শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪ নং সেক্টরের যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের প্রদত্ত বিবরণ | সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মোঃ মোহাম্মদ আব্দুর রব | মে-ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
সাক্ষাতকারঃ লেঃ কর্নেল মোঃ আব্দুর রব*
১৭-১২-১৯৭৯
৪ নং সেক্টর বাংলাদেশ ফোর্স (বি ডি এফ) এর অবস্থা ভিন্ন ছিল। আমি চেষ্টা করব ৪ নং সেক্টর বাংলাদেশ ফোর্স এর অবস্থা, বিশেষ করে স্ট্রাটেজিক ভাবে গুরুত্ব্পূর্ন যেই যুদ্ধগুলো এখানে তুলে ধরতে। যুদ্ধের সময় আমি ডাইরি লিখতাম্। সেখান থেকেই মূলত এই বর্ননা গুলো তুলে ধরব।
মেজর চিত্তরন্জন দত্ত (বর্তমানে কর্নেল) যুদ্ধের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ৪ নং সেক্টর এর কমান্ডার ছিলেন। আমার মনে আছে, সেক্টর গুলো ভাগ করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের মে মাসে। অপারেশনের সুবিধার জন্য পুরো বাংলাদেশ কে অনেকগুলো সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটা সেক্টর কে আবার বিভিন্ন সাব্-সেক্টর এ ভাগ করা হয়েছিল। এছাড়া এই সেক্টর গুলোর বাইরেও বিভিন্ন বাহিনী সংগঠিত ছিল্, যেমন্: হেমায়েত বাহিনী, কাদেরীয়া বাহিনী ইত্যাদি। যদিও এই বাহিনী গুলো খুব বেশী সংগঠিত ছিল না, তবুও সবার উদ্দেশ্য এক ছিল্, বাংলার মাটিকে হানাদার শত্রু মুক্ত করা।
আমার বর্ননা শুধু ৪নং সেক্টর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ৪নং সেক্টর সিলেটের (পূর্ব আর দক্ষিন-পূর্ব মিলে) ১০০ মাইল বিস্তির্ন সীমানা ধরে গঠিত ছিল। দক্ষিনে হবিগন্জ থেকে শুরু করে উত্তরে কানাইগন্জ পর্যন্ত এর সীমা বিস্তির্ন ছিল। সিলেটের এই বর্ডার এরিয়া ছিল পুরোটাই পাহাড়ী, যার মদ্ধে ছিল পাটারিয়া পাহাড়্, সাতগাও পাহাড় ইত্যাদি। আমাদের অপারেশন এরিয়ার মধ্যে ১০০ টা চা বাগান ছিল। এটা মিলিটারী দৃষ্টিকোন থেকে গেরিলা অপারেশন চালানর জন্য চমৎকার ছিল।
গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধ গুলোর ব্যপারে বলার আগে আমার মনে হয় যুদ্ধের পটভূমি, বিশেষ করে মার্চ- এপ্রিলের উত্তাল সময় এর কথা একটু বলা দরকার। এসময় টা ছিল উত্তেজনা, সংশয় আর ডামাডৌলের সময়। যদিও মানুষ প্রতিরোধ তৈরী করছিল্, কিন্তু সেগুলো সংগঠিত ছিল না। আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করছিল্, এবং মিলিটারী ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য তারা তুলনামূলক ভাবে ভাল অবস্থায় ছিল।
পুরো মুক্তিবাহিনী ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে ছিল: নিয়মিত বাহিনী আর গনবাহিনী। নিয়মিত বাহিনী মূলত গঠিত হয়েছিল আর্মড ফোর্স এর সদস্য যেমন: ই পি আর্, পুলিশ্, আনসার এদের দিয়ে। আর্মি আর ইপিআর এর সদস্য এর বাইরে অন্যদের যুদ্ধের ইন্ফ্রান্টি অস্র আর তার ব্যবহার সম্পর্কে তেমন ধারনা ছিল না। তাদের গেরিলা এবং সম্মুখ সমর এর জন্য অল্প সময় এ ট্রেনিং দিতে হয়েছিল। তারা খুব অল্প সময়ে এগুলো রপ্ত করেছিল এবং যুদ্ধের ময়দানে অসামান্য বীরত্ব এর প্র্মান রেখেছিল। বিশেষ করে ইপিআর সদস্য দের একক অবদান, সাহসিকতা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা শেষ পর্যন্ত কখনো বিস্বাসঘাতকতা করেনি।
গনবাহিনী ছিল সবচেয়ে ত্যাগী এবং তারা সাহসীকতা আর হিরোইসমের প্রতিকে পরিনত হয়েছিল। গনবাহিনী গঠিত হয়েছিল ছাত্র, তরুন্, যুবক দের নিয়ে। তাদের সবাই ভারতের বিভিন্ন মুক্তিবাহিনী এর গেরিলা প্রশিক্ষন কেন্দ্র থেকে থেকে প্রশিক্ষন নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরো জাতির বাচা মরার লড়াই। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে, বিভিন্ন পেশা থেকে মানুষ এই গনবাহিনী তে যোগ দিয়েছিল।
৪নং সেক্টর মূলত গঠিত হয়েছিল সেক্টর ট্রুপ্স নিয়ে। এরা প্রায় সবাই এক্স্-ইপিআর্, এক্স্-আর্মি আনসার্, মুজাহিদ এবং অল্প কিছু পুলিশ সদস্য ছিল। এই সেক্টর ৬ টা সাব্-সেক্টরে ভাগ ছিল। শুরুতে শুধুমাত্র মেজর চিত্তরন্জন দত্ত (বর্তমানে কর্নেল) এবং আমি (ক্যপ্টেন এ. রব) ছিলাম এই সেক্টর এর অফিসার রাঙ্কের। পরে ৭১ এর জুন মাসে ক্যাপ্টেন হ্ক (এখন মেজর), ফ্লাইট লে: কাদের আর ক্যাপ্টেন আনাম আমাদের সাথে যোগ দেয়।
পাকবাহিনী সিলেটে পাইকারী হারে মানুষ মারা শুরু করে ৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে। সিলেটে এক ব্যটেলিয়ন পাঞ্জাব রেজিমেন্ট (৩১ পাঞ্জাব) ছিল। ক্রাকডাউনের সময় পাকবাহিনী পুরো সিলেট জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল কিন্তু এর পরপরই তারা সিলেট শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা সিলেট শহর কে পুর্ব, পশ্চিম, এবং দক্ষিন দিক থেকে ঘিরে ফেললাম। ক্যাপ্টেন আজিজ এর নেতৃত্বে এক কোম্পানী বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিন দিকে সুরমা সেতু কাভার করছিল। এক কোম্পানি ইপিআর পূর্ব দিক থেকে শহরে প্রবেশ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ সিলেট শহরে পাকবাহিনী এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল। ভারী অস্র আর বিমান হামলার মোকাবিলার জন্য আমাদের শক্তি আর একটু বেশী থাকলে আমরা অপ্রিল ৫ বা ৬ , ১৯৭১ এর দিকে সিলেট সহজেই পাকাপোক্তভাবে দখল করে নিতে পারতাম। এপ্রিল ৬ এর পর থেকে C-১৩০ বিমান হামলার সাহায্যে শত্রু রা পুনরায় দখল নেয়া শুরু করে।
৮ এপ্রিলের মধ্যে শত্রুবাহিনী ঢাকা থেকে ১ ব্যাটেলিয়ন সেনা নিয়ে আসে এবং সিলেট শহর এর বাইরে আগাতে থাকে। শহরে থাকা ইপিআর তাদের প্রতিরোধ করলেউ টিকতে পারল না। বেঙ্গল রেজিমেন্ট সুরমা ব্রিজের কাছে সাহসিকতার সাথে তাদের শক্ত প্রতিরোধ করল এবং কিছু সময় এর জন্য তাদের থামিয়ে রাখল। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সিলেট-মৌলভীবাজার রোডের উপর শেরপুরে তুমুল যুদ্ধ হয়। পূর্ব দিকে সিলেট-সুতারকান্দি রোডের উপর গোপালগঞ্জ নামক স্থানে এক ব্যাটেলিয়ন বর্ডার সিকিউরিটি ফোরস (বি এস এফ) আর মুক্তিবাহিনী মিলে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। এপ্রিলের শেষ ২ সপ্তাহে শত্রুর কাছে এই ঘাটিটি আমরা হারিয়ে ফেলি।
দেশের ভিতর পাকবাহিনীর সীমাহীন আত্যাচার- বর্বরতা বাড়ার সাথে সাথে বর্ডার এর দিকে রিফিউজি মানুষ এর ঢল নামছিল। যেখানেই পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের সম্মুখিন হয়, সেখানেই পাকবাহিনী সাধারন জনসাধারনের উপর নির্মম অত্যাচার ও ধ্বংসলীলা চালায়। সিলেটের প্রায় সবখানে এরকম ধ্বংসলীলা হয়েছিল। প্রতিদিন সিলেটের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার লোক ভারতের সীমানা পার হচ্ছিল। ভারত তার সব সামর্থ দিয়ে এই বিশাল সংখ্যক রিফিউজি এর চাপ সামাল দিচ্ছিল। এক রাতের মধ্যে তাদের রিফিউজি ক্যাম্প ও রিফিউজি ওয়েল্কাম সেন্টার বানাতে হচ্ছিল। জুলাই, ১৯৭১ এর মধ্যে শুধুমাত্র কাচার জেলাতেই তারা নতুন তৈরী ক্যাম্পে ২ লাখ রিফিউজিকে আশ্রয় দেয়। কিন্তু তারপরেও রিফিউজিরা সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল।
শুরুর প্রতিরোধ এর পরে মুক্তি বাহিনী এর আক্রমন গুলো কিছুতা সমন্বয়হীন হয়ে পরে। এগুলো সমন্বয় করতে, গুছিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লেগে যায়। গোপালগঞ্জ ঘাটির পতনের পরে আমাদের বাহিনী পিছু হঠে বড়গ্রাম বিওপি এবং সুতারকান্দি চেকপোস্টে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। সেসময় আমাদের হাতে সব মিলিয়ে ১ কোম্পানি এর মত সৈন্য ছিল, যার মধ্যে ইপিআর ও সেনা সদস্য ছিল। সৌভাগ্যক্রমে তাদের সবার কাছে রাইফেল ছিল্, কিছু লাইট মেশিনগান্, ২” মর্টার আর ১টা মিডিয়াম মেশিনগান ছিল।
১৯৭১ এর এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত এই ছিল আমাদের অবস্থা। শত শত ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং অট্রেনিংপ্রাপ্ত মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিতে চায় কিন্তু তাদের সবাইকে অস্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবারহ করার অবস্থা আমাদের ছিল না। তাই আমরা তাদেরকে ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠালাম। শত শত মানুষ মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিতে সীমান্ত এলাকায় এলো। কিন্তু আমাদের নেতাদের ম্যানেজমেন্ট সেসময়ে খুব ভাল ছিল না। তাই তাদের অনেককেই নিজ নিজ বাসায় ফেরত পাঠানো হলো। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বেশীরভাগই নানা রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত ছিল। শুধু অল্প কয়েকজন কি করে মুক্তিবাহিনী কে সংগঠিত করা যায়, নতুন ট্রেনিংক্যাম্প তৈরি করা যায়, সেখানে নতুনদের পাঠানো যায়, এসব নিয়ে তৎপর ছিল। এই অল্পকজন এর মধ্যে দেওয়ান ফরিদ গাজী, এম সি এ এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।