You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাক্ষাতকারঃ মোঃ নূরুজ্জামান

২৭ শে মে ভোরবেলা সেক্টর কমান্ডিং প্রধান ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব, সুবেদার গোলাম মোস্তফা এবং আমি থানা হেডকোয়ার্টারে বসে ছিলাম। এমন সময় উলিপুর (থানা) নিবাসী বলে পরিচয় দানকারী দুজন মৌলভী সাহেব পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরলা নদী আক্রমন করেনি বলে জানায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পুনরায় পটেশ্বরী ডিফেন্সে পাঠাতে অনুরোধ করে। হানাদার সৈন্যরা ধরলা নদী আক্রমন করেনাই এই মর্মে তারা শপথ করে। উক্ত শপথের উপর ভিত্তি করে একটি ট্রাক, একটি পিক আপ গাড়ি ও একটি জিপগাড়ি বোঝাই প্রায় ১০০ জন গেরিলাকে ঐ দিন ই পুনরায় পটেশ্বরী ডিফেন্সে পাঠানো হয়। গেরিলাদের বহনকারী গাড়ি তিনটি পটেশ্বরি ডিফেন্সের কাছাকাছি পৌঁছতেই এমবুশরত পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলে। ফলে গেরিলারা দিশেহারা হয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে হানাদার সৈন্যদের সাথে খন্ডযুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিছুক্ষনের মধ্যেই গেরিলারা ছত্রভংগ হয়ে পরে এবং বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা হানাদার সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। গেরিলা যোদ্ধাদের অন্যতম প্রধান কমান্দার মোজাহিদ ক্যাপ্টেন শত্রুসৈন্যদের অজস্র গুলির মুখেও সংঘর্ষ স্থল পরিত্যাগ করেনাই। বেশ কিছু সংখ্যক হানাদার সৈন্যকে খতম করে তিনি বীরের ন্যায় মৃত্যুবরন করেন। এই সংঘর্ষে নিহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন ১) সিপাহী আবুল কালাম, সাবেক ই পি আর নং ১৯৩৭৭ ২) সিপাহী আবুল কাশেম, সাবেক ই পি আর নং ৫৫৩৪ ৩) সিপাহী সেকেন্দার আলী, সাবেক ই পি আর নং ১৪২৮০ ৪) এম এপ দেলোয়ার হোসেন ৫ ) এম এফ ড্রাইভার আফজার হোসেন ৬) এম এফ ড্রাইভার গোলাম রব্বানী ৭ ) আতিকুর রহমান (কুক) ৮ ) সিপাহি আবদুল আলী, সাবেক ই পি আর ৯ ) মোজাম্মেল হক (কুক) ১০ ) এম এফ রবিজউদ্দিন ভুইয়া (ছাত্র) ১১) এম এফ আবুল কাশেম (ছাত্র) ১২ ) এম এফ আসাদুল্লা (ছাত্র) ১৩ ) এম এফ আব্দুল ওহাব (ছাত্র)।

এই ঘটনার পর পটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা নাগেশ্বরি থানা বাজারে ঢুকে সমগ্র বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাজারে অবস্থানরত একজন পাগলকে দেখামাত্র সৈন্যরা তাকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। হানাদার সৈন্যরা নাগেশ্বরি বাজারে প্রবেশের পরপরি রায়গঞ্জ সেতুর নিকট ডিফেন্স রত মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে নেয়া হয়। ভুরুঙ্গামারি থানার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারি রায়গঞ্জ বাজার সংলগ্ন বৃহৎ সেতুটি মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

নাগেশ্বরি থানায় অবস্থান পাকাপোক্ত করার পর হানাদার সৈন্যরা ভুরুঙ্গামারী থানার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ভুরুঙ্গামারী থানা সদরে অবস্থিত গেরিলা প্রশিক্ষন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গেরিলা দফতর সীমান্তের ওপারে পশ্চিম বাংলার কুচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জ বাজারে সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানেই দ্রুত কয়েকটি অস্থায়ী গেরিলা ঘাঁটি গরে তোলা হয়। পরে গেরিলা যোদ্ধারা এই অস্থায়ী ঘাঁটিগুলো থেকে ভুরুঙ্গামারী থানা সদরে পারশ্ববতী স্থানে অবস্থানরত হানাদার সৈন্যসের উপর অতর্কিতে আক্রমন শুরু করে।

সুবেদার বোরহান তাঁর অধিনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভুরুঙ্গামারী থানার অন্তর্গত সাবেক রেলওয়ে স্টেশন সোনাহাটে চলে যান। পাকিস্তানী সৈন্যরা ভুরুঙ্গামারী থেকে সাবেক পাটেশ্বরী রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী দুধকুমার নদীর উপর অবস্থিত পাটেশ্বরি রেলওয়ে ব্রিজ অতিক্রম করে সোনাহাতে যাতে পৌছতে না পারে সেজন্য পাটেশ্বরী ব্রিজের পূর্বতীরে মুক্তিযোদ্ধাদের মোতায়েন করা হয়।

১৫ ই জুন সাহেবগঞ্জ অস্থায়ী ঘাঁটির গেরিলারা ভুরুঙ্গামারির অদূরে বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ই পি আর ফাঁড়িতে অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর আক্রমন চালায়। এই আক্রমনে বেশ কয়েকজন পাকসৈন্য নিহত হয়। গেরিলাদের পক্ষে মোট ৩ জন নিহত হন। নিহত গেরিলারা হলেন(১) সিপাহি আব্দুস সোবহান ই পি আর নং- ১৬০৭৪ (২) সিপাহী মনসুর আহমেদ ই পি আর নং – ৫৮০৪ (৩) কুক আবু কালাম (ই পি আর)।

২৯ শে জুন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মোগলহাতে অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর হঠাত হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন কে হতাহত করে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারি নিহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের বেশ কিছু অস্ত্র দখল করতে সক্ষম হন।

১৪ ই জুলাই বড়খাতায় অবস্থানরত পাকসৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে গেরিলারা ব্যপক ক্ষতি সাধন করে। মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মুহাম্মদ আলী (ই পি আর নং ৭২৯৬) হানাদার সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন। বড়খাতায় হানাদার সৈন্যদের অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর আর একটি দল আক্রমন চালায় ২৩ শে জুলাই। সিপাহী আনোয়ার হোসেন ই পি আর এর এই সংঘর্ষে নিহত হন।

ভুরুঙ্গামারী থানা সদরে প্রবেশের পর পাকসৈন্যরা বাজার সংলগ্ন ভুরুঙ্গামারি কলেজে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছিলো। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিরাট দল ভারী অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ২ রা আগস্ট হানাদার সৈন্যদের উক্ত অবস্থানের উপর প্রচন্ড আঘাত হানে। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষই মেশিনগান ও কামান ব্যবহার করে। মুহুর্মুহু প্রচন্ড কামানের শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হতে থাকে। হানাদার সৈন্যরা তাদের অবস্থান থেকে সরে না গেলেও বহু হতাহত হয়। এই প্রচন্ড যুদ্ধে ম্যক্তিযোদ্ধা আনসার আলি নিহত ও বেশ কিছু সংখ্যক আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর চাপ অব্যাহত রাখেন। ১৩ ই আগস্ট পুনরায় বুরঙ্গামারী বাজারের সন্নিকট থেকে হানাদার সৈন্যদের উপর আক্রমন চালান হয়। এই আক্রমন অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচন্ড সংঘর্ষে রূপ নেয়। সৈন্যরা ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি স্বিকার করে।মুক্তিযোদ্ধা সিপাহি কবির আহমদ, ই পি আর নিহত হন। এর পর থেকে আমাদের গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমন ক্ষমতা বেড়ে যায়। ভারত থেকে আমরা পর্যাপ্ত গোলাবারুদ পাচ্ছিলাম। ভারী অস্ত্র চালনায় গেরিলা যোদ্ধারা বেশ দক্ষ হয়ে উঠছিল।

২৫ শে আগস্ট কুড়িগ্রাম শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রেরিত গেরিলা লিডার সিপাহী মকবুল হোসেনকে (ইপকাপ নং ২৯১২৭) কুড়িগ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে প্রতাপ নামে ছদ্মবেশে তৎপর থাকাকালীন আমাদের গেরিলারা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রেরিত গেরিলা লিডার মকবুল নারীর ছদ্মবেশে উক্ত গ্রামে খবর সংগ্রহের জন্য ঘোরাফেরা করছিল।

৬ ই নভেম্বর প্রত্যুষে প্রায় আড়াই হাজার মুক্তিযোদ্ধা এম এম /এফ এফ ৪ থেকে ৫ ব্যাটেলিয়ন ভারতীয় সৈন্যদের সহযোগীতায় ভুরুঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাটে পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্তিশালী অবস্থান ঘাঁটির উপর প্রচন্ড আঘাত হেনে দখল করে নেয়। এই প্রচন্ড সংঘর্ষে বহূ সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়। পাকিস্তানীদের বিপুলসংখ্যক মারণাস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী হস্তগত করে। ভারতীয় বাহিনির কিছুসংখ্যক জোয়ান সংঘর্ষ কালীন নিহত হয়। অথচ মুক্তিযদ্ধাদের এম এফ /এফ এফ দের মধ্যে মাত্র কয়েকজন নিহত হন।

১৩ ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারি থানার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সহায়ক সৈন্যদের সম্মিলিত বিরাট বাহিনির বীরযোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের দখল থেকে ভুরুঙ্গামারি মুক্ত করেন। এই অভিযানে ভারতীয় সহায়ক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জোশি এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পরিচালনা করেন সাবেক বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার ও যুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার কে এম বাশার ও সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেশ। ১৩ ই নভেম্বরের এই সম্মিলিত আক্রমনে ৩ জন পাঞ্জাবি সৈন্যকে জীবন্ত ধরা হয়। কোন পথেই পাকিস্তানীরা পালাতে না পেরে বহু মারা পরে। সৈন্যদের পরিত্যক্ত বিপুল সমরসম্ভার সম্মিলিত বাহিনীর হস্তগত হয়। ভুরুঙ্গামারি দখলের পরপরই বেশ কিছু সংখ্যক বাঙালি শিক্ষিতা মহিলাকে স্থানীয় সার্কেল অফিসার উন্নয়ন অফিসে বন্দী অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মহিলাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। বর্বর সৈন্যরা এদেরকে বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরন করে এখানে এনে রেখেছিল।

২২ শে নভেম্বর রংপুর জেলার অন্তর্গত বড়খাতায় হানাদার বাহিনীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক প্রচন্ড সংঘর্ষে কোম্পানী কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান (নং ০৫৯৩) শহীদ হন। এছাড়া আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা সংঘর্ষকালে শহিদ হন। সংঘর্ষে পাকিস্তানীরা গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেনঃ হাবিলদার রঙ্গু মিয়া (নং ৭০২১২৪৭) ও এম এফ নাসির আহমেদ।(এম এফ নাসির আহমেদ ঐ সময় মেজর পদে উন্নিত হয়েছিলেন)।

২০ শে নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনিতে কমিশনপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন ছাত্র লেঃসামাদ কুড়িগ্রাম মহকুমার অন্তর্গত রায়গঞ্জ সি এন্ড বি পুলের দুই পার্শ্বে অবস্থানরত হানাদার বাহিনির শক্তিশালী ঘাঁটির উপর আক্রমন চালান। তাঁকে ভারতীয় সহায়ক বাহনী দিয়ে সাহায্য করে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার যোশি। প্রচন্ড সংঘর্ষে এক পর্যায়ে যখন হানাদার সৈন্যদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতাহাতি সংঘর্ষ শুরু হয় তখন দুঃসাহসী সামাদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করেছিলেন বীর বিক্রমে। হঠাত হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে আহত হয়ে তিনি সংঘর্ষ ক্ষেত্রেই মৃত্যু বরন করেন। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে নিহত অপর মুক্তিযোদ্ধা হলেন ই পি আর সিপাহী কবীর আহমেদ (৫০১৬৫) এবং আব্দুল আজীজ। তীব্র মুখোমুখি যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাগন শত্রুদের রায়গঞ্জ ও আন্ধারীঝাড় অবস্থান দখল করেন। বহুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয় এবং বিপুল পরিমান সমরাস্ত্র সম্মিলিত বাহিনীর হাতে আসে।

২৪ শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনির যোদ্ধারা নাগেশ্বরী থানাও পাটেশ্বরিতে অবস্থানরত সৈন্যদের ঘেরাও করে। ঐ দিনের সংঘর্ষে সাইদুর রহমান এফ এফ ৯০/৩৫, সেরাজুল হক এফ এফ ১১৮/২০ এবং সোহরাব আলী এফ এফ ১১৮/৩৬ নিহত হন।

২৮ শে নভেম্বর সম্মিলিত বাহিনী নাগেশ্বরী ও বেপারীহাট মুক্ত করে। বেপারীহাট সংঘর্ষে সিপাহি এম এফ আলী আকবর (৫০৭১২) এবং সিপাহি এম এফ আবুল হসেন (৫০৮৫৩) নিহত হন। এর পর পরই ধরলা নদীর উতর দিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত হয়।

মোঃনুরুজ্জামান
বাংলাদেশ রাইফেলস
১৫-৭-৭৮

*সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ১৫-৭-৭৮ তারিখে গৃহীত হয়।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!