বেনাপোল পতাকা
পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের সংগ্রাম এবং গৌরবের প্রতীক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস পর্যন্ত বেনাপোল চেকপোস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। এই পতাকার পেছনের ছোট ইতিহাস আছে।
এপ্রিলের শেষদিকে যখন আমাদের জনশক্তি সীমান্তের অপর পারে চলে যায় তখনো বেনাপোল সীমান্তে উড্ডীয়মান পতাকাকে আমরা অসহায়ভাবে ফেলে যাইনি। মে মাসের প্রথমার্ধে যখন মুক্তিবাহিনীর সংগঠন এবং পুনর্বিন্যাস চলছিল তখন এই পতাকার সংরক্ষণের ভার নিয়েছিলেন ১৮-বিএস এফ এর কমান্ডার লেঃকর্নেল মেঈ সিং(বীরচক্র)। বাংলাদেশের পতাকার প্রতি এতদূর শ্রদ্ধা এবং সম্মানও অনুরাগ আমি আর কোন ভারতীয়দের মধ্যে দেখিনি। এই রাজপুত অফিসারটি আমাদের পতাকাকে সম্মান দিয়ে সমস্ত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন এবং তিনি বারবার এই কথাই বলতেন। ১৮-বিএস এফ তাদের মেশিনগান দিয়ে এই পতাকাকে কভার করে রেখেছিল।মনে হয় একটি কাকপক্ষীও ভিড়তে পারেনি। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা বা গভীর রাতে মেশিনগান গর্জে উঠত, যদি তার আশেপাশে সামান্য গতিবিধি পরিলক্ষিত হত। মেশিনগানের আওয়াজ শুনলে আমরা বুঝতে পারতাম মেঈ সিং এর লোকজন তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের এই পতাকার আশপাশ দিয়ে কত হাজার হাজার গোলাবর্ষণ হয়েছে। পতাকাকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানীদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।পাকিস্তানীদের এই অপচেষ্টাকে কেন্দ্র করে কতজন হতাহত হয়েছে তা বোঝা মুশকিল। এই পতাকা নিয়ে সীমান্ত সবসময় সরগরম থাকত। এ ছিল আমাদের অনাগত দিনের বিজয়ের প্রতীক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যযোগ্য যে যশোর সেনানিবাসে যখন প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রান্ত হয়( আনুমানিক এপ্রিলের প্রথমার্ধে) মেঈ সিং তার১৮ বিএসএফ ব্যাটালিয়নকে নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর স্বীয় অনুপ্রেরণায় ঢুকে পড়েন এবং ঝিকরগাছার কাছে তার বাহিনীর সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে বিএসএফের কিছুসংখ্যক হতাহত হয় এবং কিছুসংখ্যক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মেঈ সিং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকার এই সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছিলেন বিধায় ভারত সরকারের হাতে তাকে নাজেহাল হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয় , এই সময় তিনি একবার গোপনীয়ভাবে ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমাদের চুয়াডাঙ্গা সদর দফতরও দেখতে আসেন।মেঈ সিং এর এই একগুঁয়েমি বেনাপোল চেকপোস্টে পরে মোতায়েনরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন সহ্য করতে পারত না। তারা কয়েকবার প্রস্তাবও করেছিল যে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে গোলাগুলি বন্ধ হোক। কিন্ত মেঈ সিং কোনদিন এই প্রস্তাব মেনে নেননি। পরে তাঁর ব্যাটালিয়নকে এখান অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। কর্নেল মেঈ এর পথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই পতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেন।
জুন-জুলাই মাসে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেনাপোল সীমান্ত থেকে জেড ফোর্সে যোগদান করার জন্য বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে চলে যায়। এই সময় বাংলাদেশের পতাকাটি বেনাপোলে সীমান্তে একটা স্বীকৃতি সত্য হয়ে গিয়েছিল। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং আমার কোম্পানী মিলে এইচ কোম্পানী যৌথভাবে এই পতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেই। এবং বেনাপোল সীমান্ত থেকে প্রায় ৭০০/৮০০ গজ জায়গা নো ম্যান্স ল্যান্ড এ পরিণত হয়। আমার মনে আছে ‘ওমেগা’ রিলিফ দল যেদিন এই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন আমিও ২/৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে বড় গাছগুলোর আড়াল দিয়ে ক্রল করে এগুচ্ছিলাম। চার/পাঁচ গজ দূরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকজন এদের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাস্তার পাশ থেকে এদেরকে আমরা পতাকা দেখাই এবং বলি যে এই এলাকা আমাদের দখলে আছে। ‘ওমেগা’ দল ভয়ে ডান, বাঁয়ে তাকাতে সাহস পায়নি। এইভাবে দীর্ঘ নয়মাস আমরা বেনাপোল পতাকাকে রক্ষা করেছিলাম এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনদিন এই পতাকা ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। পতাকা যেখানে উড্ডীয়মান ছিল তার আশেপাশে পেট্রল পার্টি পাঠানো হত এবং তাদের সাথে পাকবাহিনীর প্রতিদিন গোলাগুলি বিনিময় হত। মে মাসে এই পতাকাকে সামনে রেখে বিবিসির প্রতিনিধিরা ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং মেজর ওসমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
স্বাক্ষরঃতৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী
১৪-১০-৭৩
**কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে এসডিও থাকাকালীন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।