You dont have javascript enabled! Please enable it! সাক্ষাৎকারঃ তৌফিক এলাহী চৌধুরী | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

সাক্ষাৎকারঃ তৌফিক এলাহী চৌধুরী*

শেষবারের মত এপ্রিলের শেষে যশোরের বেনাপোল থেকে ভারতে পশ্চাদপসরণ করার সময় আমাদের দুঃখকষ্ট সীমাহীন ছিল।বর্ষার আগমনে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল এবং আমাদের সঙ্গীদের শোয়া দূরে থাক, মাথা গোঁজার ঠাইটুকুও ছিল না। অবিরাম বৃষ্টি, অর্ধাহার, অনাহার তার উপর আপাতদৃষ্টিতে পরাজয়ের গ্লানি মিলিয়ে আমরা অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এই রকম অবস্থায় বাংলার মাটিকে ছেড়ে বিদেশে বিতাড়িত হওয়া যে কি মানসিক যন্ত্রণা সেটা যারা কোনদিন এই রকম অবস্থায় পড়েনি তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের মানসপটে ভেসে উঠেছিল তাদের ফেলে আসা গ্রাম, ঘরবাড়ি, বাবা- মা- স্ত্রী-পুত্র পরিজন। তাদের কাছ থেকে কতদিনের বিদায় নিয়ে যাচ্ছিল তারা জানত না।এই বেদনাবিধুর বিদায়লগ্ন আমাদের কেউ কোনদিন ভুলাতে পারবে না।

এই সময়ে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা শুরু হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে কিছুদিন বিএসএফ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের রেশন, গোলাবারুদ এবং সরবরাহের দায়িত্ব নেন। খুব সম্ভবতঃ ১৮ বিএসএফ এর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেঈ সিং এর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯৬৫ সনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ‘বীরচক্র’ পাওয়া এই সামরিক অফিসারটি আমাদের এই চরম দুর্দিনে বাণী শুনিয়েছেন।এই সময় আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুনভাবে সংগঠন শুরু করি এবং সময়সূচি গ্রহণ করি। আমাদের সমস্ত ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের এবং প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের কয়েকটি কোম্পানীতে ভাগ করে দেয়া হয়।প্রায় ৩৫০ মাইল সীমান্তে(কুষ্টিয়ার উত্তর থেকে খুলনার দক্ষিণাংশে পর্যন্ত) আমাদের স্টাটেজিক দায়িত্ব ছিল কয়েকটিঃ

১। শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহগুলিতে শত্রুকে হয়রানি করা। ২। শত্রুর উপর অতর্কিত রেইড চালিয়ে কুষ্টিয়া জেলার উত্তর মাথা থেকে দক্ষিণে খুলনার সাতক্ষীরা- কলারোয়া রাস্তা অবধি কতগুলো বিশেষ সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মোতায়েন করা। এফ কোম্পানী কুষ্টিয়ার প্রাগপুর বিওপির বিপরীতে কমান্ডার প্রথমে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর এবং আমি।৩। শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিঘ্ন সৃষ্টি করা, ব্যহত করা এবং সম্ভব হলে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। ৪।শত্রুদের ছোট ছোট দলগুলোর উপর পেট্রল পার্টির অ্যামবুশ করা ইত্যাদি। মোটামুটিভাবে শত্রুর দুর্বল জায়গাগুলিতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সরে পড়াই আমাদের দায়িত্ব ছিল। যেসব জায়গায় সম্ভব হচ্ছিল আমরা বাংলাদেশের কিছু ভেতরে সামরিক প্রতিরক্ষাব্যূহও গড়ে তুলেছিলাম।

সি কোম্পানীঃ মেহেরপুর শহরের বিপরীতে কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।
বি কোম্পানীঃ দর্শনার বিপরীতে, কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান।
ডি কোম্পানীঃ চৌগাছার বিপরীতে, কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা।
এ কোম্পানী ছিল খুলনার ভোমরা বিওপির বিপরীতে,কমান্ডার ছিলেন প্রথমে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এবং পরে ক্যাপ্টেন মাহাবুব উদ্দিন আহমদ।

এইচ কোম্পানী ছিল বেনাপোলের বিপরীতে, প্রথমে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে আর কমান্ডার ছিলাম আমি নিজে। সর্ব দক্ষিণে জি কোম্পানী। সাতক্ষীরা- কলারোয়া রাস্তার বিপরীতে এই কোম্পানী মোতায়েন ছিল। কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। এই সময় আমাদের হেডকোয়াটারে মুন্সিগঞ্জের এসি এ ফ্লাইট লেঃ জামাল যোগ দেন।

এইরকম একটা সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যূহ, যেটা এ কোম্পানী ভোমরা বিওপির আশেপাশে গড়ে তুলেছিল, তার উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল ৩০শে মে তারিখে। প্রায় ১৭ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার গোলন্দাজ বাহিনীকে ব্যবহার করে। মুক্তিযোদ্ধারা এই দৃষ্টান্তমূলক সাহসও সংকল্পের পরিচয় দেয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন মাহবুব এই যুদ্ধ দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। প্রায় তিন শতাধিক শত্রুসৈন্য একজন অফিসার সহ এই যুদ্ধে হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শত্রুর কয়েকটি মৃতদেহ আমাদের কৃষ্ণনগর হেডকোয়াটারে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন। সেদিন কৃষ্ণনগরের জনসাধারণ এই লাশ দেখার জন্য হেডকোয়াটারে ভেঙ্গে পড়েছিল এবং ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা মৃতদেহ দেখতে এসেছিল।

এই সময় আমাদের মূল সাংগঠনিক কাজ চলতে থাকে। আর্মি হেডকোয়াটার থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পূর্ণ শক্তিতে বলীয়ান করে তোলার। সমস্ত মুক্তিবাহিনীকে ২টা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়।১। নিয়মিত বাহিনী (ক) সেন্টার ট্রুপস (খ) রেগুলার ট্রুপস ২। অনিয়মিত বাহিনী- গণবাহিনী।