মাঠে মাঠে এত রক্তের ঢেউ কি দামে ভাই কসম বন্ধু, খুনীদের কাছে জবাব চাই
বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াই দিন দিন তীব্রতর হইতেছে। ধীরে ধীরে এই লড়াই জনযুদ্ধে পরিণত হইয়া চলিয়াছে। বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিফৌজের দুর্ধর্ষ আক্রমণের মুখে পাকিস্তানের বব্বর হানাদার বাহিনীর মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়া উঠিতেছে। জনতার বিজয় অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিতেছে ইহাতে সন্দেহ নাই। তাই হানাদার বাহিনী এবং দেশী বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদী মহল সন্ত্রস্ত, বিচলিত। সেই জন্য তাহারা এই মুক্তিযুদ্ধকে আর চলিতে দিতে চায়না। তথাকথিত ‘রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে যুদ্ধকে থামাইয়া দিতে চায়। কিন্তু বাংলার বীর জনগণ ও মুক্তি সংগ্রামীরা এই ধরনের প্রস্তাবকে ঘৃণায় পদাঘাত করে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিটি অব্যর্থ আঘাত লক্ষ শহীদের রক্ত, অসংখ্য মা-বােনের বেইজ্জতি এবং অযুত লাখ ঘর-বাড়ী জনপদ ধ্বংসের বদলা লইবেই। বাংলাদেশের জনগণ আজ দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। যতদিন পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর একটি কুত্তাও বাংলার মাটিতে অবস্থান করিবে। ততদিন মুক্তি সংগ্রামের কাফেলা থামিবে না। বাংলাদেশ জুড়িয়া মুক্তিযােদ্ধাদের অপ্রতিরােধ্য, অগ্রাভিযান চলিতেছে চলিবে।
মাঠে মাঠে রক্তের যে ঢেউ বহিয়াছে মুক্তি যােদ্ধার অস্ত্রের ঘায়ে খুনীদের নিকট হইতে তাহার জবাব লইবেই ঢাকা নরসিংদীতে মুক্তিফৌজ এবং বিপ্লবী গেরিলাবাহিনী শত্রুদের উপর আঘাতের পর আঘাত হানিয়া। চলিয়াছে। তাহারা রূপগঞ্জের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির দালাল আলাউদ্দিনকে খতম করে। মাধবদীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি তাহারা সম্পূর্ণ উড়াইয়া দেয়। মুক্তিফৌজ বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে আনন্দিয়াস্থ ইলেকট্রিক টাওয়ারটি ধুলিস্যাত করে। শেখের চর শান্তিকমিটির আহ্বায়ক সাদেকুর রহমানও মুক্তিফৌজের হাতে খতম হয়। বিপ্লবী গেরিলা বাহীনি ও মুক্তিফৌজ পুবাইল রেলওয়ে ষ্টেশনের কাছে শত্রুবাহী ট্রেনে এক মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া ৩৫ জন হানাদারকে খতম করে। নরসিংদিতে ২ জন রাজাকার-তাহাদের অস্ত্র লইয়া মুক্তিফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২৬শে সেপ্টেম্বর মুক্তিফৌজ ও বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর গ্রেনেড চার্জে নরসিংদীর ইউনাইটেড জুট মিলটি বন্ধ হইয়া যায়। মুক্তিফৌজ অরিখাইল রেলষ্টেশনে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া ২০৯ জন হানাদার সৈন্য খতম করে এবং একজন বিপ্লবী গেরিলা একজন পাকিস্তানী সৈন্যকে নারী নির্যাতনের সময় গ্রেফতার করে। সম্প্রতি শিবপুরে আমাদের বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর একটি দল পুটিয়ার চলন্দ্যা গ্রামে পাক হানাদারদের উপর এক সফল আক্রমণ চালায়। ঐ এলাকার পার্শ্ববর্তী গ্রাম সমূহে হানাদার দস্যুরা প্রত্যহ একটি নির্দিষ্ট সময়ে আসিয়া জনসাধারণের উপর নির্যাতন চালাইত, মা-বােনদের ইজ্জতের উপর হামলা করিত এবং দোকানপাট বাড়ী ঘর লুঠ পাট করিয়া আগুন লাগাইয়া দিত বিপ্লবী গেরিলারা। সেইদিন তাহাদের অপেক্ষায় ওঁৎ পাতিয়া থাকে। হঠাৎ একটি মিলিটারী ভ্যান ও একটি জীপে করিয়া হানাদারদের একটি দল যাইতে থাকে। পাল্লার মধ্যে আসা মাত্রই আমাদের দুঃসাহসী গেরিলাদের রাইফেল গর্জিয়া উঠে। এই আক্রমণে দস্যুদের দুইটি গাড়ীই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হানাদারদের প্রায় সবাই খতম হয়। পরে নরসিংদী হইতে তাহাদের একটি সাহায্যকারী দল আগাইয়া আসিলে শত্রুদের সহিত বিপ্লবী গেরিলাদের সম্মুখ সংঘর্ষে যাইতে হয়। তুমুল লড়াইয়ের পর শত্রুরা পলায়ন করে। এই সংঘর্ষে আমাদের তিনজন দুঃসাহসী বিপ্লবী কমরেড প্রাণ দেয়। শহীদ বন্ধুদের নাম মােঃ ইদ্রিস মিঞা, আবদুল মােতালিব ও নজরুল ইসলাম ভুইয়া শত্রুদের প্রায় ৬০ জন খতম হয়।
কুমিল্লা সম্প্রতি চৌদ্দগ্রাম থানায় বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী পাক হানাদারদের একটি পেট্রোল বাহিনীর উপর এক সফল আক্রমণ চালায়। বিপ্লবী গেরিলারা আগে হইতেই ডিমাতলী রাস্তার একটু দূরে শত্রুদের অপেক্ষায় নিজেদের গুপ্ত অবস্থান ঠিক করে। হানাদারেরা পাল্লার ভিতরে আসার সাথে সাথেই একসঙ্গে গেরিলা বাহিনীর রাইফেলগুলি গর্জিয়া উঠে। ইহাতে ৭ জন হানাদার সৈন্য খতম হয়। কিছুদিন আগে চৌদ্দগ্রাম থানার বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী কালিকশার গ্রামে পাকিস্তানী হানাদার। বাহিনীর অনুচর জনৈক আবদুল বারিক নামক দালালকে হত্যা করে। শােষক গােষ্ঠির পােষা কুকুরটির নিহত হওয়ার খবর পাইয়া হানাদার বাহিনী মরােখ হইয়া ছুটিয়া আসে। বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীও তাহাদের সামান্য অস্ত্রসস্ত্র লইয়া শত্রুদের অপেক্ষায় গােপনে ওঁৎ পাতিয়া থাকে। দস্যুদের ১৫ জনের একটি দল নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার, জুলুম চালাইয়া সুজাতপুর রাস্তা দিয়া তাহাদের ক্যাম্পে। প্রত্যাবর্তন করিবার সময় আকস্মিকভাবে দেশপ্রেমিক বিপ্লবী গেরিলারা তাহাদের আক্রমণ করে এবং | ৪ জন দস্যু সেনাকে খতম ও ১ জনকে জখম করে। বাকী দস্যুরা প্রাণভয়ে পলায়ন করে। লাকশামে সম্প্রতি ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর বীর জোয়ানরা লাকশামের শত্রুঘাঁটি। এলাকাগুলিতে প্রবল প্রতিরােধ আক্রমণ চালাইয়া শক্তবাহিনীর আনাগােনা প্রায় বন্ধ করিয়া দিয়াছে। সেখানে মুক্তিফৌজ বহু হানাদার দস্যু এবং পাক দালালকে খতম করে। চট্টগ্রাম সম্প্রতি বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিফৌজ বােয়ালখালী থানার দুই জন পাক দালালকে খতম করে। ঘৃণ্য এই দালাল বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর একজন দুঃসাহসী যােদ্ধা অনিল চন্দকে শক্রর হাতে ধরাইয়া দেয় এবং সার্কিট হাউজ পর্যন্ত গিয়া অফিসারদের হাতে তুলিয়া দিয়া আসে। এই দুইজন দালাল স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ছিল।
স্বাধীন বাংলা (১): ১: ৩
১ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯