সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার এম, এ, মতিন
আমাদের হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া থেকে তুলে ভারতীয় সীমান্ত সীমানাতে স্থানান্তরিত করা হয়। মে মাসের প্রথমে আমার কোম্পানী নিয়ে তেলিয়াপাড়াতে ঘাঁটি, সংখ্যায় ছিলাম ৮০/৮৫ জন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া চট্টগ্রাম থেকে এসে আমাদের সাথে যোগ দেন। এরপর আমরা দুজন পরামর্শ করে ডিফেন্স নেই।
মে মাসের প্রথম থেকে পাকবাহিনী ৮/১০ বার হামলা চালিয়েও আমাদের সরাতে পারেনি। ওখানে মাঝে মাঝে যুদ্ধে আমরা পাকবাহিনীর গাড়ি ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছি। প্রত্যহ হামলা করতো পাকবাহিনী। বেসামরিক লোক, ইপিয়ার, মুজাহিদ এরা এতো সাহসিকতার সাথে পাকবাহিনীর সাথে মোকাবেলা করে যে আমি বিস্ময় প্রকাশ করি। ইপিআরদের কথা ভোলা যায় না। এত সাহস আমি জীবনে দেখিনি। হেডকোয়ার্টার থেকে খাবার আসতো। এমনও দিন গেছে যে ২/৩ দিন খাবার পায়নি। বৃষ্টিতে ভিজে অনাহারে যুদ্ধ করতে হয়েছে। মুজাহিদ দুলামিয়ার একটি ঘটনা বলা দরকার। মুকুন্দপুর হরশপুর (সিলেট) ওখানে পাকবাহিনীর সাথে এক যুদ্ধে দুলামিয়া বেশকিছু পাকবাহিনীকে খতম করে। পাক বাহিনীর চাপে অন্যান্যরা চলে যায়, দুলামিয়ার পেটে গুলি লেগে মারা যাবার মতো তবুও গামছা দিয়ে বেঁধে এলএমজি ফায়ার করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে প্রায় জ্ঞান হারায় এমন অবস্থা। কর্ণেল শফিউল্লাহ পিছন থেকে দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করে দুলামিয়াকে উদ্ধার করে। দুলামিয়া প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলেও তা ট্রিগারে হাত ছিল। শফিউল্লাহ তাকে উদ্ধার করে উঠে আসার সাথে সাথে বলে আমার এলএমজি কোথায়। আর বলতো, স্যার আমি মরে গেলে ‘জয় বাংলা’ বলবেন।
ইপিআর নায়েক সুবেদার মালেক, নায়েক আব্দুল ওহিদ, ল্যান্স নায়েক মফিজ, নায়েক সালাম, সেপাই হায়দার আলী, গোলাম মওলা, মুজাহিদ তাজুল ইসলাম, ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম এবং সিপাই কবির – এদের নাম ভোলা যায় না। ছাত্রদের মধ্যে সেলিম এবং আনিসের দুই ভাই এবং শাহজামান মজুমদারের কথা অতুলনীয়। সেলিম মীরপুর অপারেশনে শহীদ হয় বিহারী কলোনীতে। মরার সময় সে বলেছিল যে, ‘স্যার পাকবাহিনীর হাতে মারা গেলাম না, কুত্তা বিহারীদের হাতে মারা গেলাম’।
যাহোক, ১৯শে মে পাকবাহিনীর আর্টিলারী এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রের সাহায্যে ব্যাপক আক্রমণ চালালে আমরা তেলিয়াপাড়া ছাড়তে বাধ্য হই। যুদ্ধে আমাদের ৮/৯ জন মারা যায়। পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য মারা যায়। যুদ্ধ চলে সারাদিন ধরে।
২০শে মে ভোরে আমি পাল্টা আক্রমণ করি তেলিয়াপাড়াতে। সকালে আমরা ৪/৫ টা বাঙ্কার দখল করে নেই কিন্তু পাক বাহিনীর আরো সৈন্য আসায় আমরা প্রায় ১১টার দিকে পিছু হটে আসি। আমাদের ১০জন মারা যায়। পাকবাহিনীর ২০/২৫ জন মারা যায়। ইতিমধ্যে যুদ্ধনীতি পরিবর্তন হয়। আমরা বাহিনীকে গেরিলা শিক্ষা দিই।
১৭ই মে ক্যাপ্টেন মুর্শেদ কিছুদিনের জন্য তেলিয়াপাড়াতে আসে। ক্যাপ্টেন মুর্শেদ তার দল নিয়ে তেলিয়াপাড়া সিলেট রাস্তায় মাইন বসিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে। পাক বাহিনীর ১২টা গাড়ী ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। পাকবাহিনীর গাড়ি ধ্বংস হয় এবং ৭০ জন মারা যায়। ২টি ট্রাক এবং একটি বাস, চিঠিপত্র এবং অনেক গোপন তথ্য আমাদের হস্তগত হয়।
সম্মুখযুদ্ধ ছেড়ে দিয়ে আমরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করি। এতে করে আমরা কৃতকার্য হতে লাগলাম। দুইবার একেবারে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছি। বুলেট লুঙ্গি ও হাফ হাতা জামার হাতা ভেদ করে গেছে কিন্তু আমার শরীর স্পর্শ করেনি।
ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী পূনর্গঠিত করতে থাকি। বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে এসে ট্রেনিং দিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু কিছু নিতে থাকি এবং সার্বিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। সেপ্টেম্বর মাস থেকে সম্মুখ সমরে আসতে হয়। আমাদের উপর নির্দেশ আসে শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করে, ধ্বংস কর, অস্ত্র কাড়ো, এগিয়ে যাও। আমরা তখন দলে বেশ ভারী হয়ে চলেছি, অস্ত্রশস্ত্র বেশ আছে। আমরা কাজ আরম্ভ করে দেই। সেপ্টেম্বর মাসেই একাদশ বেঙ্গল তৈরি হয়। পুরাতন আর্মি, মুজাহিদ, আনসার এবং ছাত্র মিলে ব্যাটালিয়ন পুরা করা হয়। কোন সময়ে আমি একা, কোন সময়ে দুই কোম্পানী মিলে, কোন সময়ে তিন কোম্পানী মিলে সম্মুখসমরে অবর্তীর্ণ হয়েছি সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। হরশপুর, মুকুন্দপুর, তেলিয়াপাড়া, মনতলা, সিলেট, সাজিবাজার, শাহপুর ইত্যাদি স্থানে পাকবাহিনীর মুখমুখি হয়ে আমরা জয়লাভ করি। ভারতিয় বাহিনীর আর্টিলারী আমাদের মাঝে মাঝে সাহায্য করতো।
৩০সে নভেম্বর আমার উপর নির্দেশ আসে আখাউড়া দখলের জন্য। ১লা ডিসেম্বর আমি, মিত্রবাহিনী, ২য় বেঙ্গলের বাহিনী সম্মিলিতভাবে আমরা আখাউড়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ঘিরে ফেলি এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আক্রমণ চালাই। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়- ১লা ডিসেম্বর তারিখে শুরু হয় , ৬ই ডিসেম্বর সকালে আখাউড়া আমাদের দখলে আসে। কর্নেল শফিউল্লাহ আমাকে মাধবপুরে রওনা হয়ে যেতে বলেন। কর্নেল নিজে ১১ বেঙ্গল এবং ২য় বেঙ্গল নিয়ে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার দিকে রওনা হলেন বললেন রাস্তায় দেখা হবে। ঐ দিন ২টার দিকে আখাউড়া থেকে রওনা দিই, পুরাতন ক্যাম্প মনতলাতে রাত ১০/১১টা দিকে পৌঁছাই। সকালে মাধবপুরের দিকে অগ্রসর হবার মনস্থ করি। ৭ই ডিসেম্বর সকাল সাতটায় মেজর নুরুজ্জামান আমার ক্যাম্পে এসে একটি দুর্ঘটনার খবর দেন এবং আমার কোম্পানীকে রেখে আমাকে একাদশ বেঙ্গলের দায়িত্ব নিতে বলেন। মেজর বলছিলেন কর্নেল শফিউল্লাহ যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন হঠাৎ করে সিলেটের রামপুরে পাকবাহিনীর ৪০/৫০ জনের একটি দল আক্রমণ চালায়। ওখানে পাঞ্জাবী সুবেদারের সাথে কর্নেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি হয় কিন্তু শফিউল্লাহ বুদ্ধি বলে রাইফেলের বাঁট দিয়ে সুবেদারকে আঘাত করে ধরাশায়ী করেন। ২ জন মুক্তিবাহিনী মারা যায়। ১০/১২ জন আহত হয়। মেজর নাসিম গুরুতর রুপে আহত হয়। কর্নেলের পিস্তল যেখানে গুলি লেগে পিস্তলটি অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু কর্নেল বেঁচে যান। ১৫/১৬ জন পাঞ্জাবী মারা যায়, বাকি সব আত্নসমর্পণ করে একাদশ বেঙ্গলের কাছে।
কর্নেল সাহেবের সাথে দেখা করে একাদশ বেঙ্গলের দায়িত্ব নেই এবং তিনি ঐ রাতেই মাধবপুর, শাহবাজপুর সরাইল হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার নির্দেশ দেন। ৭ই ডিসেম্বর রাতে পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হই। ৮ই ডিসেম্বর বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হস্তগত করি। পথিমধ্যে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলেও আমাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। মিত্রবাহিনীর সহযোগীতায় আশুগঞ্জ দখলের জন্য নির্দেশ দেন কর্নেল শফিউল্লাহ ১১ই ডিসেম্বর। ১১ই ডিসেম্বর আশুগঞ্জ দখল করি। ভৈরব সেতু ধ্বংস করে ভৈরব শহরে পাকবাহিনী আস্তানা গাড়ে। মিত্রবাহিনী এবং কর্নেল শফিউল্লাহ দ্বিতীয় বেঙ্গল নিয়ে নরসিংদী হয়ে ঢাকার পথে রওনা হন আমাকে আশুগঞ্জে রেখে। আমাকে নির্দেশ দিয়ে যান আমি আমার বাহিনী নিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখি, যাতে তারা ঢাকার পথে পিছন দিক থেকে গিয়ে কর্নেল শফিউল্লাহ বা মিত্রবাহিনীর কোন ক্ষতি করতে না পারে। আমরা দুই দিক থেকে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখলাম। মাঝে মধ্যে আক্রমণ করে আমরা পাকবাহিনীর বিপুল ক্ষতি করি। ভৈরবের অপর পাড়ে যে পাক ঘাঁটি ছিল ১৭ই ডিসেম্বর তারা আমাদের কাছে আত্নসমর্পণ করে।
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং ২৫ তারিখে নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে অস্ত্র ধরি। অসহযোগ আন্দোলনে পুরো সমর্থন আমাকে এগিয়ে দেয়।
স্বাক্ষরঃ মেজর, এম, এ মতিন
২৮-৩-৭৩
*১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন। ছুটিতে থাকাকালীন অবস্থায় মার্চ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন।