You dont have javascript enabled! Please enable it! একটি অপারেশানের রিপোর্ট - সংগ্রামের নোটবুক

একটি অপারেশানের রিপোর্ট

প্রতি ,
সাব সেক্টর কামান্ডার , তা
মাবিল এম এফ (ডাউকি)।

বিষয়ঃ ২৮ শে নভেম্বর (১৯৭১) রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর প্রতিবেদন।

জনাব,

আমি বিনয়ের সাথে আপনার নিকট রিপোর্ট করছি যে , ২৫/১১/৭১ তারিখে আনুমানিক ১৫.০০ ঘন্টায় (বিকেল ৩ টা ) আমি মেজর বি এস রাও এর সাথে দেখা করি এবং তিনি আমাকে নিম্নোক্ত আদেশ প্রদান করেন। (ক) সারি – গোয়াইন রোড সম্পূর্ণভাবে শত্রু চলাচলের অনুপযোগী করে দেয়া (খ) মাইন স্থাপনের মাধ্যমে (গ) এমবুশ করে (ঘ) এবং রাস্তার ধারে গর্ত খুড়ে অবস্থান গ্রহন করা এবং পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান ছেড়ে না যাওয়া। এর আগে আমাকে একটি বিএসএফ সেকশন দেয়া হয় এবং আমি অপারেশনের জন্য যেখানেই যাই না কেন বিএসএফ এর ছেলেরা আমাকে সহযোগীতা করবে বলে আদেশ দেয়া হয়। আমি সারি-গোয়াইন রোডের একটি সেতু ধ্বংসের ব্যাপারে আমার পরিকল্পনা নিয়ে তার সাথে কথা বলি। আমি তাকে আরো অবগত করি রেকি করে জানা গিয়েছে যে টার্গেটের আশেপাশে শত্রুর কোন অস্তিত্ব নেই।

সবচে কাছের শত্রুর অবস্থান সারিঘাটে (অপারেশন স্থান থেকে ২.২৫ মাইল পূর্বে) ও লেপনাউত (১.২৫ মাইল পশ্চিমে)। আমার বেইস হেড কোয়ার্টার এ ফেরত আসার পূর্বে আরেক বার রেকি করা হয়। যারা রেকি করেছে তারা আমার সাথে বিগত ৭/৮ মাস ধরে কাজ করছে এবং তাদের তথ্যের উপর আমি আস্থাশীল। অপারেশনের আগে আমি বিএসএফ এর সাব ইন্সপেক্টর সহ আমার কামান্ডারদের সাথে বৈঠক করি এবং অপারেশনের সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। আপরা অপারেশন স্থলে যাবার জন্য ২৮/১১/৭১ তারিখে ১৯১৫ ঘন্টায় (সন্ধ্যা ৭.১৫)যাত্রা শুরু করি। গুখোয়া গ্রামে পৌছানোর পরে সারি-গোয়াইন রাস্তায় মাইন স্থাপন করি ও রাস্তার পাশে প্রায় ২৫০ গজ উত্তরে এমবুশের জন্য অবস্থান গ্রহন করি। ২৯/১১/৭১ তারিখে আমরা সেখানে প্রায় 01.30 পর্যন্ত অবস্থান করি এবং অবস্থানকালীন সময়ে শত্রুর কোন ধরনের গতিবিধি আমাদের নজরে আসেনি। এরপর আমি সহ আমার সকল সৈন্য সেতু ধ্বংসের জন্য যাত্রা করি এবং আমরা তুকৈর বাজার সেতু নামক একটি সেতু ধ্বংস করি। এর পূর্বে আমি আমার কামান্ডারদের ব্রিফ করি এবং প্লাটুন সমূহের কাজ নিম্নোক্ত ভাবে ভাগ করে দেই। এ এস আই হাবিবুর রহমানের বি/৩ প্লাটুনকে সেতুটি ক্লিয়ার করার দায়িত্ব দেয়া হয়। হাবিলদার শোয়েব আলির নেতৃত্বে ডি/১ প্লাটুনকে সারি-গোয়াইন সড়কে পশ্চিম দিক অভিমুখে (গোয়াইঘাটের দিকে) অবস্থান গ্রহন করতে নির্দেশ দেয়া হয় গোয়াইঘাটের দিক থেকে শ্ত্রু আক্রমন এলে প্রতিহত করার জন্য। বিএসএফ এর দলটিকে ব্রিজ ক্লিয়ার করার পর সার্চ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি বিএসএফ এর হাবিলদার কে বি থাপা ও নায়েক শর্মাকে নিয়ে বি/৩ প্লাটুনের সাথে যোগ দেই। আমরা ১৫ মিনিটের মধ্যেই ব্রিজটি চার্জ করে ক্লিয়ার করি এবং শত্রু পক্ষের একটি রাইফেল উদ্ধার করি। তারপর আমরা ব্রিজটি সুন্দরভাবে ধ্বংস করি। বিস্ফোরণের ফলে ব্রিজটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এটি একটি পাকা সেতু ছিলো এবং এটি দৈর্ঘ্যে আনুমানিক ৬০ ফিট ও প্রস্থে ১২ ফিট।

এরপর আমি আমার সকল যোদ্ধাদের আমাকে অনুসরন করতে আদেশ দেই এবং ডি/১ প্লাটুনের সাথে মিলিত হতে সামনে এগিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে আমি দেখতে পাই হাবিলদার শোয়েব আলি ৪ জন রাজাকার গ্রেফতার করেছে। তাদের ভালোমতো বাধা হয়েছিলো এবং এরপর আমি আমার বিএসএফ সহ আমার সৈন্যদের পূর্ব নির্ধারিত স্থান রাজবারি কান্দাই গ্রামে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য নির্দেশ দেই। আমরা গাইড টুনু মিয়ার অধীনে সিঙ্গেল ফাইলে মার্চ করে যাত্রা শুরু করি। গাইড আমাদের ভিন্ন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো এবং আমাদের আশ্বস্ত করছিলো এই রাস্তাটি কম দূরত্বের ও নিরাপদ। তাকে অবিশ্বাস করার কোন কারন নেই মনে করে আমরা মার্চ শুরু করি। আমরা পৌনে এক মাইল যাত্রা করার পরেই পেছন থেকে শত্রুর গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এর কিছুক্ষন পরেই সামনে থেকেও গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমাদের পিছিয়ে যাবার কোন রাস্তা খোলা ছিলো না। তাই আমরা শত্রুর অবস্থানের উপর আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নেই। দুপক্ষের মধ্যেই গুলি বিনিময় হয়। বিএসএফ এর জওয়ানদের পারফরমেন্স অনেক ভালো ছিলো কিন্তু অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা শত্রু দের দ্বারা পরিবেষ্ঠিত হয়ে পড়ি। ডি/১ প্লাটুনের নায়েক শুকুর আলি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন। তিনি শত্রুর এলএমজি এর নল ধরে ফেলেন এবং এলএমজির ব্রাশ ফায়ারে দুটি আঙ্গুল হারান। ইতিমধ্যেই গাইড টুনু মিয়া পালিয়ে যায় এবং আমরা অনেক কষ্টে শত্রুর এমবুশ থেকে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হই।

এরপর আমরা আমাদের পূর্বনির্ধারিত স্থান রাজবাড়ি কান্দাই গ্রামে ফিরে আসি। আমি আমার সৈন্য ও বিএসএফ দের গননা করি আমার ২ জন গাইড সহ ১০ জন ও বিএসএফ এর ৪ জন নিখোজ। আমি ব্যাক্তিগতভাবে একটি সার্চ পার্টি গঠন করে নিখোঁজদের সন্ধানে বের হই এবং একজন আহত বিএসএফ ও ২ জন মুক্তিসেনাকে খুজে পাই। এই ২ জন মুক্তিসেনা শত্রুদের হাতে ধরা পড়েছিলো এবং কোনভাবে পালিয়ে চলে আসে। আমি তাদের কাছে জানতে পারি যে হারিয়ে ফেলা বাকি সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মৃতদেহ গুলোকে উদ্ধার করতে কিন্তু এটি ছিলো অসম্ভব। আমি এমবুশস্থানে যেতে পারিনি কারন ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষ সেখানে পাকা প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করেছে।

আমি এ বিষয়ে সবকিছুই মেজর বিএস রাও কে ২৯/১১/৭১ তারিখে ১৫০০ ঘন্টায় (বিকাল ৩ ঘটিকা) অবগত করেছি। আমাদের পক্ষে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ৩ জন বি এস এফ জওয়ান ও ৬ জন মুক্তিসেনাকে হারানো। এর মধ্যে বিএসএফ এর একজন এসআই , মুক্তিফৌজ এর ১ জন এএসআই ও দুই জন গাইড রয়েছে। ধারনা করি যে তাদের সবাইকেই শত্রুসেনারা হত্যা করেছে।

শত্রুপক্ষের কমপক্ষে ১০/ ১১ জন নিয়মিত পাকিস্তানি সৈন্য , ৪ জন রাজাকার ও ৬ জন শত্রু আমাদের গুলিতে নিহত হয়েছে।

এটি আপনার আবগতি ও পরবর্তি ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য জানানো হলো।

বিনীত ,
(মোঃ রফিকুল আলম)
লেফটেন্যান্ট ৩০/১১/৭১।