You dont have javascript enabled! Please enable it!

॥আশুগঞ্জের লড়াই এবং ঢাকার পথে ‘এস’ ফোর্স॥

এদিকে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ তাঁর ‘এস’-ফোর্স নিয়ে কোন পথে অগ্রসর হচ্ছেন তার বিবরণ সংক্ষেপে দিচ্ছি। ৬ই ডিসেম্বর বিকালে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ ইসলামপুর ব্রীজের কাছে এক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন এবং নিশ্চিত মৃত্যর হাত থেকে রক্ষা পান। তারপর এখান থেকে ‘এস’-ফোর্স ৭ই ডিসেম্বর ঢাকার পথে রওনা হয় এবং এইদিন শাহবাজপুরে তাদের সাথে আর একটি খন্ডযুদ্ধ হয় ও পরে শত্রুরা ভেগে যায়। তারপর ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনী সরাইল পৌছে যায়। আশুগঞ্জে আমরা আবার শত্রুসৈন্যর সম্মুখীন হলাম ৮ই ডিসেম্বর। আশুগঞ্জে শত্রুবাহিনী প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গড়েছিল। সেটা ছিল যুদ্ধকৌশল সমৃদ্ধ এবং তার ঘাঁটিগুলি ছিল অত্যন্ত মজবুত। আমাদের ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনী প্রথম আক্রমন চালায় ৯ই ডিসেম্বর বেলা ৩টার সময়। এই আক্রমণে আমাদের পক্ষে ছিল তবুও তার সেই ভয়াবহ রূপ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাও কঠিন। সম্মিলিতভাবে ‘এস’- ফোর্স ও মিত্র বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে শত্রু বাহিনীও ভীষণভাবে মারমুখী হয়ে উঠে। একদিকে যখন আমাদের পদাতিক বাহিনী বিনা বাধায় শত্রুর উপর বোমা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। এমতাবস্তায় শত্রুপক্ষ তাদের ভারী মেশিনগান ও বিমানবিধবংসী কামান দিয়ে অবিরামভাবে গুলি ছুড়ে যাচ্ছে। তাদের আর আর (রিকয়েললেস রাইফেল) গুলোও তখন নিরস্ত ছিল না। তারাও তখন আমাদের পক্ষের ট্যাঙ্কগুলোকে লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। আমাদের পক্ষের গোলন্দাজ বাহিনীর মিডিয়াম গানগুলো শত্রুপক্ষের উপর অবিশ্রান্তভাবে গোলা নিক্ষেপ করছিল, ঠিক তার পালটা জবাবে শত্রুপক্ষও তখন সমভাবে আমাদের উপর গোলা নিক্ষেপ করছিল। তুমুল লড়ায়ের পর শত্রুবাহিনীর প্রচণ্ড পালটা আক্রমণের মুখে ‘এস’-ফোর্স ও মিত্রবাহিনীকে সাময়িকভাবে সেদিন পিছু হাটতে হয়। যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তাদের ক্ষয়ক্ষতি আমাদের থেকে অনেক বেশী ছিল। ঐ দিনকার যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর চারখানা ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং প্রায় ৪০/৫০ জন বীর যোদ্ধা মারা যান।যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের প্রায় দেড় শতাধিক লোক নিহত হয়।

দ্বিতীয়বার আক্রমণের পর অবশেষে শত্রুসৈন্য ১০ই ডিসেম্বর আশুগঞ্জ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ভৈরববাজারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শত্রুপক্ষ আশুগঞ্জ থেকে ভৈরববাজারে যাবার পূর্বে ভৈরব ব্রীজের তিনটি স্প্যা্ন ধ্বংস করে দিয়ে যায়। যুদ্ধের গতিবেগ রক্ষা করার জন্য কোন সময় নষ্ট না করে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ভৈরববাজার ঘিরে থাকার জন্য নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল সেক্টর ট্রুপস নিয়ে পদব্রজে নরসিংদীর দিকে রওনা হন।

তিনি নরসিংদী পৌঁছানোর পূর্বেই মিত্রবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন হেলিকপ্টারযোগে সেখানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু শত্রুপক্ষ সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। ১২ই ডিসেম্বর তিনি শীতলক্ষ্যা পার হন। ইতিমধ্যে তিনি দুটি ছোটখাটো সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এছাড়া তিনি দুটি দলকে ঢাকার দিকে পাঠিয়ে দেন। তার একটি ছিল বাসাবো এলাকার জন্য ও অপরটি ছিল ঢাকা সেনানিবাসের জন্য। ১৬ই ডিসেম্বর শত্রুপক্ষের ৩০০ জনের একটি দল ডেমরাতে তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

১৩ই হইতে ১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৪টা পর্যন্ত ‘এস’-ফোর্স ডেমরা ও শহরের বিভিন্ন উপকন্ঠে লড়াই করে। এরপর তারা ডেমরার পরবর্তী এলাকা মাতুয়াইলে একবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। পরে লেঃ কর্নেল শফিউল্লাহ জেনারেল অরোরার সাথে ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ৪টা ৩১ মিনিট রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। ইতিমধ্যেই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ও সেক্টর ট্রুপস ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছে যায়।

*১৯৭১ সালের মার্চে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন। প্রতিবেদঙ্গুলি তাঁর রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!