অপারেশন ‘’কাবযাকারা’’
নভেম্বরের ১০ তারিখ লেঃ কর্নেল কিউ এন জামান আমাকে অনুরোধ করেন সাতমসজিদ এলাকায় মালদহ-নবাবগঞ্জ রোডে একটি অপারেশন চালাতে। শত্রুপক্ষ সেখানে খুব শক্ত অবস্থানে ছিল। এক ব্যাটালিয়নের অ বেশী সেনা, নিয়মিত সি এ এফ এবং রাজাকার সেখানে মোতায়েন ছিল। আন্তর্জাতিক সীমানার সমান্তরালে উত্তর-দক্ষিন বরাবর সীমানার ৭/৮ মাইল ভেতর দিয়ে প্রায় ৭৫ ফিট চওড়া একটি গভীর খাল ছিল। কয়েকবার সেখানে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বাধীন ৩টি কোম্পানি লেঃ কাইউম, লেঃ রশিদ ও লেঃ কায়সারের অধীনে সেখানে অপারেশন চালায় কিন্তু বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বার বার ব্যর্থতার জন্য সবার মনোবল দুর্বল হয়ে যায়। তাই এই গুরুত্তপূর্ন অংশটি শত্রুমুক্ত করা জরুরী হয়ে পরে এবং আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এই এলাকাটি শত্রু কবলিত থাকার জন্য নওয়াবগঞ্জে শত্রুদের প্রভাব বিস্তার করা সহজ ছিল। লেঃ কর্নেল জামানের কাছ থেকে সংক্ষেপে জানার পর আমি সরাসরি সেখানটা রিকু করেতে যাই। দেখতে পাই ঐ খালের সাথে কয়েকটি সংযুক্ত নালা রয়েছে – প্রতিটি প্রায় ১ মাইল দীর্ঘ – যেটা তাদের অন্যতম যোগাযোগ ব্যাবস্থা। স্থানীয় লোকের সহায়তায় তারা বাঁশ, কাঠ ও গাছের গুড়ি দিয়ে প্রচুর বাঙ্কার বানিয়ে রেখেছে।
সম্ভবত প্রত্যেকটিতে এলএম জি অথবা মেশিনগান ছিল। উঁচু দালান অথবা গাছের উপর তাদের অব্জার্ভেশন পোস্ট ও ছিল। সম্ভ্যাভ্য সকল পথে মর্টার ফিট করা ছিল।
সমস্ত এলাকা রেকু করতে প্রায় ২ দিন লেগে গেল। এই মিশনটি সফল করা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। প্রত্যেকটি প্লাটুন ও অস্ত্র আমি চিহ্নিত করি। তৈরি করা বিশাল মানচিত্রটি যে কাউকেই পুরো এলাকা সম্পর্কে একটি পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম ছিল। ৪টি কোম্পানি আমি নির্বাচন করি। আমাদের 3x৮১ মি মি মর্টার (মধ্যপাল্লা) ছিল। এছাড়া আমাদের ৭৫/২৪ ফিল্ড আর্টিলারি গান সাপোর্ট ছিল। আমি সকল অধিনায়কদের ডেকে ১৩ই নভেম্বর সকাল ৯টায় পুরো অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলি। নকশা সহ। সকল অধিনায়কদের প্রত্যেকটি সন্দেহ ও প্রশ্নের সমাধান করি।
সকল সৈন্যকে তৈরি করা লেআউট সহ সব কিছু বুঝিয়ে বলা হয়। এধরনের ছবির মানচিত্র দেখে সবাই খুব খুশি ও উৎসাহিত হয়। অনেকেই এর আগে এমন ম্যাপ দেখেনি বা শোনেনি। প্রত্যেকের চোখে মুখে আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা দেখতে পাই। আমরা রাতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই সেটা অর্ধ-ট্রেনিং প্রাপ্ত সৈন্যদের জন্য কষ্টকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু এর চেয়ে অন্য কোন উপায় আমার ছিলোনা যেহেতু শত্রুদের আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অস্ত্র, গোলাবারুদ, বাঙ্কার এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষাবুহ্য ছিল। সিদ্ধান্ত হল ভোর ৪টায় আক্রমণ করা হবে। ১৪ই নভেম্বর ১৯৭১, লেঃ কর্নেল জামান ও আমার অপারেশনের আদেশের সময় সেখানে ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন এইস গানার। তিনি স্বেচ্ছায় এমএফসি (মোবাইল ফায়ার কন্ট্রোলার) এর দায়িত্ব নিলেন। ওইদিন সন্ধ্যায় আমি এবং লেঃ কর্নেল জামান কিছুদূর হেঁটে গিয়ে টার্গেট রেজিস্ট্রেশনের স্থান নির্বাচন করতে যাই। সন্ধ্যার একটু আগে আমরা এটি করি। সেখানে একটি ২ তোলা দালান ছিল যেখান থেকে পুরো শত্রু এলাকা দেখা যেত। আমি লেঃ কর্নেল জামানের গানারির প্রশংসা না করে পারলাম না। ৪/৫টি আর্টিলারি শটে তিনি তিনি টার্গেটে আনতে পারতেন। এরপর আমরা ফিরে যাই। ৪ প্লাটুন এবং টাস্কফোর্স বাহিনীকে সাপোর্ট অস্ত্র – যেমন ৮১ মি মি মর্টার সব টার্গেটের ২৫০০ গজের মধ্যে ১টার মধ্যে জড়ো করতে বলি। আমাদের বাহিনী ঠিক ২ টার সময় খাল পাড় হওয়া শুরু করবে এবং এফইউপি তে পজিশন নেবে যেটা ছিল শত্রু এলাকার মধ্যবর্তী একটি অংশ। আমি এদের সাথে খালপাড় পর্যন্ত যাব এরপর আমার নির্ধারিত পয়েন্টে ফিরে আসব যেখান থেকে আমি অপারেশন পরিচালনা করব। শত্রুকে ভুল বোঝানোর জন্য একটি প্লাটুন দিয়ে সম্মুখভাগ থেকে আক্রমণ করা হবে যাতে তারা মনে করে আক্রমণ সম্মুখভাগেই। বাম দিক দিয়ে শত্রুপক্ষের খুব কাছে চলে গেল একটি প্লাটুন এবং অস্ত্র রেডি রাখল। ৭৫/২৪ আর্টিলারি শেল ধীরে ধীরে পজিশন নিল ৩টার মধ্যে। তারা হাল্কা কিছু শেল বাম দিক থেকে ব্যাবহার শুরু করল। এতে শত্রু পক্ষ ভাবল আক্রমণ বাম দিক থেকে এগিয়ে আসছে। যদিও আমাদের মূল আক্রমণ ডানে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের বাহিনী হিসেবমত ৪টার মধ্যে জায়গা মত পৌঁছে যাবে এবং আক্রমণ শুরু করবে। ২টি ক্রসিং পয়েন্ট নির্বাচন করা হল খাল পাড় হবার জন্য। প্রত্যেক পাশে ৪টি করে দেশী নৌকার ব্যাবস্থা করা হল ক্রসিং এর জন্য। প্রতি পাশ থেকে ২ প্লাটুন খাল পাড় হবে। এমন স্থানে পারাপারের ব্যাবস্থা করা হল যেখানে শত্রু পক্ষের কোন সৈন্য নেই – এমনকি তারা আশাও করেনি যে সেখান দিয়ে পার হতে পারি। বোমাবর্ষনের প্ল্যানটি খুব সুনিপুণ ভাবে করা হয়েছিল। এবং ওয়ারলেস সাইলেন্ট করা ছিল যতক্ষণ আমরা শত্রুদের নিকটবর্তী ফায়ারিং রেঞ্জের ভিতরে ঢুকি। ধরা ছিল যে এটা ৪টা ১৫ মিনিটের দিকে সম্পন্ন হবে। খাল পর্যন্ত এসে দুই প্লাটুন করে দুই গ্রুপে ভাগ করে আমি আমার পূর্বনির্ধারিত পয়েন্টে চলে যাই যেখান থেকে আমি পুরো যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। লেঃ কর্নেল জামান খালের উল্টো পাশে পজিশন নিলেন যেখান থেকে তিনি আর্টিলারি গান দিয়ে টার্গেট রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন। তিনি আর্টিলারি ফায়ার প্রস্তুত করলেন। আমাদের মিডিয়াম মর্টার (৮১ মি মি) খালের যতদূর সম্ভব কাছে আনা হল যাতে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করতে সমস্যা না হয়।
দুর্ভাগ্যবশত ঐ রাতে খুব কুয়াশা ছিল। এমনকি ৫ গজ দূর থেকেও একজন অন্য জনকে দেখতে পারছিলনা। এতে আমাদের সৈন্যদের খুবই সমস্যা হল। আমরা ধারনা করেছিলাম সবকিছু ৪টা ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যাবে। কিন্তু হয়তো ৪টা ৩০ পেরিয়ে প্রায় ৫টা বেজে যাবে। এ এবং বি ফোর্সের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পেছন থেকে শত্রুদের এনভেলপ করবেন এবং সি ও ডি এর দায়িত্বে ছিলেন লেঃ কাইয়ুম। কারো কোন সাড়া না পেয়ে ৪টা ৩০ মিনিটে আমি তাদের কোড নেইমে ডাকা শুরু করি। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। ৫টা ১০ মিনিটে আমি লেঃ কাইয়ুম কে ওয়ারলেসে পাই। কথা বলে বুঝতে পারি ১ঘন্টা ১০ মিনিট পেরিয়ে গেলেও তারা এখনো এফইউপি তে পৌঁছাননি। দেরির কারণ হল ২টি নৌকা খারাপ হবার কারণে ডুবে যায় এবং সৈন্যরা অনেকেই এইব্যাপারে অনভিজ্ঞ ছিল। অন্য দলটিকে যোগাযোগ করলে তারা সন্তোষজনক কিছুই বললেন না। কিন্তু গ্রুপের সাথে কথা বলতে পেরে আমি স্বস্তি পেলাম। তারা একটু দ্রুত গিয়েছিল যেহেতু একটু জ্যোৎস্না ছিল যদিও তাদের দেখার সীমানা খুব কম ছিল কুয়াশার জন্য। প্রায় ৫টা ৩০ মিনিটে ডান পাশ থেকে ফায়ারিং শুরু হল। শত্রু পক্ষ হতচকিত হয়ে গেল কারণ তারা আশা করেছিল বাম পাশ থেকেই আক্রমণ হবে। ৫টা ৪৫ মিনিটে তারা শত্রুদের মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু করল। শত্রুপক্ষ এতোটাই অবাক হয়েছিল যে তারা আক্রমণের বদলে দ্রুত ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে নিরাপদে পালাতে শুরু করল। একের পর এক নানা পজিশন থেকে আক্রমণ চলল। ৭টার দিকে লেঃ কাইউম এর বাহিনী লক্ষ দখলে নেয়।
৬টার দিকে আমি ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে রেডিওতে পাই। খালের পানিতে তার রেডিও ভিজে গেছিল কারণ তার ওয়ারলেস অপারেটর খাল পাড়ের সময় ডুবে গেছিল। সে এটা পরিষ্কার করে ঠিক করেছে। তবুও আমি পরিষ্কারভাবে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না যেহেতু কণ্ঠ ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসছিল। কিন্তু এটা যে তার কণ্ঠ তা বুঝতে পারছিলাম। সে ৬টা ৩০ মিনিটে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করে। সেই দিকে ছিল শত্রুপক্ষের মূল ডিফেন্স। প্রায় ১ ঘণ্টা পর শত্রুপক্ষ প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে রেখে অবস্থান ত্যাগ করে। ৮টার মধ্যে পুরো এলাকা পরিষ্কার হয়ে যায়। সৈন্যরা সম্মিলিত হয়। পাকসেনাদের ১ জন ক্যাপ্টেন সহ ১১ জন নিহত হয় এবং আহত ৫ জনকে আমরা বন্দি করি। আমাদের কেউ নিহত হয়নি – তবে ৭ জন আহত হয়েছিল। একটি বিষয়ই আমাকে হতবাক করেছে – সেটা হল খালজূড়ে এতগুলো ট্রেঞ্চ এবং বাঙ্কার থাকার পরেও – যেখান দিয়ে ৬ফুট উঁচু সংযোগ ট্রেঞ্চও ছিল যেখান দিয়ে আমাদের সৈন্যদের চোখ ফাকি দিয়ে সহজেই চলে যাওয়া যায় – তবুও তারা বিনা যুদ্ধেই হাল ছেড়ে দিল। আমার ধারণা হল সম্ভবত তাদের মনোবল খুব দুর্বল ছিল এবং যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছা তাদের ছিলনা।
অন্যদিকে আমাদের সৈন্যদের মনোবল আকাশ চুম্বী হয়ে গেল এবং তারা বিজয়উল্লাস করছিল। যদিও এদের প্রত্যেকে মূল আক্রমণভাগে পৌঁছাতে অনেক কষ্ট হয়েছে – শুধু তাই নয় আক্রমণ শুরু করতেও আশাতীত দেরি হয়েছে-তবুও এদের কারো চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ দেখলাম না। জয়ের আনন্দে তারা এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে যাচ্ছিল আর শত্রুদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করছিল।
সে যুদ্ধ থেকে একটি বিষয় আমার কাছে খুব পরিষ্কার হল যে যেকন সফলতার পেছনে স্রিস্টিকর্তার আশির্বাদ খুবই দরকার। যদি ৯টা পর্যন্ত কুয়াশা না থাকতো তাহলে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্ভবনা ছিল – এমনকি অপারেশন ব্যার্থও হতে পারত। কুয়াশা আমাদের সৈন্যদের খাল পাড়ের সময় আবরণের কাজ করে এবং আক্রমণের সময়ও আমরা সুবিধা পাই। পরিশেষে একটি কথাই বলব – কষ্ট করলেই কেষ্ট মেলে।