You dont have javascript enabled! Please enable it! ৯নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধের বিবরণ মেজর (অবঃ) এম এ জলিল রচিত ‘সীমাহীন সমর’ (১৯৭৪) ১৯৭১

 

প্রতিবেদনঃ মেজর (অবঃ) এম. এ. জলিল

বরিশালের রণাঙ্গন

১০ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বরিশাল, পটুয়াখালি, ফরিদপুর ও খুলনা এই চারটি জেলার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে সেক্টর কমান্ডার ঘোষণা করা হয়। ঘোষণায় আরও উল্লেখ করা হয় যে, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ কর্নেল এম এ জি ওসমানীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশকে ৬টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। মিঃ তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট করে চার সদস্যের একটি অস্থায়ী সরকার ‘মুজিব নগরে’ গঠন করার কথাও স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঘোষণা করা হয়। ব্যাপার যাই হোক না কেন, এই ঘোষণার ফলে বাংলার জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য অন্ততঃ একটা ভিত খুঁজে পেল। শুরু হল পাকিস্তানী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ। ইতিমধ্যে ১৭ই এপ্রিল একজন পাকিস্তানী গোয়েন্দা বরিশালে গ্রেফতার হয়। আমাদের অবস্থানগুলো ও প্রস্তুতির খবরাখবর সংগ্রহ করার জন্য পাক-সামরিক বাহিনীর লেঃ কর্নেল শামস উক্ত গোয়েন্দাকে খুলনা থেকে বরিশালে পাঠায়। উক্ত গোয়েন্দাকে যে পুরস্কার দিতে পেরেছিলাম সেটা হলো কঠিন মৃত্যু। বরিশাল স্টেডিয়ামে জনতার সামনে প্রকাশ্যে তাকে গুলি করে হত্যা করা হল। তার অপরাধ ছিল ক্ষমার অযোগ্য।

বোধ হয় ১৭ই এপ্রিলের ঘটনার ফলশ্রুতিস্বরুপ পাক-বিমান বাহিনীর দু’খানা স্যাবর-জেট ফাইটারকে বরিশালের আকাশ দেখা গেল। এই প্রথমবারের মতো হিংস্র সামরিক জান্তা আমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির উপর আঘাত আনার সাহস পেল। ওই জঙ্গী বিমানগুলোকে ঠেকাবার মতো আমাদের হাতে অনেক কিছু ছিল না। তবুও আমাদের সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা সামান্য রাইফেল দিয়ে গুলি করার অনেক চেষ্টা করলো। শহরের বিভিন্ন বেসামরিক অবস্থানের ওপর নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করলো। বেলস পার্কের উত্তর দিকে ইংরেজ আমলের একটি উঁচু কাঠের ঘরে হেডকোয়ার্টার। এই ঘর ও বেলস পার্কের উপর প্রচণ্ড গোলা এসে পরতে লাগলো। এই পার্কের মধ্যেই ছেলেরা ট্রেনিং নিত। ছেলেরা ট্রেঞ্চের ভিতরে ঢুকে আত্মরক্ষা করলো। দু’একটি ছোটখাট আঘাত ছাড়া আমাদের তেমন বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। জঙ্গি বিমান দুটো যখন ঘুরপাক খেয়ে গুলিবর্ষণ করার জন্য নিচে নেমে আসে তখন বেসামরিক লোকজন বাইরে লাফিয়ে এসে মজা দেখতে থাকে। এই সরল মানুষগুলো এর আগে কখনও ভাবতে পারেনি যে, ওই সুন্দর সুন্দর বিমানগুলো এমন নির্মমভাবে দংশন করতে পারে। অজ্ঞতা ও সরলতার জন্য ওরা অনেক ভুগছে। বেসামরিক ডাক্তাররা ভয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো। মুহূর্তের ভেতরে গ্রামের দিকে ছুটে চললো মানুষের কাফেলা। ভয়ে সব ফেলে শহর খালি করে উন্মাদের মত দৌড়াতে লাগলো শহরতলীর দিকে। কি মর্মান্তিক দৃশ্য।

১৮ই এপ্রিল রাত্রে বিষাদের কালোছায়া শহরের সারা আকাশটা গুমোট করে ফেললো। শহরের রাস্তাগুলো জনমানবশূন্য। ভীষণ নীরব। কোথাও জীবনের স্পন্দন নেই। যেন ঘুমন্ত প্রেতপুরী। রাতে ভয়ানক অস্বস্তিবোধ করলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটা বেশ বড় বাহিনী তৈরি করলাম। কিন্তু সামান্য কিছু রাইফেল জোগাড় করেছিলাম। এসব হালকা অস্ত্র দিয়ে শুধু আত্মরক্ষা করা চলে। যা হোক, এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে মিঃ মঞ্জু সুন্দরবনের গোপন পথ দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ভারত হতে কিছু অস্ত্রপাতি নিয়ে এলেন। তিনি জানালেন যে, আরো ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাকে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ওগুলো নিয়ে আসতে হবে। সংবাদটা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। এই সুযোগে সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত থেকে অস্ত্র নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এই দুর্যোগময় মুহূর্তেও আমার ছোট্ট মনটি অপার উৎসাহে চোখ ফাঁকি দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসবো। লেফটেন্যান্ট মেহেদী, লেঃ জিয়া এবং লেঃ নাসেরকে যথাক্রমে পটুয়াখালী, বরিশাল ও খুলনায় যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে সাথে নিয়ে ভারত রওনা হলাম।

গুপ্ত পথে যাত্রা

সুন্দরবন বাংলাদেশের বিখ্যাত অরণ্যানি। এই সুন্দরবনের গোপন পথ ধরেই আমার ভারত যাত্রা শুরু হলো। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ ও অজগরে সুন্দরবন ভরপুর। জানা-অজানা অনেক শংকা ও বিপদের ঝুঁকি দিয়ে ছোট একটি লঞ্চ, পথের জন্য সপ্তাহের কিছু রেশন ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সবাই মিলে লঞ্চে আমরা বিশজন নাবিক ছিলাম। এদের মধ্যে দু’জন প্রকৃত যুদ্ধ করার মত। পনের থেকে বিশের মধ্যে এদের বয়স। আগে সেনাবাহিনীতে ছিল। নাম সিদ্দিক ও জব্বার। আমাদের বলা হয়েছিল সুন্দরবনের চারপাশে পাকিস্তানী হানাদাররা ‘গানবোট’ নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর বর্বরের মতো নির্বিচারে গোলাবর্ষণ করে ভয়ানক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করছে। সন্ধ্যার দিকে অনেক দূরে ‘পশুর’ ও ‘শিপ্সা’ নদীর মোহনায় হঠাৎ করে একটা গানবোট চোখে পড়লো। এই বিরাঠ নদী দুটো অতিক্রম করে আমাদের নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে। সামনেই দিগন্তবিস্তৃত বঙ্গোপসাগর। ‘পশুর’ ও ‘শিপ্সা’ এই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। অন্ধকারে বিশাল জলরাশির দৃশ্য ভয়ংকর ও ভীতিপ্রদ। একটা প্রেতপুরীর মতো। দলের অধিনায়ক হিসেবে আসন্ন বিপদের ভয়কে চেপে গিয়ে আত্মবিশ্বাসকে ঘা দিয়ে চাংগা করে তুললাম। আমাদের লঞ্চের প্রধান পাইলট কিছুদিন আগেও একজন চোরাচালানী ছিল। জংগলের সব গোপন রাস্তা তার নখদর্পণে। তাকে বললাম যদি কোন পথ থেকে থাকে তাহলে লঞ্চের গতি সেই দিকেই ঘোরাতে। সে আমার আদেশ মানলো। আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। পরদিন ভারতের সীমান্তবর্তী চৌকি ‘পারগোমতী’ এসে পৌছলাম। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা আগেই আমাদের আসার খবর পেয়েছিল। তারা আমাদের আসার বৈধতা পরীক্ষা করে সামনে এগুবার অনুমতি দিল।

২৪শে এপ্রিল ভোরে ‘পারগোমতী’র একটা জায়গায় ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ইন্সপেক্টর মিঃ পি কে ঘোষ আমাদেরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন এবং অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যোগাযোগের পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্ক পাহারায় ক্যাপ্টেন হুদা ও আমাকে সামনে এগুবার অনুমতি দিলেন। এই সময় আমরা ‘হিঙ্গুলগঞ্জ’ নামক অপর একটি ভারতীয় সীমান্ত চৌকির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। সিদ্দিকসহ লঞ্চের অন্যান্য সাথীদের লঞ্চসহ এখানেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রেখে গেলাম।

নিরাপদ স্থানে পৌঁছার জন্য ভারতের সীমান্ত ধরে আমরা এগুতে লাগলাম। কারণ, নদীর ওপারেই পাকিস্তানী হানাদাররা ওঁৎ পেতে বসেছিল। ওপারের দূরত্ব এক হাজার গজের বেশি নয়। বর্বর পাকিস্তানী হানাদারদের মেশিনগানগুলো যে কোন সময় গর্জে উঠতে পারে। এই ভয়ে আমরা সতর্ক ও সচেতন ছিলাম। দেখতে পেলাম ওপারে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্রিগারে হাত দিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। নদীর ঢেউগুলো স্পীডবোটের কাঠের দেহটাকে হাপরের মতো পিটাচ্ছিল। ভয় হল ওর দেহটা না টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

ঢেউয়ের বুক চিরে ক্ষুদে দৈত্যের মতো স্পীডবোটটা আমাদের নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললো গন্তব্যস্থানের দিকে। মুখ ঘুরাতেই সামনে দেখতে পেলাম নদীর তীর বরাবর ভারতীয় সীমান্তে বেশ বড় বড় কতকগুলো বাড়ি। উপর দিকটা লাল, এমন কতকগুলো সেনানিবাস এই বাড়িগুলো চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। বহু আকাংক্ষিত স্থানে নিরাপদে পৌঁছাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। নতুন করে ইস্পাত কঠিন সংকল্প ও শক্তি সঞ্চয় করলাম। ওই দিনই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিরে পাকিস্তানী পশুগুলোর উপর বর্বরতার সমুচিত জবাব দেবার জন্য মনটা আমার কঠিন হয়ে উঠলো। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। যাতে করে সাড়ে সাত কোটি অগ্নিদগ্ধ আত্মার শান্তির জন্য হিংস্র জানোয়ারদের উপর চরম আঘাত হানা যায়।

আমরা হিংণ্ডলগঞ্জে নামলাম এবং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন পান্ডের অফিসে হেঁটে গেলাম। তিনি তাঁর অফিসে আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। ক্যাপ্টেন পান্ডে সুঠামদেহী, সুন্দর ও বেশ লম্বা। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানালেন। আমি যা আশা করেছিলাম তার চাইতে বেশী।

এক কাপ গরম কফির পর আমাকে আবার এখনই হবে প্রথম হাসনাবাদ, পরে ব্যারাকপুর। প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী সেখনে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় ক্যাপ্টেন পান্ডে শরণার্থী হয়ে ভারত চলে আসেন। আমাকে স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুব আনন্দবোধ করলেন। তার চোখের কোণে আশা ও প্রত্যয়ের ছাপ দেখলাম।

আমাদের অনেক রাস্তা যেতে হবে। সুতরাং সময় নষ্ট না করে ওদের সেনাবাহিনীর পাহারায় আমরা তিনচাকার একটা গাড়ীতে চেপে পড়লাম। এই গাড়ীটির বন্দোবস্ত করেহিলেন মিঃ পান্ডে। তিনি হাসনাবাদে আমাদের আগমন বার্তা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। সহকারি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।

হিংণ্ডলগঞ্জ থেকে হাসনাবাদের দূরত্ব ১২ মাইল। কিন্তু মাঝপথে আমাদের দুটো খেয়া পার হতে হবে। এই তিনচাকা গাড়ীটা দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগে। এটার নাম টেম্পো।

বেশ কষ্টকর ভ্রমণের পর আমরা হাসনাবাদ পৌঁছে গেলাম। গণপরিষদ সদস্য মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছ থেকে ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং আমার সম্বন্ধে অনেক কথা আগেই শুনেছেন। মিঃ মঞ্জুর সাথে আগে থেকেই এদের জানাশুনা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন সিং কোমল হৃদয়ের অধিকারী, সুন্দর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমাদের সবার কাছেই খুব প্রাণখোলা মনে হলো। সামনে এসে মিসেস সিংও আমাদের খোশ আমদেদ জানালেন। এই ভদ্রমহিলা আর এক মধুর ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘাংগী, সুন্দরী। তারা আমাদের সাথে অতি পরিচিত বন্ধুর মত ব্যবহার করলেন। বেশ কয়েক রকুম সুস্বাদু খাবার খাওয়ার পর আমরা ব্যারাকপুর যাত্রা করলাম। এখান থেকে ব্যারাকপুর প্রায় সত্তর মাইল সামনে। এবার স্বয়ং ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং-এর পাহারায় রওনা হলাম। হঠাৎ করে ঝড় ও অবিরাম বর্ষণ শুরু হলো। কিন্তু সামরিক গাড়ীগুলোর আশ্রয় পেয়ে কতটা নিরাপদ হলাম। দীর্ঘ দু’ঘণ্টা ভ্রমণের পর গাড়ীটা একটা দালানের কাছে থামলো। ওর গায়ে লেখা ছিল ‘অফিসার মেস’, ৭২নং বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে)। এটাই আমাদের সামরিক গন্তব্য স্থান। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশে তারাগুলো উঁকি মারলো। বাইরে কিছুক্ষণ কাটানোর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ওদের অফিসার মেসে। আমাদের ৭২নং বিএসএফ অফিসার মেসে। পথের ক্লান্তিতে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা করলাম। সুতরাং শিগগিরই পানীয় এলো। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের ধ্বনি ছড়িয়ে এক ঝলক হাসি মুখে নিয়ে উপস্থিত হলেন একজন নতুন যুবক। ইনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন সরকার। ভাই ও বন্ধুর চেয়েও বেশী অমায়িক ব্যবহার পেয়েছিলাম এই ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে। পরে আমরা আত্মীয়র চাইতে বেশী আপন হয়েছিলাম। এই ৭২ বিএসএফ বাহিনীর এডজুট্যান্ট ছিলেন তিনি। মিত্রবাহিনীর বন্ধুদের উল্লাসের ধ্বনিতে আমি স্বস্তি অনুভব করতে লাগলাম। বাস্তবিক পক্ষে আমরা খুব সুখে ছিলাম। এই সময় অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী এসে পৌঁছালেন। অধিনায়কের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। বয়সী লোক। ধূসর চুল, মুখাবয়বে অভিজ্ঞতার ছাপ। আমরা খুব আস্তে আস্তে কথা বললাম।

ভেতরটা তার বড্ড নরম, বড্ড কোমল। পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যে সফলতা এসেছে সেটা সম্ভব হয়েছিল তার সুষ্ঠ নির্দেশনা ও ব্যক্তিত্বের জন্য। তাকে ভুলব না।

সুন্দরবনে প্রেতাত্মা

কোন কোন লোকের কতলগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন আমি দেখেছি যখনই তারা তাদের ইপ্সিত কোন কিছু সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই বশ্যতা স্বীকার বা মাথা নোয়াবার পরিবর্তে ওই কাজটাকে সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য দ্বিগুন উৎসাহে বার বার চেষ্টা করেছে। নিরাশ হয়নি বা আশা ছেড়ে দেয়নি। এইসব লোকদের আমি ঈর্ষা করতাম, তাদের পদাংক অনুসরণ করার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হতাম। একবার দূঢ় আত্মপ্রত্যায়ে বলীয়ান হলে পরাজয়ের গ্লানিটুকু অকিঞ্চিতকর মনে হয়। বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে যখন আমি ভারতে আসি, তখন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে এ রকম একটা অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলাম। শেষবারের মতো আমি ৭২ নং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর বাসভবনে থামলাম। অস্ত্রশস্ত্র যোগাতে তিনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। নৈশভোজের পর তিনি আমাদের গাড়ীতে করে কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মিঃ মজুমদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁকে জানালেন যে, অধিনায়ক হিসেবে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য আমি অনেক কাজ করতে পারবো। আমার কি কি অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন মিঃ মজুমদারকে জানালাম। তিনি বেশ ধৈর্যের সাথে কথাগুলো শুনে আমাকে আশ্বাস দিয়ে ভদ্রভাবে বললেন যে, তাঁর সামর্থ্যমত প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। মিঃ মজুমদারের ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। বেশী আশ্চর্য হলাম তাঁর সুন্দর ভদ্রতাবোধ দেখে এবং আশ্বাস বাণী শুনে।

ওই দিনই সন্ধ্যায় কোলকাতার আসাম হাউজে নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিঃ রুস্তমজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে হলো। মিঃ মুখার্জীকে নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলাম। আমার প্রতি যে আন্তরিকতা ও ভদ্রতা দেখিয়ে তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তাতে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। বেশ আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী সিনিয়র অফিসার। তার সাথে কথাবার্তায় আমার দূঢ় বিশ্বাস হলো যে, বেশ অল্পদিনের ভেতরেই আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাব। অস্ত্র যোগাড় করাটাই আমার আসল উদ্দেশ্য। আমার চলাফেরার সময় মিঃ মুখার্জী ও তার অফিসের কর্মচারীরা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। তাদের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক ও বন্ধুসুলভ।

১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল মিঃ মুখার্জীর গাড়ীতে করে আমাকে মেজর উসমানের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি মুক্তিসংগ্রামের আর একজন অধিনায়ক। পাক দখলদার বাহিনীর সাথে তাঁর ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে পর পর কয়েকটা যুদ্ধ করে উত্তর বাংলার পট্রাপোলে তিনি ঘাঁটি গেড়েছেন। মেজর উসমান পাক আমলে ইপিআর-এ চাকরি করতেন। তিনি অনেক হালকা অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে রেখেছিলেন তাঁর ঘাঁটিতে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জমা দেখে আমার লোভ হলো। কারণ, পৃথিবীর যে কোন জিনিসের চাইতে এই প্রয়োজনের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিকের কাছে একটি মাত্র রাইফেল সবচেয়ে বেশী মূল্যবান। কেননা, অস্ত্র ছাড়া একজন সৈনিকের গর্ব ভূলুণ্ঠিত হতে বাধ্য। যাহোক অনেক কষ্টে অনেক বলা-কওয়ার পর মেজর উসমানকে বুঝতে সক্ষম হলাম যে আমিও তাঁর মত দেশের জন্য যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেজর উসমান রাজী হলেন। অন্ধকারের ভিতর আশার আলো দেখতে পেলাম। সমস্ত কৃতিত্বই অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর। তিনি নিজে মেজর উসমানকে ব্যাপারটা গুরুত্ব বুঝিয়ে রাজী করিয়েছিলেন। সুতরাং এক ট্রাক বোঝাই হালকা অস্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে আমি হাসনাবাদ ফিরে এলাম। এখানে এগুলো লঞ্চে বোঝাই করার বন্দোবস্ত করতে হবে। মেজর উসমানের সাথে আলাপ-আলোচনার সময় আমার সহকারী ক্যাপ্টেন হুদা বেশ ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তার উপরে প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি মিঃ মুখার্জীর সাথে ফোর্ট উইলিয়াম ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে রওয়ানা হয়ে গেলাম।

প্রথমে ইস্টার্ন কমান্ডের ইনটেলিজেন্স অফিসার কর্নেল খেরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেনঃ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন আমি কোথায় কোথায় ছিলাম। কি কি করেছি ইত্যাদি। তিনি যা প্রশ্ন করলেন সবগুলোরই উত্তর দিতে হলো আমাকে। একটা লোক তাঁর কানে কানে কি বলতেই আমাকে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সাক্ষাৎ পেলাম। তাঁর স্মিত হাসি ও আন্তরিক ভদ্রতা আমাদের ভেতর ‘পদের’ বাধা মুছে ফেললো। আমার মনে ভরসা এলো। তাই কোন সংশয় না করে বা কোন কথা গোপন না করে তার কাছে মনের কথা সব কিছু খুলে বললাম। এর ফলে আমার উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হলো। একটা মানচিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের কোথায় আমার গেরিলা ঘাঁটি আছে তাঁকে দেখালাম। দেখে মৃদু হাসলেন এবং বললেন, খুব ভাল। সাথে কর্নেল খেরাকে নির্দেশ দিলেন আমাকে প্রয়োজনীয় সবরকম সাহায্য করতে। এখানে কর্নেল খেরার সাথে আমাকে পুরো তিনটা দিন থাকতে হয়। সামরিক বাহিনীতে অন্যান্য গোয়েন্দা অফিসারের মত তার অনুসন্ধিৎসু মনটা আমার সম্বন্ধে খুব উৎসুক হয়ে উঠলো। বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগের লোক হিসেবে খুব সতর্কতার সাথে কথা বললেন, নানা রকম প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চাইলেন যে, আমি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা কিনা। আমার পরিকল্পিত কাজের বিলম্ব হওয়াতে এই কয়টা দিন আমি ভয়ানক অস্থিরতার ভেতর কাটিয়েছিলাম। যাহোক, আমার বিরক্তি সত্ত্বেও তার ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা ও দেশের জন্য নিরাপত্তা বোধের আন্তরিক প্রশংসা না করে পারছি না। এখানেই তার কাছে প্রথম শুনলাম, ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানী দস্যুদের হাতে বরিশাল-ফরিদপুরের পতন হয়েছে। হতাশায় মনটা ভেঙ্গে পড়লো। এই জিলাগুলিকে রক্ষা করার পূর্ব পরিকল্পনা আমার সাময়িকভাবে ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও কঠিন সংকল্প নিলাম যে, যেভাবেই হোক এইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই হবে। অস্ত্র তুলে দিতে হবে মুক্তিসংগ্রামীদের হাতে। আমার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা। আমার বিলম্ব হবার আরও একটা কারণ হলোঃ সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম যে, কর্নেল এম এ জি ওসমানী যেভাবেই হোক আমার সাথে কোলকাতায় সাক্ষাৎ করতে চান।

৫ই মে পর্যন্ত আমি তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু তাঁর ফিরে আসার কোন লক্ষণই দেখলাম না। কেউ বলতে পারলো না কখন তিনি ফিরে আসবেন। তিনি তখন সীমান্তবর্তী অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কঠোর চেষ্টা করেছিলেন। এই বিলম্বে ভয়ানক চিন্তাম্বিত হয়ে স্থির করলাম আবদ্ধ কাজ সমাধান করার জন্য আমাকে এখনই রওয়ানা হয়ে যেতে হবে। ঠিক এই সময় মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদা পরিবার-পরিজন নিয়ে হাসনাবাদে পৌছলো। বরিশালের পতন হওয়াতে তারা চলে এসেছে।

ক্যাপ্টেন হুদাকে নির্দেশ দিলাম যে, যখন আমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকবো, তখন যেন বাহকের মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। পরিস্থিতি অনুকূল মনে হলে সরবরাহ ব্যবস্থা যেন অব্যাহত রাখে। আমাদের ক্যাম্পের দিকেও লক্ষ্য রাখতে বললাম। এই ক্যাম্পে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদার পরিবার-পরিজনও থাকতো।

সবাই মিলে মোট চল্লিশজন লোক দুটো লঞ্চে করে যাত্রা করলাম। আমাদের ভেতর চারজন নিয়মিত সেনাবাহিনীর লোক ছিল। বাকী সব ছাত্র। আমাদের গন্তব্যস্থানের রাস্তাঘাট আমার নিজেরও জানা ছিল না। লঞ্চে এরকম একটা দুঃসাহসিক যাত্রায় মোটেই ভরসা পাচ্ছিলাম না। যে কোন সময় বিপর্যয় আসতে পারে। যেহেতু যাওয়ার পথে শত্রুরা চারদিকে ওঁৎ পেতে বসেছিল, আমরা সবাই লঞ্চের পাইলটের উপর নির্ভর করলাম। পাইলটরা তাদের অনেক বছরে অভিজ্ঞতার বড়াই করে আশ্বাস দিল যে, তারা আমাদের নিরাপদে পৌছে দেবে। ওদের দুঃসাহসিক কথাবার্তা ও আত্মবিশ্বাসের জোর দেখে স্বভাবতই আমি আদেশ করা থেকে বিরত রইলাম, যেহেতু যাওয়ার প্রকৃত রাস্তাঘাট সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত। রাস্তা সম্পর্কে আমার ম্যাপ দেখা অস্পষ্ট ধারণা ছিল মাত্র। তৎসত্ত্বেও একটা সংক্ষিপ্ত ‘অপারেশন প্ল্যান’ তৈরী করলাম। প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝিয়ে বললাম কিভাবে দুটো লঞ্চে অস্ত্রশস্ত্র ভাগাভাগি করে নিতে হবে এবং শত্রুর সাক্ষাৎ পেলে নাগরিকরা কি করবে।

যাত্রা শুরু করার হুকুম দিলাম। একটা লঞ্চে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের এবং আরও কয়েকজন লোক আগে আগে চললো। আমার লঞ্চটা আগেরটার পিছু পিছু রওয়ানা হলো। কারণ, আমার লঞ্চে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অনেক অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই ছিল। সামনের লঞ্চটায় মিঃ মঞ্জু ও লেঃ নাসেরকে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার ভার দিলাম। পথের নিরাপত্তা সম্বন্ধে তাঁরা দু’জনেই বেশ আশ্বস্ত ছিলেন। কারণ মাত্র দু’দিন আগেই তাঁরা এই পথে হাসনাবাদ এসেছেন। ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর পেট্রোল বোট ‘চিত্রাঙ্গদা’ আমাদেরকে শামশেরনগর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। এখান থেকেই আমরা যাত্রা শুরু করব। শামশেরনগর ভারতের শেষ সীমান্ত ঘাঁটি। রাত ৯টা। শুরু হলো যাত্রা। আশা-নিরাশার দোদুল দোলায় সারা দেহ -মনে চাপা উত্তেজনা। যাত্রার লগ্নে দূরে বহু দূরে দেখতে পেলাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছাড়াও রাত্রের গুমোট অন্ধকার। গত কয়েক দিনের ক্লান্তিতে আমার চোখ দুটো জড়িয়ে এলো। গুম পেল আমার। ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দের মাঝেও আমি গভীর ঘুমে গা এলিয়েদিলাম। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখি কে যেন চাপা গলায় ডাকছেঃ ‘গানবোট, গানবোট স্যার’।

হ্যাঁ, সত্যিই তো গানবোট। ভূত দেখার মত উপরতলার ক্যাবিন থেকে ঝড়ের বেগে চীনা ‘কার্বাইনটা’ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ইঞ্জিন কক্ষে ঢোকা মাত্রই দু’দিক থেকে প্রচণ্ড সার্চলাইটের আলো আর মেশিনগানের গুলি আসতে লাগলো। ভেতরটা আমার অসম্ভব রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানী গানবোট ওঁৎ পেতে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। রাতটা ভয়ানক বিক্ষুদ্ধ। ঝড়ের দাপাদাপি। তার উপর চারদিক সূচীভেদ্য অন্ধকার আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণ। সার্চলাইট দিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে হানাদাররা তন্নতন্ন করে আমাদেরকে খোঁজ করতে লাগলো। একটা গুলি এসে লঞ্চের পিছন দিকটায় আঘাত করলো। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমার সাথের চার জন সৈনিক সিদ্দিক, হাবিলদার জব্বার মোখছেদ ও ইউসুফকে প্রথমে রাইফেলের গুলি করতে বললাম। যেন শ্ত্রুপক্ষ মনে করে আমাদের শক্তি খুব কম। আশ্চর্যজনকভাবে আমার এই পরিকল্পনাটা কাজে এলো। দেখতে পেলাম আমাদের বাঁ দিকের গানবোটটা পুরো সার্চলাইট জ্বালিয়ে বৃষ্টি ও বিক্ষিপ্ত ঢেউগুলোর ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের লঞ্চটার পিছন দিকটায় আরও কয়েকটি গুলি এসে লাগলো। বাইরে প্রবল বৃষ্টিপাত ও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে গুলির আওয়াজ অস্পষ্টভাবে আসছিল। সার্চলাইটের আলোকিত পথটুকুই শুধু চোখে পড়লো। পৃথিবীর আর সব কিছুই দৃষ্টির বাইরে। কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সমস্ত ব্যাপারটা এলোমেলো হওয়া সত্ত্বেও অল্প সময়ের ভেতর পাল্টা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিলাম। ইতিমধ্যে যে গানবোট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। সেটা প্রায় লঞ্চের কাছাকাছি এসে গেল। বলতে ভুলে গিয়েছি যে, আমাদের লঞ্চটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এটা নদীর তীরে, না মাঝখানে অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।

দু’জনকে মেশিনগান, দু’জনকে ‘এনারগা গ্রেনেড’ সজ্জিত রাইফেল দিয়ে বাম দিকে বসিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটা মেশিনগান ডানদিকের গানবোটটাকে লক্ষ্য করে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথেই চারজনে ওই গানবোটটাকে লক্ষ্য করে প্রচন্ডভাবে গোলাবর্ষণ শুরু করলো। এই সময় গানবোটটা আমাদের বেশ আওতার মধ্যে এসে গিয়েছিল। এই অতর্কিত আক্রমণে শত্রুরা ভয়ানক ঘাবড়ে গেল এবং ওদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো। ওদের হৈ চৈ শুরু হলে এবং গানবোট থেকে বিরাঠ একটা আগুনের গোলা ছিটকে পড়লে বুঝতে পারলাম, আমাদের নিক্ষিপ্ত রকেট ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে। বামদিকের গানবোটটাকে চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ করে দিয়ে ডানদিকের গানবোটটাকে আক্রমণের জন্য ঘুরে বসলাম। কিন্তু ওটা বিপদের আশংকা করে মেশিনগানের আওতার বাইরে পালিয়ে গেল। যাহোক, শত্রুপক্ষকে ভীতসন্ত্রস্ত রাখার জন্য গুলিবর্ষণ অব্যাহত রইলো। এই সুযোগ অন্য দু’জন লোককে আমাদের আগের লঞ্চটার খোঁজ নিতে বললাম। কিন্তু মনটা ভীষণভাবে দমে গেল যখন দেখলাম আগের লঞ্চটা ঠিক আমাদের বামদিকে চড়ার উপর বিধ্ধস্ত অবস্থায় পড়ে আছে এবং ওর ভেতরের লোকজন আগেই পালিয়ে গিয়েছে।

সাথের বেশীর ভাগ লোকজন পালিয়ে গিয়েছে দেখে মনটা ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়লো। এমন সময় পালিয়ে গেল যখন তাদের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশী। অযথা চিন্তায় সময় নষ্ট না করে আমাদের সাথের চারজনের প্রত্যেককে এক-একটা ডাল, আমরা তীরের কাছাকাছি ছিলাম। অনিশ্চয়তা, নিরাশা ও ভয়ের আশংকা। আমরা তাড়াতাড়ি লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়লাম। পায়ের নিচে আঠালো কাদা। কোমর পরিমাণ জলের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে নদীর তীরে পৌছালাম। তীরটা আমার কাছে উঁচু বাঁধের মত লাগলো। নদী থেকে অনেক উঁচুতে বাঁধের উপর তাড়াতাড়ি ঘাঁটি গেড়ে বসলাম। সামনে থেকে যত আক্রমণই করা হোক না কেন আমরা এখানে পুরোপুরি নিরাপদ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অচেনা, অজানা পথ। জীবনে কোনদিন এখানে আসিনি। এসব চিন্তা করে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। শত্রুর উপস্থিতি, ঝড়ের বিলাপ , কুচকুচে কালো আঁধার-সব মিলে রাতটাকে একটা প্রেতাত্মার ছায়ার মত মনে হলো। হঠাৎ দেখতে পেলাম বাঁধের পিছন দিকে মানুষের একটা অস্পষ্ট ছায়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। শংকিত পদে ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে দেখলাম একটা লোক পালাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এত ভীত যে মনে হলো পৃথিবীটা খুঁড়ে তার ভেতর গিয়ে লুকাবে। মৃদুভাবে তাঁকে স্পর্শ করতেই এমন জোরে চিৎকার করতেই জোরে চিৎকার শুরু করলো যে, ভয়ে আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। তাকে সান্ত্বনা দেয়া সত্ত্বেও সে এমন বিলাপ করে চিৎকার আরম্ভ করলো যে, উপর দিকে একবারও চাইবার সাহস পেল না। গরীব বেচারা। প্রায় বিকারগ্রস্ত। অনেক চেষ্টার পর সে শান্ত হলো। এই লোকটা হচ্ছে সেইসব পাইলটদের একজন যারা লম্বা লম্বা গালভরা কথা বলেছিল। অবশ্য তার কোন দোষ নেই। কারণ সে কোনদিন গুলির শব্দ শোনেনি। যাহোক এই লোকটা আমার অনেক উপকার এলো। আমি কোন জায়গায় আছি এটা সে নির্ভুলভাবে বলে দিল। এসব ব্যাপার এই ক্ষুদে ‘সাহসী’ লোকটির বেশ জোর আছে। এই জায়গাটার নাম ‘গাবুরা’। জায়গাটার পরিবেশ ও অবস্থানের কথা চিন্তা করে সংশয় জাগলো যে, ভোর হওয়া পর্যন্ত যদি আমরা এখানে থাকি তাহলে শত্রুপক্ষ হয়তো বা আমাদের মত লোভনীয় বস্তুগুলোর উপর হাওয়াই হামলা চালিয়ে ওদের করেই বসে তাহলে কিছুতেই রুখতে পারব না। এই অত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, কোন রকমে ‘ক্রলিং’ করে গ্রামের অভ্যন্তরে চলে যাওয়া।

আমাদের পিছন দিকে এই গ্রামগুলো প্রায় এক মাইল দূরে। ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষের গানবোটটা অনেক দূরে পিছিয়ে গিয়ে বাঁধের উপর আমাদের অবস্থান ও নদীর তীরে পরিত্যক্ত লঞ্চ দুটোকে লক্ষ্য করে ভীষণভাবে মেশিনগান ও রকেটের গোলাবর্ষণ শুরু করলো। ওদের অবিরাম গোলাবর্ষণে আমাদের দুটো লঞ্চেই আগুন ধরে গেল। বর্তমান অবস্থানে থাকাটা অযৌক্তিক ভেবে আমরা ক্রুলিং করে কোন রকমে বাঁধের নিচের দিকে চলে গেলাম আর খোদাকে স্মরণ করতে লাগলাম। কারণ এ দুঃসময়ে এক খোদা ছাড়া আর কেউ শত্রুর হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিল না। ঠিক এই সময় আমার সঙ্গের চারজন সৈনিক এদিক-ওদিক সরে পড়লো। সম্ভবত তারা গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। পাইলট ছাড়া আর কাউকে আমার চারপাশে দেখলাম না। মেশিনগানের গর্জন আর রকেটের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনে পাইলট আধমরার মতো আমার কাছে পড়ে রইল। গোলার ভয়ংকর আগুনে আমাদের লঞ্চ দুটোকে নির্দয়ভাবে গ্রাস করলো। পরাজিত মন ও ক্লান্ত দেহটা বাঁধের পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে হতাশার গ্লানি নিয়ে চেয়ে রইলাম লেলিহান বহ্নিশিখার দিকে। গোলার প্রচণ্ড শব্দ, রকেট বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। উৎকট গন্ধে ভরপুর সমস্ত আকাশটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন- পরাজয়ের কালিমায় কিছুটা মলিন। পূর্ব দিকটা সামান্য হালকা হতেই পাইলটকে টেনে নিয়ে কোন রকমে গ্রামের ভিতর ঢুকে সাহস করে সেখানে এক হাজী সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। আমাদের প্রতি সহৃদয় হবার জন্য ইঙ্গিতে তাকে অনুরোধ জানালাম। যখন তাকে খোদার চাইতেও জেনারেল ইয়াহিয়ার উপর বেশী অনুগত দেখলাম তখন যুগপৎ ভয় ও বিস্ময়ে মনটা বিচলিত হলো। গ্রামের অধিকাংশ লোককেই দেখলাম বর্বর ইয়াহিয়ার প্রতি অনুগত ও ভক্ত। আমাদের প্রতি ভয়ানক বিরুপ মনোভাবাপন্ন মনে হলো। প্রকৃতপক্ষে এখানকার স্থানীয় লোকজনই আমাদের সাথের লেঃ নাসের, গণপরিষদ সদস্য মিঃ মহিউদ্দিন ও আরো ছাব্বিশজন লোককে ধরে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় এবং সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আমিও এই রকম একটা গন্ধ পেলাম যে হাজী সাহেব আমাদেরকে পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে তুলে দেবার জন্য গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের চারদিকে অনেক লোকের ভীর। তারা আমাদেরকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে। আমরা দু’টি যেন অদ্ভুত জীব। আমাদের এরকম দুরবস্থা দেখে ওদের মধ্যে কেউ কেউ দুঃখও প্রকাশ করলো। এ অবস্থা দেখে হাজী সাহেবেরও বোধ হয় দয়া হলো। তিনি আমাদের কিছু ভাত ও মধু দিলেন। এটা সুন্দর বনাঞ্চলের লোকদের একটা বিশেষ খাদ্য। খাবার দেখা মাত্র আমার চোখ দুটো বড় হতে লাগলো। কেননা আমি ও আমার সঙ্গের পাইলট উভয়েই ভয়ানক ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ছিলাম। গত রাতের ভয়ংকর পরিবেশ আমি ওর সাথে বড্ড একাত্ম ও আপন হয়ে গিয়েছিলাম। যখনই এই অনির্ধারিত খাবার শেষ করে ফেলেছি, ঠিক সেই সময় হাজী সাহেব হাতে করে রাইফেলের ‘ছেরেফ’ একটা ‘বোল্ট’ নিয়ে হাজির হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, এটা কি ? কেননা তার ধারণা ছিলো এটা কোন কাজে আসে না। তার চোখের কোণে ভীতির চিহ্ন।

এই দালাল শিরোমণিকে নিয়ে কিছু মজা করবো স্থির করলাম। তার হাতে বোল্টটা দেখেই ভীতিজড়িত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলাম এবং হাজী সাহেবকে বললাম যে, তাঁর হাতের জিনিসটা খুব মারাত্নক ডিনামাইট। মাটিতে যেন কোনরকমে না পড়ে তাহলে সবাই মারা যাবে। শুনে হাজী সাহেব ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন। এইবার হাজী সাহেবকে হাতের মুঠোয় পেলাম। আমার কথায় তার কাঁপন শুরু হলো। তার চক্ষু স্থির, রক্তহীনের মত বিবর্ণ। আপাদমস্তক ভয়ে কাঁপতে লাগলো। আমার হুঁশিয়ারি স্মরণ করে তিনি বোল্টটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মত সৎ সাহসও দেখাতে পারছিলেন না। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে আমি বললাম যে, ডিনামাইটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ওটাকে পানির মধ্যে ফেলে দেয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমার কথা খুব আস্তে আস্তে আঙ্গুল টিপে টিপে বোল্টটার দিকে অপলক দৃষ্টি মেলে হাজী সাহেব পুকুরের দিকে রওনা হলেন। এই দুরবস্থার মধ্যেও আমার ভয়ানক হাসি পেল। যখনই এই মজার ব্যাপারটা ঘটছিল তখন হঠাৎ গানবোট থেকে হাজী সাহেবের বাড়ির দিকে আবার গোলাবর্ষণ শুরু হলো। হাজী সাহেবের বাড়ীটা বড় একটা দালান। বহু দূর থেকে দেখা যায়। এই আকস্মিক ঘটনায় গ্রামের লোকজন যে যেদিকে পারলো ছিটকে পড়লো। এটা আমাদের পালানোর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ দেখা দিল। আমার সাথের পাইলটটি মাত্র নদীর পথ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। সে সাহচর্য ছাড়া আর কোন প্রয়োজন আসলো না। যাহোক, একটা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দিনটা কোন রকমে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার সাথে সাথে আরম্ভ হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের প্রতি খুব সদয় ছিল। হাজী সাহবের ব্যবহারে আশ্বাস ও স্বস্তির রেশটুকু খুঁজে না পেলেও আমাদের প্রতি তার ছেলের মমত্ববোধ দেখে এই দুঃসময়েও বাঁচার ক্ষীণ আশায় বুক বাঁধলাম। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের খুঁজে বের করলো। তাকে দেখে ভরসা পেলাম। সে আমাদের আশ্বাস দিল যে, খুব ভোরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছে দিবে। তাঁর সহানুভূতিশীল মনের পরিচয় পেয়ে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম- আবার সেখানে ফিরে গিয়ে সযত্নে প্রহরায় নির্বিঘ্নে রাত কাটিয়ে দিলাম। প্রতিশ্রুতিমত হাজী সাহেবের ছেলে রাস্তার সব খবরাখবর আমাদেরকে খুলে বললো এবং খুব ভোরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দিয়ে গেল। খেয়া পার হবার জন্য সে আমাদের কিছু টাকা-পয়সাও দিল। কেননা রাস্তায় অনেক নদী ও খাল পার হতে হবে। পথটা অত্যন্ত বিপদসংকুল। তাছাড়া সমস্ত অঞ্চলটা পাক দালালে ভর্তি। প্রাণটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে আমরা প্রায় আধ মাইল পথ অতিক্রম করলাম। কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায় এইভাবে ভারতে সীমান্তবর্তী ঘাঁটি হিংগলগঞ্জ এসে পৌছালাম। হিংগলগঞ্জের ঠিক উল্টো দিকে পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটি বসন্তপুর। পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের ফেরার খবর আগে থেকেই পেয়ে ওঁৎ পেতে আমাদের ধরার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু ওদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা নিরাপদ জায়গায় পৌছে গেলাম। ২৬ জন ছাড়া সঙ্গের অন্যান্য সবাইও পৌছে গেল।

আমরা যে বেঁচে গিয়েছিলাম এটা ভাগ্য নয়। এটা একটা চরম পরাজয়। আর এজন্য আমি দায়ী। কেননা অধিনায়ক হিসেবে রাস্তাঘাটের সাথে পরিচিত ছিলাম না। তারপর অধীনস্থ লোকদের উপর নির্ভরশীল হয়ে নিজের বিবেককে করেছিলাম খর্ব, তাই হারিয়ে ফেলেছিলাম নির্দেশ দেওয়ার শক্তি। কিন্তু এক অর্থে এই পরাজয়ের গ্লানি একটা বিরাঠ বিজয়। কেননা, এটা একটা সাহসী পদক্ষেপ মাত্র। ভবিষ্যত যাতে চরমভাবে আঘাত হানতে পারি তার জন্য নতুন করে শপথ নিলাম।

সর্বাধিনায়কের দরবার

জুলাই মাসের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে আমাদের সর্বাধিনায়ক সব আঞ্চলিক অধিনায়কদের নিয়ে প্রথমবারের মত একটা বৈঠক বসেন এবং উপরোক্ত ৬টি অঞ্চলকে নয়টি উপ-অঞ্চলে বিভক্ত করেন। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, এর আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছিল নিষ্প্রভ। এটা অবশ্য ভাল পদক্ষেপ। কিন্তু বেতারযন্ত্রের অভাবে নদীবহুল বাংলাদেশের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর সুষ্ঠভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। এক-একটা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল কমপক্ষে দু’ থেকে তিনটি জেলা। অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে আমি কোন মত প্রকাশ করব না। তারা হয়তো তাদের অধীনস্থ নিয়মিত সেনাবাহিনী নিয়ে ভিন্ন রকম অবস্থার মোকাবেলা করেছিলেন। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার শক্তির প্রধান উৎস মুক্তিযোদ্ধা এবং নগন্য সংখ্যক সশস্ত্রবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর লোক। যাহোক এই সময় আমার অবস্থা ছিল খুব নাজুক ও অস্বস্তিকর। কেনা সৈন্যবাহিনী বা অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই আমি অধিনায়ক হয়েছিলাম। সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী সাহেব পরিস্কারভাবে জবাব দিলেন যে, আমাকে কোন অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে না। এমন কি যে অস্ত্রশস্ত্রগুলো পাক হানাদারদের সাথে মোকাবেলার সময় সুন্দরবনে খোয়া গিয়েছিল সেগুলো উদ্ধার করার জন্য আমাকে চেষ্টা করার উপদেশ দিলেন। আমি তার কথাগুলো সন্তুষ্ট চিত্তে হজম করিনি এবং এটাকে আমি একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করলাম। মেজর ওসমানীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু হালকা অস্ত্রপাতি দেয়ার জন্য তাঁকে রাজী করালাম। এইভাবে কাছ থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র এবং অধিনায়ক মুখার্জীর বদান্যতায় আরও কিছু অস্ত্রপাতি যোগাড় করে পাকবাহিনীর ঘাঁটি বসন্তপুরের ঠিক অপর দিকে হিংগলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে একটা আক্রমণ পরিচালনার ঘাঁটি স্থাপন করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্যাপ্টেন মেহদী ও লেঃ জিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য চিন্তা করতে লাগলাম। কোন সহ-অধিনায়কের সাথে আমার কোন যোগাযোগের ব্যবস্থা না থাকায় আমার অধীনস্ত অঞ্চল থেকে অস্পষ্ট ও অতিরঞ্জিত খবর আমার কানে এসে পৌঁছতে লাগলো। যাহোক নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেলাম যে, বরিশালে হাবিলদার হেমায়েত, পটুয়াখালীতে ক্যাপ্টেন মেহদী এবং সুন্দরবন এলাকায় লেঃ জিয়া হানাদার বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধ করছে, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলির অপ্রতুলতা একটা বিরাঠ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সময় ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরাই মুক্তিযুদ্ধে প্রধান শক্তি হিসাবে কাজ করছিলেন। সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাবার জন্য আমি অধিনায়ক মুখার্জীর কাছে ছুটে গেলাম। তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ নম্র ব্যবহারে আমাকে মুগ্ধ করলেন সর্বরকমের সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। একবার যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা যায়, তাহলে আমার অধীনস্থ সেক্টরের ভবিষ্যৎ কি হবে আমি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলাম। সমস্তু আগ্রহ ও ঔৎসুক নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে সাথে করে বিভিন্ন ঘাঁটি পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের আশায় দিনরাত অবিশ্রান্ত ভাবে ছুটতে লাগলাম। কারণ প্রথম ব্যর্থতার বোঝাটা আমি যেখনেই যেতাম সেখানেই আমাকে ধাওয়া করতো। যতক্ষণ না বর্বর পশুগুলোর উপর একটার পর একটার পর একটা প্রতিহিংসা নিতে পারলাম ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যর্থতার গ্লানিকর ছায়াটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন হয়ে আমার কাঁধ চেপে রইল। সর্বক্ষণ আমি চলার উপর ছিলাম। জুন মাসের আগ পর্যন্ত আমার কোন সদর দপ্তর ছিল না।

মৃত্যুঞ্জয়ী কাফেলা

যদিও কোন করুন দৃশ্য আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়তাম এবং আমার উপরে প্রভাব ছিল ভয়ানক প্রবল, তবুও নৃশংস পাক-হানাদার বাহিনীর অত্যাচার আমার মনে জমা হতে লাগলো চরম প্রতিহিংসা ও জিয়াংসার আগুন। বর্বর পশুগুলো হাজার নিরীহ নিরপরাধ বাঙ্গালীকে গরু-ছাগলের মত ঘরছাড়া করে নিক্ষেপ করেছে দুঃখের অর্থে সাগরে। এক মুহুতে সময় নষ্ট না করে আমাদের যা কিছু সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল, তাই নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে হিংগলগঞ্জে একটা আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য নির্দেশ দিলাম।

হিংগলগঞ্জ হাসনাবাদ থেকে বারো মাইল দক্ষিণে পথের মাঝখানে দুটো নদী। ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন হুদা ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২০টি রাইফেল নিয়ে হিংগলগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। হাসনাবাদ ও হিংগলগঞ্জ এর মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল তিন চাকা বিশিষ্ট টেম্পো নামে এক প্রকার গাড়ী আর নৌকা। ইছামতী নদী নৌকায় করে পার হতে হতো। কিন্তু এই নদীটা পার হওয়া খুব একটা নিরাপদ ছিল না। কারণ ওপারে নদীর তীর বরাবর পাকবাহিনী অসংখ্য বাস্কার ও ট্রেঞ্চ খনন করে ওদের ঘাঁটি সুদৃঢ় করে নিয়েছিল। এই ঘাঁটিগুলো ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে একজন পথিকেরও চোখে পড়তো। হিংগলগঞ্জএ ভারতের ৭২ নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটা স্থায়ী ফাঁড়ি আছে। ক্যাপ্টেন পান্ডে এর অধিনায়ক তিনি তার ফাঁড়ির এক মাইল দক্ষিণে একটি ঘাঁটি বানাতে ক্যাপ্টেন হুদাকে সবরকম সাহায্য করলেন। এ ঘাঁটিটা ইছামতী নদীর তীর থেকে আধ মাইল ভিতরে। এর ঠিক উল্টো পারে পাক-হানাদারের সুদৃঢ় পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি। এখানে ঘাঁটি স্থাপন করা কত কষ্টসাধ্য ক্যাপ্টেন হুদার তা ভালভাবেই জানা ছিল। আমারও ভাবনার অন্ত ছিল না। কেননা, অধিনায়ক হিসাবে তার চাহিদা মত তাঁবু, খাদ্য, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, টাকা-পয়সা এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যবাহিনীর মঙ্গলামঙ্গল ও অগ্রগতির জন্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কারণ তাদের জন্য গভীর সহানুভূতি ছাড়া আমার কাছে তহবিল ছিল না। এর জন্য দুয়ারে দুয়ারে আমি পাগলের মত ঘুরেছি। শীগগীরই আমরা জীবনকে কঠিনভাবে উপলদ্ধি করতে শিখলাম এবং গভীর পারস্পরি সমঝোতার মাধ্যমে সব বিপদ, সব প্রতিকূল অবস্থাকে রুখে দাঁড়াবার নতুন শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলাম।

বসন্তপুর ইছামতী নদীর পূব তীরে। কেউ শুনে বা বইয়ে পড়ে দুঃখের কাহিনী হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। ভারতের সীমান্তে হিংগলগঞ্জে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি মেলে দিলে দেখা যাবে ওপারে বসন্তপুর। মাঝখানে ছোট্ট ইছামতী। দুর্নিবার ইচ্ছা, ভাবাসা ও অসক্তি সত্ত্বেও ওই রূপসী বাংলার কোলে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে ভয়ানক কষ্টসাধ্য। কেননা, ওপারে মারণাস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল মানবতার জঘন্যতম শত্রু। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ওই অসভ্য বর্বরদের হাত থেকে আমার মা-বোনদের বাঁচিয়ে আনার উদগ্র বাসনায় উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু কি দিয়ে আমি তাদের বাঁচাবো? মাত্র ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আর ২০টা রাইফেল নিয়ে? হ্যাঁ, এই অসম্ভব কাজেও আমরা জীবনকে বাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এবং সফল হয়েছিলাম।

১৯৭১ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ। সকাল থেকে ভয়ানক ঝড়। ভিতরে আমার ভয়ানক অস্বস্তি। কারণ, আমি জানতাম যে, ক্যাপ্টেন হুদার সাথের ছেলেরা এই ঝড়ের মধ্যে ছেঁড়া তাঁবুতে বসে বৃষ্টির জলে অসহায়ের মত ভিজছে। তা ছাড়াও আমি ভাবলাম শত্রুর উপর অতর্কিত আঘাত আনার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। বলিষ্ঠ যুবক ডাক্তার শাহজাহানকে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আমার সাথে আসতে বললাম। প্রাণ-প্রাচুর্যের জীবন্ত এই ডাক্তার সাহেব। সকাল ৮টায় আমরা দু’জনে দুটো ওভারকোট নিয়ে হাসনাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ইছামতী পার হতে পুরো এক ঘন্টা সময় লাগলো হিংলগঞ্জে যাওয়ার পথে এটাই প্রথম নদী। বাত্যাবিক্ষুব্ধ ছোট্ট ইছামতী আজ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এছাড়া খেয়ার মাঝি এই দুর্যোগময় মুহুর্তে খেয়া ছাড়তেও অস্বিকার করলো। টাকায় সবকিছু সম্ভব। তাই সেই হাড্ডিসার রোগা খেয়াঘাটের মাঝি টাকার লোভ সংবরণ করে আমাদের প্রস্তাব উপেক্ষা করতে পারলো না। খুব কষ্টে নদী পার হলাম। কিন্তু বড় বিপদে পড়লাম। কেননা, কোনো টেম্পো গাড়ীওয়ালা এই দুর্যোগ ঝড়ের মধ্যে গাড়ী ছারতে সাহস পেল না। এই দুঃসাহসিক কাজে ওদের রাজী করাবার জন্য বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনগুণ ভাড়ায় পৌছে দিতে ওরা সম্মত হলো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমরা বরুনহাট নামক একটা জায়গায় নদীর পাড়ে পৌছলাম। খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার সাথে দুটো প্রধান স্থলপথে বসন্তপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা- একটা পারুলিয়া হতে কালিগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জ হয়ে, অন্যটা সাতক্ষীরা- শ্যামনগর রোড। পারুলিয়া থেকে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটা বেশ প্রশস্ত। সিএ-বি’র রাস্তা। ভারী সামরিক যানবাহন এর উপর দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু পরেরটা বিশেষ সুবিধাজনক নয়। তবুও পাকিস্তানী শত্রুবাহিনী প্রায়ই এই রাস্তায় চলাফেরা করতো। তাই সৈন্য চরাচল ও আক্রমণ পরিচালনার জন্য সামরিক দিক দিয়ে বসন্তপুর ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ। বসন্তপুর অধিকার করে উপরোক্ত রাস্তা দুটোর উপর প্রভাব বিস্তার করার অর্থ একশ’ বর্গমাইল মুক্ত এলাকা হাতের মধ্যে আসা এবং এই সংকটময় দিগুলোতে এটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।

ইছামতি নদীর চাইতে বরুনহাটের এই নদীটি পাশে ছোট। কিন্তু দেখতে ভয়ংকর দৈত্যের মতো। এই অবস্থায় খেয়া পার হওয়া সাংঘাতিক বিপজ্জনক। অযথা সময় নষ্ট না করে সুযোগসন্ধানী এক নৌকার মাঝিকে বেশী টাকা দিয়ে নদী পার হলাম। কোন যানবাহন ছিল না। দীর্ঘ পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে হিংগলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার আস্তানায় পৌছতে হবে। ভায়নক শীত। তার উপরে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজে গিয়েছিল। হাঁটু পরিমাণ কাদা ভেঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদার ঘাঁটিতে পৌছলাম। সামান্য একটু উচু জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা আস্তানা গেড়েছিল। তাঁবু ভেদ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। ক্যাপ্টেন হুদাকে বড় বিষন্ন মনে হলো। উঁচু জায়গাটার চারদিকে বৃষ্টির পানি জমে সমুদ্রের মত মনে হলো। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আমাকে আসতে দেখা হুদা যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। মুখ তার দৃঢ়প্রত্যয়ের হাসি। কাছে গিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। ‘জয় বাংলা’ বলতেই সবাই বৃষ্টি মধ্যে লাফিয়ে পড়ে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তুলে আমাদের স্বাগত জানালো। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। ইত প্রাণচাঞ্চল্য আমি আর আগে কখনও দেখিনি। ওদের সেই প্রাণচাঞ্চল্যে খুঁজে পেলাম আগামী দিনের বিজয়োৎসবের গোপন সংকেত। ওদের মনেভাবের উত্তপ্ততা লক্ষ্য করে আমি চিৎকার করে প্রশ্ন করলামঃ ‘আজ রাতেই তোমরা কি সবাই যুদ্ধ করতে রাজী আছো?’ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৩৫ শত লোকের মত চিৎকার দিয়ে উত্তর দিলঃ ‘হ্যা স্যার, আমরা সবাই প্রস্তু।” ওদের উচু মানসিক শক্তির পরিচয় পেয়ে আমি খুব ভরসা পেলাম। আগ্রহী কন্ঠ বললাম, ওকে। এই বলে ওদের বিদায় দিয়ে হুদার তাঁবুতে ফিরে গেলাম এবং আমরা ম্যাপের উপর ঝুঁকি পড়ে কোথায় আক্রমণ চালাতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম। এ ব্যাপারে সোবহান নামে একজন হাবিলদার অনেক সাহায্য করেছিল। পাকিস্তানী আক্রমণের আগে সোবহান বসন্তপুর গোয়েন্দার কাজ করেছে। কাজেই সেখানকার সব খবরই তার জানা ছিল। ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালনার ব্যাপেরে সে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছিল।

রাত একটায় শত্রুপক্ষের বাষ্কারে ঝাটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা। উদ্দেশ্যে, ওদের বাষ্কারে নিক্ষেপ করে কাবু করা এবং পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসা। পরিকল্পাটার শুনতে মধুর ও উত্তেজনাকর লাগলেও-এই ঝড়ের রাতে এই দুঃসাহসিক কাজটা সমাধান করা ছেলেখেলা নয় তবু তারা, বা প্রথম অভিজানের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদা, মোটেই দমলো না। খুব জেরে ঝর বইছিল। একবার ভালাম ঝড়ের রাতে এই বিক্ষুব্দ নদীটা পার হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু মন থেকে এই নৈরাশ্যকে দূরীভূত করলাম। করলাম কেননা আমাদের বিজয় সম্বন্ধে আমি খুবই আশাবাদী ছিলাম। জানতাম সবাইকে বিস্মিত করে অভিযান সফল হবেই। ব্যাস্তসমস্ত হয়ে সবাই সামান্য খাবার খেয়ে নিলাম। শৌখিন পাচকেরা এসব পাক করেছিল। তারাও অভিযানে শরিক হলো। যখন আমি হুদার কাছে আমার উদ্দেশ্যের কারণ ব্যাখ্যা করছিলাম, তখন হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা ধারণা এলো যে, একই সঙ্গে টাউন শ্রীপুরে পাক হানাদারদের অপর একটি ঘাঁটি আক্রমন করব। ভারতের সীমান্তবর্তী শহর ‘টাকি’র অপর দিকেই টাউন শ্রীপুর। সেখানে শাজাহান নামে একটা স্কুল শিক্ষকের অধীনে অনেট ট্রে- মোজাহিদ আছে। মিঃ শাজাহান বুদ্ধিমান, হাসিখুশী এবং উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তিনি টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা ছিলেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে হালকা অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত একটি মোজাহিদ বাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন। তারা টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা হওয়ায় ওখানকার পাকিস্তানী ঘাঁটির সঠিক অবস্থান, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য খুটিনাটি সম্বন্ধে বেশ ওয়াকেবহাল ছিল। সুতরাং দুর্যোগময় রাতটার তাৎপর্য আমার কাছে দ্বিগুণ হয়ে উঠলো।

ক্যাপ্টেন হুদাকে বিদায় জানিয়ে আমি ও ডাক্তার শাহজাহান দু’মাইল রাস্তা হেঁটে ‘টাকি’ এলাম এবং মিঃ শাজাহানের সাথে আলাপ-আলোচনা করলাম। তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে আমার অধীনে কাজ করতে রাজী হলেন। মিঃ শাজাহানের অধীনে লেঃ মুখার্জী নামে একজন অসম সাহসী যুবক কাজ করতো। সে পূর্বে যশোরের অধিবাসী ছিল এবং দাবী করতো যে, সে ভারতীয় সামরীক বাহিনীর একজন ভূতপূর্ব অফিসার। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। বেশ শক্তিশালী। অন্য দু’দজন মোজাহি সেকশন লিডার মিঃ ম-ল ও সোবহানের সাথে লেঃ মুখার্জী একত্রে ট্রেনিং নিয়েছ। টাউন শ্রীপুরে পাক-হানাদারদের ঘাঁটি আক্রমণ করবো শুনে মুখার্জী উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বসন্তপুর অভিযানের মতো এখানেও এদের ইছামতী পার হয়ে যেতে হবে। ইছামতী আরও উত্তরে গোজাডাঙ্গা পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গায় পড়েছে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলোর ঠিক অপর দিকে পাকিস্তানী পর্যবেক্ষণ ঘাঁটি। আমার সেক্টরে ইছামতী নদীর তীর বারবার দু’তিন মাইল অন্তর পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলোর অবস্থান। সর্ব উত্তরে ‘শংকরা’। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে টাউন শ্রীপুর, দেবহাটা, খানজী, বসন্তপুর, উখসা ও সর্বশেষ কৈখালি। এসমস্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলোর শক্ষি বিভিন্ন রকমের। ভাবলাম, আমার প্রথম কাজ হলো, রাতের অন্ধকারে এবং গোপনে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে এই বিক্ষিপ্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো আবিষ্কার করা। এতে করে গেরিলাদের জন্য কতকগুলো গোপন অবস্থানের পরিকল্পনা করা আমার পক্ষে সুবিধাজনক হবে। যার ফলে একটা মুক্তাঞ্চলে গড়ে তোলা যায়। বাস্তবিক পক্ষে প্রথম অবস্থায় আমার পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় সীমান্তে টাকি, হিংগলগঞ্জ ও শসমেরনগর এই তিন জায়গায় আক্রমণ ঘাঁটি করে এর ঠিক বিপরিত দিকে পাকিস্তানী ঘাঁটি টাউন শ্রীপুর, বসন্ত পুর ও কৈখালি অধিকার করা। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অপ্রতুলতা হেতু আমার আশা সফল হয়নি। তবুও আমার কল্পনার উদ্দাম গতি থামেনি। যারা নিজেদের ভাগ্য গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সাহাযোগ্য এগিয়ে আসেন। এ কথার সত্যতা প্রমাণীত হলো ১৩ই জুন-যখন ক্যাপ্টেন গুদা বাগকের মারফত খবর পাঠালো যে, সেই দুর্যোগময় রাত্রে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী ঘাঁটি আক্রমণ করে ২০ জন হানাদারকে খতম এবং ৫০টি রাইফেল, দু’টি এল-এম-জি, অনেক অসশস্ত্র, গোলাবরুদ, গ্রেনেড ও বিষ্ফোরক দ্রব্য হস্তগত করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমন্ত শত্রুদের উপর হামলা চালিয়েছিল। শত্রুপক্ষের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে আমাদের একজন যুবক সামান্য আহত হয় মাত্র। শত দুঃখের মাঝেও বিজয়গর্বে বুক ফুলে উঠলো। লেঃ মুখার্জি, মিঃ ম-ল, সোবহান ও মিঃ শাহজাহান আমার সদর দপ্তরে এসে খবর দিল যে, তাদের আক্রমণও সফল হয়েছে। ওদের সবার মুখেই বিজয়ের হাসি। বিজয়োল্লাসে মিঃ শাজাহান আমাকে অভিনন্দন জানালো। আমিও আন্তরিকভাবে ওদেরকে স্বাগত জানালাম। আমার সুন্দরবনের ব্যর্থতার গ্লানি আজ যেন কিছুটা লাঘব হলো। পরক্ষণেই প্রতিহিংসার দাবানল আমার ভেতর আবার দ্বিগুণভাবে জ্বলে উঠলো। মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা ৩৫টি রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র অধিকার করেছিল। এই বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র হাতে আসায় আমার আক্রমণ পরিচালনা ঘাঁটির পরিধি আরও প্রসারিত করতে মনস্থ করলাম। ওই দিনই মিঃ শাজাহানের সহায়তায় টাকিতে আমার অন্তর্বর্তীকালীন ঘাঁটি স্থাপিত হলো। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী দক্ষ সৈন্যর উপর দুর্যোগের মধ্যে হামলা চালিয়ে এই বিরাট সফলতা অর্জন করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন হুদা, মিঃ শাজাহান, লেঃ মুখার্জী ও মিঃ মণ্ডলকে অভিনন্দন জানালাম। একই সঙ্গে খুব অল্প সময়ের ভেতর সীমান্তবর্তী সমস্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো আক্রমণ করার ইচ্ছা ওদের কাছে প্রকাশ করলাম। এছাড়াও আর একটা জিনিসের উপর জোর দিলাম যে, সীমান্তের ওপারের ছেলেদের জোগাড় করে এই মুহূর্তেই ওদের ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এই জন্য টাকি থেকে দুই মাইল দুরে ‘টকিপুরে’ একটি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা নিলাম। সীমান্তের ওপার থেকে ছেলে জোগাড় করার দায়িত্ব মিঃ শাজাহনকে দিলাম। বসন্তপুর ও টাউন শ্রীপুরে আমাদের সফলতার খবর সর্বাধিনায়কের কানে শিগগিরই পৌঁছে গেল। ভবিষ্যতে আরও এরকম সফলতা আশা করে তিনি স্বাগত জানালেন।

ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনীর অনেক লোক ও স্কুল-কলেজের ছাত্র সীমান্ত পার হয়ে এপারে চলে এলো। ছাত্রদের টাকিপুর যুবকেন্দ্রে ট্রেনিং-এর জন্য এবং সামরিক বাহিনীর লোকদের হুদায় ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দিলাম। ওদের সাথে বরিশাল থেকে এম, এ, বেগ নামে একজন লোক এসে পৌঁছলো। যুবক, শিক্ষিতও চটপটে। গায়ের রং কালো, সারা মুখমণ্ডলে প্রতিভা ও চাঞ্চল্যের স্বাক্ষর ও সে পাকিস্তান সৈনাবাহিনীতে একজন দক্ষ প্যারাসুট সৈনিক ও একজন ফ্রগম্যান হিসেবে অনেক দুঃসাহসিক কাজে নিযুক্ত ছিল। এই কাজে ওর সমতুল্য বড় একটা কেউ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের চেরাটে’ দীর্ঘ আট বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে ‘মিডশীপম্যান’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়। ওখান থেকে ১৯৭১ সারের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সে বাংলাদেশ পালিয়ে আসে। এ রোমঞ্চকর জীব ছেড়ে পালিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে উত্তর দিল – ‘বাংলাদেশ’।

আরোও দুটো সাহসী ছেলেকে সাথে নিয়ে বেগ জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে হাসনাবাদ পৌঁছলো। বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি থানার কুড়িগ্রাম নামক একটা গ্রামে পাক হানাদারদের সাথে সংঘর্ষের এক চমকপ্রদ কাহিনী শুনালো সে। জায়গাটা স্বরূপকাঠি থানার অনেক ভেতরে। এখানে সারি সারি অনেক পেয়ারা বাগান আছে। দুটো সারির মাঝখানটা নালার মত। সেখানে যে কেউ অনায়াসে আত্মগোপন করে থাকতে পারে। বেগ প্রায় একশ’ ঝানু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দিনের বেলায় এই নালার মধ্যে লুকিয়ে থাকতো এবং রাতের অন্ধকারে ওখান থেকে বেরিয়ে এসে হানাদারদের উপর আঘাত হানতো। সবার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। কারো কারো কাছে মান্ধাতায় আমলের তীর-ধনুক, বর্শা ইত্যাদী থাকতো। বেগ-এর বাহিনীর অবিরাম আক্রমণে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত পাক-হানাদার একদিন, এক দালালের কাছে খবর পেয়ে দিনের বেলায়াই ওদের উপর আক্রমণ চালাবার জন্য অগ্রসর হলো। বেগও ঠিক সময়মত বাহকের মারফত হানাদারদের অগ্রসর হবার সংবাদ জেনে গেল এবং হাতের কাছে যে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও পুরনো আমলের তীর-ধনুক পাওয়া গেল-তাই নিয়েই ওর লোকজনদের প্রধান প্রধান জায়গায় বসিয়ে দিল। একদিকে নগণ্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত বাংলার দুর্জয় মুক্তিবাহিনী, অন্যদিকে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ পাকিস্তানী সৈন্য। সবাই প্রস্তুত। কিন্তু প্রাচিন রোন নগরী বা অন্য কোন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যুদ্ধের মত এখানে বেজে উঠলো না কোন রণদামামা। উত্তেজনা চরমে উঠলো যখন দালালরা প্রায় ৫০ জন হানাদারকে সাথে নিয়ে এস পেয়ারা বাগানের ভেতর তল্লাশী চালাতে বললো। হানাদাররা বাগানে ঢুকে খুব সর্তকতার সাথে বাগানের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। দক্ষ শিকারীর মত বেগ তার দুঃসাহসিক মুক্তিবাহিনী নিয়ে অসম্ভব রকমের চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই। ওরা অপেক্ষায় ছিল কতক্ষণে শত্রুপক্ষ বন্দুকের নলের আওতায় আসবে। পাক হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মুক্তি’ বলে ডাকতো। অনেক তল্লাশী চালিয়ে কোন ‘মুক্তির’ খোজ না পেয়ে হানাদাররা পাক পেয়ারায় ভর্তি একটা গাছের উপর বিশ্রাম নিতে লাগলো। আর কি! চতুর্দিক থেকে আচমকা ছুটে আসতে লাগলো বন্দুকে গুলি, তীর, বর্শা ইত্যাদি। হতভম্ব হয়ে হানাদাররা চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক ছুট দিল। ঘটনাস্থলেই ২০ জন হানাদার খতম হলো। বাদবাকিগুলো জীবনের মায়ায় পেয়ারা গাছের ভেতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। ওদের পলায়নের পালাটাও খুব আরামে কাটলো না। বাগানের বোলতা ও মৌমাছি ভয়ানকভাবে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতেমুখে হুল ফুটাতে লাগলো।

পরে শুনেছি, পেয়ারা বাগানের এই পরাজয় হানাদারদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। এই বোকাগুলো শেষ পর্যন্ত স্থানীয় লোকজন দ্বারা সম্পূর্ণ পেয়ারা বাজান কেটে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয় যাতে করে ভবিষ্যতে ওরা নিরাপদ হতে পারে। এই ঘটনার পর বেগ তার গোপন আড্ডা দিয়ে অন্য আর একটি জায়গায় গিয়ে ‘যাদু’ দেখাবার আয়োজন করছিল। ঠিক এই সময় গোলাগুলির অভাব দেখা দিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের গোপন পথ ধরে হাসনাবাদ আসতে হয়েছে। এই সময় বেগের মত একজন দক্ষ লোকের সাহায্য ও সহযোগিতার খুবই প্রয়োজন ছিল। কেননা, সে নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা পদ্ধতি ও কলাকৌশল সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। তার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে শত্রুদের উপর আঘাত হানবে। কিন্তু ওকে আমি যেতে দিলাম না। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ওকে ক্যাপ্টেন হুদার কাছে পাঠালাম। বেগকে পেয়ে ক্যাপ্টেন হুদা ওর কাঁধেও কিছুটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিল।

বসন্তপুর ঘাঁটি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করার দায়িত্ব ওদের একলার উপর ছেড়ে দিয়ে আমার দৃষ্টি আরও দক্ষিণে শমসেরনগরে দিকে নিবদ্ধ করলাম। হাসনাবাদ থেকে শমসেরনগরের দূরত্ব চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল। আক্রমণ পরিচালনার জন্য কৌশলগত কতকগুলো মূল অসুবিধা ছিল। প্রথমতঃ জায়গাটা আমাদের আওতা থেকে অনেক দূরে। যাতায়াত ব্যবস্থা একমাত্র নদীপথ। দ্বিতীয়তঃ যদিও ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়িতে একটা বেতার ব্যবস্থা ছিল, তবুও আমাদের নিজস্ব কোন বেতারযন্ত্র না থাকায় এতদূর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তাছাড়াও নতুন আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করার আগে জনশক্তিও প্রয়োজন উপকরণ সামগ্রীর স্বল্পতার কথা চিন্তা করতে হবে। এই সমস্ত সমস্যা বিদ্যমান থাকা জনশক্তিও প্রয়োজন উপকরণ সামগ্রীর স্বল্পতার কথা চিন্তা করতে হবে। এই সমস্ত সমস্যা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নতুন করে কোন কিছু করতে যাব কিনা এ বিষয়ে নিজে নিজে ভাবছিলাম। সৌভাগ্যবশতঃ একদিন ভোরে ২০০ ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বিহার প্রদেশের ‘চাকুলিয়া’ থেকে এসে হাজির হলো। এইসব যুবক মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘ক্রাশ প্রোগ্রামে’ ট্রেনিং লাভ করে। প্রয়োজনের সময় ওদের প্রেয়ে খুব স্বস্তি অনুভব করলাম। সংবাদ বাহকে মাধ্যমে আমাদের সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে একখানা চিঠি পেয়ে আরও খুশি হলাম। তাতে লেখা ছিলঃ “ব্যারাকপুরে চার্লি সেক্টর থেকে এই দু‘শো’ মুক্তিযোদ্ধারা জন্য শীগগীরই অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাবেন।” সংবাদটা দ্বিগুণ জোরে আমার কানে বাজতে লাগলো দু‘শা’ রাইফেল।

সংবাদটা পাওয়ার পরেই মোজাহিদ ক্যাপ্টেন মিঃ শাজাহানকে ডেকে টাকির কাছাকাছি কোথাও একটা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য স্থান নির্বাচন করতে বললাম। নিরাপত্তার খাতিরে আমি চাইনে যে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা অদক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে টাকিপুর যুদ্ধক্ষেত্রে এক হয়ে মিশে থাক। আমার দপ্তরে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে মিঃ খুরশীদকে নিয়ে জীপে চাপলাম। খুরশীদ তথাকথিত আগরতলা মামলার একজন আসামীও ছিলো। সে সাধারণতঃ লেঃ খুরশীদ নামেই পরিচিত। জীবনের মূল্যবান অংশটা সে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কাটিয়েছে। একথা সে আমাকে প্রায়ই সম্মরণ করিয়ে দিত। মিঃ খুরশীদ খুব সরল, সৎ ও দেশপ্রেমিক। মুখে সবসময় হাসি। এই ভদ্রলোকটি বন্ধুবান্ধবের জন্য যে কোন সময় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারতো। একমুখ দাড়ি-প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গী। খুরশীদকে একজন পাক্কা গোয়েন্দার মত লাগতো। জন্ম থেকেই সে আশাবাদী। ভয়ানক দুঃসময়ে ওকে আমি হাসতে দেখেছি। তার সাহচর্য পেয়ে খুব আশ্বস্ত হলাম এবং তাকে নিয়ে আমাদের সর্বাধিনায়কের সাথে দেখা করার জন্য তাঁর সদর দপ্তরে রওনা হলাম। কি আর বলবো- তিনি এমন একটা জায়গায় সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন, যার নাম নিরাপত্তার (!) খাতিরে প্রকাশ করা যায় না। যা হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশী কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশী কথাবার্তা পছন্দ করতন না। কোলকাতাতেই মিঃ খুরশীদ, সুলতান আহমেদ নামে চটপটে এক ভদ্রলোককে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আলাপ পরিচয়ে বুঝতে পারলাম মিঃ সুলতান আহমেদ বেগের একজন প্রশিক্ষণ-গুরু। এই সংবাদে শুধু সাহসই পেলাম না, রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কেনা, এতে করে আমার নতুন আখড়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেদের আরও উন্নত প্রণালীতে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ এস গেল। আর এ জন্য মিঃ সুলতানের তত্ত্বাবধানে কাজ কার জন্য বেগকে নির্দেশও দিলাম।

সুলতান ও খুরশীদকে সংগে করে কর্মচঞ্চল কোলকাতার রাস্তা দিয়ে ব্যারাকপুরের দিকে ছুটলাম। চার্লি সেক্টর খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগে গেল। কেননা, এটা একটা নতুন সংস্থা। আমার ও মেজর ওসমানের সেক্টও থেকে আক্রমণ পরিচালনায় সমন্বয় সাধনের জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই সংস্থা স্থাপন করেছে। সংক্ষেপে চার্লি সেক্টরের পরিচয় হলো- এর অধিনায়ক একজন ব্রিগেডিয়ার, তাঁর অধীনে দু’জন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন এবং কয়েকজন কেরানী। ব্রিগেডিয়ার জানালেন যে, ভবিষ্যৎ আক্রমণ পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্যের জন্য তিনিই দায়ী। সব সময় তাঁর ও ষ্টাফেল সক্রিয় সহযোগিতা পাব বলে আশ্বাস দিলেন। দুর্যোগময় চারটি মাসের ব্যথা-বেদনা, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মাঝে এই প্রথমবারের মত সক্রিয় আশ্বাসের বাণী শুনলাম। এই প্রতিশ্রুতি আমাকে ভরসা দিল, সাহস যোগালো। আমর ঝিমিয়ে পড়া মনটাকে আবার আশা- আনন্দের নতুন উদ্দীপনায় সজীব করে আরও কঠিনভাবে শত্রুপক্ষের উপর আঘাত হানার জন্য ফিরে এলাম আমার সদর দপ্তরে হাসানাবাদে।

এক এক দলে ছ’জন করে মোট ষাটজন মুক্তিযোদ্ধাকে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে খুলনা পাঠিয়ে দিলাম। উদ্দেশ্য, শহরের ভেতরে ও চতুর্দিকে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের বলে দিলাম, প্রাথমিক কাজ সমাধা করার পর যারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, তাদেরকে আমার ঘাঁটিতে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতে- যাতে করে ওরা চেনা গোপন পথ ধরে পরপর গেরিলা দলকে বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে যেতে পারে। এই গিরিলা পদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রথম উদ্দেশ্য হলো বিকল্প গোপন পথ খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়তঃ নির্ভরযোগ্য স্থানীয় লোকদের সহায়তায় শহরের ভেতরে ও তার চতুর্দিকে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করা। তৃতীয়তঃ পথপ্রদর্শকদের ফেরত পাঠিয়ে খবরাখবর আদান-প্রদান কর। তখনকার দিনে এই কাজগুলো সমাধা করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। কেননা, পাকিস্তানী পশুগুলোর হিংস থাবা গ্রামবাংলার সব জায়গায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে। তবুও অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা কঠিন আত্মবিশ্বাসের দুটো কারন হতে পারে। প্রথমতঃ খুলনার অধিবাসী দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানী হানাদাররা নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলেও ভেতরের জনসাধারণের আওয়ামীলীগের উপর আস্থা ছিল। গেরিলাদের কাছে ছিল ষ্টেনগান গ্রেনেড ও চাকু। ওদের নিরাপত্তা ও পথে যদি ওরা হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অথবা শত্রুর সামনে পড়ে তাহলে ওদের মোকাবেলা করার জন্য কিছু হালকা ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্যও সাথে দিয়ে দিলাম। প্রাণঢালা আশীর্বাদ করে আগের নির্দেশানুযায়ী ওদের বিভিন্ন রাস্তায় পাঠিয়ে দিলাম।

সময়টা ছিল ১৪ই জুলাইয়ের রাত্রি। শত্রুপক্ষের সামরিক যন্ত্রটাকে শুদ্ধ করার জন্য শিল্প এলাকায় আমার দ্বিতীয় পর্বের আক্রমণ শুরু হলো। শিল্প এলাকাগুলোর কার্যক্ষমতা অচল করে দিতে পারলে সামরিক যন্ত্রটাকে বাঁচিয়ে রাখার মত হানাদারদের অর্থের অনটন ঘটবে। এই কাজটা খুবই মর্মান্তিক। কেউই চায় না তার নিজের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিসাধন বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক। এছাড়া কোন উপায় ছিল না। কেননা, আমাদের সামগ্রিক সাফল্য অর্জনের জন্য এ কাজটা ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করবে এবং সেই সঙ্গে শত্রুপক্ষের আক্রমণধারাও পংশু করে দেবে। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন হুদাও তার ঘাঁটি থেকে আক্রমণের গতি বেশ সন্তোষজনকভাবে বাড়িয়ে দিল। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ ৩৫ জনের ছোট্ট বাহিনীটি বাড়তে বাড়তে ৩৩০ জনে এসে দাঁড়ালো। শত্রুপক্ষের উপর রীতিমত আক্রমণ চালিয়ে তারা বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জন করলো। বেগের অক্লান্ত সহযোগিতায় হুদা পাকবাহিনীর তিনটি সীমান্ত ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। এর ভেতর ছিল দক্ষিণে উকসা, বসন্তপুরের উত্তরে দেবহাটা ও খানজী সীমান্ত ফাঁড়ি। মাইন, ডিনামাইট ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে ওই ফাঁড়িগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। উকসা অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যরা পাহারায় বেরুলে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে ওদের কাবু করেছিল, সে সম্বন্ধে হুদা আমাকে একটি চমপ্রদ কাহিনী শোনালো। ওঁৎ পেতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর আঘাত হানার জন্য জুলাই মাসের ২৮ তারিখ ক্যাপ্টেন হুদা ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধারা একটি দল নিয়ে ইছামতি পার হলো। পাকিস্তানী সৈন্যরা উকসা ঘাঁটিতে খুব ভোরে পাহারায় বেরুতো। হুদা ও তার সাথের লোকের একটা খুঁটির সাথে ‘জয় বাংলা’ পতাকা লটকিয়ে তারা চারিদিকে ‘এন্টিপার সনাল’ মাই পুঁতে রেখে নিকটবর্তী একটা ধানক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে ওরা ফিস ফিস শব্দে শুনতে পেল। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তখনও গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু আবছা অন্ধকার। হুদা ও তার সাথের লোকন জলভর্তি ধানক্ষেতের মধ্যে চুপচাপ প্রস্তুত হয়ে রইলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হানাদাররা এদিকে আসলো না। উড়ন্ত ‘জয় বাংলা’ পতাকাটা চোখে পড়তেই মাথাভারী কুত্তার দল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো এবং ওটাকে নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলার জন্য বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে ছুট আসলো। আর যায় কোথায়? গমস্ত পৃথিবীটাকে কাঁপিয়ে প্রচ- বিস্ফোরণ। হাতির মত পাকিস্তানী দৈত্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়লো এবং হুদা তার লোকজন ও শত্রুদের পরিত্রক্ত অস্ত্র নিয়ে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে এলো।

আমার মনে পড়ে, ‘ভট্টাচার্য’ নামক দশ বছরের একটি ছেলে বেগের বিশেষ ‘বাহিনীতে’ যোগ দেয়। এই বিশেষ বাহিনীটির নাম ‘হার্ড কোর অব সার্জেন্টস’। এর বিশেষত্ব ছিল বারো বছরের ঊর্দ্ধে কোন বালককে এই বাহিনীতে নেয়া হতো না। নতুন এসেও, ভট্টাচার্য কঠিন পরিশ্রমের বলে সার্জেন্ট মেজরের পদে উন্নতী হলো। সে নিজের অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। উপরন্ত, চারদিকে শত্রুথাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান, শক্তি, সাতক্ষীরা- কালিগঞ্জ রাস্তায় পারূলিয়া ব্রীজের খুঁটিনাটি-সব মূল্যবান সংবাদ সংগ্রহের জন্য তার ক্ষুদে বাহিনীকে যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করেছি। পারুলিয়া ব্রীজটা লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট। এই ব্রীজের উপর দিয়েই হানাদাররা তাদের রসদসম্ভার, অস্ত্রশস্ত্র কালিগঞ্জ ও বসন্তপুরের নিয়ে যেত। ব্রীজটার উপর হামলা চালানোর দিন ভট্টাচার্য রাতের অন্ধকারের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ব্রীজের এক প্রান্তে পাহারারত সান্ত্রীদের কয়েক গজের মধ্যে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আর এদিকে বেগ ব্রীজের নিচে বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে দিল। সংকেত দিতেই এই দশ বছরের সার্জেন্ট মেজরটি ঝোপের আডাল থেকে শত্রুর দিকে গ্রেনেড ছুড়ে মারলে কোনদিক থেকে গ্রেনেড ছুঁড়েছে টের পাবার আগে সান্ত্রীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তারপর সার্জেন্ট মেজরটি তার ছোট্ট কনুইয়ের উপর ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে বেগের সাথে এসে মিলিত হলো এবং নীরব অপেক্ষা করতে লাগলো কখনো বিস্ফোরণের ভয়ানক গর্জনটা কানে ভেসে আসবে। দীর্ঘমেয়াদী বিস্ফোরক দ্রব্য বুকে নিয়ে ব্রীজটা অসম্ভব সকমের নীরব ও শান্ত। মগজহীন হানাদার সান্ত্রীরা ভারী বুট পায়ে ব্রীজের অপর প্রান্তে পায়াচারি করছিলো। বেগ হাতঘড়িটার দিকে তাকালো। সময় আসন্ন। উহ কি ভয়ানক উত্তেজনা। প্রচ- শব্দ করে ব্রীজের বেশীর ভাগ অংশ উড়ে গেল। আর পোশাক পর পাকিস্তানী পশগুলো চিরদিনের জন্য ভেসে গেল স্রোতের জলে।

আমাদের উপর্যুপরি সাফল্যে একদিন যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল উন্নত হলো, অন্যদিকে অনেকগুলো অসুবিধাও দেখা দিল। কেননা, মুক্তিযোদ্ধারা ঘন ঘন আক্রমণ করায় পাক হানাদাররা ক্ষেপে গিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের লোকজনের উপর চরম অত্যাচার আরম্ভ করলো। ওদের অকথ্য অত্যাচারের ফলে স্থানীয় লোকজন আমাদের উপর কিছুটা বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠলো। এর ফলে আমাদের গেরিলা কৈৗশল অনেকটা ব্যাহত হলো। বেসামরিক জনসাধারণ আমাদেরকে শত্রুমনে করতো না। কোন অঞ্চল মুক্ত হলে সেখানে আমরা অবস্থান করি, এটা তারা মনে মনে সব সময় কামনা করতো। কিন্তু নানান অসুবিধার জন্য আমরা মুক্তাঞ্চলে থাকতাম না। প্রথমতঃ প্রকৃতপক্ষে কোন জায়গা দখলে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না, দ্বিতীয়তঃ আমাদের ছেলেরা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নয়। তৃতীয়তঃ লোকসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে ওরা আমাদের চাইতে অনেক উন্নত। খ-যুদ্ধ চালাবার মত শক্তি আমাদের ছিল না। সুতরাং একমাত্র কৌশল আমাদের সামনে যা খোলা ছিল, সেটা হলো সেই পুরানো কায়দা-‘আক্রমণ করো এবং পালিয়ে এসো।’ এই কৌশল আবলম্বন করায় যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকের নিরীহ লোকদের জীবনে নেমে আসলো অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। কিন্তু আমাদের কোন বিকল্প পন্থাও ছিল না।

শাসনকার্য পরিচালনার জন্য কিছু লোক হিংগলগঞ্জ রেখে ক্যাপ্টেন হুদা ইতিমধ্যেই তার দপ্তর উকসা নিয়ে এসেছে। উকসায় তাঁকে পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কেননা, নদীর তীর বরাবর উঁচু বাধ ছাড়া আর কোন জায়গা ছিল না, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে। বঁধের নীচে যতদূর চোখ যায় শুধু কর্দমাক্ত ধানক্ষেত। অন্য কোন উপায় না থাকায় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মাথা গুঁজতে হতো। তাড়াতাড়িতে খোঁড়া এই ব্যূহগুলো প্রবল বৃষ্টির ঝাপটা সহ্য করতে পারতো না। এই মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজতো। বেশীর ভাগ সময় আধপেটা খেয়ে দিন কাটাতো। কেননা, রান্নাবান্না কার অনেক অসুবিধাও ছিল। যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে হুদা ওদের মনোবল বাঁচিয়ে রেখেছিল। ভাবতে অবাক লাগে, মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার চাইতে যুদ্ধের দিকে আসক্তি ছিল বেশী। শত্রুর উপর হামলা করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদা ও সহ-অধিনায়ক বেগ দুশো মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একদিন রাতে শ্যামনগরের দিকে অগ্রসর হলো। সময়টা এমনভাবে নির্ধারিত করা হয়েছিল যে রাত্রে রওনা হয়ে ভোর হওয়ার কিছু আগেই শ্যমনগর পৌঁছে যায়-যাতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়া যায়।

ছোট ছোট ছেলেদের পক্ষে ধানক্ষেতের মধ্যে এই দীর্ঘ পথ হেঁটে যাওয়া খুব আরমদায়ক ছিল না। নিচে পায়ে কাঁটার আঘাত, উপরে ঠাণ্ডা বাতাস আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওরা অন্ধকারের ভেতর এগিয়ে চললো শ্যামগরের দিকে। পথের সাময়িক বাধাকে ওরা ভ্রক্ষেপই করলো না। কেননা ওদের অন্তরে ছিল বাংলার সোনালী ভবিষ্যৎ আর শ্রত্রুর প্রতি হিংসার চরম আগুন। সারাদিন তীব্র সংঘর্ষের পর সন্ধ্যা নামতেই শত্রুপক্ষের কামান, মর্টার, মেশিনগান স্তব্ধ হয়ে গেল এবং হানাদাররা চরম পরাজয় বরণ করলো। যুদ্ধক্ষেত্রের কিছু পেছনে শত্রুপক্ষের পঞ্চাশজনের একটা দল বেতারযন্ত্র ও ভারি অস্ত্রপাতি নিয়ে অবস্থান করছিল। ওদের মর্টার ও কামানের গুলি শ্যামল-শস্যক্ষেত পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। কিন্তু আমাদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারলো না। শত্রুপক্ষের লোকজন পালিয়ে যাবার সময় পথে গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকা আমাদের ছেলেরা অতর্কিত ওদের উপর হামলা চালিয়ে খতম করে দেয়।

শ্যামনগর থেকে পালাবার দুটো মাত্র পথ খোলা ছিল। একটা ভেটখালির দিকে, অন্যটা বসন্তপুরের দিকে। এই দুটো রাস্তাতেই হাবিলদার সোবহান ও মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকতের অধীনে আমাদের ছেলেরা ওঁৎ পেতে বসে ছিল। লিয়াকত দুর্দান্ত সাহসী। নভেম্বর মাসের কোন সময়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে অফিসার পদের প্রশিক্ষণের জন্য চলে যায়। শ্যামনগরের উপরে এই আক্রমণ আমার সেক্টরে একটা বিরাট বিজয়। এই বিজয়ে জনসাধারণেরও মনোবল অনেকাংশে বেড়ে গেল। শত্রুপক্ষের ক্ষতির তুলনায় আমাদের তেমন বিশেষ ক্ষতি হয়নি। ওদের অনেক লোকজন মারা যায়। আমাদের চারটি ছেলের মধ্যে মারাত্মকভাবে দু’জন জখম হয়। আর দু’জন সামান্য আঘাত পায়।

শ্যামনগর মুক্ত হওয়ায় জনগণের চক্ষু খুলে গেল। ওরা এই প্রথমবারে মত মুক্তিবাহিনীর শক্তির পরিচয় পেল। হুদার কাছে খবর পাঠালাম, যেভাবেই হোক একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শ্যামনগর আমাদের দখলে রাখতেই হবে। কেনন, আমার ইচ্ছা দখলক্রত রাস্তা ধরে খুলনা, মংলা ও চালনা পোর্টে মুক্তিবাহিনী পাঠিয়ে দিয়ে শত্রুর উপর আঘাত হানবো। আমার নির্দেশমত হুদা ও বেগের উপর শ্যামনগরের সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কালিগঞ্জ-বসন্তপুর অঞ্চওে শত্রুপক্ষের উপর হামলা জোরতার করার জন্যা সে নিজেই হিংগলগঞ্জে ছুটে এলো।

পদাতিক বাহিনীর দ্বারা সাহায্যযুষ্ট শত্রুপক্ষের একদল সৈন্য এই অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। ওরা নদীপথে ইছামতী দিয়ে যাতায়াত করতে পারতো না। কিন্তু ওদের গানবোটগুলো কালিগঞ্জ বরাবর যমুনা নদী দিয়ে দক্ষিণে পাইকগাছা পর্যন্ত পাহারা দিত। যাতায়াত ও সরবরাহ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার এটাই প্রধান রাস্তা। শত্রুদের সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার জন্য উত্তর-পূর্বদিকে যমুনার তীর বরাবর গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদাকে একটা পরিকল্পনা তৈরী করে দিলাম। যখন খবর পাওয়া গেল যে, পাকিস্তানী গানবোটগুলো যমুনায় পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা দল ‘রিকয়েললেস’ রাইফেল নিয়ে হিংলগঞ্জ এসে ঘাঁটি গাড়লো। এই দূরপাল্লার রাইফেল দিয়ে গানবোটগুলোকে সহজেই আঘাত করা যায়। সেন বর্মা নামে একজন অল্পবয়স্ক লেফটেন্যান্ট এই বাহিনীর অধিনায়ক। ভারতের প্রধান নির্বাচনী কমিশনার মিঃ সে বার্মার পুত্র। পূর্বে বরিশাল জেলার অধিবাসি ছিলেন। এ সময় ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরী মুক্তিযুদ্ধে অংশহগ্রহণ করতো না। প্রয়োজনবোধে মুক্তিযোদ্ধারা কোন সাহায্য চাইলে ভারতীয় সৈন্যরা পিছন থেকে শত্রুপক্ষের উপর গোলাবর্ষণ করতো। কিন্তু প্রতিভাদীপ্ত যুবক এই সেন বর্মাকে বাধা দেবে? সে ক্যাপ্টেন হুদার ইছামতী পার হয়ে হানাদারদের উপর ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ চালিয়ে আবার এপারে ফিরে আসতো। ক্যাপ্টেন হুদা লেঃ সেন বর্মাকে সহযোগী হিসাবে পেয়ে খুবই খুশী হলো।

আক্রমণ পরিচালনায় হুদার যোগ্যতার উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে আমি ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহকে নিয়ে শমসেরনগরে যুদ্ধ পরিচালনা ঘাঁটি স্থাপন করার পাকাপোক্ত সিধান্ত নিলাম। সলিমুল্লাহ শক্তিশালী ও সাহসী। তখনকার পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তাকেই উপযুক্ত মনে করলাম। হাসানাবাদে আমার যে লঞ্চটি ছিল তাকে করে ত্রিশজন মুক্তিযোদ্ধাকে সলিমুল্লাহর অধীনে শমসেনগর পাঠিয়ে দিলাম। শমসেরনগর অনেক দূরে রায়মংগল নদীর তীরে অবস্থিত। এই জায়গাটার অনেক রকমের অসুবিধা ছিল। কিন্তু আমার সার্বিক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য স্থানটার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রথমতঃ আমি চাচ্ছিলাম সমগ্র সুন্দও বনাঞ্চলে আধিপত্র বিস্তার করে বাংলাদেশের অভ্যান্তরে গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহের জন্য একটা নিরাপদ রাস্তা। দ্বিতীয়তঃ আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশের অভ্যান্তরে একটা আক্রমলকারী দল পাঠিয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও গোপালগঞ্জে যেসব বিক্ষিপ্ত মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের সাথে একটা সুষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করা। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তাঁবু, রেশন ও পোশাক না থাকা সত্ত্বেও সলিমুল্লাহ হৃষ্টচিত্তে শুধুমাত্র সাহসের উপর ভর করে আগষ্ট মাসের শেষদিকে শমসেরনগরে ঘাঁটি স্থাপন করতে উঠে পড়ে লেগে গেলা। বর্ষা ঋতুতেই সে ঘাঁটি বানাবার মনস্থ করলো। শমসেরনগরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়ির আধ মাইল দক্ষিণে নদীর তীরে বাঁশ দিয়ে একটা ঘাঁটির মত তৈরী করা হলো। এর চতুর্দিকে কাদাপানি। ওকে যে কাজের ঘাঁটিটার চারদিক জলকাদা। আসওে সলিমুল্লাহ সাহেব একজন কেতাদুরস্ত লোক। বর্ষা ও কাদামাটির ভেতর যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তো, তখন ফ্লাইট সার্জেন্ট সলিমুল্লাহকে খুবই খুশী মনে করত। বিশেষভাবে তাগিদ দেয়ায় তার ছেলেদের জন্য বর্ষাতি পাঠিয়ে দিলাম। সপ্তাহ শেষে প্রয়োজনীয় রেশনপত্র পাঠিয়ে দিতাম। সলিমুল্লাহর তেমন আর কোন অভিযোগ ছিল না। শুধু প্রধান লঞ্চচালক মোশাররফ মিযা মাঝে মাঝে অস্ত্রশস্ত্রের একটা বড় তালিকা নিয়ে হাজির হতো।

শমসেরনগর যাবার কিছুদিন পরেই কৈখালিতে পাক বাহিনীর উপর উপর্যুপরি কয়েকবার হামলা চালিয়ে সীমান্তবর্তী ঘাঁটিটা অধিকার করি এবং সরাসরি এপারে সলিমুল্লাহ আর একটা ঘাঁটি স্থাপন করে। ইতমধ্যে সুন্দরবনের ‘রাজা’ নওয়াবদীর সাথে পরিচয় হয়। সুন্দরবন এলাকায় এই নওয়াবদী রূপকথার সেই কালো দৈত্যটার মত। বেশ বড় মুখম-ল। সারামুখ ভর্তি দার্ড়ি। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। দেহগঠন অত্যান্ত সুদৃঢ়। সারা সুন্দরবন এলাকায় সে একটা ভয়ানক ত্রাস। তার একমাত্র ব্যবসা চোরাচালানি। পূর্বের কুকীর্তি সত্ত্বেও, যখন আমি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তার সাথে দেখা করলাম তখন আমার কাছে সে অত্যান্ত লাজুক, ভদ্র ও অতিথিপরায়ণ বলে মনে হলো। হ্যাঁ, মনে পড়ছে, তারিখটা ৩রা সেপ্টেম্বর।

আমার সেক্টরের একটা লঞ্চে করে যাচ্ছিলাম। আমার অধীনস্থ লঞ্চগুলো শীগগীরই ‘বাংলাদেশ নেভি’ নামে পরিচিত হলো। সেপ্টেম্বরের শেষদিক আমার নৌ-বাহিনীতে ৬টা মটর লঞ্চ যোগাড় করা হয়। এগুলো শত্রুবাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। শুধুমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য নিয়োজিত রাখার চাইতে আমি ভাবলাম, এগুলোকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে গানবোটের কায়দায় ব্যবহার করা ভাল। সর্বধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর কাছে আমি আমার পরিকল্পনার কথা জানাতেই তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলেন। তারপর অধিনায়ক মুখার্জীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় বাহিনীকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমার ছ’টি লঞ্চের জন্য ৫০টি ব্রাউনিং বিমানধ্বিংসী মেশিনগান নিয়ে এলাম। হালকা মেনিগান ও ছোট ধরনের অস্ত্রশস্ত্র চালাবার জন্য এক একটি লঞ্চে দশজন করে নাবিক মোতায়েন করলাম। আমার ভাগ্য ভাল যে, আমি সব নৌ-বাহিনীর লোকজন পেয়ে গিয়েছিলাম। আগে তার পাকিস্তান নৈৗ-বাহিনীতে চাকরিরত ছিল। বদরে আলম নামে একজন বেশ অভিজ্ঞ লোকের অধীনে নৌ-বাহিনীর এইসব লোকজনকে একত্র করলাম। যুদ্ধের সময় বদরে আলমকে সম্মানসূক লেফটেন্যান্ট পদে ভূষিত করা হয়। লেঃ খুরশীদ এই নৌ-বাহিনী গড়তে আমাকে সাহায্যে করেছে। এইসব লোকেদের যোগাড় করার জন্য সে একসেক্টর থেকে আর এক সেক্টরে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেরিয়েছে। ছেলেরা মানের মত কাজ পাওয়ায় ওর উপর খুব কৃতজ্ঞ হলো। আমার এই সংস্থাটি পরে ‘বাংলাদেশ নৌবাহিনী’ নামে পরিচিত হয়ে ভয়ানক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। এই বাহিনীর উপর প্রথম কাজ দেয়া হলো, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটিগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রীতিমত সরবরাহ করা। দ্বিতীয়তঃ নদীতে আক্রমণাত্বক পাহার দেয়া। তৃতীয়তঃ নৌ-সংক্রান্ত কাজকর্ম সুসমাধা করা। নৌ-সংক্রান্ত কাজকর্ম বলতে বুঝায়-মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্দিষ্ট ঘাঁটিতে নামিয়ে দেয়া। তারপর কাজ সমাধা হলে আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ রাত্রে যার সাথে দেখা হয়েছিল, সুন্দরবনের ‘রাজা’ সেই নওয়াবদী প্রসঙ্গে ফিরে আসি। হাসনাবাদ থেকে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা লঞ্চে থাকার পর শমসেরনগর পৌছলাম। তখন রাত গাঢ় অন্ধকার। মূষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এত অন্ধকার যে দু’গজ সামনে পর্যন্ত দেখা যায় না। চালকের পক্ষে লঞ্চ চালনা করা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠলো। সার্চলাইটের আলোতে বেশীদুর দেখা যায় না। প্রমত্তা রায়মঙ্গল এর উপর ভেসে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ তীর থেকে আমাদের উপর টর্চলাইটের আলো এসে পড়লো। অনুসন্ধানে জানতে পারলাম যে, ওটা ভরতের সীমান্ত ফাঁড়ির আলো। ওই ফাঁড়ির লোকেরা সলিমুল্লাহার আস্তানায় পৌছতে আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করলো। এই সময় বৃষ্টির মধ্যে দেখতে পেয়ে সলিমুল্লাহ আনন্দে আত্মহারা। ওখানকার সব ছেলের সাথে আমি দেখা করলাম। বৃষ্টির ঝাপটা এসে বাঁশের ঘরের মধ্যে ঢুকছিল। এই বর্ষার রাত্রেই সুন্দরবনের ‘রাজা’ নওয়াবদীর সাথে আমার দেখা হয়। পাক-বর্বরদের নৃশংস অত্যাচারে টিকতে না পেরে সুন্দরবনের হরিনগর গ্রামে তার পৈতৃক ভিটামাটির মায়া ত্যাগ করে ঝড়ের মধ্যেই পরিবারের সবাইকে তিনটি নৌকায় নিয়ে নওয়াবদী বেরিয়ে পড়ে। সুন্দরবনের রাজার চোখে জল। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, তার জীবন এমন দুঃখের দিন কখনো আসবে এবং পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে। হারিকেনের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম তার চোখে প্রতিহিংসার আগুন। চপলমতি ছোট্ট বালকের মত হঠাৎ সেই শক্ত মানুষটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। সে আমাকে জানালো যে মাত্র চারটা রাইফেল পেলে আজ রাত্রেই তার পরিবারের লোকজন নিয়ে সে গ্রামে ফিরে যাবে। তক্ষুনি তাকে চারটা রাইফেল দিয়ে দিলাম। নিকষ কালো লোকটা প্রচ- উল্লাসে সাদা দাঁতগুলো বের করে দুরন্ত বাতাসের সাথে দৈত্যের মত অন্তর্হিত হলো। এর ফলে শীগগীরই সে সুন্দরবনের গভীরে আমাদের গেরিলা ঘাঁটি প্রসারিত করতে নিষ্ঠার সাহে সাহায্য করেছিল।

বেগের একটি ‘যুদ্ধবাহিনী’ ছিল। তারা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় যে কোন ঝুঁকি নিতে তারা সর্বদা প্রস্তুত থাকেতো। সংখ্যায় সব মিলিয়ে দুশো হবে। সবাই যুদ্ধ করার মত উপযুক্ত। যা কল্পনা করেছিলাম- সেই প্রস্তুতি, সেই উৎকর্ষতা ওদের মাঝে দেখতে পেয়ে আমি সুন্দরবনের গভীরে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করার লোভ সামলাতে পারলাম না। সুন্দরবনটা দেখতে প্রায় ভিয়েতনামের হো চি মিন সড়কের মতো। কোন কারণে যুদ্ধ বিলম্বিত হলে, প্রাকৃতিক গুপ্তস্থানে ভরপুর এই সুন্দও বনাঞ্চল ছাড়া বাংলার আর কোন জায়গা এতটা সুবিধাজনক নয়। ব্যূহ রচনার কৌশলাদি ঠিকমত নিরূপণ করে এই অঞ্চলে যদি ঘাঁটি স্থাপন করা যায় তাহলে মুক্তিযুদ্ধ যে কোনভাবে যে কোন সময়সীমা পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। এই পরিকল্পনা মনে রেখে কৈখালিতে সলিমুল্লাহর জায়গায় বেগকে বসিয়ে দেয়ায় আমি তাকে শ্যামনগর থেকে নিয় এলাম। কাজ শুরু করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে বেগকে বুড়ি গোয়ালিনী, হরিনগর ও মুন্সিগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপন করার দায়িত্ব দিলাম। ফ্লাই সার্জেন্ট সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে রাতের বেলায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে দু’জন পাকিস্তানী সৈন্য কয়েকজন রাজাকার খতম করে এক সপ্তাহ আগে এই ‘বুড়ি গোয়ালিনী’ অধিকার করা হয়। বুড় গোয়ালিনীতি বন বিভাগের অফিস ও একটা শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ছিলো।

দুঃসাহসিক কাজের জন্য সলিমুল্লাহকে সম্মানসূচক লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত করা হয়। এই বুড়ি গোয়ালিনী অধিকার করা আমাদের পক্ষে একটা বিরাট সফলতা। কেননা, এখান থেকেই পাক সৈন্যরা সুন্দরবনের ভেতরে ও অগ্রভাগে আমাদের চলাচলের উপর নজর রাখতো এবং খবর সংগ্রহ করতো। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই ট্রান্সমিটারটাই আমার যাত্রার উদ্দেশ্যটা ব্যর্থতার পর্যবসিত করেছিল। সলিমুল্লার কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেগ ও তার বাহিনী শত্রুপক্ষের হামলা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। গানবোটগুলির উপর আঘাত করার জন্য বেগ সবসময় ওঁৎ পেতে প্রস্তুত হয়ে থাকতো। বুড়ি গোয়ালিনি পতনের পর পাক হানাদাররা মাঝে মাঝে আমাদের ঘাঁটির নিম্নাঞ্চল গানবোট নিয়ে পাহারায় বেরুতো। অক্লান্ত পরিশ্রম করে উপর্যুপুরি কয়েকবার আক্রমণ চালিয়ে হরিনগর ও মুন্সিগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী বিতাড়িত করে বেগ সেখানে গোপন ঘাঁটি স্থাপন করলো। এইসব ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত হবার পর পাক হানাদাররা সহসা পাল্টা আক্রমণ করতো না। কোন কারণে তারা যেন নরম হয়ে গেল। আমরা কখনও আক্রমণ করলে হানাদাররা খুবই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠতো। বোধ হয় ওদের ভয় ধরেছিল যে, আমরা ওদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছি। কেননা একদিকে সুন্দরবনের উপরিভাগ থেকে বেগ ও তার দুঃসাহসী যোদ্ধারা শত্রুদের উপর ক্রমাগত আক্রমণ চালাচ্ছি, আর অন্যদিকে দক্ষিণ শরণখোলা থেকে কঠিন আঘাত হানছিল ক্যাপ্টন জিয়া।

মাত্র সীমান্ত পরিধির ভেতর সীমাবদ্ধ এই যুদ্ধে আমি খুশী ছিলাম না। কেননা, সীমান্ত এলাকা থেকে মাত্র কয়েক মাইল জুড়ে আমাদের মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছে এবং পাকিস্তানের সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সার্বিক বিজয় অর্জন করতে আমাদের বহু বছর লাগতে পারে। কারন ওরা বৃত্তাকারে সুদৃঢ় ব্যূহ রচনা করে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করছে এবং যতই সময় যাচ্ছে, ওরা নিজেদের অবস্থার খুবই মজবুত করে নিচ্ছে। যদিও পাকিস্তানী হানাদাররা বৃত্তাকার যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তবুও তারা মানসিক দিক দিয়ে একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। তৎসত্ত্বেও ওদের উপর বড় রকমের আঘাত হানার মত অবস্থান আমাদের ছিল না। তাছাড়া, মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি সম্বন্ধেও খুব বেশী পারদর্শী নয়। তাড়াতাড়িতে যেটুকু প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, তাতে কোন কোন খন্ডযুদ্ধে সবাইকে একত্রে জড় হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে দেখা গেছে। এটা আমাদের পক্ষে আত্মঘাতী স্বরূপ। যখনই আমাদের বড় রকমের একটা বিপর্যয় এসেছে, তখনই দেখা গেছে যে, এটা ওদের একত্রে জড় হবার চিরাচরিত অভ্যাসের পরিণত। যা হোক, সময়ে যুদ্ধ করে সফলতা আমরা অর্জন করেছি, তা থেকে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, যুদ্ধকৌশল নয়-আক্রমণের গতিধারা ও আক্রমণাত্মক মনোভাবটাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সফলতা আসবেই।

এই রুপরেখাটা মনে রেখে বিশদভাবে পরিকল্পনা তৈরী করলাম যে, দেশের প্রতি আনাচে-কানাচে মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়িয়ে দিতে হবে ও আক্রমণের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে প্রতি থানায়। থানা থেকে গ্রামে। গ্রাম থেকে ঘরে ঘরে-যেন শত্রুরা পিছনে দেখতে ‘আজরাইল’ ওদের সামনে। যে হারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা আমার নতুন ক্যাম্প ‘বাকুনদিয়া’ এসে জড় হচ্ছিল, তাতে ওদের জন্য যদি প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করা যায়, তাহলে এই পরিকল্পনার রূপায়ণ মোটেই কষ্টকর নয়। বাকুদিয়া বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যস্ততম ও বৃহত্তম পাদপীঠ-যেখানে মুক্তিগামী মানুষের এই মৃত্যুঞ্জীয় কাফেলা প্রবল প্রাণোদ্দামে ভরপুর হয়ে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে উল্কার মতো ছুটে গিয়েছিল ঐ মানুষখেকো বাঘ ও হিংস্র জন্তুর অবাধ লীলাক্ষেত্র সুন্দরবনের গভীর অভ্যন্তরে এবং বাংলার মাঠে-ঘাটে, প্রতিটি গ্রামে ও গঞ্জে।

গেরিলা অভিযান

৯ নং সেক্টর আমার অধীনে সর্বসাকুল্যে তিনখানা জীপ, একটি বাস ও একটি ট্রাক ছিল। এর ভেতরে মেজর ওসমানের কাছ থেকে নেযা টয়োটা জীপটাও আছে। আমি ভাগ্যবান যে, গেরিলা পদ্ধতি প্রবর্তনের সময় এই যানবাহনগুলো পেয়েছিলাম। গাড়ী ও ট্রাকগুলো বৃষ্টির মধ্যে অনেক সময় চলতে পারতো না। এই গাড়িগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। কোননা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে এই গাড়ীগুলো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। তারপর থেকে এর কোন রক্ষণাবেক্ষণই হয়নি। অবশ্য শেষের দিকে ১৯৭১ সালের অগষ্ট মাসের কোন এক সময়ে ব্যারাকপুরের চার্লি সেক্টর পশ্চিম রণাঙ্গনের ‘জয় বাংলা’ গাড়ীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। এ কাহিনীর একটা দিক মাত্র। নৌকায় খালবিল দিয়ে গেরিলা পাঠানোর চেয়ে স্থলপথে পাঠানোর অনেকটা কম সমস্যা- সংকুল। স্থলপথে যারা যাবে তাদের শুধু রেশনের টাকা দিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু যারা জলপথে যাবে, তাদের জন্য চাই পথঘাট ভাল চেনে এইরকম উপযুক্ত মাঝি। এই সময় ওই রকম মাঝি যোগাড় করা খুবই দুষ্কর ছিল। ভাগ্য ভাল, এ ব্যাপারে আদম সন্তান পাচার করে এই রকম একজন চোরাচালানীর সাক্ষাত পেয়ে গেলাম। সারাজীবন সুন্দর বনের খাল বিল দিয়ে সে চোরাকারবার করেছে। সুতরাং মানচিত্রের চাইতেও সুন্দরবনের গোপন পথঘাটের খবর তার কাছে সঠিকভাবে পাওয়া যেত। সে প্রাণ দিয়ে কাজ করছে এবং কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে পথ দেখিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালীতে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছে। তার নাম রইজুদ্দিন। এক সময়ের কোটিপতি। আজ তার সর্বস্ব পাকহানাদাররা কেড়ে নিয়েছে। বয়স পঞ্চাশের মাঝামাঝি, পাতলা, কালো। এই রইজুদ্দিন ভয়ানক ধূর্ত ও চটপটে একদিন সে গর্ব করে বললেঅ, “স্যার, হানাদারদের বাপের সাধ্য নেই আমাকে ধরে। কোননা, এই দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ওদের চোখে ধুলো দিয়ে ‘কাম’ করে আসছি। কিন্তু খোদাকে বিশ্বাস করি। তিনি নারাজ হলে যে কোন মুহূর্তে আমি ধরা পড়তে পারি।

জুলাই মাসে ৬০ জন লোকের একদল মুক্তিযোদ্ধা খুলনার উদ্দেশ্য যাত্রা করেছিল। আরও দল, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার পথপ্রদর্শকদের আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ফেরত পাঠিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু ওরা মাত্র চারজন ফিরে এসে খবর দিল যে, রাজাকারদের জন্য খুলনায় থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। মুসলিম লীগের পান্ডরা বাঙ্গালীদের দিয়ে এই রাজাকার বাহিনী গঠন করেছে। জুন মাস থেকেই রাজাকার বাহিনীতে লোক ভর্তি বেড়ে যায়। কেননা, ওই সময়ে বেশীভাগ জোয়ান ছেলেরা প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত পার হয়ে ভঅরতে চলে আসে। তখন থেকে আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটা থমথমে ভাব। এই সময়ে রাজাকারদের ঘৃণ্য সহযোগিতায় পাক-বর্বররা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাত্রা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। এর উপর এই সময়ে বিহারী মুসলমানদের নিয়ে গঠিত আর একটা বাহিনী দেশব্যাপী লুন্ঠন, ধর্ষণ ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠলো। এমনকি, ওদের প্রভুদের পশুপ্রবৃত্তিকে খুশি করার জন্য এই পা-চাটা কুকুরের দল নারী হরণ পর্যন্ত করতে এতটুকু সংকোচ বা দ্বিধা করলো না। এইসব হৃদয়বিদারক খবর শুনে আমরা যে কিরূপ মর্মাহত হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেই প্রতিহিংসার অনির্বাণ শিখা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অন্তরে দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। সারা জুলাই মাস ধরে পুরো বর্ষা। দপ্তরে দপ্তরে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, অধিনায়ক এখনই এই মুহুতে শত্রুবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। সবাই যুদ্ধংদেহী চিৎকারে ফেটে পড়লো। বর্ষাকালেই শত্রুর বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলে বাংলার পবিত্র মাটিতে যুদ্ধ করার চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে। মোট কথা জুলাই, আগষ্ট-এই দু’মাস মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ উভয়ের কাছেই ভয়ানক উত্তেজনাপূর্ণ। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে জরুরী কাজ হলো- বৃত্তাকার যুদ্ধে, শক্তি কেন্দ্রীভূত না করে বেশী সংখ্যায় দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে রাজাকার ও অন্যান্য গজিয়ে ওঠা সহায্যকারী সংগঠনগুলোর প্রসার এখনই স্তব্ধ করে দেয়া। আমাদের সর্বাধিনায়ক যে পরিকল্পনা অনুযায়ী ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী এই চারটি জেলাকে ১৯টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হলো। আগের কার্যক্রম অনুযায়ী এক একটি অঞ্চলে দু’একটি থেকে তিনটি থানা থাকবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আগে হতেই যেসব গেরিলা ঘাঁটি ছিল তা সর্বমোট ৮৩টি। প্রতিটি জেলা, প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি থানার দায়িত্ব যথাক্রমে একজন সামরিক অফিসার, একজন জুনিয়ার কমিশন অফিসার, অথবা অভিজ্ঞ নন-কমিশন অফিসার এবং বাছাই করা একজন ছাত্রের উপর ন্যস্ত থাকবে। সকল পর্যায়ে এদের সাথে থাকবে একজন করে সহ-অধিনায়ক।

আরও স্থির করলাম যে, উপরের সংখ্যানুযায়ী একই অনুপাতে রাজনৈতিক নেতারাও তাদের সহকারীদের নিয়ে এ ঘাঁটিতে থাকবেন-যেন গেরিলারা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় কার্যকারীভাবে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে। কেননা, আমি জানি যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয় ব্যতিরেকে, শুধুমাত্র সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করেই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো না। রাজনৈতিক শক্তি এসে যোগ না দিলে যে কোন রকম সামরিক সফলতা, ঐক্যবদ্ধ, সমঝোতা ও সমন্বয়ের অভাবে চরম লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে না। যা হোক, আমাদের সর্বাধিনায়ক এবং চার্লি সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এন.এ. সালিক আমার পরিকল্পনাটা অনুমোদন কররেন এবং তাড়াতাড়ি এর বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশও দিলেন।

বিভিন্ন কেন্দ্রে গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। আমি চারটি কেন্দ্রের খবর জানতাম। সেগুলো হলো, চাকুলিয়অ ও মূর্তি বিহার প্রদেশে, একটি মেঘালয়ে ও অপরটি বীরভূম জেলায়। বিভিন্ন কেন্দ্রের ছেলেদের নিকটবর্তী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। বাংলাদেশের সাহায্য ও পুর্নবাসন মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান ভারতীয় সাহায্য ও পুর্নবাসন মন্ত্রীর সহযোগীতায় এই যুব এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করতেন। বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে সাধারণ নীতিমালা গ্রহণ করেন যে, পঞ্চশ হাজার লোককে গেরিলা ও বিশ হাজার লোককে নিয়মিত সামরিক ট্রেনিং দিতে হবে। জুলাই মাসে সব সেক্টর কমান্ডারের যে আলোচনা সভা ডাকা হয়, তাতে মিঃ তাজউদ্দীন আহমদ (তখনকার প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী) একথা প্রকাশ করেন। আমাদের কেউ কেউ গেরিলা ও সৈন্য সংখ্যা এই নির্দিষ্ট অংকে সীমাবদ্ধ রাখার কারন জিজ্ঞেস করলেন। কেননা আমরা মনে করতাম যে, নূন্যতম সংখ্যার হয়তো সীমারেখা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঊর্ধ্বতম সংখ্যা কোন সীমারেখা থাকা উচিত নয়। মনে হল এর কারন তিনি নিজেও জানতেন না। কাজেই অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এর কারন ব্যাখ্যা করতে তিনি ব্যর্থ হলেন। ভাবতে এখনও আশ্চর্য লাগে যে, মাত্র এই দুটো বাহিনীর উপর নির্ভর করে এত তাড়াতাড়ি তিনি বিজয়ের আশা করেছিলেন কোন আশ্বাসের উপর ভর করে?

যাহোক, এ সমস্যাটা গেরিলা যুদ্ধের অগ্রগতিকে কোনক্রমেই ব্যহত করতে পারলো না। একজন বা দু’জন ছাড়া আমার সাথে কোন অভিজ্ঞ গেরিলা নেতা ছিলনা। যে দু’একজন ছিল তারা কাজকর্ম ভালই জানতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা, যারা সময় সময় আমার ক্যাম্পে আসতো-তাদের ভিতর দিয়ে দলের নেতা হবার যোগ্যতা যাদের আছে- তাদেরকেই বেছে নিতে হলো। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন জেলার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন ও যুদ্ধ পরিচালনার জন্য চারটি জেলায় চারজন সামরিক অফিসার পাঠানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আগে থেকেই মুক্তিবাহিনীকে নির্দেশ দেবার জন্য খুলনা-বরিশালে ক্যাপ্টেন জিয়া এবং পটুয়াখালীতে লেঃ মেহদী ছিল। কিন্তু ফরিদপুরে কেউ না থাকায় মিঃ নুর মোহাম্মদ নাম একজন অভিজ্ঞ নৌবাহিনীর গেরিলা শিক্ষককে সেখানে পাঠিয়ে দিলাম। চারটি জেলার জন্য চারজন সামরিক অফিসার পাওয়া যাওয়ায় তাদের নির্দেশ দিলাম সৎ লোকদের ভিতর দিয়ে কমান্ডার নির্বাচন করে প্রতিটি অঞ্চল ও থানায় পাঠিয়ে দিতে। পাকিস্তানী সামরিক তৎপরতার পর থেকেই যারা নিজেদের উৎসাহে ও উদ্যোগে বাংলাদেশের ভিতরে শত্রহননের কাজে নিয়জিত আছে-তাদের সাথে যাতে করে কোন মতবিরোধ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য ওদের আমি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম।

জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সর্বাত্মক গেরিলা আক্রমণ চালানো হয়। আক্রমণ পরিচলনার জন্য আমি তিনটি জায়গা ঠিক করেছিলাম, পশ্চিম বঙ্গের উত্তর দিকের বনগাঁর নিকট বাগদাতে একটা হাসনাবাদের দক্ষিনে শমসের নগরে একটা এবং আর একটা টাকিতে। এই তিনটি ঘাঁটির ভিতর বাগদাই সবচেয়ে ব্যস্ততম। এর কারন মুক্তিযোদ্ধারা এই পথেই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আসতো এবং এই দিকের পথ-ঘাট ওদের ভাল জানা ছিল। শমসেরনগর ঘাঁটি থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলায় গেরিলাদের পরিচালনা ও নির্দেশ দেওয়া হতো। খুলনা জেলার গেরিলারা নদীপথে টাকির সাথে যোগাযোগ রেখে কাজ করত। শত্রুপক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে আক্রমনের গতিপদ্ধতিও পরিবর্তিত হত। পাঁচ মাসে, অর্থাৎ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সরকারী হিসাবমতে আট হাজার গেরিলা আমার সেক্টর থেকে হাল্কা অস্ত্রপাতি ও বিস্ফোরক দ্রব্যসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়েছিলাম। শতকরা পঞ্চাশজন গেরিলাকে অস্ত্র দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। বাকী সবাই কেউ গোলাবারুদ, কেউ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যেত। সেপ্টেম্বর মাসে অবস্থার পরিবর্তন হল। তখন থেকেই সবাই হাতে অস্ত্র পেল। তাছাড়াও রাজাকার, পুলিশ ও পাক হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্রপাতি দিয়ে বেশি সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধা ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম। এমন একটা সময় এলো যখন আমার সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাড়ালো প্রায় বিশ হাজার। মুক্তাঞ্চলে স্থানীয় অধিনায়কেরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আরো বাড়তে লাগলো। আমার মতে, এতে ছেলেদের কষ্ট অনেকটা লাঘব হতো। কেননা, বিপদসংকুল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ভারতে আসার কষ্ট থেকে ওরা বেঁচে যেত। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলেও সফলতার পরিমাণ আশানুরুপভাবে বৃদ্ধি পায়নি। সময়ে সময়ে বাহকের মারফৎ যেসব খবর পেতা, তা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠলো যে, মুক্তিযোদ্ধারা প্রধানতঃ রাজাকার ও পুলিশদের উপর আক্রশণ চালিয়ে সফলতা অর্জন করছে পাক সৈন্যর বিরুদ্ধে খুব কমসংখ্যক আক্রমণই পরিচালিত হতো। এর কারণ গেরিলারা যে পাক-হানাদারদের ভয় করত তা নয। অল্প সময়ের প্রশিক্ষণে ওরা শুধু আক্রমণ করে শত্রুকে কিভাবে খতম করতে হয়, তাই শিখেছিল। আক্রমণ করে কিবাবে পলায়ন করতে হয়, সে কৌশল ওদের ভাল করে জানা ছিল না। যদিও গেরিলা যুদ্ধের নীতি- ‘আঘাত করো ও পালিয়ে যাও’ এ সম্বন্ধে তাদের একটা মোটামুটি ধারনাও ছিল, তবুও আমার কাছে মনে হল, ওরা যেন কম আঘাত করে বেশী করে পালিয়ে আসতো। আমার এ ধারনা অনেকাংশে সত্যি। তা না হলে যদি গেরিলারা নির্দেশ মোতাবেক তাদের দায়িত্ব পুরাপুরি পালন করতো, তাহলে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সেক্টর থেকে যে পরিমাণ গেরিলা ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাতে পাক সামরিক যন্ত্রটাকে মাত্র দু’মাসের ভেতরেই বিকল করে দেওয়া সম্ভব হতো।

খুলনা জেলার তেরখাদা, মোল্লারহাট, মোড়রগঞ্জ, বাগেরহাট, সুন্দরবন, পাইকগাছা এবং ভোলা, পটুয়াখালী ও বরিশাল শত্রুপক্ষের সাথে অবিরাম সংঘর্ষের ফলে উত্তেজনায় সর্বদা উত্তপ্ত থাকতো। বস্ততপক্ষে গতিশীল নেতৃত্বের জন্যই উপরোক্ত জায়গা গুলি মুক্তিসংগ্রামে ভাল অবদান রাখতে পেরেছিল। দেশের ভিতরের এতসব ঘটনার কথা আমাদের কাছে পৌঁছতো না। কারন বাহকের মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদান করা ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা ছিল না। অনেক বাহক আমারে সদও দফতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারতো না। পথেই কঠিন মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে পড়তো। যখন দেশের আনাচে-কানাচে হানাদারেরা জাল পেতে বসে আছে, তখন বাহকের কাজটা খুব আরামদায়ক নয়। বর্ষাকালে রাত্রের অন্ধকারে বুক পরিমাণ জলের ভিতর দিয়ে হেঁটে সংবাদ নিয়ে আসাটা কতটা কষ্টসাধ্য তা সহজেই অনুমেয়। মনে পড়ছে পনের বছর বয়স্ক পাতলা গড়ন প্রবেশিকা পরিক্ষার্থী আলমের কাছ থেকে শোনা একটা লোমহর্ষক কাহিনীর কথা। বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের ছেলে আলম। শত শত গেরিলাকে পথ দেখিয়ে সে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বরিশাল থেকে সুদূঢ় পশ্চিম বঙ্গ পর্যন্ত সংবাদ নিয়ে ফিরে আসে। একজন পথপ্রদর্শক ও সংবাদ বাহক হিসাবে আরম নিজেকে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রমানিত করেছিল। দেখতে খুবই বেমানান এই ছেলেছি, জলন্ত দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শত শত গেরিলাকে শুধু পথ দেখিয়েই ভিতরে নিয়ে যায়নি, ভিতর থেকে শত শত অদক্ষ যুবককে ভারতে প্রশিক্ষনের জন্য নিয়ে এসেছে। এই ছেলেটি চতুর ও বুদ্ধিদীপ্ত। অনেকবার সে পাক হানাদারদের হাতে ধরা পড়েছে। তার চেহারার ভিতর একটা সরল মাধুর্য আছে সে এত ভাল উর্দু বলতে পারতো যে, মাথাভারী দেহসর্বস্ব পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে বিহারী মুসলমান বলে ভূল করে ছেড়ে দিয়েছে। জুলাই মাসে সীমান্তবর্তী বাগদা থেকে আলমই সর্বপ্রথম গেরিলাদের বরিশাল ও ফরিদপুরে নিয়ে আসে।

জুলাই ও আগষ্ট মাসের সেই বর্ষণমুখর রাতগুলোর কথা আজো আমার মনে পড়েছে। প্রতি রাত্র বর্ষা মাথায় করে বাংলার অতন্দ্র প্রহরী এই গেরিলার বাগদার সীমান্ত অতিক্রম করে ভিতরে চলে যেত। প্রমত্তা ইছমতি ছুটে চলেছে। দু’কুল তার বহু দুর পর্যন্ত প্লাবিত। এরই ভিতর কত রাত দেখেছি বাংরার এই অগ্নিসন্তান গেরিলার ভয়কে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কোন রকম ওজর আপত্তি না করে অন্ধকারে অস্ত্র হাতে নিয়ে পানি কাদার মধ্যে শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছে। শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। রাইফেলটায় যাতে পানির স্পর্শ না লাগে, সে জন্য ওটাকে উপর দিকে তুলে ধরতো। কি অভূতপূর্ব দেশপ্রেম। নিজেকে অভিশাপ দিতাম, কেন ওদের সাথী না হয়ে অধিনায়ক হলাম। কেন ওদের পাশে থেকে যুদ্ধ করে ওদের মুখের হাসিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না। ওদের রক্তের সাগরে দাড়িয়ে মুক্তির আনন্দক আজ বড্ড বিস্বাদ লাগলো।

কিছুক্ষণের ‘জয় বাংলা’ তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব-শেখ মুজিব’ এই ধ্বনিই তো ওদের অনুপ্রানিত করেছিল অনিশ্চয়তার আধার ও চরম বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কোন পুরষ্কার বা প্রতিশ্রুতির লোভে ওরা এ কাজ করনি। দেশ ও নেতার প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ওদের যাদুমন্ত্রে ওদের উদ্দীপ্ত করেছিল এই মৃত্যু ভয় কে জয় করতে। আত্মোৎসর্গের কঠিন ব্রতে দীক্ষা নিয়ে বাংলার এই গেরিলারা স্বাধীনতার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছে। বর্ষার ঔদ্ধত্যকে সংকল্পের দৃঢ়তায় ছিন্নভিন্ন করে ওরা এগিয়ে চললো। অন্ধকারের মাঝে ওদের এগিয়ে যাওয়া আমি নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম, যুদ্ধ না করেই বজ্রকঠিন শপথের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হানাদারদের কাজ থেকে মুক্তির আলো একদিন এই সুর্যসন্তানেরা ছিনিয়ে আনবেই। ঘটেছিলও তাই। পাক-হানাদররা ক্রমাগত থানা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যেতে লাগলো। গ্রামে যেখানেই গেরিলাদের সাথে ওদের মোবাবেলা হয়েছে, সেখানেই ওরা পুনর্বার যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর হানাদাররা থাা ছেড়ে জমা হতে থাকে। সামরিক ছাইনতে এবং রাজাকারদের ওরা পুরো সুযোগ দিতে লাগলো গ্রামের উপর প্রভুত্ব চালাতে। দুর্জয় গেলিাদের হাতে চরম মার খেয়ে রাজাকররা তাদের রাজত্ব চালাতে চরম অসুবিায় পড়েছিল। ওদের জঘন্য কার্যকলাপের জন্য গেরিলারা নির্মমভাবে রাজাকারদের নিশ্চিহৃ করে দিত। আমার কাছে খবর আসলো যে, গেরিলারা পুরোদমে আক্রমণ চলিয়ে শত শত রাজাকার খতম করছে। এতে সুফল হলো-যারা একদিন রাজাকারদের বর্বরতার শিকার হয়েছিল, সেই নিঃস্ব গ্রামবাসী আবার মনোবল ফিরে পেল। বাঙ্গালী রাজাকারদের হত্যা করাটা আমি যেন পছন্দ করতে পারলাম না- কারন, আমি জানতাম যে এই হত্যার দ্বারা শুধু অনাথ ও বিধবার সংখ্যাই বেড়ে গিয়ে দেশের সমস্যা আরো জটিল করে তুলবে। একবার আমি নির্দেশও পাঠিয়েছিলাম যে, রাজাকারদের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন এনে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করতে হবে। এই মর্মে কিছু প্রচারপত্র বিলি করা হলো। দেখা গেছে, এর ফলে অনেক রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ স্বেচ্ছায় আত্মসমাপন করেছে। গেরিলা পদ্ধতির প্রবর্তনের ফলে দুটো সুফল পাওয়া গেল। প্রথমতঃ গ্রামবাসী রাজাকার ও পাক-বর্বরদের অত্যাচারের হাত থেকে অনেকটাই রেহাই পেল। দ্বিতীয়তঃ হানাদাররা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য গোপন আস্তানায় ঢুকে আত্মসমর্পন করতে লাগলো। তাছাড়াও রাজাকারদের ভিতর অর্ন্তদ্বন্ধ, অসন্তোস ও বিভেদ সৃষ্টি করতে সফল হলাম। এর ফলে হানাদরদের পরিকল্পনায় সহজেই ফাটল ধরলো।

আর কোন পথ খোলা না দেখে পাক-বর্বররা গানবোটের সাহয্যে আক্রমনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। রাজাকার ও পাকিস্তানী সৈন্যরা গানবোটে চেপে নদীর পথ ধরে চলতে থাকলো, আর মেশিনগান ও রকেট দিয়ে নির্বিচারে গোলাবর্ষন করে নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতে লাগলো। পাকিস্তানী গানবোট গুলোর এরূপ আকস্মিক হামলায় ক্ষেখামারে কর্মরত শত-শত কৃষক, জেলে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করলো। বাংলাদেশের নদীপথ দিয়ে গান-বোট গুলো চালিয়ে নেওয়ার সময় হানাদারেরা যাদেরই সামনে পেত তাদের উপরই পৈশাচিক উল্লাসে মেশিন গানের গুলি ছুড়তে থাকতো। মনের অবস্থা যখন ভাল থাকতো না তখন হানাদাররা নদীর তীরে কোন গ্রামের কাছে গান-বোট ভিড়িয়ে অসভ্য তাতারের মত গ্রাম থেকে সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ছিনিয়ে আনতো। যারা আপত্তি করতো, তাদের খতম করে দিত।

যদিও আমাদের গেরিলারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে এই গানবোট গুলো কাবু করার জন্য, কিন্তু ওদের কাছে নিম্নমানের অস্ত্রপাতি থাকায় গানবোটগুলোর মোকাবেলায় পেরে উঠতো না। এভাবে নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে গানবোটগুলো গ্রামের লোকদের ভিতরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলো। গানবোট কাবু করার জন্য ভারী অস্ত্রপাতি চেয়ে গেরিলারা আমার কাছে খবর পাঠালো আমরা যদি জনগণকে এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করত না পারি, তাহলে যত রকমের সফলতাই আমরা অর্জন করিনা কেন, জনগন অচিরেই তা ভূলে গিয়ে আমাদের প্রতি সহযোগীতার হাত বন্ধ করে দিবে। বিশেষ করে আমার ৯নং সেক্টর নদীনালায় ভর্তি। পাকবাহিনী গোপালগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনার হাজার হাজার গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে লাগলো। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসলে যে কি ঘটছে আমি জানতাম। গানবোট ধ্বংস করার উপায়ও আমার জানা ছিল। কিন্তু আমার কাছ থেকে বারবার তাগিদ যাওয়া সত্ত্বেও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সেসব নতুন অস্ত্র শস্ত্র যোগাবার জন্য কোন আন্তরীক প্রচেষ্টাই করেনি। গানবোট কাবু করতে সামনে কয়েকটা রকেট লাঞ্চারই যথেষ্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা সেগুলোও পাইনি। বস্তুতপক্ষেঃ গানবাট কাবু করতে যায় এ সম্বন্ধে আমি একটা রিপোর্ট তদানীন্তন অস্থায়ী রাষ্টপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী মিঃ তাজউদ্দীন আহমদকে দেখিয়েছিলাম। তখন তাঁরা ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাদের আস্বাস সত্ত্বেও এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অর্ধমীমাংসিতই রয়ে গেল। তাদের এই নির্লিপ্ততায় আমি খুব ব্যথা পেলাম; পাগলের মত ছুটে গেলাম চার্লি সেক্টরের অধিনায়কের কাছে। তিনি তাঁর নিজের প্রচেষ্টায় আমাকে গোটা দুয়েক রকেট লাঞ্চার যুগিয়ে দিলেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ও গুলো খুবই অপর্যাপ্ত। যাহোক, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চার্লি সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এন, এ সালিক মংলা পোর্টের কাছাকাছি একটা গেরিলা। ঘাঁটি স্থাপন করতে ও কিছু পথপ্রদর্শক প্রস্তুত রাখতে বললেন। তার কথামত পঞ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধাসহ আফজাল নামক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন হাবিলদারকে সেখানে পাঠিয়ে দিলাম। এ ছাড়াও আগে থেকেই মিঃ খিজিরের অধীনে সেখানে একশ’ গেরিলা ছিল। মিঃ খিজির খুলনার একজন মেকানিক। হাবিলদার আফজালের যোগ্যতা ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মিঃ খিজির উদ্দীপনা পেল এবং ‘বানীশান্ত’ নামক একটি জায়গায় আর একটি ঘাঁটি স্থাপন করলো। এখান থেকেই মংলা বন্দরে হানাদারদের গতিবিধি, সামরিক, শক্তি, জাহাজগুলোকে রক্ষা করার জন্য ওর কতটা সতর্কতা অবলম্বন করেছে ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের কাছে খবরাখবর এসে পৌঁছতে লাগলো।

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ‘ফ্রগম্যান’ পাঠানো। আগষ্টের শেষ সপ্তাহে লেঃ জিয়া ছ’খানা নৌকা নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র- গোলাবারুদ সংগ্রহের আশায় ভারতে এসে পৌঁছালো। সুন্দরবনের একটা বৃহত্তম গেরিলা ঘাঁটির অধিনায়ক লেঃ জিয়া। তার কাছে যেসব অস্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ ছিল, তা খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর সে সবিস্তারে আমার কাছে খুলে বললো। কথার মাঝখানে বারবার সে গানবোট ধবংসকারী অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিতে লাগলো। সে জানালো যে পাকহানাদারদের মনোবল একদম ভেঙ্গে গিয়েছে। এখন একমাত্র গানবোটের সাহয্যেই আক্রমণ অব্যাহত রাখছে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্যাপ্টেন শাহাজানকে বরিশাল জেলায় আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য পাঠিয়েছিলাম। তার উপর বিশ্বাস রেখে জিয়া জানালো যে, শাজাহান ভাল কাজই করছে। ক্যাপ্টেন ওমর এই ছদ্মনামে শাহজাহনকে ডাকতাম। ক্যাপ্টেন শাজাহান পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সিগনাল ব্রাঞ্চের একজন অফিসার। সে দুঃসাহস করে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে রাজস্থানের মরুভূমি পার হয়ে একশো মাইল পথ পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে আসে। সে আমার সেক্টরে যোগ দেয়ার আগে সে গেরিলা বাহিনীতে দীর্ঘ ছ’মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ভালই হলো। একটা গেরিলা বাহিনী তার অধীনে পাঠিয়ে দিলাম। জিয়ার কাছে থেকে এসব খবর পেয়ে আংশিকভাবে খুশী হলাম। পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তাকে আমাদের সর্বাধিনায়কের সদর দফতরে নিয়ে গেলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ওর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার জন্য সর্বাধিনায়ক সাহেব কোন ঔৎসুক্যই দেখালেন না। যা হোক, কোনরকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সর্বাধিনায়ক সাহেবকে জিয়ার সাথে একটিবার দেখা করার জন্য কতকটা বাধ্য করলাম।

ভয়ানকভাবে সমস্যা-পীড়িত সর্বাধিনায়ক সাহেব শেষ পর্যন্ত অনেক নিয়ম-কানুন পালনের পর জিয়াকে ডেকে পাঠালেন। অসংখ্য ধন্যবাদ কয়েক মিনিটের মধ্যেই এ সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হলো। এরপর ব্রিগেডিয়ার এন, এ, সালিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য জিয়াকে নিয়ে আমি ব্যারাকপুর গেলাম। এটা সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ব্রিগেডিয়ার সাকিল খুব ধৈর্য সহকারে লেঃ জিয়ার কথাবার্তা শুনলেন এবং তাকে আশ্বাস দিলেন যে, ভারতীয় ৯ নং ডিভিশনের অধিনায়কের আলাপ-আলোচনা করে তিনি শিগগিরই যতটা সম্ভব রকেট লাঞ্চার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রপাতি সরবরাহ করার চেষ্টা করবেন। ভয়ানকভাবে সমস্যা-পীড়িত সর্বাধিনায়ক সাহেব শেষ পর্যন্ত অনেক নিয়ম-কানুন পালনের পর জিয়াকে ডেকে পাঠালেন। অসংখ্য ধন্যবাদ কয়েক মিনিটের মধ্যেই এ সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হলো। এরপর ব্রিগেডিয়ার এন, এ, সালিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য জিয়াকে নিয়ে আমি ব্যারাকপুর গেলাম। এটা সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ব্রিগেডিয়ার সাকিল খুব ধৈর্য সহকারে লেঃ জিয়ার কথাবার্তা শুনলেন এবং তাকে আশ্বাস দিলেন যে, ভারতীয় ৯ নং ডিভিশনের অধিনায়কের আলাপ-আলোচনা করে তিনি শিগগিরই যতটা সম্ভব রকেট লাঞ্চার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রপাতি সরবরাহ করার চেষ্টা করবেন।

‘ফ্রগম্যানদের সম্বন্ধে একটা কথা বলে রাখছি। এই ফ্রগম্যানদের দেশের বাইরে থেকে আমদানী করা হয়নি। তারা দেশেরই সরল নিরীহ যুব সম্প্রদায়। বেশির ভাগই ছাত্র। জুনের শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওদের যোগাড় করা হয় এবং নবাব সিরাজুদৌল্লার ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের পলাশী নগরে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এইসব ছেলেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর লেঃ কমান্ডার মার্টিস ও লেঃ দাসির সহযোগিতায় প্রশংসনীয়ভাবে মাত্র দু’মাসের ভেতর এ সমন্ত কচি গ্রাম্য ছেলেরা দক্ষ ফ্রগম্যানশীপ ট্রেনিং নিয়ে বেরিয়ে আসে। যে কোন মূল্যায়নে মিঃ মার্টিন ও মিঃ দাসের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রশংসার যোগ্য।

আর একদল লোক পলাশীতে এই ফ্রগম্যানশীপ প্রশিক্ষণের উন্নতির জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করেছিল। তারা পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিনে কাজ করতো। ফ্রান্সে যখন একটি বিশেষ কাজে ওদের পাঠানো হয়, তখন সেখান থেকে মুক্তিসংগ্রামের প্রাক্কালে ওর পালিয়ে লন্ডনে আসে। সেখান থেকে ভারতীয় হাইকমিশনের সহয়তায় দিল্লী পৌঁছে। সংখ্যায় তারা আটজন। খুলনা জেলার অধিবাসী মিঃ রহমতউল্লাহ ওদের অধিনায়ক হয়ে নিয়ে আসে। সত্যিকারভাবে রহমতউল্লাহ একজন দেশপ্রেমিক। ফ্রগম্যানশীপের কলাকৌশল সম্বন্ধে সে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছে।

৯ই সেপ্টেম্বর। পরিকল্পনা মাফিক বাংলার ফ্রগম্যানরা সবাই যখন, তখন নৌকাগুলো কি আর পিছনে পড়ে থাকতে পারে। ত্রিকোনা আক্রমণ করার জন্য লেঃ জিয়ার আটজন ফ্রগম্যানসহ আগেই যাত্রা করার কথা। তাকে দুটো রকেট লাঞ্চার, কিন্তু এলএমজি এবং অভ্যন্তরের মুক্তিবাহিনীর জন্য প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হলো। নির্ধারিত তারিখমত লেঃ জিয়া কোলকাতার উত্তর-পশ্চিম দিকে বাসন্তী নামক একটা বন্দরনগরী থেকে রওনা হলো।

বর্ষার মাতামাতি। আবহাওয়া ভয়ানক বিক্ষুব্ধ। নদীগুলো যেন এক-একটা দৈত্যের মত রাগে ফুলছে। বুকে তার প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে-পড়া বিদ্রোহী তরংগমালা। ফ্রগম্যানদের গোপ ঘাঁটি থেকে নৌকায় করে শমসেরনগর পৌঁছতে হবে। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা মিঃ আসাদুল্লাহর নেতৃত্বে তিনটি নৌকায় ত্রিশজন ফ্রগম্যান ‘লিম্পেট মাইন’ নিয়ে ১৫ই সেপ্টেম্বর মংলা এবং চালনা বন্দরের পাকিস্তানী বাণিজ্যিক ও নৌবাহিনীর জাহাজগুলো আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। ওদের বিদায় দেবার জন্য ১০ই সেপ্টেম্বর লেঃ কমান্ডার মার্টিস, মেজর রায় চৌধুরী এবং আমি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটা লঞ্চে করে শমসেরনগর পৌঁছে একটা বাঁকের কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এখানে হয়েই জিয়ার নৌকাগুলো যাওয়ার কথা।

সকাল বেলা-ভয়ানক ঝড়, উথাল পাতাল ঢেউয়ের বুক চিরে নৌকা চালানো খুবই কষ্টকর। বেলা তিনটা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ওদের আসার কোন হদিস পেলাম না। দেরী হবার অবশ্য অনিবার্য কারণ ছিল, কিন্তু ওদের পৌঁছতে বিলম্ব দেখা আমার খুবই চিন্তিত ও অধৈর্য হয়ে উঠলাম। বিকার প্রায় সাড়ে চারটার সময় প্রথম নৌকা এসে বাঁকের কাছে পৌঁছলো। কেউ তাদের শিক্ষিত বা মুক্তিবাহিনীর লোক বলে চিনতে পারলো না। কেননা, ওরা বুদ্ধিমত্তার সাথে সাধারণ মাঝিও জেলের বেশ ধরে আত্মগোপন করে ছিল। পরনে ছিল লুংগী ও ছেঁড়া শার্ট। বৃষ্টির জলে ওদের জামাকাপড় সব ভিজে গিয়েছিল। কেউ কেউ চা বা অন্যকিছু গরম করার জন্য আগুন জ্বালাতে খুব চেষ্টা করতে লাগলো। যা হোক আমাদের অপেক্ষা করতে দেখে ওরা খুবই উল্লসিত হলো। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আরো দুটো নৌকা বিক্ষুব্ধ ঢেউগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। নৌকাগুলো সব এক জায়গায় হলে, মুক্তিযোদ্ধাদের সবাইকে আমাদের লঞ্চে এনে গরম চায়ে আপ্যায়িত করলাম। ছেলেদের মনোবর খুবই উঁচু বলে মনে হলো।

একজন লিডার নিয়ে চারজনসহ এক একটা দল। লিডারদের আমরা ক্যাবিনের ভিতর ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ ও কিছু টাকা পয়সা দিলাম- যেন পথে ওরা খাদ্যের জন্য কষ্ট না পায়। সবই প্রস্তুত। কিন্তু ঝড়ের দাপট প্রশমিত হবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। এই ঝড়ের মধ্যে ওদের কে পাঠানো আমি সমীচীন মনে করলাম না। কাজেই কাজটা রাত্রের মত স্থগিত রইল এবং ১১ তারিখের খুব ভোরে ওদের যাত্রা করতে দিলাম। এই মোশাররফ পথ দেখিয়ে আমাকে ভারতে পৌঁছে দেয। সে সুন্দরবন এলাকার মুন্সিগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা। সবার মুখেই হাসি। সবাই খুশী। শেষ বারের মত সবাইকে উপদেশ দিয়ে এবং ওদের মংগল কামনা করে ওই রাত্রেই আমরা হাসনাবাদ রওনা হলাম। আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ঠিক তিনদিন পরেই অর্থাৎ ১৪ই সেপ্টেম্বর ভোরে ওরা নিরাপদে ঠিকমত জায়গায় পৌঁছে গেল।

১৫ই সেপ্টেম্বর সামনে। শত্রুর উপর চরম আঘাত হানার মাহেন্দ্রক্ষণ। যে জায়গা থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে তার সাথে সংযোগ সাধন, আক্রমণের পর যেখানে গিয়ে সবাই জমা হতে হবে সেখানে গেরিলাদের ঠিকমত জায়গায় রাখা, উদ্দেশ্য সমাধা করার পর সবাইকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় রাখা, উদ্দেশ্যে সমাধা করার পর সবাইকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে পড়া-ইত্যাদি প্রাথমিক কাজকর্ম সম্পন্ন করার জন্য হাতে খুব কম সময়ই আছে ১৪ তারিখ ভোর থেকে ১৫ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত ওদের প্রস্তুতি নিতে কেটে গেল। হাবিলদার আফজাল ও খিজিরের স্থল গেরিলারা ওদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা লোভাতুর চোখে চেয়ে দেখলো আটটি বানিজ্যিক জাহাজ চালনা বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। পশুর নদীর মাঝখানে সবগুলো নোংগর করা। ঠিক হলো ‘জোড়া পদ্ধতিতে’ আক্রমণ চালাতে হবে- অর্থাৎ দু’জন ফ্রগম্যান এক একটি জাহাজকে আঘাত করার জন্য এক-একজন ফ্রগম্যানের কাছে চারটি করে, দু’জনার কাছে মোট আটটি লিম্পেট মাইন’ থাকবে। লিম্পেট মাইন পানিতে ভাসে। সুতরাং ওদের পক্ষে এতগুলো মাইন এক সংগে বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ হলো। ঘাঁটি থেকে প্রায় পনেরশ’ গজ দূরে জাহাজগুলো এলোমেলো অবস্থায় নোংগর করা। ১৫ সেপ্টেম্বরের সারাটা দিন কেটে গেল ওদের সবকিছু বুঝিয়ে দিতে। এক-একটা জাহাজ আক্রমণ করার ভার এক একটা দলের উপর ন্যস্ত করা হলো।

ষোলজন ফ্রগম্যান নিয়ে আটটি দল। ওরা আক্রমণ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রথম অভিযান ব্যর্থ হলে বাকী চৌদ্দজনকে পরবর্তী পর্যায়ে আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য রিজার্ভ রাখা হলো আঘাত করার সময় নির্ধারিত হলো রাত সাড়ে চারটা। সাধারণতঃ এই সময়েই পাক হানাদাররা বিরক্ত ও ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়ে। আর যারা ঘুমিয়ে থাকে, একই সঙ্গে তারা আরও বেঘোরে ঘুমাতে থাকে। স্থির হলো একই সংগে আটটি জাহাজের উপর হামলা চালাতে হবে।

রাত আড়াইটা। খুব অন্ধকার। বাইরে ঝড়ের দাপাদাপি। দমকা বাতাসের চাবুক খেয়ে পিছন দিকের অরণ্যটা আর্তনাদ করে উঠলো। অধিনায়ক মিঃ আসাদুল্লাহ ছেলেদের কানে কানে বললো, আঘাত করার এইতো উপযুক্ত সময়। সতর্কতার সাথে শেষবারের মত আবার সে সবাইকে পরীক্ষা করে নিলো। এখন থেকে মাত্র দু’ঘন্টা পরে সমস্ত নদীর বুক জুড়ে তরংগায়িত হবে বলে টকটকে উত্তপ্ত রক্তস্রোত। নদীর অপর পাড়ে শত্রুপক্ষ নিশ্চিন্ত। কেননা ওরা ভাবতেই পারেনি অলস বাঙ্গালীরা ওদের পায়ের তলায় কোনদিন আঘাত হানতে পারবে। নদীতে হিংস্র জীবজন্তু আছে জেনেও দুর্যোগময় এই ঝড়ের মাঝরাতে প্রমত্তা নদতীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। মৃত্যুভয়কে দূরে ঠেলে দেশপ্রেমের জলন্ত বহিৃশিখা বুকে নিয়ে ওরা ষোলজন সবাই একংগে দুটো পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুখে লেশমাত্র ভীতের চিহৃ নেই। আত্মপ্রত্যয়ের মহান আদর্শে উদ্ভাসিত। বেয়াড়া প্রকৃতির রক্তচক্ষুকে ভয় না করে মুক্তিযোদ্ধারা নদীর বুক চিরে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো লক্ষ্যবস্তুর দিকে। ওদের কোমল ডানাগুলো ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়লো। কিন্তু জলের উপর ভেসে ভেসে ঢেউয়ের কোলে মাথা রেখে ওরা লক্ষ্যবস্ততে গিয়ে পৌঁছলো। সাড়ে চারটা বাজতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি।

অর্ধ- আবৃত তারপলিনের নীচে আবছা আলোতে ওরা সন্ত্রাসীদের দেখতে পেলো। হঠাৎ আকাশটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ভয়ানক বৃষ্টি। আঘাত করার সময় এসে গেল। ঠিক চারটা ত্রিশ মিনিট। যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে ওরা লিম্পেট মাইনগুলো জাহাজের তলায় লাগিয়ে দিল। এই মাইনগুলোর উপরের দিকে চুম্বক লাগানো। লোহার সংস্পর্শে এলে গায়ে লেগে থাকে। তারপর ওরা সাঁতরিয়ে ঘাঁটির দিকে ফিরে চললো। এই সময় ওরা খুব তাড়াতাড়ি সাঁতরাতে লাগলো। ওরা জনতো যে, মাইন লাগানোর এক ঘন্টা পরে, এই সুন্দর জাহাজগুলো বিকট শব্দে বিদীর্ণ হয়ে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার বহ্যৃৎসবে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। মাইনগুলো বিস্ফোরণের জন্য ‘ফিউজে’ একঘন্টা সময় বেধেঁ দেয়া হয়েছিল- যেন ওরা নিরাপদ ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পারে। আবেগ ও উত্তেজনায় উদ্বেলিত হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ওরা ষোলজন সবাই তীরে ফিরলো। যারা তীরে সাগ্রহে প্রতিক্ষয়া ছিল, তারা সবাই ওদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চুমু খেতে লাগলো। শুয়ে পড়ে মুক্ষিযোদ্ধারা অধীর আগ্রহে জাহাজগুলো দিকে চেয়ে রইল- কখন সাড়ে পাঁচটা বাজবে। হ্যাঁ, চরম লগ্নটি এলো। সমস্ত পৃথিবীটাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়ে বিকট শব্দে মাইনগুলো বিস্ফোরিত হলো। আটটি জাহাজের মধ্যে সাতটি ডুবে গেল। আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক ও সফল হলো। এই ঘটনার পর বন্দরের শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে দিয়ে যে যেদিকে পারলো পালিয়ে গেল। বেশ কিছুদিনের জন্য চালনা ও মংলা বন্দর জনশূণ্য হয়ে পড়ে রইল।

শমসেরনগরে ফিরে আসার সময় মৃত্যুঞ্জীয় মুক্তিসেনারা একটা ফরেষ্ট অফিসে হামলা চালিয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র অধিকার করে। এর মধ্যে ‘বনবালা; ও ‘বনমৃগী’ এই দুটো লঞ্চও ছিল। এই লঞ্চে চেপে বিজয়ের উত্তেজনায় আত্মহারা মুক্তিযোদ্ধারা শমসেরনগরে ফিরে এলো। পাকিস্তানী ঘাঁটির অবস্থানের অনিশ্চয়তার জন্য লেঃ জিয়ার ত্রিকোণা অভিযান স্থগিত রাখা হলো। তাছাড়া আবহাওয়াও খুব অনুকুলে ছিল না। সব রকমের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গেরিলাদের ভেতর আসা বন্ধ করতে না পারায় পাক-হানাদাররা ভয়ানকভাবে ক্ষেপে গিয়েছিল। সুতরাং ওরা সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে চালনা পোতাশ্রয়ের বিপরীত দিকে সুন্দরবনে আগুন ধরিয়ে দিল এবং গানবোট নিয়ে পাহারায় বেরিয়ে সুন্দরবনের সমস্ত পথঘাট একদম বন্ধ করে দেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো।

সেপ্টেম্বরের শেষদিকে হানাদাররা শ্যামনগর ঘাঁটির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারলো। আমাদের হাতেই কিছুদিন আগে এই ঘাঁটির পতন ঘটে। এবার শ্যামনগর ঘাঁটি পুনরুদ্ধার করার জন্য হানাদাররা গানবোট ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে ভীষণভাবে আমাদেরকে আক্রমণ করলো। তিনদিন তীব্র যুদ্ধ চালাবার পর, হানাদারদের চরম ক্ষতি করে, সমর-কৌশলের দিকে দিয়ে খুঁব গুরুত্বপূর্ণ এরকম অন্য একটা জায়গায় আমরা সরে গেলাম। এই যুদ্ধে আমরা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়েছিলাম। এর মধ্যে সুবেদার মোহাম্মদ ইলিয়াস মেশিনগানের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর চারজন নতুন ভর্তি মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদাররা বন্দী করে। শ্যামনগর পুনরুদ্ধার করে ও হানাদাররা গেরিলাদের ভেতরে যাওয়া বন্ধ করতে পারলো না।

এক মাস পরে ঠিক একই উপায়ে ফ্রগম্যানরা আবার মংলা ও চালনা বন্দর আক্রমণ করলো। ১৬ই অক্টোবর আলম নামে পাক-নৌবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা একজন সৈন্যের অধীন দ্বিতীয় দলটি শ্যামনগরের অনেক দক্ষিণ দিক দিয়ে হেঁটে ভেতরে গেল। এবারেও আমরা সফল হলাম। এই আক্রমণে শত্রুপক্ষে চারটি জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। একটি নাম ‘লাইটনিং’ এবং অপরটার নাম ‘আল-মুরতজা’। অন্যগুলো চীনা জাহাজ বলে শনাক্ত করা হয়। আমাদের এই দ্বিতীয়বারের আক্রমণ চালনা ও মংলা বন্দরকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিল। এর উপরও নভেম্বর মাসে রহমতউল্লাহর নেতৃত্বে খুলনায় আক্রমণ চালিয়ে সাফল্য অর্জন করা হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র-বাহিনর অন্যান্য সেক্টরের নির্দেশ অনুযায়ী চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং চাঁদপুরে শত্রু জাহাজের উপর আক্রমণ চালানো হয়।

এই আক্রমণের মোটামুটি ফল হলো- এইসব জায়গায় শ্রমিকরা সবাই পালিয়ে জান বাঁচলো। ডিসেম্বরে দেশ মুক্ত হবার আগ পর্যন্ত ওরা আর ফিরে এলোনা। এই ঘটনার পর এমনকি কোন বিদেশী জাহাজও বন্দরে নোংগর করতে রাজী হতো না। আমরা এটাই চেয়েছিলাম।

বিজয় অভিযান

বিজয় অভিযানে মুক্তিযোদ্ধারা শুধূমাত্র নীরব দর্শকই ছিল না। তাদের একটা নির্দিষ্ট ও উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। এই তৎপরতা নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এরপর টাকি থেকে একশো পঞ্চাশ মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে চার্লি সেক্টরে একটা কনফারেন্সে যোগদান করার জন্য আমাকে ডাকা হয়। চার্লি সেক্টর এই সময় ব্যারাকপুর থেকে কৃষ্ণ নগরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার এন,এ, সাকিলও ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ভারত জরুরী অবস্থা ঘোষনা করলে কিভাবে আমাকে সামনে অগ্রসর হতে হবে, এ ব্যাপারে তিনি মোটামুটি একটা ধারনা দিলেন। মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনার কথা গোপন রেখে সাতক্ষীরা- দৌলতপুর রোডে এবং আরও দক্ষিণে আমার লোকজন নিয়ে যে কোন সময় অগ্রসর হবার জন্য তিনি আমাকে প্রস্তুত ও সতর্ক থাকতে বললেন। পরিকল্পনার কথা আমাকে না জানালেও আমি অনুমান করলাম যে, সাতক্ষীরার বাঁ দিক থেকে একটা সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সাতক্ষীরা- দৌলতপুর বরাবর শত্রু ঘাঁটিগুলো নিশ্চিহ্ন করার জন্য যশোরের উত্তর দিক থেকে প্রধান আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। তাছাড়া, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পাক-বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর গোলাবর্ষণের মাঝখানে পড়ে যাতে বিপর্যস্ত না হয়, সেই জন্য মিত্র বাহিনীর আগে আমার সৈন্য বাহিনী পাঠাতে বারন করা হলো। আমাকে জানানো হলো যে, মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য হবে এইরুপঃ প্রথমত, সময়মত মিত্রবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য লোকজন দেয়া। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর মিত্রবাহিনী কোন প্রশাসনিক অসুবিধার সম্মুখীন হলে তা দূর করার জন্য তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। তৃতীয়ত, ঘনিষ্ঠ ভাবে মিত্রবাহিনীকে অনুসরণ করা এবং তাদের সংস্পর্শে থাকা। আমাকে বলা হলো যে, যেহেতু ‘বাংলা অঞ্চল’ (বেঙ্গল এরিয়া-ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি) আমার নিকটবর্তী, সেই জন্য আমার সেক্টর এখন থেকে বাংলা অঞ্চলের প্রশাসনিক আওতাধীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া দক্ষিন সুন্দরবন এলাকার সম্পুর্ন জলপথ বাংলা অঞ্চলের অধীনে এনে, এর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় জেনারেল পি,কে, রায় চৌধুরীর উপর।

সেক্টরে ফিরে আমি আমার নিজস্ব পরিকল্পনা তৈরী করলাম। আবার দুই হাজার গেরিলা সৈন্য ছিল। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র খুবই অপ্রতুল। তবুও আমি মনে করলাম যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা সৈন্য ছিল। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র খুবই অপ্রতুল। তবুও আমি মনে করলাম যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলাদের উপস্থিতিই অনেকটা প্রভাব বিস্তার করবে। কেননা, বিজয় অভিযানের সময় সম্ভাব্য রাহাজানি, ধর্ষন ও অন্যান্য অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে সেদিকে আমার লোকজন সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারবে। কাজেই, পরপর দুরাত্রিতে আঠারোশো গেরিলা সৈনযকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বাদবাকী গেরিলাদের বিজয় অভিযানের সময় অগ্রসর হওয়ার জন্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত করে রাখা হলো। সদর দপ্তরে ও আমার সেক্টরের অন্যান্য জায়গায় আমার নিয়ন্ত্রাধীনে যেসব সৈন্য মোতায়েন ছিল, তাদের সদা সতর্ক থাকতে বলেছিলাম। আমার সেক্টর সদর দপ্তরের বিস্তৃতি অনেক দূর পর্যন্ত। অল্প সময়ের নোটিশে এটা গুটিয়ে আনা সম্ভব নয়। আমি ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে বুঝিয়ে বললাম যে, যে সমস্ত আর্মিরা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে হাজির হতে পারবে না, তারা যেন দেশ মুক্ত হওয়ার পরই খুলনায় আমার সাথে মিলিত হয়। হিসাবপত্র ঠিক রাখা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যত্ন নেয়ার জন্যও সার্জেন্ট ফজলুল হককে নির্দেশ দিলাম। কেননা, আমরা চলে গেলে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্যান্য যুবক এখানে হাজির হবে তারা নিতান্ত অসুবিধায় পড়বে। সৌভাগ্যক্রমে দবিতীয়বারের মত লেঃ জিয়া এসে গেল। সুন্দরবন এলাকায় সে পাকিস্তানী গানবোটের সামনে শত্রুপক্ষের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করে তার অঞ্চলকে সম্পুর্নরূপে মুক্ত করেছে হানাদাররা নদী বরাবর তাদের ঘাঁটিগুলো ছেড়ে দিয়ে খুলনার দিকে হেঁটে গিয়ে জড়ো হয়েছে। আমি স্থির করলাম যেসব গেরিলা খুলনার সীমান্ত বরাবর শত্রু হননে লিপ্ত, তাদেরকে খুলনা শহরের চারিদিকে সমাবেশ করে হানাদারদের পিছু হটার রাস্তা সম্পুর্নরূপে বন্ধ করে দেব। মিত্র-বাহিনীর সার্বিক পরিকল্পনা মনে রেখে মাসের ১৫ তারিখে সাব- এরিয়া কমান্ডারদের নিয়ে আমাদের দপ্তরে একটা সম্মেলনে মিলিত হয়ে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম। খুলনা শহরের নিকট রূপসা নদীর পশ্চিম তীরে। আক্রমণ ব্যুহ তৈরী করার জন্য লেঃ জিয়াকে সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ দিলাম। বাগেরহাটে সুবেদার তাজুল ইসলামের অধীনে যে সমস্ত সৈন্য ছিল তাদেরও লেঃ জিয়ার নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিলাম। শত্রুপক্ষ যাতে নৌ-পথ ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য জনৈক মিঃ নোমানউল্লাহকে তেরখাদা ও মোল্লারহাটে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিল, তাঁদের সাথে সমন্বয় স্থাপন করে খুলনার উত্ত্র-পূর্ব দিক থেকে এসে এক জায়গায় জড়ো হয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সতর্ক থাকতে বললাম। আরও যেন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত থাকে। খুলনার দক্ষিনে পাইকগাছা, তালা ও আশাশুনি অঞ্চলে সেকেন্ড লেঃ আরেফিন গেরিলাদের হিসাবে কর্মরত ছিল। তাকে বললাম, সে যেন গেরিলাদের সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে খুলনা শহরের কাছাকাছি কোথাও প্রস্তুত হয়ে থাকে।

ক্যাপ্টেন হুদার অধীনে দুই ব্যাটালিয়নের বেশী যোদ্ধা ছিল। তাকেও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলাম। বসন্তপুরে শত্রুপক্ষের অবস্থান খুবই সুদৃঢ়। বসন্তপুর আমাদের খুবই নিকটে। একান থেকে হানাদারদের বিতাড়িত করে গুরুত্বপূর্ন সাতক্ষীরা- দৌলতপুর সড়কে শত্রু মুক্ত করে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদাকে দায়িত্ব দিলাম। খুলনা শহরের চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের জড়ো করে রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দখলদার আমলে বিহারীরা বাঙ্গালী মুসলমানদের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিল তারই প্রতিহিংসা নিতে গিয়ে অনিবার্য পরিনতি স্বরূপ বযাপক হারে বিহারী নিধন আরম্ভ হবে এবং সারাদেশ জুড়ে নেমে আসবে বিশৃংখলা। এই আশংকা করেই উপরোক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। উল্লেখিত পরিকল্পনা ছাড়াও আমি দুটো দলকে প্রস্তুত করে বেগের নেতৃত্বাধীনে বরিশালের দিকে নৌকায় পাঠিয়ে দিলাম। প্রথম দলটি ক্যাপ্টেন ওমরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে বরিশালের উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলা করবে আর দ্বিতীয় দলটিকে সেকেন্ড লেঃ মুয়িনের নেতৃত্বে পটুয়াখালী পৌছানো হলো। কথা প্রসঙ্গে বলতে হয় সেকেন্ড লেঃ মুয়িন মিত্র বাহিনীর অধিনে বিহার প্রবেশের ‘মুর্তিহতে বাংলাদেশের ক্রাশ ট্রেনিং কোর্স সমাপ্ত করে আরও চারজন তরুণ অফিসার সহ প্রথম দলে অক্টোবর মাসে আমার কাছে আসে। তারা তিনমাসের ক্রাশ ট্রেনিং প্রোগ্রাম অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণ করে। এই তিনজন অফিসার হলো- সেকেন্ড লেঃ মোহাম্মদ অলি, আহসানউল্লাহ এবং শচীন্দ্র। তাঁদের সবাইকে ক্যাপ্টেন হুদার বাহিনীতে কাজ করার জন্য দেয়া হলো। বয়সে সবাই নবীন, কর্মক্ষম ও কষ্টসহিষ্ণু। যাহোক, নির্দেশ মোতাবেক লেঃ জিয়া, নোমান ও আরেফিন স্বস্ব গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হয়ে গেল। বসন্তপুরের উপর যে কোন সময় আঘাত হানার জন্য ক্যাপ্টেন হুদা প্রস্তুত হয়ে রইল। এই সময়ে লেঃ জিয়াকে একটা বেতার যন্ত্র যোগাড় করে দিলাম। ওদের সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে মনের গভীরে একটা প্রশ্ন উকি দিলে নিজেই বিস্মিত হলাম- এইবার কি সত্যিই আমরা খুলনা যাচ্ছি?

ওদের যে সমস্ত আদেশ দেয়েছিলাম তা আমার কানে অবিশ্বাস্য রকমের প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। স্বপ্নাবিষ্টের মত মনে হলো, ওগুলো যেন আমাকেই উল্টো পরিহাস করছে। কেননা, দালালও হানাদার পরিবেষ্টিত খুলনার মত বিপজ্জনক শহরে এত শীগগীর প্রবেশ করতে পারবো- একথা কল্পনাও করতে পারিনি। যদিও স্থানীয় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও কমপক্ষে পাঁচ হাজার গেরিলা খুলনা শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল, তবুও হানাদারদের প্রকৃত শক্তি সম্পর্কে আমরা ছিলাম সন্দিহান।

সমস্ত শঙ্কা, সমস্ত ভয় উবে গেল। চরম লগ্নটি সমাগত। পবিত্র ঈদের দিন সকালবেলা, ১৯৭১ সালের ২০শে নভেম্বর- ক্রিং ক্রিং করে টেলিফোনে কয়েকবার শব্দ হতেই রিসিভারটা কানের কাছে নিলামঃ অত্যন্ত সুখবর। প্রশংসনীয় তৎপরতা। অবস্থান মজবুত করে টিকিয়ে রাখো। কুত্তাগুলোকে পিছু পিছু ধাওয়া করো।‘

আনন্দ- উত্তেজনায় এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেললাম। ক্যাপ্টেন হুদা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বসন্তপুর, কালীগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জে শত্রুর অবস্থানের উপর চরম আঘাত হেনে এই ঘাঁটিগুলো আমাদের কব্জায় এনেছে। কি ভয়ংকর উত্তেজনা। ক্যাপ্টেন হুদা কথা বলতে পারছিলনা। তার বাক রুদ্ধ হয়ে এলো। উত্তেজনা ও চাঞ্চল্যের অফুরন্ত আনন্দে আমরা সবাই বিস্ময়াভিভূত, হতবাক। হুদা ও তার সাথের মুক্তিসেনাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানালাম। বললাম যে। শত্রুর উপর আঘাতের ক্ষিপ্রতা ও তার গতিবেগ যেন পুরোপুরি রক্ষা করা হয়। আনন্দ ও উত্তেজনায় এতটা আত্মহারা যে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এই পবিত্র দিনটিতে বহু প্রতীক্ষিত বিজয় অভিযান শুরু হলো। স্কল শিক্ষক মিঃ শাহাজানকে পারুলিয়া রোডের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম। কেননা বসন্তপুর ও কালীগঞ্জ ঘাঁটি থেকে শত্রুবাহিনীকে এই পথ দিয়েই পালাতে হবে এবং এটাই একমাত্র পাকা রাস্তা। একই সংগে মিঃ চৌধুরীর নেতৃত্বে ষাটজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে পারুলিয়া ব্রীজটি অক্ষত অবস্থায় অধিকার করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। মিঃ চৌধুরী পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন অভিজ্ঞ নাবিক। বেশ হাসিখূশী। কঠোর প্রকৃতির এই মানুষটি আমার পরিকল্পনায় খূশী হয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিলো।

প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার পর আমি মোস্তফাকে নিয়ে স্থানটা স্বচক্ষে দেখার জন্য বসন্তপুরের দিকে রওনা হলাম। দীর্ঘ ন’মাস যাবত ইছামতির ওপার থেকে বসন্তপুর আমাদের কতবার ইশারায় আহবান জানিয়েছে। এক ঘণ্টা পরে হিংগলগঞ্জে পৌঁছে দু’জন ষ্পীডবোটে নদী পার হয়ে তীরে নামলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার আজ কোন মেশিনগান গর্জে উঠলো না। আগে অবশ্যই কোন অতিথির পদার্পন মাত্র মেশিনগানগুলো মুহুর্তে এক ঝলক আগুন ছূড়ে গর্জে উঠতো।

রক্তলাল সূর্যটাকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা যখন পত পত করে উড্ডীন দেখলাম, তখন কি যে উত্তেজনা! ওই সূর্যটাকে স্বাগত জানাতে কত না রক্ত ঢালতে হয়েছে এই ইছামতির তীরে। সমুন্নত পতাকার নিচে দু’ থেকে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা নীরবে দন্ডায়মান। শত্রুর কোন চিহ্ন নেই। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র। গোলাবারুদ, রেশন এবং চারিদিকে কুৎসিত ধ্বংসাবশেষ রেখে হানাদাররা পালিয়েছে।

স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াবার জন্য আত্মহুতি দিতে হয়েছিল অনেক মুক্তিপাগল তরুণকে। ওদের মহান আত্মত্যাগের জন্যই আজ স্বাধীন বাংলার পতাকা সমুন্নত শিরে উড্ডীন রয়েছে। পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র দেখে আজ আর আমি উত্তেজিত হই না। আগে মাত্র একটা রাইফেল দেখে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। এখন এটা আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগলো।

বসন্তপুর অধিকার করে আনন্দ ও উত্তেজনার পরিবর্তে মন আমার বেদনাভরাক্রান্ত হয়ে উঠলো। নভেম্বরের শীতল বাতাসে উঁচু বাঁধটার উপর দাঁড়িয়ে মানুষের এই বীভৎস কংকাল গুলোর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। কি মর্মান্তিক! ওরা রক্ত দিয়েছে, আমরা ও রক্ত দিয়েছি। সাক্ষী রয়েছে ওদের কংকালগুলো। সবাধীন্তা-পাগল আমার মুক্তিযোদ্ধাদের কংকালও ছড়িয়ে- ছিটিয়ে আছে এখানে-ওখানে।

এই মিশ্র অনুভূতি সম্বল করে কালীগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জ পরিদর্শন করলাম। এই জায়গাগুলো কিছু ভাল বলে মনে হলো। কিছুটা প্রানের স্পন্দন এখনও যেন বেঁচে আছে।

এখানে কিছু লোকজন দেখলাম। অনেক বাড়িঘর ধবংস্তুপের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আবার অনেকগুলো নারকীয় অগ্ন্যতসবের বিকলাঙ্গ চেহারা নিয়ে বীভৎসতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত দুঃখের মাঝেও যে ক’জন লোক আমরা এখানে পেয়েছিলাম, তারা আমাদের স্বাগত জানাতে কার্পন্য করলো না। স্থানীয় লোকজন বললো, গত রাত থেকেই হানাদাররা সাততাড়াতাড়িতে পালাতে শুরু করেছিল পলায়নপর হানাদারদের স্থানীয় লোকজন যখন জিজ্ঞেস করেছে’ আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? তখন ওরা কম্পিত স্বরে জবাব দিয়েছিল, মুক্তিরা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, ওপরওয়ালাদের হুকুমমত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি’। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে হানাদাররা যে ভাবে পালিয়ে গিয়েছিল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় লোকজন হাসিতে ফেটে পড়লো। অনেক দামী ও লোভনীয় জিনিস রেখে যাওয়া ছাড়াও হানাদাররা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নদীতে ফেলে দেয়।

ক্যাপ্টেন হুদা রাতে বসন্তপুরের উপর আক্রমণ চালায়। জবাবে সারা রাত ধরে হানাদাররাও প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করে। আর এই গোলাবর্ষণের আড়ালে রাতের আধাঁরে গা-ঢাকা দিয়ে শত্রুরা পালিয়ে যায়। ভোরে অবস্থা অত্যন্ত শান্ত ভাব ধারন করায় হুদা, মুক্তিযোদ্ধার একটি ছোট দলকে গ্রামের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে, যারা আমাদের গোপনে সংবাদ সরবরাহ করতো, তাঁদের কাছ থেকে প্রথম জানতে পারলো যে, হানাদাররা পালিয়ে গেছে।

সংবাদ পেয়ে হুদা এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে কালীগঞ্জ- সাতক্ষীরা রাস্তা ধরে একরকম দৌঁড়ে বসন্তপুরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। একটা ভাঙ্গা জীপ ছাড়া তার সাথে আর কোন যানবাহন ছিল না। জীপটা কিছুদিন আগে হানাদারদের কাছ থেকে অধিকার করা হয়। হানাদাররা তখনও পালাচ্ছিল। প্রশংসনীয় উদ্যম ও মনোবল নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দীর্ঘ বারো মাইল পথ হেঁটে তার বাহিনীসহ মিঃ শাজাহানের লোকদের কাছে পৌঁছে হানাদারদের সম্মুখ থেকে আঘাত হানলো, তখন ওরা দিশেহারা হয়ে পারুলিয়ার দিকে পালাতে শুরু করে। ওদিকে মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বে টাকি থেকে যে সৈন্যদলটি এসেছিল, তারা পলায়নপর হানাদার বাহিনীর একটি দলকে মাঝপথে অবরোধ করে ফেললো। এদিকে হুদা জানতে পারলো যে, হানাদাররা পারুলিয়া সেতু উড়িয়ে দিয়ে ওপারে আত্মরক্ষা মূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সেতুর চার মাইল দূরে অবস্থান নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা দ্রুত মিঃ চৌধুরী ও শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীকে তার লোক জনদের একত্র করে পুনর্বিন্যাস করলো।

ওই রাতেই আমি অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শন করলাম। তখন পাক-হানাদার ও আমাদের মধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হচ্ছিল। আমাদের বাঁ- দিকে মিঃ মাহাবুবের নেতৃত্বাধীন ৮ নং সেক্টরের সৈন্যদের নিয়োগ করা হয়েছিল। মিঃ মাহাবুব একজন পি-এস-সি অফিসার। কর্মদক্ষতার জন্য তাকে মেজর পদে উন্নীত করা হয়। তিনি সাহসী ও বুদ্ধিমান। আঘাতের পর আঘাত হেনে শত্রুপক্ষকে সর্বদা ব্যস্ত রাখতেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মিত্রবাহিনীর তরফ থেকে আমরা কোন সাহায্যকারী সৈন্য পাইনি।

৭২ নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সৈন্যরা আমাদের অধিকৃত জায়গাগুলো, যেমন বসন্তপুর ও কালীগঞ্জের উপরে তদারকী করতো। আর তাদের সাহায্য করতো পিছনে অবস্থানরত আমাদের মুক্তিবাহিনী। সুবেদার মেজর এ, জলিল ও লস্করের অধীনে মুক্তিবাহিনী এখানে কাজ করেছে। আমাদের সাথে মর্টার সজ্জিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল ছিল। তারা শুধু হানাদারদের গোলাবর্ষনের জবাবে পাল্টা গুলি ছুড়তো। সুবেদার গফুর নামে একজন অভিজ্ঞ মর্টার শিক্ষক পাক-হানাদারদের গুলির জবাবে দক্ষতার সাথে পাল্টা গোলাবর্ষন করে প্রত্যেকবারই শত্রুদের প্রভুত ক্ষতি সাধন করতো। ভয়ানক ভাবে কোণঠাসা হয়ে হানাদারদের মেশিনগান গুলো সব সময় গর্জন করতে লাগলো। যেহেতু আমাদের অবস্থানের চতুর্দিকে হানাদারদের দৃষ্টির আওতায় সেজন্যে রাত্রে বা দিনের পাহারায় বেরুনোর খুবই কষ্টকর ছিল। কিছুক্ষনের জন্য যুদ্ধ দানবটা দম নিয়ে পুনর্বার আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতো।

২৩শে নভেম্বর পারুলিয়া থেকে চার মাইল দূরে আর একটা ব্রীজের পেছনে হানাদাররা সরে গেল। সরে যাবার আগে ওরাই এবার নৃশংসতার স্বাক্ষর রেখে গেল। এদিকে আমাদের সৈন্যরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। স্পষ্ট বোঝা গেল যে হানাদাররা প্রথমে সাতক্ষীরায় ও পরে খুলনার দিকে পালাবার জন্য যুদ্ধে দীর্ঘসূত্রতার কৌশল অবলম্বন করেছে। এই ব্রীজের কাছে এসে ঊভয় পক্ষই মাঝে-মধ্যে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার করে গুলি বিনিময় করতো। এখানে মূর্তজা নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হারাতে হয়। সে অত্যন্ত সাহসী এবং অনেক যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছিল। মাথায় বুলেটের আঘাত লাগার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কেননা, বুলেটের আঘাতে ওর মগজ বের হয়ে গিয়েছিল। যাহোক, আমরা সব সময় আত্মরক্ষা মূলক অবস্থান থেকে শত্রুর প্রতিটি গতিবিধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম।

হানাদাররা যে সমস্ত জায়গা ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তার খবরটা কোলকাতার জনগনের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে গেল। মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করার জন্য সাংবাদিক, টিভি ক্যামরাম্যান এবং আরও অনেক সম্মানিত ব্যাক্তি আসতে লাগলেন। ইছামতীর পশ্চিম তীর লোকে লোকারণ্য, মনে হলো কোন জনাকীর্ণ মেলা। পরিদর্শনকারী দু’একটি দলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা এখানে ঘোরাঘুরি করছেন কেন? উত্তর এলো, মুক্তির আনন্দ, মেজর সাহেব- মুক্তির আনন্দ’।

মুক্তির আনন্দই যেন বৈধ পাসপোর্ট। শিগগিরই মুক্ত-অঞ্চল লোকের আগমনে সরগরম হয়ে উঠলো। কোলকাতা থেকে শরণার্থীরা দলে দলে তাদের পরিত্যক্ত বাড়িঘরে ফিরে আসতে লাগলো। আবার নতুন করে ঘর বাধাঁর প্রবল ইচ্ছা।

এবার সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী সাহেব মুক্তাঞ্চল সফর করতে এলেন। তাঁকে আমি রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী এলাকায় নিয়ে গেলাম। কতকগুলো অসুবিধার জন্য সাতক্ষীরা থেকে আট মাইল দূরে আমাদের থামতে হয়েছিল। কি করে এই অসুবিধাগুলো দূর করা যায়, তাঁকে বুঝিয়ে বললাম। আমার পরিকল্পনা ছিল, সাতক্ষীরার পিছনে দু’দিক থেকে সৈন্য পাঠিয়ে হানাদারদের পালানোর পথ বন্ধ করে দেয়া এবং যাতে নতুন সৈন্য আমদানী করে শক্তি বৃদ্ধিকরতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। দু’টো প্রধান রাস্তা দিয়ে সাতক্ষীরার সাথে চলাচল ব্যবস্থার সংযোগ সাধন করা হতো। একটা হলো, যশোর থেকে কদমতলা হয়ে- অপরটা হলো কালিগঞ্জ থেকে যে পথ ধরে আমরা অগ্রসর হচ্ছিলাম, সেই পথ। এ রাস্তাটা সাতক্ষীরার ভেতর দিয়ে দৌলতপুর-খুলনা পৌঁছেছে। স্থির করলাম, প্রত্যেকটি রাস্তায় বাধা সৃষ্টি করবো।

২৯শে নভেম্বর, হাবিলদার আফজালের নেতৃত্বে দু’শো মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সাতক্ষীরার প্তহে পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু যেভাবে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম সেইমত কাজ করতে ব্যর্থ হলো। তারপর লেঃ আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে দু’শো মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে ওই একই পথে পাঠানো হলো। আহসানউল্লাহ অত্যন্ত সাহসী যুবক। তার যোগ্যতা ও সামর্থ্য সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত ছিলাম ছিলাম। এগিয়ে যাবার প্রচন্ড শক্তি তার মধ্যে। ডানদিক থেকে একশো মুক্তিযোদ্ধার আর একটি দলকে মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা-দৌলতপুর রাস্তায় ওঁত পেতে শত্রুকে আঘাত করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। ক্যাপ্টেন হুদাকে বললাম যে, রাতের বেলায় আক্রমণাত্মক পাহারা দিয়ে শত্রুদের উপর চাপ সৃষ্টি করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাতক্ষীরা অধিকার এবং সৈন্যদের দ্রুত পুনর্গঠিত করে পলায়নের পর শত্রুদের পিছু ধাওয়া করতে হবে।

ইতিমধ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার বৃহদাংশ নদীর ওপার থেকে দেবহাটায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এখানে ভুতপুর্ব সি-এস-পি অফিসার মিঃ আতাউর রহমানের তত্ত্বাবধানে পাঁচশো তরুণ যুবক নিয়ে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প খুলে দিলাম। মিঃ আতাউর রহমান যুবক, কর্তব্যপরায়ন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সর্বান্তকরনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে তার দান অপরিসীম। শীগগীরই ক্যাম্পের কার্যকলাপ সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র প্রযোজকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সব মতাদর্শের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্যাম্প পরিদর্শনে আসতে লাগলেন। অনেক গণ্যমান্য লোকজন সাথে নিয়ে ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মেঃ কামরুজ্জামান এই ক্যাম্প পরিদর্শন করে অত্যন্ত খুশী হলেন। ছেলেরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে মন্ত্রী মহোদয়কে স্বাগত জানালে তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন। কিন্তু এই সৌজন্যমুলক পরিদর্শনে আমি খুশী হতে পারিনি। কেননা, সামনে এখনও অনেক দুস্তর পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে। ২রা ডিসেম্বর পর্যন্ত লেঃ আহসানউল্লাহর কাছ থেকে কোন ফলপ্রসু খবর পাইনি। রাস্তায় ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে শত্রুদের একটি জীপ সে উড়িয়ে দিয়েছিল। রাস্তার ধার দিয়ে একটা সুদৃঢ় ব্যাংকার তৈরী করে শত্রুপক্ষ অবস্থান নেয়ায় আহসানউল্লাহ ওদের কাছে ঘেঁষতে পারেনি। শত্রুদের অবস্থান থেকে দু’দিকে প্রায় দু’শো গজ পর্যন্ত উম্মুক্ত ধান ক্ষেতও জলাশয়। সবকিছুই ভালভাবে দৃষ্টিগোচর হতো না। ডান দিকে মিঃ শাজাহানের বেলায় ঠিক একই অসুবিধা। তাছাড়াও, রাজাকারদের কাছ থেকে তাকে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

অবস্থার কোন উন্নতী হলো না। যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। শত্রুদের পরিকল্পনা ছিল রাজাকার দ্বারা প্রতিরোধ তৈরী করে রাতের অন্ধকারে আস্তে আস্তে সরে পড়া। সাতক্ষীরা ও তার পার্শবর্তী এলাকার প্রায় শতকরা পচাঁশি জন লোক সামরিক চক্রের দালাল হিসাবে হানাদারদের সক্রিয় মদদ যুগিয়েছে। তার ফলে সবকিছুই মন্থর গতিতে চলতে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের ক্রমবিকাশ ও চিরন্তন গতিকে কে রুখতে পারে? পুর্ব রণাঙ্গনেই শুধু পাকিস্তানী জেনারেলরা বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হলো না, পশ্চিম রণাঙ্গনে ও রিতিমত হিমশিম খেয়ে উঠলো। ১৯৬৭ সালে ইস্রাইল যে রকম ব্লীসৎক্রীগ’ কায়দায় আরবদের উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক একই কায়দায় পাক-সামরিক জান্তা তাদের বিমান বাহিনীর মিরেজ ও মিগ নিয়ে ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ রাত্রে ভারতের উপর হামলা চালায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীও খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি ওই রাত্রেই জরুরী অবস্থা ঘোষনা করে পাক হামলার সমীচীন জবাব দিলেন। সুরায় বিভোর জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান মনে করেছিল রাজনীতি সচেতন বাঙ্গালীকে চিরদিনের জন্য দাবিয়ে রাখতে পারবে এবং এই হীন উদ্দেশ্যই সে ভারত আক্রমণ করে সমস্যাটার উপর আন্তর্জাতিক রং চাপিয়ে ভারতের সাথে একটা রাজনৈতিক মিমাংসায় আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সে চরম ভাবে ব্যর্থ হলো।

৬ই ডিসেম্বর। বেলা ১১ টার সময় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ মারফত ঘোষনা করা হলো যে, ভারত বাংলাদেশকে সর্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দীর্ঘ ন’মাস যাবত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী অধীর আগ্রহে দিনটির জন্য প্রতিক্ষায় ছিল। সংবাদটা শুনে মন থেকে চিন্তা ও উত্তেজনা দূরীভূত হলো। হটাত স্বীকৃতির এই ঘোষনা শুনে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর এই বিধ্বস্ত অন্তর গর্বে ফুলে উঠলো। স্বীকৃতি শুধু ফাইলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রইলনা বা বাতাসে মিলিয়ে গেল না। মিত্রবাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাধে কাধ মিলিয়ে প্রথম তিন দিনেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট অধিকার করে নিল। সুদৃঢ় অবস্থান ছেড়ে দিয়ে পাক হানাদাররা উর্ধবশ্বাসে পালাতে শুরু করলো। প্রত্যেকেই আশা করেছিল যে, পাক বাহিনী যশোরে আমাদের প্রচন্ড বাধা দেবে। কেননা, যশোর ক্যান্টনমেণ্ট দুর্ভেদ্য বলে মনে করা হতো। কিন্তু হানাদাররা তেমন কোন বাধা দিতে না পারায় মিত্রবাহিনী ও আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। অথচ মিত্রবাহিনীর কমান্ডাররা প্রথমে, মনে করেছিল যে, পাকিস্তানীদের উৎখাত করতে কমপক্ষে ১৫ দিন সময় লাগবে।

অপর দিকে আমাদের মুক্তিবাহিনী ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে সাতক্ষীরা দৌলতপুর রোড ধরে অগ্রসর হতে লাগলো। সাতক্ষীরা অধিকার করে যে পরিমান অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানী তেল, রেশন ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস পত্র আমাদের হাতে এসেছিল তা দিয়ে পুরা একবছর যুদ্ধ করা যেতো। কিন্ত এই সময় অধিকৃত জিনিসপত্রের প্রতি আমাদের কোন মোহ ছিল না। আমাদের একমাত্র মোহ, একমাত্র উত্তেজনা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। পেছনে মুক্তিবাহিনীর উপর ওইসব পরিত্যক্ত জিনিসের হেফাজতের ভার দিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা তার বাহিনীর লোকজন নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে অগ্রসর হতে লাগলো।

হানাদাররা পালাবার সময় প্রধান সেতুগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল। এর ফলে আমরা খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হলাম। দু’একটা জীপ ছাড়া আমাদের কাছে কোন যানবাহন ছিল না। এই জীপ গুলো নানা উপায়ে পার করা হতো। মিঃ ফজলুল হক ও সুলতান উদ্দিন আহমেদ যথাক্রমে সদর দফতর ও গেরিলা ক্যাম্পের সামরিক দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। তাদের শেষ নির্দেশ দেওয়ার জন্য আমি ফিরে গেলাম।

চার্লি সেক্টর থেকে সর্বশেষ যে নির্দেশ পেলাম, তা হলো- অস্ত্রপাতি ছাড়া মুক্তিযূদ্ধাদের বিদায় দিতে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বিভিন্ন যুবকেন্দ্রের ম্যানেজাররা এম সি এ’রা স্বাধীনতার উল্লাসে আত্মহারা হয়ে ছেলেদের ফেলে রেখে যে যার মত আগেই চলে যায়। আর ছেলেরা পড়ে মহাসংকটে। বাংলাদেশে ফিরে যাবার মত কোন সম্বলই ছিল না তাঁদের। তারা আমার হেডকোয়ার্টারের চারিদিকে এসে ভীড় করলো এবং অনুরোধ জানালো যে তাঁদের জন্য যেন কোন বন্দোবস্ত করে দেই। আমার এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে ছেলেদের যাবার বন্দোবস্ত করার জন্য সুলতান ও হককে বলে দিলাম।

দিনটা ডিসেম্বরের ৯ তারিখ। সবকিছুই এলোমেলো। কারুর দৃষ্টি নেই। কাজকর্ম ফেলে রেখে সবাই বাংলাদেশের ভেতর চলে যেতে চায়। আমি তাঁদের মানসিক অবস্থা উপলব্দি করতে পারি। কিন্তু পিছনের কাজকর্ম গুছিয়ে দেয়ার জন্য কাউকে অন্ততঃ এখানে থাকতে হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক বেগকে তার দলবলসহ গ্ণ-পরিষদ সদস্য মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর সাথে বরিশালে পাঠিয়ে দিলাম।

টাকি ও হাসনাবাদের দিকে চেয়ে মনটা কেঁদে উঠলো। মনে হলো, ওরা আজ বড্ড শূন্য, বড্ড নিঃসঙ্গ। দীর্ঘ ন’মাস যাবত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীর ভীড়ে কর্মচঞ্চল হাসনাবাদ ও টাকি আজ নীরব। যেন ফুঁপিয়ে কাঁদছে আমি ভয়ানক অন্ত জ্বালা অনুভব করলাম। শেষবারের মত ইছামতী ও আমার হেডকোয়ার্টারের দিকে অশ্রুসজল চোখ দুটো বুলিয়ে মোস্তফাকে আমার জীপে উঠতে বললাম। অন্যমনস্কভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম, হক ও অন্যান্য সাথীদের দিকে। পরে খুলনায় এসে আমার সাথে যোগ দেয়ার জন্য ওদের নির্দেশ দিলাম এবং আমাদের অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে যোগ দেয়ার জন্য আমি এগিয়ে চললাম। পিছনে পড়ে রইল স্মৃতিবিজড়িত হাসনাবাদ, টাকি- চেনা-অচেনা মুখ ও হাসিকান্নার অনেক গল্প।

বিজয়ের আনন্দে আমার গাড়ী চাকাগুলো অসম্ভব দ্রুতবেগে ঘুরতে লাগলো। আমি দৌলতপুর থেকে ১০ মাইল দূরে একটি স্কুলের কাছে আমার লোকজনদের সঙ্গে মিলিত হলাম। এই জায়গাটার নাম শাহপুর। এখান থেকে একটি রাস্তা বের হয়ে যশোর-খুলনার বড় রাস্তার সাথে ফুলতলার কাছে এসে মিশেছে।

ডিসেম্বর ৯ তারিখের রাত। স্কুল থেকে অগ্রবর্তী এলাকায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী মাত্র এক মাইল দূরে। শত্রুপক্ষের অবস্থানের হাজার গজের মধ্যে মিলে এক কোম্পানী সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। ৯ তারিখ রাত্রেই আমি ওদের কাছে যেতে চাইলাম। কিন্তু ওদের কাছে, পৌছানো দুঃসাধ্য ছিল। কেননা, ওরা তখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সুতরাং স্থির করলাম, ১০ তারিখে ভোরে ওদের সাথে মিলিত হবো। রাতটা ভয়ানক রকমের অশান্ত। সারারাত ধরে দু’পক্ষের কামানগুলো অবিশ্রান্ত গর্জন করছিল। স্কুলের ছাদে উঠে আমি, মোস্তাফা, ডাঃ শাজাহান ও হুদা দেখতে পেলাম সারা আকাশটা লালে লাল। কামানের গর্জনে স্কুলের ছাদটা থরথর করে কাঁপছে। খুবই উত্তেজক সন্দেহ নেই। কিন্তু বড় করুন, বড় নির্মম। কেননা, শত্রু মিত্র অনেক মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে হিংস্র কামানের গোলায়। সমস্ত রাত শুধু কামানের গর্জন আর গর্জন।

১০ই ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টা অতিবাহিত হলো অহেতুক উদ্দীপনা, উত্তেজনা ও এক রকম বিশ্রামের মধ্য দিয়ে। মুক্তিসংগ্রামের শেষ পর্ব। দুঃখ ও আনন্দে আবহাওয়া ভারাক্রান্ত। স্থানীয় লোকজন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা। নানাভাবে আতিথ্য দেখিয়ে জনগন আমাদের মুগ্ধ করলো। যেন আমরা সবাই একই সংসারের লোক, একই সুখ দুঃখের ভাগী। রাস্তার পার্শে সেই স্কুলটায় যে সপ্তাহটা কাটিয়েছিলাম, তার পূর্নাংগ চিত্র তুলে ধরার জন্য রণাংগনের ডাইরীর কিয়দংশ তুলে ধরছিঃ

১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ গতরাতে ঘুমাতে পারিনি। কামানগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। গুহায় আহত সিংহের মত কামানগুলো তবুও মাঝে মাঝে গোঙাতে লাগলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক মগ চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে অগ্রবতী ঘাটিতে যুদ্ধরত সৈন্যদের কাছে গেলাম।এটা আমাদের দ্বিতীয় অবস্থান্ সাতক্ষীরা দৌলতপুর রাস্তায় প্রায় একহাজার গজ সামনে মেজর ঠাকুরের নেতৃত্ব ১৩নং “ডোগরা” পদাতিক বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। অগ্রবর্তীদলের মর্টার সজ্জিত সৈন্য দলটি ও এখানে অবস্থান নেয়। রাস্তায় দু’দিক খোলা জলাশয়, সব কিছুই চোখে পড়ে। রাস্তায় কোন রকম চলাচল করলেই শত্রুপক্ষের মেশিনগানগুলি গর্জে ওঠে। রাস্তাটা খুব উঁচু। খুলনায় অয়ারলেস ষ্টেশনের টাওয়ার ও দৌলতপুর পানির ট্যাংক ভালভাবে দেখা যায়। এত কাছ তবু সোজাসুজি যেতে পারছি না। খুলনাকে দেখে আমি খুবই তৃষ্ণার্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। যেহেতু পিছন দিক থেকে অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হয়, সেজন্য আমাদের সেজন্য সৈন্যরা দু’দিক থেকে অগ্রসর হতে লাগলো। তাছাড়া মিত্রবাহিনীর আগে আমাদের যাবার কথা নয়। কাজেই আমাদের পিছনে থেকে যুদ্ধের গতিবিধি লক্ষ্য করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বললাম। ওদের অধিকাংশই খুলনার লোক। দেখলাম, ওদের মনোবল খুবই উঁচু। ওদের ঘরদোরের করুন দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। স্কুলে ফিরে এসে আমাদের যা কিছু আছে সব একত্র করার জন্য হুদাকে বললাম। স্মভাব্য বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ট্রেঞ্চ খনন করে তার ভেতর আমরা আশ্রয় নিলাম। কেননা ,এই জায়গা শত্রুক্ষের কামানের আওতায়। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে সতর্ক হয়ে প্রস্তুত রইলাম। আকাঙ্ক্ষিত চরম লক্ষ্যবস্তুর কত কাছে আমরা-তবু কত দূরে।

১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ যে দৃশ্য দেখেছি, তা জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। দেখলাম , সাতক্ষীরা-দৌলতপুর রোড লোকে লোকারন্য। বিভিন্ন যুবকেন্দ্র থেকে ওরা দলে দলে ফিরে আসছে। যতদূর চোখ যায় শুধু লোক আর লোক। কাঁধে ছোট ছোট বোঝা। রিক্ত,নিঃস্ব, সম্বলহীন। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আসছে মানুষের কাফেলা। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ, আমরা ওই রাস্তার উপরই ছিলাম, নইলে ওই রিক্ত মানুষগুলো হিংস্র শত্রুদের খপ্পরে পড়ে যেতো। সামনে অগ্রসর হতে ওদের থামিয়ে দিলাম।

একটা দোতলা দালান থাকার জন্য ঠিক করা হলো। ওদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। ভয়ানক চিন্তায় পরে গেলাম। ওরা প্রত্যেকেই এসে অভিযোগের সুর বললো, ‘স্যার, আমাদের সাথে কোন টাকা পয়সা নেই। এম-এন-এ, এম-পি-এ’ রা আমাদের ফেলে পালিয়ে গেছে।‘ মুখগুলো শুষ্ক, কুঞ্চিত। কেননা পঞ্চাশ মাইল পথ ওদের পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছে। মনটা আমার কেঁদে উঠলো। ওদের সান্তনা দিয়ে একটা বড় লংগরখানা খোলার জন্য চৌধুরীকে বললাম। খুলনা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের এখানেই থাকতে নির্দেশ দিলাম। চৌধুরীকে লংগরখানা দেখাশুনার ভার দিয়ে আমি হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা হয়ে গেলাম এবং ফুলতলা পোঁছে ৯নং পদাতিক ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ করলাম মেজর জেনারেল দলবীর সিং এই ডিভিশনের কমান্ডার।

ফুলতলা থেকে কিছু সামনে খুলনার দিকে যে রাস্তাটা গিয়েছে তার ডানপাশে একটি কলেজের মধ্যে হেডকোয়ার্টারের অফিসাদি। মেজর জেনারেল সিং-এর দেখা না পেয়ে তাঁর ষ্টাফ অফিসারের সংগে দেখা করলাম এই ডিভিশনের একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে তিনি মাইল সামনে অবস্থান নিয়েছিল।

পাক হানাদাররা এখনে তীব্র প্রতিরোধ দিয়ে খুলনা – যশোর উপর মিত্রবহিনী অগ্রগতি বন্দ করে দিল। অবিরাম গোলাবর্ষন চলতে লাগলো। মনে হলো, খুলনা শত্রুপক্ষ সুদৃঢ় ঘাঁটি গেড়েছে। সীমান্ত ও যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা জড়ো হয়েছে খুলনায়। কেননা মুক্তিবাহিনী চতুর্দিক থেকে ওদের ঘিরে রেখেছে। হানাদাররা মিত্রবাহিনীর চাইতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ভয় করতো।

১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ আমাদের আত্ম রক্ষামূলক অবস্থানের সামনে শত্রুঘাঁটির উপর বিমান হামলা পর্যবেক্ষন করার জন্য আমি, ডিভিশনের ষ্টাফ অফিসার মেজর ভট্টাচার্‍্য ভারতীয় বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট দত্ত আমাদের দ্বিতীয় অবস্থানে বসে সারা দিন অপেক্ষা করলাম। মিঃ দত্তের নির্দেশে এই বিমান হামলা পরিচালিত হচ্ছিল। বায়ুস্তর ভেদ করে বিমানগুলো উড়ে আসতেই মিঃ দত্ত বেতার যন্ত্র মারফত পাইলটদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং সঠিক লক্ষ্যস্থলের বর্ননা দিয়ে আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। পাইলটদের ঠিকমত নির্ভূলভাবে লক্ষ্য বস্তু চিনে বারবার বিমান নিয়ে ‘ড্রাইভ’ দিতে লাগলো। হানাদারদের কোন বিমান বা বিমানধ্বংসী কামান না থাকায় তার এই বিমান আত্রুমনের কোন প্রত্যুত্তর দিতে পারল না। অসাহায়ের মত শুধু মার খেতে লাগলো।

১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ মেজর জেনারেল দলবীর সিং-সাথে তাঁর হেড কোয়ার্টারে সাক্ষাৎ করলাম। দেখলাম গাড়ীর ভেতর তিনি একটি ম্যাপ দেখছেন এবং খুবই ব্যস্ত। তাঁকে ভয়ানক বিরক্ত ও রাগান্বিত মনে হলো। কেননা, প্রচন্ড গোলাবর্ষন করার পরও তিনি এগুতে পারছিলেন না। তাঁর অগ্রগতি থেমে গিয়েছিল।

ভারতের সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশ’ অল ইন্ডিয়া রেডিও মারফত ঘোষনা করলেন যে, আত্মসমর্পনকারী সৈন্যদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে। তৎসত্বেও শত্রুপক্ষের আত্মসমর্পন করার কোন লক্ষন দেখা গেল না।

জেনারেল দলবীর সিং তাঁর একটি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার কাজে আমার কাছে কয়েকজন দক্ষ লোক চাইলেন। উদ্দেশ্য, শত্রুদের বাঁদিক থেকে আত্রুমন করে বিভ্রান্ত করে ফেলা। তারাতারি হেড কোয়ার্টারে ফিরে গিয়ে খুলনার পথ-ঘাট যাদের ভাল জানা আছে এ-রকম পাঁচজন আমি নির্বাচিত করলাম।

১৫ই ডিসেম্বর ,১৯৭১ সালঃ গতরাতে মুষলধারে বৃষ্টি থাকায় মিত্র-বাহিনী সামনে এগুতে পারলো না। আজকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। এদিকে লেঃ দত্তের তত্ত্ববধানে দৌলতপুর ও খুলনার কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গায় বিমান হামলা চালানো হলো। বারবার বিমান হামলায় খুলনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেখে মনে ব্যথা অনুভব করলাম এবং পাক হানাদাররা এখনও আত্মসমর্পন না করায় মনে মনে ওদের অভিশাপ দিতে লাগলাম। আজকে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা বুলেটের আঘাতে প্রান হারায়। ক্যাম্পের আর একজন মুক্তিযোদ্ধা রাইফেলের ম্যাগাজিন খালি ভেবে ট্রিগার টিপ দেয়, যার ফলে এই মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারনা হয়। মুক্তিযোদ্ধাটি একজন এস,এস,সি পরীক্ষার্থী। মুকড়া স্কুল প্রাঙ্গনে ওকে সমাহিত করা হয়েছিল। স্থানীয় স্কুল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলাম, তারা যেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার নামে স্কুলটির নামকরন করে।

১৬ই ডিসেম্বর,১৯৭১ সালঃ দিনটা মেঘাচ্ছন্ন। কিছুটা ক্লান্তি ও বিষন্ন বোধ করতে লাগলাম।গতরাত্রের পরিকল্পনামাফিক মিত্র বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক’ খুলনার দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু ফরাফলের কোনখবর পেলাম না।

সকাল দশটা। শাহপুর স্কুলে কতকগুলো ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ক্যাপ্টন হুদার জীপ এসে থামতেই সে একটা দুষ্ট ছেলের মত লাফিয়ে পড়ে গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এ-রকম করতে আগে তাকে কখনও দেখিনি। তার এই ব্যবহার দেখে খুবই বিস্মিত হলাম। সে এক রকম কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘অত্যন্ত সুখবর স্যার, পাক সৈন্যরা আত্মসর্মপন করেছে এবং ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল জ্যাকপ ইতিমধ্যে ঢাকা অবতরন করেছেন’।

সংবাদটা অবিশ্বাস্য মনে হলো। কেননা, কল্পনাও করতে পারিনি যে, ওই হিংস্র পশুগুলি এত তারাতারি আত্ম সর্মপন করবে। তবুও এ সংবাদটা শুনে আমার সারা দেহে তপ্ত রক্তস্রোত বইতে লাগলো। চিৎকার করে ছেলেদের উদ্দেশ্য বললাম, ‘আমরা যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি’।

আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত। ছেলেরা সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করতে লাগলো। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ডিগবাজি খেয়ে ঘাসের উপরে গরাগরি করতে লাগলো। সবাই এক সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘তোমার নেতা, আমার নেতা- শেখ মজিব।’

আমি এবং হুদা মিত্রবাহিনীর ৯নং ডিভিশনের সদর দপ্তরে গিয়ে মেজর জেনারেল দলবীর সিংহকে তাঁর বাহিনীর অপর দু’জন অধিনায়কসহ খোশ মেজাজে বসা দেখলাম। আমাদের দেখে তাঁরা সবাই উল্লসিত হলেন এবং আমাদের স্বাগত জানালেন।

সময় বেলা ১২টা। কামানগুলি নীরব। আমরা একটা ট্রানজিষ্টারের কাছে বসে ঢাকার খবরাখবর শুনতে লাগলাম। শুনলাম পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেনারেল নিয়াজী তাঁর অধীনস্থ সমস্ত সৈন্য নিয়ে সকাল সাতটায় মিত্র-বাহিনীর লেঃ জেনারেল অরোরার নিকট আত্মসমর্পন করেছেন। একদিকে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের আনন্দ, অপরদিকে ওদের অপমানজনক পরাজয়ের তীব্র গ্লানি।

যাহোক, এদিকে খুলনাকে নিয়ে বড্ড দুর্ভাবনায় পড়লাম। তখন পর্যন্ত এখানকার শত্রুপক্ষের আত্মসমর্পন করার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। উত্তেজনায় জেনারেল দলবীর সিং টেবিল ধাপরে বললেন, যদি ওই শয়তানগুলো এখন আত্মসমর্পন না করে, তাহলে আমার নিকট যে গোলন্দাজ বাহিনী আছে, তা পাঠিয়ে দিয়ে ওদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিব।’

সময়ের চাকাটা ঠিকমতই চলতে লাগলো। কিন্তু আমাদের সামনে যে শত্রুরয়েছে, তারা যেন স্থবির। সবাই আমরা বসে। প্রতি মুহূত আশা করছি এইবার বুঝি হানাদাররা আত্মসমর্পন করবে। সূর্য ডুবে গেল, কিন্তু আত্মসমর্পনের কোন আভাস পাওয়া গেল না। আজ ঢাকার শত্রুপক্ষ আত্মসমর্পন করলো। কিন্তু খুলনায় আত্মসমর্পন করতে ওরা অস্বীকৃতি জানালো। মনে হলো, খুলনায় শত্রুপক্ষের কমান্ডার অত্যন্ত শক্ত লোক। আমি আমার হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলাম।

রাতটা ভয়ানক অস্বস্তিতে কাটলো। আমরা কেউ ঘুমাতে পারলাম না। মিত্রবাহিনীর কামানগুলি আবার সত্রিুয় হয়ে উঠলো। মাঝে মাঝে প্রত্যুত্তরে শত্রুপক্ষের কাছ থেকেও জবাব আসছিল। ওদের গোলাবারুদ হয়তো শেষ হয়ে আসছে। আমি আশাবাদী ছিলাম যে, আগামীকালই আমরা বিজয়ীর বেশে খুলনায় প্রবেশ করতে পারবো। বিগত ন’মাসের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে আজ আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো।

১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালঃ গত রাতে ক্যাপ্টেন হুদার সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে, মুক্তিবাহিনীর অধিকাংশ লোককে লেঃ মোহাম্মদ আলির তত্ত্বাবধানে দৌলতপুর রোড দিয়ে খুলনায় পাঠিয়ে দিতে হবে। ওদের ভেতর ষাটজন মুক্তিযোদ্ধাকে গাড়িতে চাপিয়ে প্রস্তুত করে রাখলাম, যেন ওরা নির্দেশ পাওয়া মাত্র আমাদের সাথে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারে। সকাল বেলা সবাই প্রস্তুত। চরম বিজয়ের অভিযানের উত্তেজনায় সবাই কাপঁছে। ক্যাপ্টেন হুদা, ডাঃ শাজাহান ও মোস্তফাকে সাথে নিয়ে সকাল সাতটায় মিত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে গিয়ে পোঁছালাম। গাড়ীতে যেসব মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তত করে রাখা হয়েছিল তাঁরা আমাদের পিছে পিছে রওনা হলো। রাস্তায় শত শত গাড়ীর ভীর। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন মিত্রবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে গাড়ী ছাড়ার সংকেত সবুজ বাতি জ্বলে উঠবে এবং খুলনার দিকে অগ্রসর হবে। মিলিটারী পুলিশ স্ট্যান্ডের নিকট সবার আগে আমাদের গাড়ী দাঁড় করালাম। ৯নং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে আমাকে স্বীকৃতি দেয়ায় মিত্র বাহিনী আমাকে গাড়ী পার্ক করার অনুমতি দিল। অন্যথায় কোন বেসামরিক লোককে মিলিটারি পোষ্টের একশো গজের মধ্যে গাড়ী পার্ক করার অনুমতি দিল। অন্যথায় কোন বেসামরিক লোককে মিলিটারি পোষ্টের একশো গজের মধ্যে গাড়ী পার্ক করার অনুমতি দেয়া হতো না। পিছন দিকে চেয়ে দেখলাম অসংখ্য দেশী বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার গাড়ীর চারদিকে ভির করে আছে। আমি হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। কারও উপর কারো নিয়ন্ত্রন ছিল না। সবাই ব্যস্ত-সমস্ত। বিজয়ের লগ্নটা আজ কত না প্রানবন্ত। প্রতিটি মুহুর্ত উত্তেজনাময়-ঐতিহাসিক। প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাস বিজয়ের আনন্দে মুখর। বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্নের ফলশ্রুতি। সবাইকে খুশি মনে হলো। কিন্তু অন্তর খুলে কেউ হাসতে পারলো না। মনের অস্থিরতায় সবাই আড়ষ্ট হয়ে এলো।

জেনারেল দলবীর সিং-এর সাক্ষাৎ করলাম। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কেননা, প্রধান ষ্টাফ অফিসার ,আত্মসর্মনকারী পাকিস্তানী কমান্ডার নিয়ে ইতিমধ্যেই রওনা হয়েছেন। এখনও এসে পেঁছৈাননি। সময় অতি মন্থর গতিতে চলতে লাগলো। এক একটি মুহূর্ত যেন এক একটি ঘন্টা। মিত্রবাহিনীর ৯নং ডিভিশনের ষ্টাফ অফিসার কর্নেল দেশ পান্ডে জেনারেল দলবীর সিংকে বললেন, ‘বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সাথের সাতজন এসে পোঁছে গেছেন’।

উত্তেজনার চরম মুহূর্ত। জেনারেল দলবীর সিং গভীর স্বরে হকুম দিলেন , ‘ওদের এখানে নিয়ে আসুন’। আমরা হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং- এর উপরের তলায় বসা ছিলাম। নিচের দিকে চাইতে দেখলাম সাংঘাতিক অবস্থা। সামরিক বাহিনীর ফটোগ্রাফাররা আত্মসর্মনকারী পাকিস্তানি কমান্ডারদের ফটো নেয়ার জন্য, ওরা গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে ঘিরে ধরলো। এত ভীর যে, নিয়ন্ত্রন করা কিছুতে সম্ভব নয়। উৎসাহী সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফাররা এতদিন ধরে পাগলের মত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।

যাহোক, পাকিস্তানী কমান্ডারদের নিয়ে আসা হলো। আমি চারদিকে তাকাচ্ছিলাম ওদের ভেতর আমার চেনা কেউ আছে কিনা। হ্যা ওদের ভেতর আমার চেনা দু’জন ছিল। একজনের নাম লেঃ কর্নেল ইমতিয়াজ ভয়ায়েচ। পাকিস্তানী মিলিটারী একাডেমিতে যখন আমি ক্যাডেট ছিলাম তখন ওখানে তিনি ক্যাপ্টন ছিলেন। অপর জন লেঃ কর্নেল শামস। তার সাথে আমার জানা শোনা ছিল। ব্রিগেডিয়ার হায়াতকে ও একবার কি দু’বার পশ্চিম পাকিস্তানে দেখেছি। তখন তাঁদের মনে হতো খুব ভদ্র, বিনয়ী। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁরাই অভদ্র, অযোগ্য প্রমানিত হয়েছে। বসতে তাঁদের চেয়ার দেওয়া হলো। জেনারেল দলবীর সিং অত্যন্ত সৌজন্যমূলক ব্যবহার করলেন তাদের সাথে। বিজয়ী ও বিজিতের কোন সামঞ্জস্য রাখলেন না। তিনি ওদের চা-পানে আপ্যায়িত করলেন। জেনারেল দলবীর সিং-এর মার্জিত রুচিবোধ ও ব্যবহার দেখে সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ব্রিগেডিয়ার হায়াতের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই যে উনি হচ্ছেন মুক্ত-কমান্ডার। আগে আপনাদেরই একজন ছিলেন।’

আত্মসমর্পনের খুঁটিনাটি বিষয় সমাপ্ত হলো। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার ব্রিগেড মেজরকে ডেকে বললেন, মেজর ফিরোজ, তুমি এখনই চলে যাও এবং সৈন্যদের হুকুম শুনিয়ে দাও, যে যেখানে আছে সেখানেই অস্ত্র সম্বরন করতে। ওদের বলে দিও আমরা আত্মসমর্পন করেছি’।

শেষের কথাগুলি যখন তিনি উচ্চারন করলেন, তখন তাঁর সারা মুখমন্ডলে বেদনা ও গ্লানির উৎকট রেখাগুলি প্রকট হয়ে উঠলো। বেলা এগারটার সময় মেজর ফিরোজ তার সাথের অন্যান্য অফিসারদের নিয়ে জীপে করে খুলনার দিকে রওনা হলেন। ঠিক তাঁর পিছনেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান। তাঁর পিছনে ৯নং ডিভিশনের একটা জীপ আমি ও লেঃ কর্নেল দত্ত পাশাপাশি বসা। মিঃ দত্তকে বেসামরিক গনসংযোগ অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমাদের জীপের পিছনে ক্যাপ্টেন হুদা, মোস্তফা ও ডাঃ শাজাহান।

আত্মসমর্পনকারী পাক-সৈন্যারা রাস্তার দু’ধারে অবস্থান গেড়ে বসেছিল। এই রক্তপিপাসু নরখাদকরা আজ বন্দী। অবনত মস্তকে মন্থর গতিতে হেঁটে চলেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আত্মসমর্পনকারী ইতালীয় সৈন্যর মত হানাদাররা দীর্ঘ লাইন দিয়ে চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে আমরা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের ভেতর ঢুকলাম এখানে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের হেডকোয়ার্টার। চারদিক শান্ত, নীরব। মিত্রবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ারের তত্ত্বাবধানে আত্মসমর্পনকারী সৈন্যদল মার্চ করে এগিয়ে এলো। চেয়ারে বসে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গন, পূর্ব পাকিস্তানে বসে শেষবারের মত এক কাপ চা দিয়ে আপ্যায়ন করা ছাড়া দেবার মত আমার কিছুই নেই।’

‘মৃত পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ বলবেন কি?’ আমি একথা বলতেই ব্রিগেডিয়ার হায়াত অসাহায়ের মত আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উপায়ন্তর না দেখে নিতান্ত অনিচ্ছা স্বত্বেও তিনি তাঁর ভুল সংশোধন করে নিলেন। চা খেয়ে আমরা সবাই সার্কিট হাউসে যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। এই যাত্রাটা খুবই আনন্দকর। আমরা খুলনা শহরের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার দু’পাশের লোকজন গগনবিদায়ী চিৎকারে আমাদের স্বাগতম জানালো। জয়বাংলা ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। আজ মনে হলো জয় বাংলা বাস্তব সত্য। প্রত্যেক বাড়ির চুড়ায়, দোকানে বাংলাদেশের পতাকা। প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশুর হাতেই বাংলাদেশের পতাকা। হাত নেড়ে উল্লসিত জনতার অভিনন্দনের জবাব দিলাম। সবার মূখেই হাসি। শিগগিরই আমরা সার্কিট হাউজে পোঁছালাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে এদিকে আসতে লাগলো। সার্কিট হাউসের উপরে বাংলাদেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে। বুকটা গর্বে ফুলে উঠলো। সমুন্নত পতাকার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। হাজার হাজার উৎসুক মানুষ সার্কিট হাউস ঘিড়ে রয়েছে এবং সবাই সামনে আসার জন্য প্রানপন চেষ্টা করছে।

যে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরা নিরীহ বাঙালীদের উপর এতদিন অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের একনজর দেখার জন্য জনতা বাধঁভাঙা স্রোতের মত আসতে চাইলো। জনতার অসম্ভব ভীর নিয়ন্ত্রন করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু জনতার চাপ এত বেশী যে, মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই ওদের সামলাতে পারছে না। সার্কিট হাউজের দরজায় নামতেই এত ভীড়ের মধ্যেও পিষ্ট হতে হতে জনতা আমাদের দেখার জন্য প্রানপন চেষ্টা করতে লাগলো। কেউ আনন্দে হাততালি দেয় কেউ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, কেউবা পাগলের মত ছুটে আসে চুমু খায়। কি অপূর্ব দৃশ্য। মানবতার কি মহান বহিঃপ্রকাশ। সব হারাবার দুর্বিষহ জ্বালা ভূলে গিয়ে নতুন সূর্যকে কত আপন করে কাছে নিতে চায়। মহামানবের তীর্থসলিলে অবগাহন করে অবহেলিত জনতা আজ যেন নতুন প্রানের সন্ধান পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ওরা আজ মুক্ত, ওরা আজ স্বাধীন। প্রতিটি জিনিস আজ নিজস্ব। ইতিমধ্যেই একটা হেলিকপ্টার জেনারেল দরবীর সিংকে নিয়ে সাকির্ট হাউজে অবতরন করলো। উন্নত চেহারার অধিকারী জেনারেল দলবীর সিং সার্কিট হাউজ পর্যন্ত হেঁটে আসলেন এবং আত্মসমর্প পর্বের খুঁটিনাটি বিষয় ঠিক না করা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। সবুজ ঘাসের উপর লাল কার্পেট বিছানো। তাঁর উপর একটি টেবিল ও একটা চেয়ার।

ঐতিহাসিক মুহুর্তটি সমাগত। সুশিক্ষিত আট হাজার পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের কমান্ডারদের আত্ম সমর্পন। যে দাম্ভিক পাকিস্তানী সৈন্যরা হিংস্র কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করতো, তারা আজ নিরীহ মেষশাবকের মত আত্ম সমর্পন করলো। জেনারেল দলবীর সিং চেয়ারে উপবিষ্ট। ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার সাথের আটজন কর্নেল নিয়ে মার্চ করে তাঁর সামনে এসে থামলেন। পাকিস্তানী কমান্ডার যখন সাকির্ট হাউস থেকে বেরিয়ে মার্চ করে আসছিল, তখন বাইরে আপেক্ষমান হাজার লোক আনন্দে ফেটে পড়লো। কেউ হাততালি দেয়। কেউবা শিস দেয়। কি গ্লানিকর পরাজয়। কত বড় শাস্তি মূলক অনুস্ঠান। জেনারেল দলবীর সিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, পাকিস্তানী অপরাধীগুলি এটেনশান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠান খুবই সাদাসিধা। জেনারেল দলবীর সিং আত্ম সমর্পনের দলিল পাঠ করলেন এবং পাক-বাহিনীর পরাজিত কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান মাথা নুইয়ে কম্পিত হাতে দলিলে স্বাক্ষর দিলেন। সোজা হয়ে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান ও তাঁর সাথের অন্যান্য অফিসাররা কোমরের বেল্টে খুলে মিত্রবাহিনীর কাছে অর্পন করলেন। এই সময় সমস্ত ফটো গ্রাফার ফটো নেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেল। দেখে মনে হলো যেন একটা বিয়ের পর্ব। ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের পক্ষে এই রকম গ্লানিকর আত্মসমর্পন আমি আর কখনও দেখিনি। অত্যন্ত অপমানজনক পরাজয়।