You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল এম এ মঞ্জুর
২৯-৩-১৯৭৩

মানসিক দিক থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। পালাবার পথ খুঁজেছিলাম। অবশেষে সে সুযোগ হয় ২৬ শে জুলাই। ইতিপূর্বে আলাপ-আলোচনা পরিকল্পনা করেই রেখেছিলাম। মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর তাহের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী , আমার পরিবার এবং আরদালী সহ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। আরও আগে বেরোবার চেষ্টা করেছি কিন্ত সুযোগ হয়নি, তাছাড়া আমার শিশু সন্তান তখন মাত্র কয়েক দিন ছিল।
অনেক পথ পেরিয়ে ৭ই আগস্ট আমি কলকাতা আসি। তারপর ১১ই আগস্ট আমাকে ৮নং সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৯ই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। তবুও যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে এই সেক্টরের দায়িত্বও আমাকে দেওয়া হয়েছিল।
আসার পর পরই আমি পেট্রো পোলে আমার এলাকা পরিদর্শনে যাই। সেখানে শুনলাম ছয়জন রাজাকারকে গণবাহিনীরা ধরে নিয়ে এসেছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদেকে মুক্তি দেই এবং গ্রামে ফিরে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে বলি। পরে শুনেছিলাম দুই জন অনুশোচনায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে, অপর চার জন বাংলাদেশের জন্য মরণপণ লড়াই করেছে । ফিরে এসে এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকি এবং কতকগুলি অবস্থা লক্ষ্য করলাম।
গণবাহিনী নিয়মিত বাহিনী থেকে সম্পূর্ণ ভাবে পৃথক। তারা অন্য কমান্ডের আওতায় কাজে-চিন্তায় নিয়মিত বাহিনী থেকে আলাদা। বস্তুতঃ পক্ষে গণবাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনী পৃথক রাজ্যে বাস করতো।
গণবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাঝে মাঝে গেলেও পাকবাহিনী আসছে শুনলে সে গ্রাম বা গৃহ থেকে পালিয়ে যেত। এতে কোন মুক্তিবাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ক্রমশ হারাতে থাকে।অপরদিকে নিয়মিত বাহিনী ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি বিভিন্ন ‘ পকেটে’ থাকতো। তারা বিস্তৃত পরিসরে ঘুরতো না।বস্তুতঃ তাদের কাজ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। গণবাহিনী কোন কোন সময় জোর করেও কোন কোন বাড়িতে থেকেছে, এতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম।‘ আঘাত কর এবং পালাও’এই নীতির ফলে পাকবাহিনী এসে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, হত্যা লুণ্ঠন সন্ত্রাসও বাদ যেত না। অপরদিকে যেসব রাজাকারদের ধরে সবদিক বিবেচনা না করে হত্যা করতো সেই পরিবারের গোটা লোককে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে দেখলাম।এমনিভাবে তারা বাংলার মানুষের সহযোগিতা হারাতে বসেছিল।এছাড়া গণবাহিনী মাঝে মাঝে দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতো। অপরদিকে একজন মিয়মিত সৈনিক হিসাবে তাদের কাছে যা পাওয়া উচিত ছিল তার প্রায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি বুঝলাম গণবাহিনীকে যদি আমার অধীনে নিয়ে আসতে না পারি তাহলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু কতকগুলি সিদ্ধান্ত নেই।(১)সেক্টরটিকে পুরাপুরি পুনঃসংগঠিত করি।এবং পুনরায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি।(২) গণবাহিনীকে সম্পূর্ণ আমার আওতায় নিয়ে আসি।(৩) আমার এলাকাকে বিভিন্নস্থানে বিশেষ বিশেষ এলাকায় ভাগ করি এবং সেখানকার জন্য একজন কমান্ডার নিযুক্ত করি।সবাই দেশের অভ্যন্তরে থাকবে, যাবতীয় সরবরাহ আমরা করবো এ সিদ্ধান্তও নিই।(৪) গণবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য রাজনৈতিক উপদেষ্টা পাঠাই।(৫)রাজাকারদের প্রশ্নেও বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলাম।
আমি আসার পর গণবাহিনীতে ভর্তি বাড়িয়ে দেই। ট্রেনিং এর সময় কমিয়ে তিন সপ্তাহ করি।প্রতি মাসে তিন হাজার করে গণবাহিনী তৈরি করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার ব্যবস্থা করি। ভিতরে পাঠাবার সময় প্রত্যেকের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি বাবদ রাহাখরচ৮০ টাকা করে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। এর আরেকটি দিক ছিল তা হলো দেশের ভিতরে এইভাবে সবাই টাকা ব্যয় করলে অন্যেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হলে আমাদের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হবে।
গণবাহিনী ভিতরে পাঠাবার পর প্রত্যেক গ্রুপের মাত্র একজন সীমান্ত নিকটবর্তী আমাদের স্থায়ী ’পকেটে’ এসে সবার জন্য টাকা, অস্ত্র এবং অন্যান্য নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করি। সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুনর্গঠনের কাজ হয়ে যায়।
পরবর্তী পর্যায়ে নিয়মিত বাহিনীও ভিতরে এগিয়ে যায়। মোটামুটিভাবে নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনীকে একটি বিশেষ ‘চেইনে’ নিয়ে আসি।এতে করে ভাল ফল হতে লাগলো।এই বাহিনীর ভিতরে প্রবেশ করলে আমি এদেরকে ট্রাঙ্ক দেই- যেমন রেল লাইন উড়িয়ে দেওয়া, সেতু ধ্বংস করা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করা ইত্যাদি। এসব শুরু হলে পাকবাহিনী ভীষণ বিপদের মুখে পড়ে যায়। আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে যাই। শুধু তাই নয়, আওতাভুক্ত এলাকাতে যাতে প্রশাসন যন্ত্র চালু হয় এবং সুষ্ঠুভাবে চলে তার নির্দেশ নেই। এতে করে ভাল ফল পাওয়া গেল।ত্বরিত যোগাযোগের জন্য বিভিন্নস্থানে অয়ারলেস পাঠাই এবং এ বিষয়ে একটি দলকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করি। দেশের ভিতরে গিয়ে বুদ্ধিমান এবং সাহসী ছেলে বেছে এনে ‘ ইন্টেলিজেন্স’ বিভাগ খুলি। এর ফলে যাবতীয় খবরাখবর আমরা অতি সহজে পেতে থাকলাম।আমাদের অগ্রগতি এগিয়ে চলে।
অপরদিকে আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে শুধুমাত্র পাকবাহিনীকে হত্যা বা তাড়ানোর ব্যবস্থা করলেই চলবে না, তাতে করে পুরো প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ে সেদিকেও নজর দিতে হবে। একাজের প্রাথমিক দিক হিসাবে আমি প্রথমে পুলিশ থানাগুলি দখল করতে বলি। অপরদিকে চালনা এবং মংলা পোর্ট যাতে অকেজো হয়ে যায় তার নির্দেশ দেই। সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয় নৌবাহিনীর একটি দল বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।
এইভাবে কাজ করে যেতে আমরা একের পর এক জয়ের পথে এগিয়ে যেতে থাকলাম।গণবাহিনীও নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করতে লাগলো।মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে যেটি প্রয়োজন, জনসাধারণের সমর্থন, তা পেতে লাগলাম।আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে গেলাম।
এরপর নভেম্বরের ২০ তারিখ থেকে মিত্রবাহিনী আমাদের সাথে সাথে আসে।এবং মিত্রবাহিনী ও আমাদের বাহিনী মিলিতভাবে শত্রুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক এলাকা জয় করে চললো। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ মুক্ত হয়।
আলবদর বা আলশামসদের ক্ষেত্রে অন্য কথা হলেও রাজাকার প্রশ্নে বলা যায় যে, তারা সবাই সমান ছিল না। এদের অনেকেই আমাদের পক্ষে কাজ করেছে, যদিও মানুষ এদের ঘৃণা করতো।
সত্যিকার অর্থে যশোর সেনানিবাসটাকেই গণকবর স্থান বলা যেতে পারে। কারণ, বিভিন্ন স্থানে ঘটনা বিক্ষিপ্তভাবে যা পাওয়া গেছে, শোনা গেছে, দেখা গেছে তা অবর্ণনীয়। যাবার পথে পাকবাহিনী সেনানিবাসের বহু ব্যারাক ও স্টোরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে। সেনানিবাসের ভিতরে মডেল প্রাইমারী বিদ্যালয়, দাউদ বিদ্যালয় ইত্যাদি স্থান ছিল চাপ চাপ রক্তে ভরা। অনেক মানুষকে রশি দিয়ে গাছে টাঙ্গিয়ে হত্যা করা হতো। আরও শুনলাম কিভাবে মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে নৃশংসভাবে, তার পরিচয় পাওয়া গেল।
ডিসেম্বরে পুরামাত্রায় যুদ্ধ বেধে গেলে বাংলার মানুষ আনন্দিত হয়ে উঠে। তারা উন্মুখ হয়ে থাকে মিত্র আর মুক্তিবাহিনীর অপেক্ষায়।
মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীকে বাংলার মানুষ প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়। শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, নারী সবাই যে যা পেয়েছে তাই দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। স্বাধীনতার পর জনমনে সাড়া পড়ে যায়। বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে।
স্বাক্ষরঃ মঞ্জুর ২৯-৩-১৯৭৩

** মেজর হিসাবে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। পরবর্তীতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!