You dont have javascript enabled! Please enable it!

“চিলমারীঃ যুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিস্ময়”

বিশাল ব্রহ্মপুত্রের অপর তীরে অবস্থিত চিলমারীর দুর্ভেদ্য শত্রু ব্যুহে এক প্রচণ্ড হানা দিয়ে আমরা শত্রুর বিপুল ক্ষতিসাধন করি। এই আক্রমণের মুক্তি বাহিনীর মূল আক্রমণ ভেবে সে এলাকায় বৃহৎ আকারের শত্রু সমাবেশ ঘটে। এধরণের আক্রমণকে শুধুমাত্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মিত্র বাহিনীর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমণের কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। এক্ষেত্রে সুশিক্ষিত কয়েক ডিভিশন ছাত্রীসেনা এবং স্পেশাল ফোর্স অংশগ্রহণ করেছিলেন।

যুদ্ধের ইতিহাসে চিলমারী বন্দর আক্রমণ একটি উজ্জ্বল ঘটনা। এই যুদ্ধ বাংলার সোনার ছেলেদের নিয়ে গঠিত আমার সেক্টরের প্রাইভেট আর্মি দ্বারা সংঘটিত হয়।

রৌমারীর মুক্তাঞ্চলে মাত্র ১৫ দিনের অনুশীলণপ্রাপ্ত এ সমস্ত ছেলের নিয়মিত খাবারের সরবরাহ ছিল না, হাতখরচ ব্যবস্থা ছিল না এবং শুধুমাত্র দখলীকৃত অস্ত্রের উপরই তাদের নির্ভর করতে হত। কোন অনুমোদিত ট্রেনিং ক্যাম্পে অনুশীলনপ্রাপ্ত না হওয়া এ সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা সেক্টর কমাণ্ডারের প্রাইভেট আর্মি হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের চিলমারী আক্রমণ পরিকল্পনায় দক্ষতা এবং সাহস ও নৈপুণ্যের সাথে তার বাস্তবায়নের বিষয় যুদ্ধ বিদ্যার ছাত্রদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে।

১১নং সেক্টরের সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে যখন আমি দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন বেশ অনেকগুলো চরের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল রৌমারী এলাকা মুক্ত ছিল। এর প্রতিরক্ষা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ মুজিবনগর থেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে আমরা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। মেজর জিয়ার (বর্তমান মেজর জেনারেল) ব্রিগেডে দুটো বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই মুক্তাঞ্চল প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। শুধুমাত্র কোদালকাঠী চর ছাড়া ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপারের সকল এলাকা মুক্ত ছিল। কোদালকাঠীতে শত্রু সৈন্যের অবস্থান স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সকল শত্রু সৈন্য প্রায়ই পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাতো।

ব্রহ্মপুত্রের পূর্বাঞ্চলকে সম্পূর্ণ শত্রু মুক্ত করার জন্য সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে দুই কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকের এক রাতে গোপনে কোদালকাঠীতে অনুপ্রবেশ করে এবং শত্রু ব্যুহের মাত্র কয়েকশত গজ দূরবর্তী ঝাউ বনে ট্রেঞ্চ খনন করে তাতে অবস্থান করতে থাকে। মুক্তি যোদ্ধাদের পরিখাগুলোর সামনেই শত্রু নিধনের উপযোগী বিস্তৃত খোলা জায়গা ছিল। আমাদের কৌশলের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিখাগুলোতে উপস্থিতি টের পেয়ে যখন শত্রু সৈন্য তাদেরকে উৎখাত করার জন্য আক্রমণ চালাবে, তখন আক্রমণোদ্যত শত্রুসেনাদেরকে খোলা জায়গায় পেয়ে আমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করবো।

পরের দিন ভোরে আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণ ঘটে এবং ত্বরিত গতিতে প্রতিহত করা হয়। শীঘ্রই সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় এবং তারপর তৃতীয় আক্রমণ ঘটে- সেগুলোও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা হয়। নিধন এলাকা শত্রুসৈন্যের মৃত দেহ ভড়ে ওঠে। যে কজন শত্রুসৈন্য পরিখা পর্যন্ত এগুতে পেরেছিল তাদের বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। আমাদের অবস্থানের দু’প্রান্তে স্থাপিত মেশিনগান দুটি সেদিন আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। মেশিনগান দুটি আড়াআড়ি গুলিবর্ষণে বেশির ভাগ শত্রুসৈন্য মারা পড়েছিল তৃতীয় আক্রমণে প্রতিহত কারার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিখা থেকে বেরিয়ে আসে এবং শত্রুদের উপর মরণ আঘাত হানার জন্য এগিয়ে যায়। খুব অল্পসংখ্যক শত্রুসৈন্য অপেক্ষমান গানবোট পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
কোদালকাঠী আমাদের হস্তগত হলো। গ্রামবাসীদের মধ্যে দারুণ উল্লাসের সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও দক্ষতার উপর তাদের আস্থা বহুলাংশে বেড়ে যায়। যদিও তাদের সামর্থ্য ছিল সামান্য। তবু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তারা রান্না করা খাবার এবং মিষ্টান্ন নিয়ে আসেন।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মেজর জিয়া তার ব্রিগেড নিয়ে সিলেটের পথে ১১নং সেক্টর ত্যাগ করেন। সেদিন আমরা সবাই বিষন্ন বোধ করেছিলাম। সে সময় আমরা জামালপুর এবং টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার পথে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। শুধু যে আমাদের রণনীতি পাল্টাতে হলো তা নয়, রৌমারীর বিরাট মুক্তাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব আমাকে বিচলিত করে তুলল। আমার সেক্টরে কোন নিয়মিত বাহিনী রইলনা। আমাকে রৌমারীতে ১৫ দিনের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছেলেদের উপর নির্ভর করতে হলো। এদের মধ্যে শতকরা মাত্র ২৫ জন অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। রৌমারীর প্রতিরক্ষার কাজে ভারতীয় বাহিনী পাঠাবার প্রস্তাব করেছিলেন ভারতীয় কমাণ্ডার। তার সে প্রস্তাব আমি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করি। বাংলার মাটি রক্ষা করবে বাংলার বীর ছেলেরাই- রৌমারীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ আবার ঢেলে সাজাতে হবে। নেতৃত্বের পুরো ভার পড়ল সুবেদার আফতাবের উপর। চওড়া কাঁধ আর লম্বা কোঁকড়ানো চুলের অধিকারী এই নির্ভীক জে-সি-ও সব সময়ই বীরত্ব এবং দৃঢ়তার প্রতীক ছিল। আমি যখন পুরো পরিস্থিতি তাকে বুঝিয়ে বললাম সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করল এবং বলল স্যার, পাকিস্তানীরা শুধুমাত্র সুবেদার আফতাবের মৃত দেহের উপর দিয়েই রৌমারীতে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু জেনে রাখবেন সুবেদার আফতাব মরবে না। এই বিপ্লবী নেতার মনোবল যে কত উপরে ছিল তা এই উক্তি থেকে বোঝা যায়। তখন থেকেই পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময় দক্ষ সৈনিক, অস্ত্র এবং গোলা বারুদের অভাব পূরণের জন্য আমাকে যুদ্ধে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানীরা চিলমারী বন্দর থেকে গানবোটের সাহায্যে রৌমারীর মুক্ত অঞ্চলে প্রায়ই থাবা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু শত্রুরা কোন সময়ই সদা জাগ্রত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। রৌমারীর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রে সজ্জিত করাটা আমাদের আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। এবং আমি সব সময় চাইতাম তারা শত্রুঅস্ত্রে সজ্জিত হোক এবং অস্ত্র দখলের জন্য আমার চিলমারী বন্দরকে বেছে নিলাম।

চিলমারী আক্রমণের পেছনে আরো কারণ ছিল। নেতা আবুল কাশেম এবং তার সহযোগীদের নেতৃত্বে সেখানে বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল। চিলমারীতে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর আঘাত হানাটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল, তা যতই বিপদজনক হোক না কেন। এভাবে চিলমারী আক্রমণের পরিকল্পনা রূপ পেলো।
ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে অবস্থিত চিলমারী একটি নদী বন্দর। চিলমারীর কয়েক মাইল দক্ষিণে তিস্তা নদী ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। নদীপথ ছাড়াও চিলমারী রেল ও সড়ক দ্বারা যুক্ত। চিলমারীতে পাকবাহিনীর যাতায়াতের জন্য রেল এবং নদীপথ উন্মুক্ত ছিল। আমার অক্লান্ত গোয়েন্দা অফিসার ওয়ারেন্ট অফিসার শফিউল্লা শত্রু সম্পর্কীয় খবরাখবর সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি শত্রুসৈন্যের সঠিক অবস্থানসহ চিলমারীর বিস্তারিত এবং হুবহু মাটির নকশা তৈরী করে ফেললেন। চিলমারীতে তখন পাকবাহিনীর দুই কোম্পানী নিয়মিত সৈন্য এবং দুই কোম্পানী মিলিশিয়া অবস্থান করছিল। তারা চিলমারীর ওয়াপদা ভবন, জোরগাছ, রাজভিটা, থানাহাট পুলিশ স্টেশন, বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশন এবং পুলিশ স্টেশন সংলগ্ন রেলওয়ে ব্রীজে মোতায়েন ছিল। তাদের সাথে ছিল কুখ্যাত ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বড় আকারের এক রাজাকার বাহিনী।

শত্রুকে প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য আমাদের দরকার ছিল একই সময়ে বিভিন্ন শত্রুসৈন্যদের আক্রমণ করা এবং স্ব অবস্থানে তাদের আটকে রাখা যাতে করে তাদের একে অপরের সাহায্যে বিশেষ করে চিলমারীতে সাহায্যকারী শত্রুসেনা এগিয়ে আসতে না পারে। সেজন্য চিলমারীর বেশ পেছনে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য একটি দল পাঠানোর প্রয়োজন ছিল। এ অভিযানের সাফল্যের চাবিকাঠি নিহিত ছিল শত্রুর অজ্ঞাতে অতর্কিত আক্রমণের উপর। এক বিরাট বাহিনীর পক্ষে সকলের অগোচরে প্রায় ৩২ মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দেয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এছাড়া মূল আক্রমণকে সমর্থন দেওয়ার জন্য যে চারটি দুরপাল্লার কামান আমাদের কাছে সেগুলো নিকটবর্তী এক চরে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। শত্রু সম্পর্কে বিভিন্ন খবর সংগৃহীত হল। প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন হল। বিভিন্ন অবস্থানের শত্রুদের উপর একই সাথে আঘাত হানার জন্য বিভিন্ন সময়সূচী আমরা পুংখানুপুংখভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম। এই অভিযান বিফল হয়ে যাওয়ার একমাত্র সম্ভাবনা ছিল, সেটে হচ্ছে যদি কোন অতিউৎসাহী মুক্তিযোদ্ধা আক্রমণ মুহূর্তের পূর্বেই উত্তেজনা বশতঃ কিছু করে বসে।

অক্টোবরের ৯ তারিখে সড়ক এবং রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি প্রত্যেকের নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশ নিয়ে সন্ধ্যার পর রওনা হলো। গোপন ও অতি সন্তর্পণে এই দলটিকে উলিপুর এবং চিলমারীর মাঝামাঝি স্থানে ঘাঁটি স্থাপন করে মূল আক্রমণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকতে হবে। ১১ই অক্টোবর মূল বাহিনী চিলমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অনেকগুলো বেশি নৌকা তাদের বহন করে এগিয়ে চলল। একসাথে এতগুলো দেশী নৌকার ব্যবস্থা করা ও তাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে গোপনে একই সময় শত্রুঘাঁটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সে সময়ে বড় কঠিন ব্যাপার ছিল। কমাণ্ডার আবুল কাশেম চাঁদ, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ ব্যাপারে এগিয়ে এলো আর সমস্ত ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করল। রাতের অন্ধকারে দুরপাল্লার কামানগুলো চালিয়াপাড়ায় স্থাপন করা হলো। এই ভারী অস্ত্রগুলোকে নৌকা থেকে নামিয়ে বালুচরের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে স্থাপন করা যে কি বিপজ্জনক এবং কঠিন ছিল তা লিখে বুঝানো যাবে না।

স্বাধীনতা যুদ্ধের আর এক অসম সাহসী সৈনিক নায়েব সুবেদার মান্নান। তার উপর ন্যস্ত ছিল ওয়াপদা ভবন ধ্বংস করার দায়িত্ব। ওখানে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রমোদ বিলাসে মত্ত থাকতো। আমরা মাত্র দুটি রকেট লাঞ্চার তার দলকে দিতে পেরেছিলাম। কমাণ্ডার চাঁদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দল গোরগাছা, রাজভিটা, তানাহাট পুলিশ স্টেশন এবং ব্রীজ অবস্থান আক্রমণের জন্য নির্দিষ্ট হলো। এদের অর্ধেকের সাথে ছিল ৩০৩ রাইফেল, কিছু পুরোনো স্টেনগান আর বাকিদের কাছে শুধুমাত্র গ্রেনেড। মূল বাহিনীর এই ছোট ছোট দলগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছিল খালেদ দুল, সুলায়মান, নূর আহম্মেদ আলো, আর নজরুল। বলবাড়ি পুলিশ স্টেশনের জন্য কোন দল পাঠানো হয়নি, কারণ আমাদের জানা ছিল শত্রুসেনারা রাতে সে অবস্থান ছেড়ে চলে আসতো। আক্রমণ পরিচালনার জন্য চালিয়াপাড়া আমি আমার হেড কোয়ার্টার স্থাপন করলাম। চিলমারীর দুই মাইল দক্ষিণে গাজীর চরকে আক্রমণকারী বাহিনীর আক্রমণের পূর্ব মুহূর্তের ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয়া হল।

গভীর রাত। ১টার সময় খবর এলো আমাদের সম্পূর্ণ বাহিনী আক্রমণস্থলের নিকটবর্তী ঘাঁটিতে পৌঁছে গেছে এবং যার যার নির্দিষ্ট আক্রমণস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্রাউন্ড সিট বিছিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম এবং সাড়ে তিনটায় আমাকে জানানো হল কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাহিনী শত্রুসেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। নানা ভাবনা সেই স্বল্প সময়টুকুতে আমার মনে ভীড় জমালো। হাতিয়ারের অভাব, অল্পবয়সী ছেলেরা- এরা কি পারবে এই বিরাট আক্রমণে সাফল্য লাভ করতে? কি হবে ওখানকার জনসাধারণের, যখন আমরা চিলমারী ছেড়ে চলে আসবো। রাতে খুব কাছে থেকে রকেট লাঞ্চার দিয়ে ওয়াপদা ভবনের উপর আঘাত হানার সাথে সাথে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হলো। সমস্ত শত্রুঘাটিতে ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এলো। দূরপাল্লার কামান গুলো শত্রুসেনাদের গানবোটগুলোর সম্ভাব্য অবস্থানের উপর গোলা বর্ষণ করে চলেছে। কামানের গোলা গ্রেনেড, মেশিনগান আর ছোট অস্ত্রের আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে যেতে লাগলো। সকাল ৬টার মধ্যেই গোরগাছা, রাজভিটা, পুলিশ স্টেশন ও ব্রীজের অবস্থানগুলো আমাদের আয়ত্তে আসল, কিন্তু ওয়াপদা ভবনের আশেপাশের চলাচল আমাদের নজরে পড়ল। আমাদের একমাত্র নির্ভর রকেট লাঞ্চার দুটি শত্রু বাংকারগুলিকে নির্মূল করতে পারল না বটে, তবে ওয়াপদা ভবনে অবস্থানরত প্রচুর শত্রুসেনা খতম করতে সক্ষম হলো। শুধুমাত্র এ দুটি অস্ত্রের উপর নির্ভর করায় আমরা শত্রুর এই অবস্থানটি দখল করতে সক্ষম হলাম না। যেহেতু সম্পূর্ণভাবে শত্রুকে আঁকড়ে থাকতে হলো। কারণ একমাত্র রাতের অন্ধকারেই সফল পশ্চাদপসারণ সম্ভব। সকাল ৮টা। আমার কাছে খবর এলো চাঁদ আরো সাহায্য চাচ্ছে। মনে হলো অবস্থা সংকটজনক। সে লক্ষ করছে বলবাড়ি রেল স্টেশন থেকে শত্রুসেনারা নতুন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার ছোট্ট স্পীড বোটটি নিয়ে নদী পার হয়ে চালিয়াপাড়া থেকে গাজীর চরে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ বন্দীদের কাছ থেকে খবর বার করার চেষ্টা করছেন। তার ব্যবস্থাপনা মন্দ ছিল না। যাওয়ার সাথে সাথে এক মগ গরম চা পেলাম। আরও জানলাম চাঁদকে সাহায্য করার মত কোন বাড়তি দল রাখা হয়নি। তৎক্ষণাৎ আমি আমার ছোট্ট রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে থানা অভিমুখে এগিয়ে গেলাম। ভাগ্যক্রমে আমাদের একটি এল-এম-জি ছিল। এই অস্ত্রটি সেদিন আমাদের ভীষণ উপকারে আসে। নানা দিক থেকে মাঝে মধ্যেই গোলাগুলি চলছিল। গ্রামবাসীরা যে যেদিকে পারছিল দৌড়াচ্ছিল। কেউ কেউ জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চিৎকার করেছিল। থানার এক মাইলের মধ্যে চলে এসেছি, এমন সময় একটি ফেলে যাওয়া গরুর গাড়ি রাস্তার মাঝখানে পেলাম। গাড়িতে শুয়ে ছিল একজন মেয়েলোক। একটি হাত ভাঙ্গা, বুকের স্তন নেই। পাকিস্তানী মর্টার শেলের শিকার। তার বাচ্চা ছেলেটি মায়ের রক্তে মাখা। বসে বসে কাঁদছে। এই নিষ্পাপ শিশুটি মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। একজন গ্রামবাসীকে ডেকে জানলাম মেয়েটিকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল। থানার পাশেই হাসপাতাল। তার মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। আর ঐ দিক থেকেই গুলি আসছে। তাই মাকে ছেড়ে সবাই পালিয়েছে। আমি লোকটিকে গাড়ি চালিয়ে আমার সাথে আসতে বললাম। আমার সাথে থাকায় সে সাহস ফিরে পেলো। হাসপাতালে যখন পৌঁছলাম গুলি বর্ষণ তখন আরো তীব্রতর হয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি হাসপাতালের দেয়ালে আঘাত হানছে। ভাগ্যক্রমে হাসপাতালের ভেতর ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ডাক্তারকে পেলাম। আমি সেই হতভাগ্য মেয়েলোকটির ভার ডাক্তারের উপর ছেড়ে দিলাম,- জানি না আজ সে বেঁচে আছে কিনা। হাসপাতাল বের হয়েই দেখি চাঁদ দৌড়ে আসছে আমার দিকে। সে কাঁদছিল। আমাকে জানাল, তার দলের ছেলেরা ৭৬টি দখল করা অস্ত্র এবং প্রচুর গোলা বারুদ ফেলে থানার অবস্থান ছেড়ে চলে এসেছে। থাকে উৎসাহ দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম পূর্ব অবস্থান পূণঃদখলের জন্য। মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি আমাদের উপর দিয়ে চলে গেল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় ১০০ গজ দূরে রেল লাইনের উপর অবস্থান নিয়েছে। বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে আমরা এগিয়ে এবং শত্রু বাহিনীর একপাশে আমার রক্ষাকারী বাহিনীর এল-এম-জি টি স্থাপন করলাম। একনাগাড়ে গুলি করার পর কিছু পাকিস্তানী সেনা পড়ে গেল। বাকিরা তাদের অবস্থান ছেড়ে রেল লাইনের উপরে চলে গেল। ত্বরিত গতিতে আমরা রেল লাইন দখল করলাম। গুলি চালিয়ে আরো কিছু পলায়নপর পাকিস্তানী সৈন্য খতম হলো। কিছুক্ষণ পরই বলবাড়ি স্টেশনের অবস্থান থেকে শত্রুসৈন্যরা আমাদের উপর গুলি চালাল। আমরা পিছু হটে পুলিশ স্টেশনে অবস্থান নিলাম। সেখানে পাকিস্তানীদের তৈরী পরিখার অভাব ছিল না। দখল করা অস্ত্র এবং গোলা বারুদ গাজীরচরে পাঠানো হলো একটি ঘরে আমি দশ বস্তা চাল ও দুই বস্তা গম পেলাম। চেয়েছিলাম এগুলো গ্রামবাসীরা নিয়ে যাক, কিন্তু নেয়ার মত কেউ সেখানে ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি একজন বুড়ো লোককে পেলাম। আমি তাকে দরকার থাকলে কিছু চাল নিতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক থেকে লোকজন আসতে লাগলো। মনে হচ্ছিল তারা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হচ্ছে। হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। ছেলে, বুড়ো, পুরুষ, মেয়েলোক সবাই কাড়াকাড়ি করছে যা পাচ্ছে তুলে নেয়ার জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা ও থানার পাশের পুলিশের বাসাগুলো খালি হয়ে গেলো সে দৃশ্য ভোলার নয়।

রাতের অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে আমি কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রেখে প্রধান দলটি নিয়ে গাজীরচরে চলে এলাম। কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রেখে আসার উদ্দেশ্য ছিল যাতে পাকিস্তানীরা আমাদের পিছু নিতে না পারে। যদিও আমরা ওয়াপদা ভবনের বাংকারগুলো এবং বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারিনি, তবুও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অতি নিকট থেকে সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও হয়েও শত্রুসৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেনি। সত্যি তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল। আমরা জানতাম আমাদের চলে আসার পর ঐ এলাকার জনসাধারণের উপর পাকিস্তানীরা কি ভয়াবহ অত্যাচার চালাবে! কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। এই আক্রমণের উদ্দেশ্যই ছিল শত্রুকে অকস্মাত আঘাত হানা, যত বেশী সম্ভব শত্রুসেনা খতম করা, তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া, অস্ত্র ও গোলা বারুদ দখল করা। আমরা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলাম।

আমরা চলে আসার দু’দিন পর পাকিস্তানীরা ঐ এলাকার নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। নিরস্ত্র জাতি এমনভাবে অত্যাচার সহ্য করেই বাংলার স্বাধীনতা এনেছে।

ওয়ারেন্ট অফিসার শফিউল্লার নেতৃত্বে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। তারা শুধু সড়ক ও রেল পথের ব্রীজগুলো ভেঙ্গে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, জায়গায় জায়গায় রেলওয়ে লাইন এবং রাস্তা কেটে তারা সমান করে দেয়। বেশ কিছুদিনের জন্য এই যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকিস্তানীরা ব্যবহার করতে পারেনি।

১৩ই অক্টোবর। বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্ধী এবং প্রচুর অস্ত্র, গোলা বারুদ নিয়ে আমরা রৌমারী ফিরে এলাম। জনগণের আদালতে ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার বিচার হলো। দেশপ্রেমিক হত্যা, রাজাকার বাহিনী সংগঠন এবং লুন্ঠনের অপরাধে তারা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাদের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল। বহুসংখ্যক বাঙ্গালী রাজাকার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। ওয়ারেন্ট অফিসার শফিউল্লা, নায়েব সুবেদার মান্নান, চাঁদ, দুলু, আলো সুলেমান, নজরুল এবং আরো অনেকের বীরত্ব এবং ত্যাগের কথা কোনদিনই ভোলা যাবে না। এরাই বাংলার সোনার ছেলে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!