মান্নান কামালপুরে শত্রুশিবিরে বাংকারে সশরীরে উপস্থিত হয়ে দু’জন খানসেনাকে হত্যা করে একটি চাইনিজ ও একটি জি-থ্রি রাইফেল নিয়ে আসে।
কামালপুরে রণাঙ্গনে একটি স্মরণীয় দিন ৩১ শে জুলাই তারিখ।শেষ রাত্রের দিকে কামালপুর বাংকারে এক বিরাট ধরনের দুর্ধর্ষ আক্রমণ করা হলো।এই দুর্ধর্ষ আক্রমণের নেতৃত্বে দিচ্ছেন সম্মুখভাগে ক্যাপ্টেন শহীদ সালাউদ্দিন,লেঃ মান্নান ও ক্যাপ্টেন হাফিজ।বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ তুমুলভাবে লড়ে যাচ্ছেন এবং পিছন থেকে ব্যাক্তিগতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করছেন মেজর মঈনুদ্দীন।কর্ণেল জিয়াও তাঁর।সদর দপ্তর নিয়ে এ সময় উপস্থিত ছিলেন।মোট কথা এই দুর্ধর্ষ আক্রমণটি সেদিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।যুদ্ধক্ষেত্রে কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি না হলে হয়তো সেই দিনই কামালপুর মুক্তিবাহিনীর দখলে আসতো-ভুল বুঝাবুঝি উৎরে যেয়ে তবুও হয়তো বা কামালপুর দখল করা সম্ভব হতো যদি সেদিন বাংলার বীর সন্তান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ না হতেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন হাফেজ একটি কোম্পানীকে কমান্ড করছিলেন।আর একটা কোম্পানীকে কমান্ড করছেন স্বয়ং শহীদ সালাউদ্দিন। নির্দিষ্ট সময়ে শহীদ সালাউদ্দিন নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছলেন কিন্তু হাফিজ একশ গজ পিছিয়ে ছিলেন।এর মধ্যেই আর্টিলারি ফায়ার শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষন পর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন কামালপুর ক্যাম্পের ভিতরে চলে যান এবং আর্টিলারী ফায়ার বন্ধ করতে পারেন।ওদিকে ক্যাপ্টেন হাফেজ আর্টিলারীকে একশগজ আগের ফায়ার দিতে বলেন এবং আর্টিলারী অফিসার ক্যাপ্টেন হাফিজ সাহেবের সিগনাল ও গোলা বর্ষণ করেন।ফলে সালাউদ্দিন কোম্পানীর বেশ কিছু ছেলে হতাহত হন।এবং ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন স্বয়ং আঘাতপ্রাপ্ত হন।তবুও তিনি দমেননি।শত্রুদের অনেকেই মারা পড়ছিল এবং কেউ কেউ পালাতে চেষ্টা করছিল ও একজন পালিয়েও ছিল।ইতিমধ্যেই শত্রুপক্ষের মেশিনগান ফায়ার পশ্চিম দিক থেকে অর্থাৎ কামালপুর পোস্ট অফিস ও গোডাউনের মাঝামাঝি থেকে সালাউদ্দিন কোম্পানীর দিকে আসতে থাকে।দুর্ধর্ষ সৈনিক সালাউদ্দিন ভেবেছিলেন ঐ এম-জি টাকে স্তব্ধ করে দিতে পারলেই বিখ্যাত কামালপুর দখলে আসবে এবং এই ভেবে তিনি একাই গিয়েছিলেন সেই এম-জি টাকে মারতে।তিনি যখন গোডাউনের কাছ থেকে ফায়ার করবেন,ঠিক সেই সময়েই পোস্ট অফিসের দিক থেকে একটি এল-এম-জি হঠাৎ গর্জে উঠলো এবং বাংলার বীর সন্তান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেল। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন বীরের মত শহীদ হলেন।তাঁর মৃতদেহ আনা সম্ভব হয়নি এবং তার মৃতদেহ আনতে গিয়ে ১৭ জন বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্য আহত হয়েছিলেন। পরে শোনা গেছে সালাউদ্দিনের লাশ পাকসেনারা সামরিক কায়দায় সমাধিস্থ করেছে।
সেদিন এই মর্মন্তদ যুদ্ধে শুধু ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ হননি, আরও দুজন জুনিয়র অফিসার,ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেঃ মান্নান গুরুত্বরভাবে আহত হন এবং আরও তিনজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার আহত হন।সেদিনের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ মোট ৬১ জন সৈন্য বীরের মত শহীদ হন।অপরদিকে পাকবাহিনী হারায় একজন অফিসার সহ মোট ৭০ জন সৈন্য।সেদিন কামালপুর দখল করা সম্ভব হয়নি।
তারপর অমিতবিক্রমে কামালপুর আক্রমণ করা হয়েছিল।সেদিন ছিল ৯ ই আগষ্ট।এই আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাই বেশী।তাছাড়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈন্যও ছিল।৯ ই আগষ্ট রাত ৮-৩০ মিনিটে হেলাল কোম্পানীর ৩৭ জন ছেলে বক্সিগঞ্জ-কামালপুর সড়কে এমবুশ নিয়ে থাকে এবং তারা টেলিফোনের তার কেটে দিয়ে পাক বাহিনীর তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেলাল।সেই রাত্রিটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন,বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল।
এই এমবুশ থাকাকালীন বক্সিগঞ্জ থেকে কামালপুর গমনরত দু’জন রাজাকারকে এই দল গ্রেফতার করে দুটি রাইফেল ও ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে।এদের কে মহেন্দ্রগঞ্জে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়ে এই দল এখানেই এমবুশে থাকে।কিছুক্ষন এখানে এমবুশে থাকার পর এই দলের ট-আই-সি বিচিক্ষন লতা দেখতে পেল তাদের পজিশন থেকে দশ হাত দূরে দুজন রাজাকারসহ পাক-বাহিনীর বিরাট বাহিনী পজিশন নিচ্ছে।সঙ্গে সঙ্গে লতা দিক নির্দেশ করে ফায়ার এর আদেশ দিল।ফলে পাক দস্যুরা আর পজিশন নিতে পারেনি।৭টা এস-এল-আর ও একটি এল-এম-জি দিয়ে বৃষ্টির মত গুলি ছুড়লো হেলাল-লতার দল।গুলির আঘাতে পাকবাহিনী দলের কমান্ডার আহত হয়ে গেল,তারপর অকথ্য মুক্তিবাহিনীর দলকে গালাগালি করতে লাগলো।ওরা সার্চ শুরু করলো।ততক্ষণে হেলাল কোম্পানীর দল ওখান থেকে উইথড্র করে চলে এসেছে।কিন্তু সবাই বিচ্ছিন্ন অবস্থায়।সবাইকে পাওয়া গেল কিন্তু লতা ও আর একটি ছেলেকে হেলাল খুঁজে পেল না।পরে ওরা রাত ১২ টার সময় নির্দিষ্ট স্থানে এলো এবং খবর দিল একজন কর্ণেল আহত ও ৪৭ জন পাক সৈন্য খতম হয়েছে।এই দুর্ধর্ষ আক্রমণে হেলালের কৃতিত্বের জন্য ওর কোম্পানীর নাম সেদিন টাইগার দেওয়া হয়েছিল।তারপর মেজর তাহের আগষ্ট মাসের ১১ তারিখে মহেন্দ্রগঞ্জে ১১ নং সেক্টর পরিদর্শনে আসেন।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হেলাল লেঃ কর্ণেল তাহেরের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে কামালপুর রণাঙ্গনে অভুতপূর্ব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।২৬ শে অক্টোবর এক সময়ে তিনি তার দল সহকারে কর্ণেল তাহেরের নির্দেশে কামালপুরের পেছনে গেদ্দা ও উঠানুরপাড়ায় পর পর তিনদিন এমবুশ থেকে বিস্ফারণ ঘটানোর কাজ করেন। তার মাইন বিস্ফোরণে এই এলাকার পাকনাহিনী খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।এক সময় এক মাইন বিস্ফোরণে ৪৬ জন খানসেনা আহত হয়।
লেঃ কর্ণেল তাহের এই হেলাল কোম্পানীর বিশেষ কৃতিত্ব দেখে নভেম্বর মাসে বক্সিগঞ্জ আক্রমণ করার জন্য পাঠান।এর মধ্যে কর্নঝোরাতে তিনি পাক বাহিনীর সঙ্গে এক তুমুল সংঘর্ষে ৪ জন খানসেনাকে খতম করেন।বাকী খান সেনা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে।ঐ সময় হেলাল লেঃ কর্ণেল তাহেরের এই কোম্পানী ফিরে আসে এবং পরে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা সহকারে মেলান্দহানার পাটের গুদাম ধ্বংস করার আদেশ পায়।হেলাল কোম্পানী এই নির্দেশ মেলান্দাহর দিকে যাত্রা করে।এর মধ্যে কোন এক নদীতে পাকবাহিনী দালালদের ১২০০ মণী নৌকা ধ্বংস করে এবং পাক বাহিনীর সঙ্গে এখানে এক সংঘর্ষ বাধে।তারা তিনদিক থেকে এই হেলাল কোম্পানীকে আক্রমণ করে।তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অতি বিচক্ষণতার সাথে আক্রমণ প্রতিহত করে ১৩ জন শত্রুসেনাকে খতম করেন।পরে তার বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে মেলান্দাহ যাত্রার পথি দূরমুরির পুল ধ্বংস করেন।পুল ধ্বংসের সময় পুলরক্ষী বাহিনী ও রাজাকারদের সাথে এক সংঘর্ষে তিনি ১৭ জন রাজাকারকে খতম করে ৬ টি রাইফেল উদ্ধার করে তাহেরের কাছে জমা দেন।
তারপর ১৪ নভেম্বর।এই ঘটনাটির কথা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের কয়েকহাজার মুক্তিযোদ্ধা সহ এই এলাকার বাসিন্দা ইন্ডিয়ার জনসাধারণ চিরদিন মনে রাখবে।
১৩ ই নভেম্বর দিবাগত রাত্রি ৩-২০ মিনিট লেঃ কর্ণেল তাহের মুক্তিফৌজ কমান্ডার হেলাল,সাঈদ ( লেঃ কর্ণেল তাহেরের ছোট ভাই),পান্না,লেঃ মান্নান,গোয়েন্দা অফিসার মোঃ মনিরুজ্জামান,আবেদীন,ভুঁইয়া – এদের সবাইকে ডাকলেন এবং বললেন,আজকে কামালপুরে শক্তিশালী আক্রমণ করা হবে।তিনি কিভাবে কোথা থেকে আক্রমণ করা হবে তা সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন।তিনি কোম্পানী কমান্ডারদের মোট ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কামালপুরের আশেপাশের কোন এক গ্রামে এমবুশ নিয়ে থাকতে বললেন।কোনরকম সাড়াশব্দ ব্যতিরেকে।তিনি আরও বলে দিলেন,তার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত যেন কোন রকম গুলিবর্ষণ করা না হয়-আর যদি পাক-বাহিনী পালাতে চেষ্টা করে,তবে যেন তাদেরকে ধরা হয়।
যথাসময়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।যুদ্ধ পরিচালনা করছেন লেঃ কর্ণেল তাহের স্বয়ং।তিনি অয়ারলেসের মাধ্যমে মুক্তিফৌজের রণাঙ্গনের খবর রাখছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন।সকাল ৯-৩০ মিনিট হঠাৎ তুমুল সংঘর্ষ থেমে গেল।পাক-বাহিনীর ওদিক থেকে কোন গুলি আসছে না।সবাই মনে করলো ওরা সবাই খতম।মুক্তিফৌজের মনে দারুণ উৎফুলভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল সে সময়।এই মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনে কর্ণেল তাহের একটি অয়ারলেস সেট নিয়ে দৌড়ে গেলেন,কি ব্যাপার।তখন তার সঙ্গে ছিল তার দুই ভাই বেলাল ও বাহার-তারা উভয়েই আসন্ন জয়ের জন্য খুবই আনন্দিত।লেঃ কর্ণেল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন,ঠিক এই সময় লেঃ মিজান এসে খবর দিল কামালপুর ক্যাম্প এখনই চার্জ করতে হবে।কর্ণেল তাহের ভাবছেন কোন দিক থেকে কামালপুর চার্জ করা হবে।ঠিক এমন সময় একটা গোলা এসে তাঁর পায়ে লাগলো।আর্ত চিৎকারের সঙ্গে সব মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসে।এসে দেখতে পায় এক অসহনীয় করুণ দৃশ্য-তাহের রণনেতা কর্নেল তাহের চিরদিনের মতো তার একটি পা হারিয়েছেন।সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিফৌজদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল যারা নাকি কিছুক্ষন আগে দুর্ধর্ষ পাক সৈন্যকে হত্যা করেছে-তারা সবাই শিশুর মতো কাঁদছে।কিন্তু লেঃ কর্ণেল তাহের,সেই অসীম সাহসী রণনেতা,এত বড়ো আঘাত পেয়েও একটুও বিচলিত হননি।তখন তার মাত্র চারটি কথা ছিল,(১) যুদ্ধ চালিয়ে যাও-(২) ঐ জায়গা দখল কর (যে জায়গায় তিনি আহত হয়েছেন), (৩) কামালপুর দখল করতে হবে,(৪) আমি আসছি এবং এসে যেন দেখতে পাই কামালপুর থেকে ঢাকার রাস্তা পরিস্কার।তারপর আহত লে কর্নেলকে কাঁধে করে নিয়ে আসে অশ্রুসিক্ত চোখে মুক্তিযোদ্ধা মিঠু ( এই মুক্তিযোদ্ধা খুবই কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কামালপুর রণাঙ্গনে),সুজা,লেঃ মিজান,ভূঁইয়া ও আবেদীন।তারা গারোডোবা পর্যন্ত নিয়ে আসে তাঁকে।ওখান থেকে হেলিকপ্টারে লেঃ কর্ণেল তাহেরকে ভারতের পুনার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারগণ কর্ণেল তাহেরকে দেখে বলেছেন- তিনি যদি জ্ঞান হারাতেন তবে তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হতো না।কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে সেদিনের সেই কামালপুরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধে পাকবাহিনী ১৩৫ জন সৈন্য হারায়।ধ্বংস হয়েছিল ৬ টি ট্রাক,১ টি জীপ এবং বহুসংখ্যক হাতিয়ার।
তারপর লেঃ কর্ণেল আবু তাহেরের অনুপস্থিতে এই সেক্টরটি সংযুক্তভাবে নেতৃত্ব দেন মেজর আজিজ,লেঃ মান্নান ও এয়ারফোর্সের অফিসার জনাব আবু তাহের সাহেবের বড় ভাই জনাব আবু ইউসুফ।এই সময়ে কর্নেল আহত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিনিয়তই কামালপুর আক্রমণ করতে থাকে।
১৬ ই নভেম্বর তারিখের এক আক্রমণে খানসেনাদের মেজর রিয়াজ আহত হয় ও ১২ জন খান সেনা নিহত হয়।
২০ শে নভেম্বর তারিখের আর এক আক্রমণে এই দিনের আগের রাত্রে পাকনাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট করার সময় ৮০ জন পাকসেনা মারা পড়ে।এই সময় প্রতিটি আক্রমণের সময়ে কামালপুরকে ঘেরাও অবস্থায় রেখে আক্রমণ করা হয়।
১ লা ডিসেম্বর আর এক আক্রমণের সময় সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় পাকবাহিনীকে।এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে,কোম্পানী কমান্ডার হেলালসহ মেজর তাহেরের সহোদর বড় ভাই জনাব আবু ইউসুফ,ছোট ভাই কমান্ডার সাঈদ (এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট),বেলাল বাহার( এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট), ও আনোয়ার হোসেন (এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট) – এই পাঁচ ভাই প্রত্যেকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
৪ ঠা ডিসেম্বর কয়েকজন অফিসার সহ বেলুচ,পাঠান,পাঞ্জাবী সৈন্য – মোট ১৬২ জন পাক সৈন্য মুক্তিফৌজ ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পাক বাহিনীর শিবিরে গিয়ে অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জু বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল।শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়।পাক-বাহিনীর অফিসারকে দিয়ে সারেন্ডারপত্র সই করিয়ে সঞ্জুই প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়ায়।তারপর ৬ তারিখে বক্সিগঞ্জ ও মোরাপুর মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।৭ তারিখে দখল হয় দেওয়ানগঞ্জ ও বাহাদুরাবাদ ঘাট।এই বাহাদুরাবাদ ঘাট দখল কারী কমান্ডার ফয়েজুর রহমান জামালপুরের দিকে অগ্রসর হন।তারপর তুমুল সংঘর্ষে ৪০ জনের মতো পাকসেনা নিহত এবং ৬০০ জনের উপর শত্রুসেনা বন্দী হলে ১১ ই ডিসেম্বর সকালবেলা তিনিই জামালপুরের বুকে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উঠান।তারপর মেজর আজিজ লেঃ কর্ণেল তাহেরের পরিকল্পনা অনুযায়ী টাঙ্গাইলের পথে রওনা হন।
*(জুলাই ১৯৭২ এর সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত “লেঃ কর্ণেল আবু তাহের- স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিক” শীর্ষক খালেদুর রহমান রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)