সাক্ষাৎকারঃ ক্যাপ্টেন (অবঃ) নূরুল হুদা
মেজর জলিলকে ৯ নং সেক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে পাক ঘাটিঁ শ্রীপুর, বসন্তপুর এবং কৈখালি দখলের জন্য তার বিপরতে টাকী, হিঙ্গলগঞ্জ এবং শমসের নগর মুক্তিবাহিনীর ঘাটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিলেন। তিনি প্রথমে টাকীতে হেডকোয়ার্টর স্থাপন করে পরে হিঙ্গলগঞ্জে আমার নেতৃত্বাধীন প্রথম বেইস ক্যাম্প স্থাপন করেন। পাকসেনাদের শক্ত ঘাঁটি ছিলো শংকরা শ্রীপুরা, দেবহাটা, খানজী, উকসা এবং কৈখালী। আমি বসন্তপুর পাক ঘাটিঁ আক্রমণ সিদ্ধান্ত নিই। একই সময়ে টাকী বেইস থেকে শ্রীপুর পাক ঘাঁটির অক্রমণে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হাবিলদার সোবহান ইছামতি পেরিয়ে ‘রকী’ করে সকল তথ্য সংগ্রহ করলেন।
১২/১৩ জুন রাতে আমি মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাতুন নিয়ে পাক ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হই। অপরদিকে ইছামতী পেরিয়ে হাবিলদার সোবাহান এবং শাজাহানের নেতৃত্বে একটি করে প্লাটুন শ্রীপুর পাক ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের এই দুটো দলই রাত ১২ টার পর অকস্মাৎ পাক ঘাঁটি আক্রমণ করে বসে। পাকসেনারা এই আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। তারা ভাবতেও পারেনি, এই দুর্যোগের রাতে প্রমত্তা ইছামতি নদী পেরিয়ে আমরা তাদেরকে আক্রমণ করতে পারি। আমাদের তীব্র আক্রমনের মুখে পাকিস্তানীরা চরমভাবে মার খায়। সংঘর্সে ২০ জন পাকসেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। আমরা ৫০ টি রাইফেল, দুটি এল-এ-জি, এবং বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করি। অপরদিকে জনাব শাজাহানের নেতৃত্বে শ্রীপুরেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমন সফল হয়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা জানা না গেলেও মুক্তিবাহিনী ৩৫ টি রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করে। দুটি অপারেশনে কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আমরা ভোরবেলা মূল ঘাঁটিতে ফেরন্ত আসি।
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি মুক্তিবাহিনীর ১৬০ জন লোক নিয়ে পাক ঘাঁটি খাঞ্জি বি-ওপি, আক্রমণ করি। রাত ১০ টায় আমি আমার বাহিনী নিয়ে লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হই। আমার বাহিনীকে তিনটি কলামে বিভক্ত করি। ডান দিকে এটি কলাম নিয়ে আমি নিজে রইলাম। বামদিকে কলামাটিতে লেঃ বেগ এবং হাবিলদার সোবাহান রইলেন। অপর কলামটি ‘ কাটআফ’ পার্টি হিসেবে থাকলো। বি-ও-পিতে পাকসেনাদের শক্তি ছিল দুই প্লাটুন। আমাদের তিনটি কলামাটি যথাযথ স্থানে পৌঁছে গেলো। প্রথমে নায়েক সুবেদার গুফর ৩” মর্টারের সাহায্যে পকিস্তানী অবস্থানের উপর গোলা নিক্ষেপ করা শুরু করেন। উভয় পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষ ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। আমাদের তীব্র আক্রমণের মুখে পাকসেনা পালিয়ে সাতক্ষীরা এবং দেবহাটার মধ্যস্থলে পারুলিয়া নামক স্থানে আশ্রয় নেয়। আহত অবস্থায় ৪ জন পাকসেনা বন্দি হয়। নিহতে সংখ্যা সঠিক জানা যায়নি। আমরা পাকসেনাদের কাছ থেকে ২”মর্টার, এস-এম-জি, ৭৬২ চায়নিজ রাইফেল এবং বেশকিছু গোলাবারুদ ও রেশন- সামগ্রী উদ্ধার করি। এই বিজয় মুক্তিবাহিনী সদস্যদের মনোবল বহু গুণে বৃদ্ধি পায়।
আমি হিঙ্গলগঞ্জে ঘাঁটি স্থানের কিছুদিনের মধ্যে উকসা পর্যন্ত আমার ঘাঁটি বিস্তৃত করি। আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাকসেনারা উকসা ঘাঁটি আক্রমণ করে। আমরাও প্রস্তুত ছিলাম। ফলে শেষ পর্যন্ত পাকসেনারা দারুণ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই অপারেশন সম্পর্কে বাংলার মুক্ত এলাকা থেকে প্রকাশি ‘বিপ্লবী বাংলাদেশে’ পত্রিকায় ‘উকসা- গোবিন্দপুরে নয় গোবিন্দপুর মুক্ত’ শিরোনাম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
২০ শে আগস্ট তারিখে আমি ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শ্যামনগরে আক্রমনের জন্যে অগ্রসর হই। লেঃ বেগ, সুবেদার ইলিয়াস, নায়েব সুবেদার গফুর, হাবিলদার সোবাহান আবদুল হক প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাগণও আমার সাথে ছিলেন। উকসা হেডকোয়ার্টার থেকে রওয়ানা হয়ে রাত দু’টায় আমরা শ্যামনগর শত্রুব্যূহের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। শ্যামনগর ওয়াপাদা কলোনীতে অবস্থানরত পাকসেনাদের একটি প্লাটুন ছিলো। পাকসেনা প্রতিরক্ষা অত্যন্ত সুদৃঢ়। আমি আমার বাহিনীকে তিনটি কলামে ভাগ করি এবং একটি কলামে আমি নিজে থাকি। সড়কের অপর পাশে একটি কলামের সঙ্গে রইলেন লেঃ বেগ। নায়েব সুবেদার আবদুল গফুর ও হাবিদার সোবাহান রইলেন অপর অলামে। আমাদের অস্ত্র ছিলো ৮ টি এল-এম-জি এস- জি ১২ টি, ২”মর্টার ৩টি এবং অবশিষ্ট এস-এল-আর ও রাইফেল।
রাত দুটোর পরই নায়েব সুবেদার গফুর ২” মর্টার নিয়ে প্রথম পাক অবস্থানের উপর আঘাত হানতে শুরু করেন। এদিকে পাকসোনাদের প্রচন্ড বাধা অতিক্রম করে আমি ও লেঃ বিগ কিছুতেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারছিলাম না। রাত ৪ টার দিকে কালিগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের আর একটি প্লাটুন নির্বিবাদে শ্যামনগর চলে আসে। উভয়পক্ষে প্রচন্ড সংঘর্ষ চলতে থাকে। দু’ পক্ষেরই মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সকাল ৯ টায় শ্যামনগর আমাদের নিয়ন্ত্রণের আসে। সংঘর্ষে ৪জন পাকসেনা নিহত এবং ৪ জন আহত অবস্থায় আমাদের হাতে বন্দী হয়। এই সংঘর্ষের পর শ্যামনগর থানা আমাদের নিয়ন্ত্রণে এলেও সুবেদার ইলিয়াসসহ ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা এই যুদ্ধে শহীদ হন এবং ৬ জনকে পাকসোনারা ধরে নিয়ে যায়। সকালে ২৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পন করে। আমরা শ্যামনগর থানায় স্বাধীন বায়লার পতাকা উত্তোলন করি। স্বাধীন বাংলা থেকে প্রকাশিত ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার ২১ আগস্ট ১৯৭১-এর সংখ্যা এ সম্পার্কিত সংবাদ পরিবেশ করা হয়েছিল।
ফ্রগম্যানের তৎপরতাঃ ৯নং সেক্টরের ফ্রগম্যানরা নদীপথে তৎপরতা চালিয়ে বেশ সাফল্য অর্জন করতে থাকে। এইসব দক্ষ ফ্রগম্যানরা ভারতীয় তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ফ্রগ্যম্যনদের ৩০ জনের একটি দলকে আসাদুল্লাহর নেতৃত্বে শমসেরনগর পাঠানো হয়। উক্ত দলটি মঙ্গল ও চালনা বন্দরে পাকিস্তানী বাণিজ্যিক নৌকা বাহিনীর উপর হামলা চালানোর জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অপর দল ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে ত্রিকোণ দ্বীপে যেখানে পাকিস্তানীদের গোপন ঘাঁটি আছে বলে মনে কার হচ্ছিলো সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিকূল আবহাওয়া এবং অন্যান্য বাস্তব অসুবিধার জন্যে ‘ত্রিকোণে দ্বীপে হামলা চালনো। এরপর সিদ্ধান্ত সম্ভব না হলেও, প্রথম দল চালানো এবং মঙ্গলাতে পরিকল্পনা অনুসারে সাফল্যের সাথে আক্রমণ চালায়। এরপর সিদ্ধান্ত হলো, ১৬ই সেপ্টেম্বর হামলা চালালো হবে। চালনা বন্দরে তখন ৮টি জাহজ এলোমেলোভাবে নোঙ্গর করা ছিল। এটি জাহজের জন্যে দু’জন করে ফ্রহম্যান নির্দিষ্ট করা হলো এবং চারটি করে মোট আটটি ‘লিম্পেট মাইন’ প্রতি দলে দেয়া হলো।
সেপ্টেম্বরের ১৫/১৭ তারিখ ২টা ৩০ মিনিটে ১৬ জন ফ্রগম্যান পশুর নদীতে নেমে পড়ে। ১৪ জন ফ্রগম্যানকে রির্জাভে রাখা হলো। রাত তখন ৪টা বেজে ৩০ মিনিট। দ্রুতগতিতে ১৬ জন ফ্রগম্যান ৮টি জাহজে ‘ লিম্পেট মাইন’ লাগিয়ে চলে আসে ভোর ৫ টা ভেজে ৩০ মিনিট চালনা বন্দর থেকে গগনিবিদারী আওয়াজ শোনা যায় অত্যন্ত সফল ঐ অভিযানে ৮টি জাহজের মধ্যে সেদিন ৭ টি জাহাজই ধ্বংস হয়েছিল।
১৬ই অক্টোবর নৌাবাহিনীর আলমের নেতৃত্বে চালনা বন্দর আর এক বড় রকমের অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে ফ্রগম্যানরা চারটি জাহাজ ধ্বংস করেছিলো। জাহাজ চারটির মধ্যে বিশেষ করে ‘লাইটনিং’ এবং ‘আল- মুরতজা’র ধ্বংসের কথা উল্লোখযোগ্য। এই অপারেশনে ফ্রগম্যান আনোয়ারের সাহসিকতা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
নৌবাহিনীর রহমতুল্লাহর নেতৃত্বে ফ্রগম্যান অপর দল নভেম্বর মাসেও অত্যন্ত সফল অভিযান চালায়। রহমতুল্লাহ নৌবাহিনীর একজন দক্ষণ অফিসার। তাঁর আত্মত্যাগ, সাহসিকতা, নিরলস নিষ্ঠা এ দেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
অক্টেরর মাসে ৯ নং সেক্টরের বেশ কয়েকটি তরুণ অফিসার যোগদান করেন। লেঃ মোহাম্মদ আলী লেঃ আহসান উল্লাহ এবং লেঃ শচীদ্রর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। অফিসার তিনজন আমার নেতৃত্বে কালিগঞ্জ, পারুলিয়া প্রভৃক্তি স্থানের অভিযানের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালনা করেন।
কালিগঞ্জ অপারেশনঃ নভেম্বরের ২০ তারিখে কালিগঞ্জে পাকবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয়। কালিগঞ্জ ওয়াপদা কলোনীতে পাকসেনাদের একটি কোম্পানী অবস্থান করছিলো। এছাড়া ছিলো পশ্চিমা রেঞ্জার এবং বেশ কিছু রাজাকার। আমি আমার বাহিনী নিয়ে হেডকোয়ার্টার ইকসা থেকে রওনা হয়ে লক্ষ্যস্থলের নিকট এসে পৌঁছি। এই সময়েএকটি কলাম নিয়ে লেঃ আহসান উল্লাহ এবং আয়েব সুবেদার সোবহান শত্রুঘাঁটির কাছাকাছি এসে পড়েন। সাথে ছিলো মাত্র দু’টি প্লাটুন। ২০/২১ শে নভেম্বর ভোর ৫ টায় আমরা পাকসেনাদের উপর হামল চালাই। মিত্রবাহিনীর ৩য় রাজপুত্র হিঙ্গলগঞ্জ থেকে আমাদেরকে আর্টিলারী সাপোর্ট দেয়। ভোর ৫ টা থেকে সকাল ৭টা পর্যস্ত উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। এই দু’ঘন্টা স্থায়ী সংঘর্ষে কোন পক্ষেরই কোন হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়নি। তবে প্রায় ৪০ জন পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। লেঃ আহসানউল্লাহ নিজেই ২২ জন পাকসেনাকে বন্দী করেন। নায়েব সুবেদার গফুর ও ৬ জন খানসেনাকে বন্দী করেন। কালিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়।