You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাক্ষাৎকারঃ লেঃ কর্নেল হেলাল মুর্শেদ*

৪ঠা মে আমি আমার প্লাটুনসহ শাহবাজপর পৌছি। ৫ই মে সকালে আমি রেকি করি এবং রাত্রে রেইড করি। ৬ই মে সকালে জনসাধারণের মুখে শুনতে পাই ৯ জন পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়। তার ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা জনসাধারণের বাড়ীঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার প্লাটুনের মাত্র ১ জন আহত হয়। রেকি করে ৭ই মে আমি আহত সৈন্যসহ প্লাটুন নিয়ে মাধবপুর পৌছি। মাধবপুরে তখনো আমাদের ডিফেন্স ছিল। আমরা মাধবপুর পৌঁছার পর এবং মেজর শফিউল্লাহ তেলিয়াপাড়া থেকে মাধবপুর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যরা শাহবাজপুর থেকে মাধবপুর পৌঁছে আমাদের উপর আক্রমণ চালায় এবং গোলাগুলি করে। ঐ মুহুর্তে আমরা যদিও অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম তথাপি মেজর শফিউল্লাহ আমাকে শত্রুর বাদিক দিয়ে আক্রমণ করার আদেশ করেন। আমি প্লাটুন নিয়ে শত্রুর বাদিকে অগ্রসর হই। উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর আক্রমণ কে প্রতিহত করা। ঐ সময় আমি শত্রুর উপর আক্রমণ করতে পারলাম না এ জন্য যে আমাদের চতুর্দিক দিয়ে শরণার্থী যাচ্ছিল। বিকেল ছটা পর্যন্ত পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানীদের চরম আক্রমণে আমাদের আলফা কোম্পানী সৈন্য তুলে নিয়ে মনতলায় নতুন করে ডিফেন্স তৈরি করে।

মনতলায় আমি তাদের সঙ্গে যোগদান করি। মনতলায় আমাদের প্রধান ঘাঁটি তৈরি করে এবং সেখান থেকে ছোট ছোট রেইড এবং এ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত নেই।

এ সময় পাকিস্তানী সৈন্য মাধবপুর দখল করে তেলিয়াপাড়া পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। তেলিয়াপাড়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তারা রাস্তা তৈরি করে সিলেটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। মাধবপুর এবং তেলিয়াপাড়া হয়ে যে বড় রাস্তা সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত সেই রাস্তায় পাকিস্তানী সৈন্যদের রেইড এবং এ্যামবুশ করাই শ্রেয় মনে করি এবং সেভাবে রেইড ও এ্যামবুশ করতে থাকি। কেননা ঐ রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানী গাড়ী যাতায়াত করতো।

মনতলা থেকে আমি কয়েকবার এ্যামবুশ করি। আমি প্রথম এ্যামবুশ করি ইসলামপুর গ্রামের রাস্তায়। ঐ রাস্তায় মাইন বসিয়ে গাড়ি উড়ানোর চেষ্টা করি এবং তাদের যোগাযোগ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেই। মাইন বসানোর ফলে আমার প্রথম এ্যামবুশে একটা জীপ, একটা ট্রাকসহ মোট ৩০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। আমাদের গুলিতেও প্রায় ২০ জন নিহত হয়। সর্বমোট প্রায় ৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। মনতলায় এটাই আমার সাফল্যজনক এ্যামবুশ। পরেও কয়েকবার এ্যামবুশ করি কিন্তু তত সুবিধা করতে পারিনি।

এরপর মনতলা থেকে তেলিয়াপাড়া যাবার নির্দেশ পাই। আমি মেজর নাসিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তেলিয়াপাড়া চলে যাই। তেলিয়াপাড়া যে কোম্পানীটি ডিফেন্সে ছিল তার ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) মতিনের পরিবর্তে আমাকে দেওয়া হয়। আমাকে আমার প্লাটুনসহ উক্ত কোম্পানীর কমান্ডার নিযুক্ত করে। তেলিয়াপাড়া অবস্থানকালে আমার কোম্পানী নিয়ে আরও একটি এ্যামবুশ করি।

১৬ই মে তেলিয়াপাড়া রাস্তার ৮১ মাইল পোস্টের নিকট উক্ত এ্যামবুশ করি। ঐ এ্যামবুশে দুটি পাকিস্তানী ট্রাক ধ্বংস করতে সক্ষম হই। একটা ট্রাক দখল করি এবং প্রায় ৫০ জন সৈন্য হতাহত হয়।

মে মাসের ১৫ তারিখে পাকিস্তানী সৈন্য তেলিয়াপাড়া আক্রমণ করে। সেখানে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রায় ৪০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। আমাদের শহীদের সংখ্যা ছিল ৫ জন। পাকিস্তানী সৈন্যদের আর্টিলারী ও মর্টার আক্রমণ আমরা তেলিয়াপাড়া থেকে সৈন্য তুলে নিয়ে সিমলা চলে যাই এবং সেখানে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। তেলিয়াপাড়া থেকে সৈন্য তুলে নেয়া সত্ত্বেও তেলিয়াপাড়া সিলেট বড় রাস্তায় আকস্মিক আক্রমণ আমরা অব্যাহত রাখি।

সিমনা থেকে ডেল্টা কোম্পানী আমার অধীনে দেয়া হয় এবং এই ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে আমি শাহবাজপুর মাধবপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করি এবং জুলাই মাস নাগাদ আমি ঐ সমস্ত জায়গায় যুদ্ধ করি।

১৮ই জুলাই পাকিস্তানী সৈন্যরা আমার কোম্পানী এবং ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানীর উপর আক্রমণ করে রাত প্রায় ৪ টার সময়। এক ব্রিগেড পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের দুটি কোম্পানীর উপর আক্রমণ করে। ১৯শে জুলাই বিকেল ৩ টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। এখানে আমরা একটি পাকিস্তানী লঞ্চ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হই। আমার কোম্পানীর ১ জন শহীদ ও একজন আহত হয়। পাকিস্তানী সৈন্যও কয়েকজন নিহত হয়।

২৯শে জুলাই মুকুন্দপুর হরশপুর রেল স্টেশন আমি আমার কোম্পানী নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করি। তখন আমার ঘাঁটি ছিল লক্ষীপুর গ্রামসহ আর ৪টি গ্রাম নিয়ে। মাঝে মাঝেই আমরা মুকুন্দপুর হরশপুর রেলস্টেশনের চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করি। কেননা তখন পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান ছিল মুকুন্দপুর হরশপুর রেল স্টেশনের মাঝে।

লক্ষীপুর ছিল আমার কোম্পানীর মূল ঘাঁটি। এখান থেকে আমার এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়ে আমিরগঞ্জ ব্রিজ ভেঙ্গে দেই। আমিরগঞ্জ ব্রিজে পাকিস্তানী মুজাহিদ বাহিনীর দশজন মুজাহিদকে আক্রমণ করলে তারা পালিয়ে যায়। এবং আমার প্লাটুন, উক্ত ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।

১৩ই সেপ্টেম্বর সিঙ্গারবিল এবং মুকুন্দপুর-এর মাঝখানে এক খানা ট্রেন নষ্ট করে দেই। ট্রেনে ৪ টা বগি ছিল। ইঞ্জিনটা মাটিতে পড়ে যায়। ৪টা বগির প্রায় ৭০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত এবং আহত হয়। উক্ত ট্রেন ধ্বংস করে দেওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুকুন্দপুর থেকে তাদের ঘাঁটি তুলে নেয়।

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উক্ত এলাকা আমাদের দখলে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানী সৈন্য পুনরায় মুকুন্দপুর দখলের চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তারা মুকুন্দপুর রেললাইন মেরামত করে পুনরায় দখল করে নেয়।

২৪ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) ভূঁইয়া তার কোম্পানী নিয়ে ধর্মঘর নামক জায়গায় পাকিস্তানীদের উপর চরম আক্রমণ করেন। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে সাহায্য করার জন্য আমার কোম্পানী ছিল বাঁ দিকে ফ্ল্যাঙ্ক প্রোটেকশনে। ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানী ছিল ডান দিকের ফ্ল্যাঙ্ক প্রোটেকশনে। উক্ত যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের একজন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারসহ দশজন নিহত হয়। আমাদের পক্ষে কোন হতাহত হয়নি।

২রা নভেম্বর ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইন্ডিয়ান আর্মির সহায়তায় বেলুনিয়াতে একটি বড় যুদ্ধের পরিকল্পনা করে এবং ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অনুরোধ করে ১টি কোম্পানী সেখানে পাঠানোর জন্য। অনুরোধ অনুযায়ী আমাকে বেলুনিয়া পাঠান হয়। আমি আমার ডেল্টা কোম্পানী নিয়ে বেলুনিয়ায় রওনা হই এবং বিকেলে পৌঁছি। বেলুনিয়ায় আমি দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগদান করি।

১০ নভেম্বর বেলুনিয়া বাল্জ-এ অবস্থানরত পাকসেনাদের ছত্রভঙ্গ বা বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রথমে আমার কোম্পানী নিয়ে আমি শত্রুপক্ষের ভিতরে অনুপ্রবেশ করে দুইভাগ করে দেই যে তাদের যোগাযোগ বা একত্রিত হওয়া সম্ভব না হয়। আমার কোম্পানীসহ দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪ কোম্পানী এখানে চারদিন অবস্থান করি এবং যুদ্ধ করি। তারা একজন নায়েক শহীদ হন এবং একজন নায়েক সুবেদার আহত হন। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে এবং তৃতীয় দিনে আমাদের উপর পাক বিমানবাহিনী আক্রমণ করে। এতে দুজন মুক্তিসেনা শহীদ হন এবং ১ জন মুক্তিসেনা গুরুতরভাবে আহত হন।

১৫ই নভেম্বর এভাবে অনবরত যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১ ব্যাটালিয়ন ইন্ডিয়ান আর্মি ঢুকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করে এবং তাদের ঘিরে ফেলে। ফলে প্রায় ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ৫০ জন ইন্ডিয়ান আর্মির হাঁতে বন্দী হয়। বেলুনিয়া মুক্ত হয়। বেলুনিয়া মুক্ত হবার পর দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪ কোম্পানীসহ আমার কোম্পানীকে ফেনী পৌঁছে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নিতে আদেশ করা হয়।

প্রথমে আমি আমার কোম্পানী নিয়ে ফেনীর দিকে অগ্রসর হই এবং পরপর দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪ কোম্পানীও পৌঁছে। ২৩শে নভেম্বর এই দিন ফেনী এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পৌঁছে আমরা ডিফেন্স বসাই। ফলে এয়ারপোর্ট থেকে পাক বাহিনী সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

২৬ নভেম্বর আমার কোম্পানী তুলে নিয়ে ২য় বেঙ্গল রেজেমেন্টে যোগদান করার নির্দেশ পাই। ২৮শে নভেম্বর আমি আমার কোম্পানী তুলে নিয়ে আখাউড়ায় রওনা হই। এবং ২৯ নভেম্বর আখাউড়া পৌঁছি। আখাউড়া পৌঁছে দেখতে পাই আমার ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট আখাউড়া অপারেশন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

১লা ডিসেম্বর পুরা ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে রাজাপুর এবং আজম্পুর গ্রামে অবস্থানকারী পাকসেনাদের উপর চরম আঘাত হানি। ১লা ডিসেম্বর থেকে ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচণ্ড মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এখানে শত্রু পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। ২৫ জন খান সেনা আমাদের হাতে বন্দী হয়। এখানে আমাদের লেঃ বদিউজ্জজামান ও একজন নায়েক সুবেদারসহ কয়েকজন শহীদ হন। রাজাপুর এবং আজমপুর আমরা দখল করতে সক্ষম হই।

৬ই ডিসেম্বর আমরা ডেমরার অভিমুখে রওনা হই এবং ১২ই ডিসেম্বর ডেমরা পৌঁছি। ১২ই ডিসেম্বর থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করি।

১৬ই ডিসেম্বর ডেমরা থেকে রওনা হয়ে যখন বালুনদী অতিক্রম করি তখন বিকেল সাড়ে চারটা। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলাম পশু শক্তি বর্বর পাকহানাদার বাহিনীর আত্নসমর্পণের কথা। আত্নসমর্পণের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। হাজার হাজার জনতা জয়োল্লাসে ফেটে পড়ে রাস্তায় রাস্তায়। “জয় বাংলা” আর “জয় মুজিব” স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলে। আমরা সোজা ঢাকার অভিমুখে রওনা দেই। রাস্তায় একইভাবে জনসাধারণ আমাদের স্বাগত জানাতে থাকে এবং বিজয় উল্লাসে মেতে উঠে। রাত ১২ টার সময় আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছি এবং সেখানে অবস্থান করি।

ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীও তখন লোকে লোকারণ্য। সারা রাত ধরে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আনন্দে আকাশে অসংখ্য ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে যে সমস্ত বেঙ্গল রেজেমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও জনসাধারণ অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন তাদের নাম বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হবে, এই কামনাই করি। নয় মাসের যুদ্ধে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাকিস্তান পদাতিক বাহিনীর চরম পরাজয়ে এটাই প্রমানিত হয় যে, বাঙ্গালী সৈনিক, যুবক তথা জনসাধারণ প্রকৃতপক্ষেই সৎ সাহসী, বীর সৈনিক ও রণকৌশলী। এ দেশের আপামর জনসাধারণ একযোগে একবাক্যে সম্মিলিত হয়ে শত বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েও মাতৃভূমিকে হানাদার বর্বর পাক সামরিক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এ স্বাধীনতা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা সমগ্র বাঙালী জাতির স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতাকে রক্ষা করাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

স্বাক্ষরঃ ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মুর্শেদ খান

*১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটিঃ ১৯৭৩ সালে গৃহীত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!