You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৪ নং সেক্টরের যুদ্ধ সম্পর্কে অন্যান্যের প্রদত্ত বিবরণ সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল মোঃ মোহাম্মদ আব্দুর রব মে-ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

সবুজপুর (লাটু) রেলওয়ে স্টেশন অপারেশন
(১০ আগস্ট ১৯৭১)

কিছুদিন ধরে আমি সবুজপুর (লাটু) রেলওয়ে স্টেশনে বড় ধরনের অপারেশন করার কথা ভাবছিলাম। আগস্ট এর প্রথম সপ্তাহে আমি অপারেশনের মাস্টার প্ল্যান সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল চিত্ত রঞ্জন দত্ত কে দিলাম তাঁর অনুমুতির জন্য। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উডকে আমাদের সব ধরনের সাহায্য করার আশ্বাস দিলেন। তিনি আমাদের প্রয়জনীয় আর্টিলারি সাপোর্ট দেবারও প্রতিশ্রুতি দিলেন।

সবুজপুর (লাটু) রেলওয়ে স্টেশন ছিল পাহাড়ি এলাকা। পুরো এলাকা ৩১ পাঞ্জাব এর এক প্লাটুন এবং এক প্লাটুন অস্ত্রধারী রাজাকার দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। শত্রুর ঘাটিতে সরাসরি হামলা করার কোন সহজ উপায় ছিল না। গেরিলা হামলা চালানোর মত অবস্থাও ছিল চিন্তার বাইরে। তবুও আমরা হামলা চালাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আমি ১০ আগস্ট, ১৯৭১ অপারেশনের দিন (“D” দিন) ঠিক করলাম। আমার হাতে ৫ কোম্পানি ছিল এই অপারেশনের জন্য। রেকি করার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, সামনা সামনি হামলা করা ছাড়া কোন উপায় নেই, কিন্তু সেটা হবে অনিয়মিত উপায়ে। এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধার কাজ হবে বিয়ানিবাজার থেকে শত্রুর সংযোগ লাইন কেটে দেবা। তাদের উপরই দায়িত্ব পড়ে পিছন দিক দিয়ে শত্রুর উপর প্রথমে হামলার সূচনা করা। ঠিক ১০ মিনিট পরে তাঁরা ফায়ারিং বন্ধ করবে। এর পরে তাঁরা পিছু হঠবে এবং একি সময়ে এক ব্যাটারি মিডিয়াম গান শত্রুর উপর ফায়ারিং করবে তাদের ব্যাস্ত রাখতে। ৫ মিনিটের জন্য শেলিং করা হবে এবং তারপরে ৩ কোম্পানি সামনা সামনি শত্রুর উপর হামলা করবে। অবশিষ্ট এক কোম্পানি শাহবাজপুর-বড়লেখা রাস্তায় পজিসন নিয়ে থাকবে, যাতে সেখানে শত্রুরা জমায়েত হতে না পারে। শুরুতে সবকিছু প্ল্যান মোতাবেকই হল।

৫টার দিকে আমার সব কোম্পানি তাদের নিজ নিজ নির্ধারিত পজিশনে চলে গেল। কোম্পানিগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের কোন উপায় ছিল না। আমি যেহেতু আক্রম্নকারী দলের সাথে ছিলাম, আমার পক্ষে অন্য কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগের কোন পথ ছিল না। অন্য ২ কোম্পানির কাজটা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তাঁরা যদি শত্রুর সাপ্লাই লাইন বন্ধ না করতে পারে, পুরো অপারেশনটা ফেল করবে।

শত্রুর বাংকার অবস্থান এত মাটির এত গভীরে খনন করা ছিল যে, মিডিয়াম গান এর শেলিং তেমন কোন ক্ষতি করতে পারল না। যাই হোক, আমরা আমাদের পুরো শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম। ১৫ মিনিটের মধ্যে শত্রু বাহিনী পিছু হটা শুরু করল। ৭ টার দিকে আমরা শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের একটা বড় অংশ মুক্ত করলাম। এবার শত্রুর যেই অবস্থান থেকে সবচেয়ে বেশী প্রতিরোধ আসছিল, সেখানে চার্জ করলাম। সেখানে তখনও পাকিস্থানী পতাকা উড়ছিল। আমরা সেটা সড়িয়ে সেখানে আমাদের বাংলাদেশের পতাকা উড়ালাম।

এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের বাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। আমি তাদের সমন্বয় করার চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। এসময় একজন দৌরে এসে খবর দিল, শত্রুরা আমাদের বাম দিকে জড়ো হচ্ছে। বড়লিখা থেকে সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দেবার এবং তাদের পুনরায় একত্রিত হতে বাধা দেবার যেই দলের দায়িত্ব ছিল, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্থানীরা আমাদের অবস্থানে আর্টিলারি শেলিং শুরু করে। আমি লেঃ কর্নেল দত্ত কে এই অবস্থা জানালাম। উনি আমাকে বলেছিলেন, অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু নতুন উদ্যমে একত্রিত হবা পাকিদের আর্টিলারি শেলিং এর মুখে টিকে থাকা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই অবশেষে আমরা পিছু হঠলাম।
যাই হোক, আমরা পিছু হঠলেও আমাদের শাহবাজপুর মিশন সফল ছিল। আমরা শত্রুর বিওপি দখল করে নিয়েছিলাম, রেলওয়ে স্টেশন ও প্রায় দখল করে ফেলেছিলাম। ওখানে ৮ জন শত্রু সেনার লাশ পড়েছিল সেদিন। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের হাতে আসে কিন্তু ট্রান্সপোরটেশান না থাকায় সেগুলো সব আমরা সেদিন নিয়ে যেতে পারেনি। এছাড়াও পাকিরা পিছু হঠার সময় তাদের হতাহত অনেককে সাথে নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি, শত্রু পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ৫০ এর মত। আমাদের পক্ষে ৬ জন শহীদ আর ৫ জন আহত হন। আমি আমার কিছু সাহসী যোদ্ধাকে এদিন হারাই। যেমনঃ ইপিআর হাবিলদার কুতুব, যে কিনা ইপিআর ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য ছিল, কিংবা নায়েক মান্নান, যে খুব ভাল আথলেট ছিল। ফেঞ্চুগঞ্জ এর হাবিলদার ফাইজ যে কিনা কাটা পোড়া এর ওষুধ তৈরী করে বিখ্যাত হয়েছিল, এদিন শহীদ হন।

চারটে চা বাগানসহ ২০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত হয় এবং আমাদের দখলে আসে। শত্রুরা বিভিন্ন জায়গা দিয়ে এখানে হামলার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আমাদের সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় গেরিলা যোদ্ধা এসময় সিলেটের একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং অনেক সফল অপারেশন করে। কিন্তু যা আগে বলেছি, যদি তাঁরা আরও বেশী লোকাল সাপোর্ট পেতো, তাঁরা আরও বেশী সফল হতো।

আমার অধীনে কিছু অসাধারন বীর গণবাহিনী দলনেতার দুঃসাহসিক অভিযানে আমি সত্যি গর্বিত। তাদের সবাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তাদের সবার নাম আমার মনে নেই, কিন্তু তারপরও কিছু নাম যেগুলো মনে আছে, যেমন এ মতিন চৌধুরী, শামীম, বাবুল, মুক্তাদির বিশেশভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। ২ ব্যাটেলিয়ন এর মত পাকসেনা আমাদের বিয়ানিবাজার, বড়লেখা এবং জাকিগঞ্জ থানার ঘাটিতে আক্রমন করে। তাদের প্রচুর সেনা হতাহত হয় এই যুদ্ধে। আমাদের পক্ষে ৭ জন শহীদ হন। ১৩ সেপ্টেম্বর আমার স্ত্রী আমার সাথে সীমান্তে দেখা করে। সেই সময় শত্রুর চোখকে ফাকি দিয়ে আমার সাথে দেখা করা তাঁর মত সাহসী মেয়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

সম্ভবত ২০ অক্টোবর, ১৯৭১। আমার কাছে অর্ডার আসল আমার বাহিনী নিয়ে জাকিগঞ্জ পুলিশ থানার উল্টাদিকে জালালপুর সাব-সেক্টরে যোগ দিতে। ধর্মনগর সাব-সেক্টর, অমলশিদ সাব-সেক্টর, এবং কুকিতাল সাব-সেক্টর থেকেও মুক্তিযোদ্ধারা এখানে যোগ দিয়েছে। সবাইকে আমার কম্যান্ড এর অধীনে দেবা হল। সেখানে ২ সপ্তাহের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয় সরাসরি যুদ্ধ এর এবং আরও যুদ্ধের ময়দানের নানা কলাকৌশল রপ্ত করার জন্য। এসময় আমাদের কোম্পানি গুলোর যোগাযোগের জন্য কিছু ওয়্যারলেস সেটও দেবা হয়। এগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেজন্য ও কিছু ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!