You dont have javascript enabled! Please enable it! সাক্ষাৎকারঃ মেজর এস এম খালেদ - সংগ্রামের নোটবুক

সাক্ষাৎকারঃ মেজর এস এম খালেদ

১০ই অক্টোবর তারিখ থেকে বিভিন্ন সেক্টরে আমাদের ডেসপ্যাচ করা শুরু হয়। আমাকে দেওয়া হলো সেক্টর নং পাঁচ-এ। কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন কর্নেল মীর শওকত আলী বীরোত্তম পিএসসি। অক্টোবরের চৌদ্দ কি পনের তারিখ আমি পাঁচ নং সেক্টরে হাজির হলাম। ছাতক আগেই দখল করা হয়েছিল, তৃতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্বে দুটো ফ্রিডম ফাইটার ও রেগুলার ফাইটার কোম্পানি নিয়ে সম্ভবত। পাকিস্তানী সৈন্য এক ব্রিগেড দিয়ে ঘেরাও করে ফেলায় ছাতক থেকে উইথ্রড করতে হয়েছে। ঠিক সেই সময়টায় আমি সাব-সেক্টরে জয়েন করি। আমার সংগে আরোও কয়েকজন অফিসার ছিলেন- লেঃ রউফ ও লেঃ মাহবুব। আমরা এই তিনজন একত্রেই সম্ভবত সিলিংয়ে গিয়েছিলাম। শিলং থেকে জেনারেল শওকত আমাদের রিসিভ করে নিয়ে গেলেন পাথরঘাটা। সেখানে তৃতীয় ইষ্ট বেঙ্গল কোম্পানী তখন একটা অপারেশন করছিল। এরপর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাব-সেক্টর ভোলাগঞ্জে সেখানে তখন ছিলেন অনারারি লেফটেন্যান্ট এম এ এম আলমগীর। তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। সাব-সেক্টরের এডমিনিস্ট্রেশন দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে। আমি আলমগীর সাহেবের কাছ থেকে অপারেশন কমান্ড নিয়ে নিলাম। পরবর্তী পর্যায়ে ৩১ তারিখে তাহেরউদ্দিন আখঞ্জি এলেন। সাব সেক্টরকে তখন দুভাগে ভাগ করা হয়-ইষ্টার্ন এবং ওয়েষ্টার্ন। বাউন্ডারি রাখা হয়েছিল গৌরীনগর রোডটাকে-সেটার পূর্বদিক আমার নেতৃত্বে ও পশ্চিমদিক তাহেরউদ্দিন আখুঞ্জির। তখন পূর্বদিকটার ডিসকিবাড়ি বলে জায়গায় একটা প্লাটুন ছিল, সেখানে জয়েন করে প্লাটুনটাকে আরোও পূর্বে ভেদেরগাঁও-এ নিয়ে গেলাম। ওখানে বসে ছোট ছোট অপারেশনের কাজ করতাম, যেখানে রাজাকারদের আক্রমণ করা ও পাকসেনাদের যাতায়াত পথে এমবুশ করা। স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের জন্য আমার অপারেশন ছিল সীমাবদ্ধ।

নভেম্বরের দিকে আমার স্ট্রেনথ আরো বেড়ে গেলো। চার্লি ও ডেল্টা নামক দুটো কোম্পানী এসে মিলিত হওয়ায় তখন আমি শওকত সাহেবের নির্দেশে চার্লি এবং ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে আদারপাড়ে চলে গেলাম। ওদের নেতৃত্বের অভাব ছিল। এলাকায় আমি যাওয়ার আগে কোন প্রতিরোধব্যুহ ছিল না। আমি গিয়ে পাটনিগাং পর্যন্ত প্রতিরোধব্যুহ রচনা করলাম। সে সময় আমার সামনে ছিল ২৫ বালুচরে একটি কোম্পানী, একটি স্কাউট ও আজাদ কাশ্মীর ট্রুপস।

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এমবুশ, রেইড করেছি-পাকিস্তান রাজাকারদের বিভিন্নাবস্থানের উপর, বিভিন্ন পেট্রোল পার্টির উপর। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপারেশনে ৩৪ জন নিয়মিত পাকসেনা, প্রায় এক কোম্পানী রাজাকার নিহত এবং আহত হয়। আমার পক্ষের দু’জন শহীদ এবং ৮ জন আহত হয়।

খাইরাই স্কুলে শত্রুর হেডকোয়ার্টার ছিল। ৫ই ডিসেম্বর নোয়া পাড়ায় সর্বপ্রথম এনেমি ডিলইন ফেইস করি। সেখানে শত্রুরা এল-এমজি ফায়ার করে। এল-এমজি ফায়ারের সংগে সংগে আমার ছেলেরা বসে গেল। রেগুলার ট্রেইন্ড ছেলে ছিল না কেউ, কাজেই এদের বুঝাতে আমার বহু সময় লাগলো যে এটা পাকিস্তান আর্মির ডিলইন পজিশন। ওরা ভেবেছিল পাকিস্তান আর্মি এসসে গেছে। তারপর যখন আমি ডিলইন পজিশনের উপর বিশজন ছেলে নিয়ে চার্জ করি, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী উইথড্র করে চলে গেছে। তারপর আমার কথা ওদের কাছে সত্য মনে হলো এবং মনোবল ফিরে এলো। যখন দেখলো আমি চার্জ করে উঠে দাঁড়িয়েছি এবং কোন কিছু হচ্ছে না তখন তারা বুঝতে পারলো যে পাকিস্তান আর্মি ডিফেন্স নেই। তারা ব্যাক করছে, পালাচ্ছে।

তারপর ওখানে রিঅর্গানাইজ করে এগুতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত খাইরাই পৌঁছে গেলাম। শত্রুর হেডকোয়ার্টের পাঁচশ গজ দূরে একটা এলাকায় পৌঁছালাম। এবং ডিগিং শুরু করে সামনের দিকে যখন রেকি করতে শুরু করলাম তখন পাকসেনা সন্ধ্যায় আবছা আধারে আমাদের উপর মর্টার দিয়ে ফায়ার করলো-কিন্তু আমাদের পজিশন ঠিক বুঝতে না পারায় আমাদের ঠিক লাগছিল না। আমার ছেলেরা অত্যন্ত ক্লান্ত ছিল বলে তখন আক্রমণ করে খাইরাই দখল করা সম্ভব ছিল না। তাই ডিশকিবাড়ি ভেদেরগাঁও এলাকায় আমার একটা কোম্পানী ছিল, রাতে তাদের মুভ করিয়ে দিলাম, ওরা রাতারাতি খাইরাইর পেছনে এসে গেল। তখন রাত সারে ৪টা (৬ তারিখ)- খাইরাইর উপর ফায়ার করলো। এটা ঠিক আক্রমণ নয়, এটা হচ্ছে পলায়নপর সৈনিকদের মনোবল ভেঙে দেবার এক কৌশল।

পাকসেনারা তখন সালুটিকর থেকে আর্টিলারী সাপোর্ট চাইলো, প্রায় পাচটার দিকে আর্টিলারী শেল এসে পড়তে শুরু করলো, খাইরাইর আগে এবং চারদিক সার্কেল করে। এই সেলের কভারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী উইথড্র করতে শুরু করলো। আমাদের সামনের ও পেছনের গোলাগুলিতে ওদের সর্বমোট পঁচিশজন মারা গিয়েছিল। আমরা কয়েকটা লাশ পেয়েছিলাম। ভোর ছ’টায় আমি খাইরাইর পাকসেনাদের ডিফেন্সে উঠে যাই। আমার আটটা ক্যাজুয়েলিটি হয়-দু’জন সিভিলিয়ানও মারা যায়। পাকসেনাদের ডিফেন্স প্রায় ছ’হাজার এম্যুনিশন, ছ’টা রাইফেল, ফিল্ড টেলিফোন এবং প্রচুর পরিমাণ মেশিন ও আরর কিছু মর্টারের রাউন্ড পেলাম।

সকাল আটটায় রওনা হলাম। তোয়াকিবাজারে কোম্পানী হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে এডভান্স করলাম পাইকরাজ, জাংগাইলের দিকে। পাইকরাজ ও জাংগাইলের মাঝামাঝি সময় থেকে সত্রুরা আমাদের উপর গুলি চালালো। আমরা তৎক্ষণাৎ ওখানে হল্ট করে গেলাম- শত্রুকে সামনাসামনি রেখে জমির নালায় পজিশন নিয়ে গুলি বিনিময় শুরু করলাম বিকেল প্রায় ৪টা পর্যন্ত। সারে চারটার দিকে আমরা চার্জ করে শত্রুর বাংকারে উঠে গেলাম। সেখানে রাজাকারও ছিল। যারা বেঁচে ছিল তাদের ধরা হল এবং ওরা মারা যাবার আগে ওদের খবর পেলাম ওদের তেরজন ও রাজাকার দশজন মারা গেছে।

সামনে এগোনো শুরু হলো আবার। ১০ই ডিসেম্বরের মধ্যে পুনাছাগাঁও, বীরকুলি এবং নোয়াগাঁওয়ের শত্রুর অবস্থান মুক্ত করে আংগারজোর আমার হেডকোয়ার্টার করলাম। বি-এস-এফের মেজর র’ এলেন আমারমার সহযোগিতার জন্য। ১১ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত আংগারগাঁও থেকে সালুটিকর বাজার মুক্ত করলাম। ১৫ তারিখ ম্যাসেজ পেলাম যে, কোন অবস্থাতেই যেন শত্রুর উপর যেন ফায়ার না করি, যদি তারা ফায়ার না করে। এটা সম্ভবত সারেন্ডারের ব্যাপারে করা হয়েছিল। এই ম্যাসেজ নিয়ে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল। পাকিস্তানের অবস্থা তখন শেষ ধাপে। আমাদের সম্মিলিত বাহিনী তখন ঢাকার কাছে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন নির্জীব, তবুও আমাদের উপর ফায়ার করেছে এবং করলে পাল্টা আমরাও করেছি।

সতেরো কি আঠারো ডিসেম্বর। সালুটিকর নদীর অপর পারে পাকসেনা ছিল, তারা খবর দিল তারা সারেন্ডার করবে, তাদের উপর যেন ফায়ার না করা হয়।

সে সময় আমি চলে গিয়েছিলাম পশ্চিম দিকে, যেখানে তাহেরউদ্দিন আখুঞ্জি গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সিলেট শহরে ঢোকার চেষ্টা চালাতে। সেখান থেকে আমি ওয়াকিটকিতে ম্যাসেজটা পাই এবং গিয়ে হাজির হই। আমাদের সালুটিকর নদীর ও পারে যেতে দেওয়া হয়নি সারেন্ডার অনুষ্ঠানে আমার সংগের ছেলেরা গণ্ডগোল করতে পারে এই আশংকায়। আমিই শুধু গিয়েছিলাম।

আমি সেক্টর হেডকোয়ার্টারে নির্দেশ পেলাম আমারমার ছেলেরা ভেতরে যাতে ঢুকতে না পারে। কারণ তখন সম্ভাবনা ছিল আত্নসমর্পিত পাকসেনাকে পেলে ছেলেরা হয়তো মেরেই ফেলবে। আমি তখন আমার তিনটা কোম্পানী আংগারজোরে ক্লোজডোর করে রাখলাম।

তার সাত দিন পর গোটা ট্রুপস নিয়ে আমি সিলেট শহরে ঢুকি।

* ১৯৭১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। সাক্ষাৎকারটি ১৪-১-৮০ তারিখে প্রকল্প কতৃক গৃহীত।