“মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও কামালপুর অভিযান”
পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১১নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে একটি জিনিস দেখে বার বার অবাক হয়েছি। দেখেছি প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মত হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য নির্বাচিত না হতে পেরে অতৃপ্তির ব্যাথা নিয়ে ফিরে গেছে। তারপর যুব শিবিরে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকার চর, ডালু ও অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় ওরা আমাকে ঘিরে ধরেছে। সবারই এক প্রশ্ন, আর কতদিন অপেক্ষা করব? একজন সৈনিক হিসেবে আমি বুঝতে পারি কখন মানুষ ভয়াবহ যুদ্ধকে সহজভাবে গ্রহণ করতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার দৃষ্টান্ত আর নেই। গণচীন থেকে শুরু করে ইন্দোচীনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কোনটাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মত এ দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। চীন ভিয়েতনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির সঙ্গে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলার তরুণরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে শৌর্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই। মুক্তিযোদ্ধারা এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে অন্য কেউ নয়। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী এককভাবে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনগনের এই বিজয়কে নিজের বলে করে তা হবে অবৈধ, মিথ্যা। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শক্তির শোষণ এত তীব্র ছিল যে বাঙ্গালী জাতির জাতীয়তাবোধ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কারণ হবার প্রখরতা অর্জন করেছিল। জাতীয় শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আদেশের জনগণ তথা তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার শক্তি যুগিয়েছে। এ কৃতিত্ব জনগণের আর জনগণের যোদ্ধা তরুন সম্প্রদায়ের নিজস্ব।
আগষ্ট মাসে ১১নং সেক্টরের কার্য ভার গ্রহণ করার পর পাকিস্তানীদের ঘাঁটির উপর আমি কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করি। এই আক্রমণগুলো চালাবার ফলে পাকিস্তানী রণনীতি সম্বন্ধে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্মে এবং সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দোষ গুনগুলোও প্রকাশ পায়। পাকিস্তানীরা সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য প্রবেশ পথগুলো বন্ধ করার জন্য সীমান্তে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। এই ঘাঁটিগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য তারা ব্যাপকভাবে কাঁটা তারের বেড়া ও মাইন ব্যবহার করে। ঘাঁটিগুলোর ভিতর মজবুত বাংকার তৈরী করা হয়, যা তাদেরকে কামানের গোলা থেকেও বাঁচাতে পারে। ঘাঁটিগুলোতে নিয়মিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যক রাজাকার ও আলবদর রাখা হয়। সীমান্তবর্তী এই সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলো ছাড়াও সড়ক ও যোগাযোগ কেন্দ্রগুলোকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী ঘাঁটি গড়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা ঘাঁটিগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত।
কামালপুর ছিল উত্তর সীমান্ত পাকিস্তানীদের একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি। আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি এই ঘাঁটির উপর আমরা দুবার প্রত্যক্ষ আক্রমণ চালাই। দুবারই মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তথাপি তারা ঘাঁটিটি দখল করতে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যখনই ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে সে সময়ই তাদের উপর পাকিস্তানীদের ব্যাপক ১২০ মিলিমিটার মর্টারের গোলা বর্ষিত হয়েছে। বকশীগঞ্জের পাকিস্তানী অবস্থান থেকে এই মর্টারের গোলা ছোঁড়া হত। শত্রুসেনারা মজবুত বাংকারের ভেতর থাকত বলে এই আক্রমণে তাদের কোন ক্ষতি হত না এবং অবস্থা বেগতিক দেখলেই তারা নিজ অবস্থানের উপর নিজ মর্টার দ্বারা গোলাবর্ষণ করত। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানীরা এই রণনীতির কথা চিন্তা করে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তা ব্যাপকভাবে কাজে লাগায়। কামালপুর ঘাঁটির উপর দুটি আক্রমণ চালিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দোষগুলোকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করি।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বলতম দিক ছিল- রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের অভাব। যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা ও তার মূল লক্ষ্য অন্তরঙ্গ সাহচর্যের মাধ্যমে শিক্ষা দেয় তা কোন সময়ই ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কিভাবে গণসংযোগ করতে হয় তা কোন সময়ই ছিলনা। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের আচরণে তারা জনসমর্থন হারিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সামরিক নেতৃত্বের দূর্বলতা। কয়েক সপ্তাহের ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করা হত নেতা। প্রায় ক্ষেত্রেই সামরিক জ্ঞানের অভাবে সংকট মুহূর্তে সে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হত। অবশ্য এই অল্প সময়ে সরবরাহ ও অস্ত্রের দিক থেকে প্রত্যক্ষ আক্রমণের ভূমিকা গ্রহণের উপযুক্ত হয়ে ওঠেন। আগষ্ট মাসের শেষের দিকে ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আমি নির্দেশ দিই শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণ থেকে বিরত থাকো। শত্রুকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে তার শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে নির্ধারিত স্থানে বের করে আনো এবং হত্যা করো।
৭ এবং ১০ই সেপ্টেম্বরের অভিযানগুলো সুরক্ষিত কামালপুর ঘাঁটি থেকে শত্রু সৈন্যদের কৌশলে প্রলুব্ধ করে নির্ধারিত স্থানে বের করে এনে হত্যা করার সুন্দর উদাহরণ। এই অভিযানগুলো ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের বহুদিন মনে থাকবে। গেরিলা যুদ্ধের ছাত্রদের জন্যেও এগুলো মূল্যবান শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে।
কামালপুরে শত্রু ঘাঁটি থেকে ৫০০ গজ পশ্চিমে ধানুয়া কামালপুর গ্রাম, দক্ষিণ পশ্চিম ও দক্ষিণে ঘাসীর গ্রাম ও উঠানের পাড়া। ধানুয়া কামালপুর, ঘাসীর গ্রাম, আর উঠানের পাড়া এই গ্রামের সারি এবং কামালপুরের মাঝে বিস্তীর্ণ জলোমাঠ। শত্রুকে এই জলোমাঠে বের করে আনতে হবে। এই জলোমাঠই হবে তাদের মরণফাঁদ। এই উদ্দেশ্য সম্মুখে রেখে আমি ধানুয়া কামালপুর এবং ঘাসীর গ্রামে একটি নকল ব্যুহ রচনা করি। মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজকে এই রক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলার ভার দেয়া হয়। (বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ পরবর্তীকালে একটি অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে শহীদ হন)। মাহফুজ রাতের অন্ধকারে গ্রামবাসীদের সহায়তায় বাংকার ও ট্রেঞ্চ তৈরী করে ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীর গ্রামে আশ্রয় নেয়।
কামালপুর থেকে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বকশীগঞ্জ- জামালপুর টাঙ্গাইল সড়ক। ঢাকা দখলের জন্য সর্বাত্মক আক্রমণে এই সড়কটির গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তানীর এই সড়কের গুরুত্ব উপলব্ধি করতো এবং সেজন্য তারা সড়কটির পাশে বিভিন্ন স্থানে মজবুত ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। এই সড়ক ধরেই ১৬ই ডিসেম্বর ১১নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সর্বপ্রথম ঢাকা প্রবেশ করে।
কামালপুরের শত্রু ঘাঁটিকে তার যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। নকল রক্ষা ব্যুহ থেকে কামালপুর ও বকশীগঞ্জের মাঝের সড়কটিতে মুক্তিযোদ্ধারা এন্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে। এই মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আগষ্ট মাসের শেষের দিকেই পাকিস্তানীদের সরবরাহ ও সৈন্য বোঝাই নয়টি ট্রাক এতে ধ্বংস হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর বিকাল বেলা ধানুয়া কামালপুর রক্ষা ব্যুহ গিয়ে মুক্তি বাহিনীর একটি দলকে উঠানের পাড়ার কাছে কামালপুর বকশীগঞ্জ সড়কের উপর এ্যামবুশ নেবার নির্দেশ দিই। সড়কের খুব কাছে গিয়ে কেমন করে অবস্থান নিতে হবে বারবার তার মহড়া দেয়া হয়। মাঝরাতে এ দলটি তাদের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে এ্যামবুশ পাতে। তাদের উপর নির্দেশ ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত এ্যামবুশ স্থলে শত্রু প্রবেশ না করে সে সময় পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে। রক্ষা ব্যুহ থেকে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে ফিরে এসে আমি আর একটি কোম্পানীকে অস্ত্র নিয়ে তৈরী থাকার নির্দেশ দিই। বামুনের পাড়া থেকে বনজঙ্গলে পূর্ণ পথ দিয়ে কামালপুর ঘাঁটিতে পৌঁছান যায়। ভোর সাড়ে চারটার সময় এই পথ দিয়ে এগিয়ে কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করতে হবে। আমরা জানতাম কামালপুরের দিকে রওনা হবে। উঠানের পাড়ার কাছে মুক্তি বাহিনীর দলটি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাতের অন্ধকারে আমাদের চারটি তিন ইঞ্চি মর্টার বাম রোডের উত্তর পাশে স্থাপন করি। ভোর চারটা। বাম রোডের উপর বসে আছি। আক্রমণকারী দলটি কামালপুরের দিকে এগিয়ে গেছে। সারারাত আমরা কেউ ঘুমাতে পারিনি। আসন্ন সংঘর্ষের উত্তেজনায় আমরা সমস্ত অবসাদ ভুলে গেছি। ভোর হয়ে আসছে। আক্রমণকারী দলটি কামালপুর ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ তাদের তীব্র আক্রমণ ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিল। আমাদের মর্টারগুলো কামালপুর পশ্চিম অংশে গোলা নিক্ষেপ শুরু করল। কিছুক্ষণ পর সকালের আলোতে দেখা গেল বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা কামালপুর ঘাঁটি অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। ঘাঁটির পূর্ব অংশ তাদের দখলে। ঘাঁটির পশ্চিম অংশের বাংকার থেকে ক্রমাগত মেশিনগানের গুলি আসতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে মর্টারের গোলা। অল্পক্ষণের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারায় ও ১৭ জন আহত হয়। সকাল সাতটায় এ্যামবুশ স্থলে পাকিস্তানী সাহায্যকারী দলটির প্রথম ট্রাকটি এ্যামবুশকারী দলের স্থাপিত মাইন বিস্ফোরণে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। এতে বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত ট্রাকটির পেছনেই ছিল একটি জীপ ও অপর একটি ট্রাক। এই গাড়ি দুটো থেকে শত্রুসৈন্যরা ত্বরিত নেমে রাস্তার পাশে অবস্থান নেয় ও এ্যামবুশকারী দলটির সাথে গুলি বিনিময় শুরু হয়। এতে আরো পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। বেলুচ রেজিমেন্টের মেজর আইয়ুব জীপ থেকে নেমে আসার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। যখন এই গুলি বিনিময় চলছিল তখন একদল পাকিস্তানী সৈন্য কামালপুর ঘাঁটি থেকে পালিয়ে বকশীগঞ্জ যাচ্ছিল। এই পলাতক দলটি সে সময় এ্যামবুশকারী দলটির পেছনে এসে অবস্থান নেয় ও তাদের উপর গুলি চালায়। এতে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও ৪ জন পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েন। এই আকস্মিক বিপর্যয়ে এ্যামবুশকারী দলটি তাদের এ্যামবুশস্থল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এই বিপর্যয় না ঘটলে সেদিন একটি পাকিস্তানীও এ্যামবুশস্থল থেকে ফিরে যেতে পারত না। সামগ্রিক ভাবে এই অভিযোগটি ছিল একটি সফল অভিযান। অভিযান শেষে আনুমানিক ৩৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে বলে মুজিবনগরে খবর পাঠাই। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে সেদিনের রাতের খবরে বলা হয় যে শেষ রাতে দুই ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তান সীমান্ত ঘাঁটি কামালপুর আক্রমণ করে। স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য এই আক্রমণ প্রতিহত করে এবং ভারতীয় সৈন্যদের পেছনে হটিয়ে দেয়। এতে ৩০০ ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় ও ৬৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য শহীদ হয়। এখবর শোনার পর আমরা খুবই উল্লসিত হয়ে উঠি। নিঃসন্দেহে এই অভিযানে আমরা শত্রুকে প্রলুব্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে এনে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
১০ই সেপ্টেম্বর অভিযানটি ও শত্রুকে কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের করে আনার একটি সুন্দর কাহিনী। আমি লক্ষ্য করেছি মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের পরপরই পাকিস্তানী সৈন্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠতো। বাংলাদেশের ভেতর মুক্তি বাহিনী তাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে এই ধারণা তারা স্থানীয় জনসাধারণকে দিতে চাইত না। তারা সবসময় এ কথা প্রমাণ করতে চাইত যে, তারা অসীম শক্তির অধিকারী এবং পাকিস্তানকে তারা টিকিয়ে রাখবেই। তাদের এই মানসিকতার জন্য আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এবার তারা আমাদের ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীর গ্রাম অবস্থানগুলোয় আক্রমণ করবে। ৭ তারিখ দুপুর থেকে আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কটি ব্যবহারের অবাধ সুযোগ দিই। এসময় তারা কামালপুরে অবস্থানরত ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের সরিয়ে নতুন সৈন্য নিয়ে আসে। আমিও তাই চেয়েছিলাম। ৮ তারিখ বিকাল বেলা মেজর জিয়াউর রহমানের ব্রিগেডিয়ার প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী মহেন্দ্রগঞ্জে নিয়ে আসি। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। ৯ তারিখ ভোর বেলা মেজর জিয়াউদ্দিনকে আমি ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীর গ্রামের অবস্থানে যাই। কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের হয়ে এসে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঘাসীর গ্রামের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাবে বলে আমি ধারণা করি। এই অবস্থানকে মজবুত করার জন্যই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটিকে সেখানে রক্ষা ব্যুহ তৈরী করার নির্দেশ দেই। কোম্পানী কমাণ্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী (বর্তমানে মেজর ও প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক)। ৯ ও ১০ তারিখ রাতে কোম্পানীটি নিজ অবস্থান নেয়। সে রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কে এন্টি ট্যাংক ও এন্টি পার্সোনাল মাইন স্থাপন করে। সে সময় থেকে তারা ছোট ছোট দলে সড়কটির পাশে পেট্রোলিংও শুরু করে দেয়। কামালপুরের পূর্ব পাশেও একটি মুক্তিবাহিনী কোম্পানী নিয়োজিত করা হয়। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় বকশীগঞ্জ থেকে কোন সাহায্যকারী দল আসলে তাদের বাধা দেয় এবং কামালপুর থেকে যদি কোন সৈন্য বের হয়ে যায় তাদের হত্যা করা।
১০ তারিখ ভোর বেলা থেকেই আমরা কামালপুর ঘাঁটিকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে ফেলি। সরবরাহ বন্ধ, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ, শত্রু জন্য কেবল দুটি পথ খোলা রয়েছে- হয় রাতের অন্ধকারে ছোট ছোট দলে পলায়ন করা অথবা একত্রিতভাবে আমাদের অবস্থানে আক্রমণ করা। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই ঘটবে বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। এই আক্রমণ আসবে ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর রাতে। ১০ তারিখ ভোর বেলা আমি ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী রক্ষা ব্যুহ করি। রাতারাতি বেশ কতকগুলো বাংকার তৈরী করে তাদের অবস্থানকে মজবুত করে তুলেছে। তাদের অবস্থানের সামনে থেকেই জলোমাঠটির শুরু। পানির গভীরতা এক ফুট থেকে তিন ফুট। শত্রু একশত গজের মধ্যে আসলে গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি স্থির নিশ্চিত ছিলাম যে এবার আমরা বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্য নিধন করতে সক্ষম হবো। এর সাথে সাথে কামালপুর ঘাঁটিও আমাদের দখলে আসতে পারে। শত্রুসৈন্যরা কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের হয়ে এসে যখন আক্রমণ চালাবে, তখন সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক পরিত্যক্ত কামালপুর ঘাঁটিটি দখলের জন্য বেশি কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার প্রয়োজন হবে।
এজন্য আমি এক কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধাকে মহেন্দ্রগঞ্জে ক্যাম্পে তৈরী হওয়ার নির্দেশ দিই। নিরাপত্তার খাতিরে এই কোম্পানীকে কি কাজ করতে হবে তা জানতে দিইনি। সে সময় সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর লোক। নিরাপত্তা বজায় রাখা তখন একটি দুরূহ ব্যাপার।
সন্ধ্যার পূর্বে কোন আক্রমণ পরিচালিত হবে না বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। আরও বেশ কয়েক ঘন্টা সময় হাতে রয়েছে। তাই দুপুর বেলা মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে মানকার চর সাবসেক্টরের দিকে রওনা হয়ে যাই- অপর একটি মুক্তিবাহিনী দলকে তাদের অভিযান সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়ার জন্য। মানকার চরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আমি খবর পাই যে, ধানুয়া ও ঘাসী গ্রামে আমাদের অবস্থানগুলো পাকিস্তানীরা আক্রমণ করছে। এ খবর পেয়েই আমি মহেন্দ্রগঞ্জ ফিরে আসি। বেলা তখন সাড়ে চারটা। ক্যাম্পে পৌঁছে যে কোম্পানীটিকে তৈরী থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম তাদের খোঁজ করি। আমার অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানী আক্রমণের খবর পেয়ে এই কোম্পানীটিকে আমাদের অবস্থানগুলোর সুদৃঢ় করার জন্য প্রেরণ করা হয়। কোম্পানীটিকে এভাবে পাঠাবার ফলে আমার পরিকল্পনার আংশিক বানচাল হয়ে যায়। সেই সময় কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কামালপুর ঘাঁটিটি আক্রমণ করলে তা সহজেই দখল করা যেতো।
কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণের কোন উপায় না দেখে আমি ধানুয়া কামালপুরের দিকে রওনা হয়ে যাই। পথে দেখি ছোট ছোট দলে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের দিকে ফিরে আসছে। তাদেরকে পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি ঘাসীর গ্রামে পৌঁছি। তখন প্রায় সন্ধ্যা। পৌঁছে দেখি বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটি বিশৃঙ্খলভাবে তাদের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী একজন সঙ্গীসহ তখনও সেখানে রয়ে গেছেন। জলোমাঠটির মাঝামাঝি জায়গা থেকে তখনও পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের নিহত ও আহত সৈন্যদেরকে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। ধানুয়া কামালপুরের অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধারা তখনও অটুট রয়েছে।
সেদিন বেলা আড়াইটার সময় আমার মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পরপরই কামালপুর থেকে আনুমানিক দুই কোম্পানী সৈন্য আক্রমণ ধারা রচনা করে ঘাসীর গ্রামের দিকে এগোতে থাকে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে শত্রু আসার পূর্বেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা এই গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে নানা যুদ্ধাস্ত্র সহকারে বেপরোয়া ভাবে এগোতে থাকে। তাদের পালটা গুলিতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নায়েক সুবেদার ও অপর একজন জোয়ান নিহত হন। সে সময় পেছন দিকে কেউ চিৎকার করে বলে যে, বকশীগঞ্জ থেকেও সৈন্যদল তাদের আক্রমণ করতে আসছে। এতে কোম্পানীটিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং তারা নিজ স্থান ছেড়ে পলায়ন করে। এসময় ধানুয়া কামালপুরের দক্ষিণ দিকে ছিল আমাদের একটি এল-এম-জি। এই এল-এম-জি’র কোনাকুনি গোলা বর্ষণে বহুসংখ্যক আক্রমণরত পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এবং শেষ পর্যায়ে তারা হটতে বাধ্য হয়। যে মুক্তিযোদ্ধা এল-এম-জি চালাচ্ছিল, উত্তেজনা বশত সে এল-এম-জি’র ব্যারেলটি বাম হাতে চেপে ধরে রাখে। এতে তার হাতের তালু সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যায়। বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হত্যা এবং আক্রমণকারী বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব তারই। সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে আমি নির্দেশ দিই তার কোম্পানীটিকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। রাত ন’টার সময় বোঝা গেল কোম্পানীটির মনোবল ভেঙ্গে গেছে। তাই তাদের ঘাসীর গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাদের জায়গায় পাঠানো হল আর একটি মুক্তিবাহিনী কোম্পানী। এই অভিযানটিতে যদিও আমাদের অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে তথাপি পরিকল্পনার দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। এই অভিযানকে একটি সুপরিকল্পিত এ্যামবুশও বলা চলে। শত্রুকে প্রলুব্ধ করে জলোমাঠটিতে এনে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে আমরা সমর্থ হয়েছিলাম। এই অভিযানটির পর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও আত্মনির্ভরতা বহুগুণ বেড়ে যায়। হত্যা কথাটি আমি বারবার করেছি। অবশ্য নিয়মিত যুদ্ধে এই শব্দটির বিশেষ ব্যবহার নেই। শত্রুকে পরাজিত করাই মূল উদ্দেশ্য। গেরিলা যুদ্ধে চিহ্নিত শত্রু মানবিক প্রশ্নে বড় অপরাধী। হত্যাই তার যোগ্য শাস্তি।