সাক্ষাৎকারঃ মেজর দোস্ত মোহাম্মদ সিকদার*
আমাকে আলফা কোম্পানীতে পোস্টিং করা হলো। কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর নাসিম, যিনি এখন ব্রিগেড কমান্ডার। এখনো তিনিই আমার ব্রিগেড কমান্ডার তাঁর সাথে আমি গেলাম। আমি তাঁর কোম্পানীতে কোম্পানী অফিসার হিসেবে কাজ করতাম। একটা বড় রকমের অপারেশনের জন্য কোম্পানীগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই আমি গিয়ে উপস্থিত হই। ব্রিগেডিয়ার নাসিম আমাকে নিয়ে কয়েক জায়গায় ঘুরোঘুরি করেছেন। আমার সাথে তেমন কোন আলোচনা করেন নাই। তবে কয়েকটা মহড়া দেখেছি তাঁর মধ্যে একটা আমার মনে পড়ে খুব ইন টেলিজেন্স মহড়া, যেটা ইন্ডিয়ায় হয়েছিল। মানুষ কিভাবে চট করে ফক্স হোল তৈরি করে নিজেকে লুকিয়ে রেখে শত্রুপক্ষের সাথে লড়ত, এটা তারই মহড়া। তিনি বললেন, এটা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি তাড়াতাড়ি নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কেননা মাটিতে ট্রেঞ্চ করতে সাধারণত বেশ সময় লাগে কিন্তু ফক্স হোল পদ্ধতি চট করে করা যায়। তাঁরা কয়েকটা সেকশন মিলে একটা প্লাটুন তৈরি করে ছিলেন আমি সেটা বুঝতেই পারিনি। এটাতে নিজেকে আত্নরক্ষা করা যায়। আবার শত্রু পক্ষকে ঘায়েল করা যায়। এসব দেখে আমি এতে যোগদান করি। আমাদের একটা টার্গেট ছিল, ঠিক সেই টার্গেটই আমরা আক্রমণ চালাই। টার্গেট ছিল আগরতলার উত্তর দিকে ধর্মঘর বলে একটা জায়গা ছিল, তারপর বামুটিয়া। এরপর ঠিক জায়গাগুলোর নাম মনে নেই, তবে বামুটিয়া ঐ সব এলাকার কাছাকাছি।
প্রশ্নঃ ওখানে পাকিস্তানী স্ট্রেনথ কত ছিল?
উত্তরঃ ওখানে শুধু নিয়মিত আর্মি ছিলনা, মিক্সড ছিল- রাজাকার মিলে ছিল। সংখ্যা ছিল এক কোম্পানী। মাসটা ছিল অক্টোবরের দিকে। আমাদের প্লানে ছিল যে সেখানে কিছু আর্টিলারী বোমবার্ডমেন্ট পাব। সেকেন্ড বেঙ্গলের আলফা কোম্পানী এবং ডেলটা কোম্পানী এই অপারেশনে অংশ নেয়। আলফা কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন মেজর নাসিম এবং ডেল্টা কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হেলাল মুর্শেদ।
আমরা এদিক থেকে এক কোম্পানী যাই এবং আরেক দিক থেকে ক্যাপ্টেন মুর্শেদ আরেক কোম্পানী নিয়ে এলে একসাথে মিলিত হই। মাঝখানে থেকে ইন্ডিয়ান আর্মি ঢুকে এডভান্স করে। ইতিপূর্বে আর্টিলারী ফায়ার হয়। আমরা পিছনে থাকি। আমরা টার্গেট থেকে ১৫০০ গজ দূরে ছিলাম। মেজর নাসিমের পরামর্শে সেখানে যে টেলিফোন লাইন ছিল সেটি কেটে দেয়া হয়। নিশ্চয় সেটা ঠিক করবার জন্য পাকিস্তানীরা আসবে। ঠিক তাই কয়েকজন পাক সেনা (এক সেকশন মত) রাইফেল নিয়ে এদিকে আসছিল কিন্তু হঠাৎ করেই আমাদের থেকে একজন আনকন্ট্রোল হয়ে ফায়ার করে ফেলে। এটা প্রিম্যাচিউর টার্গেট হয়ে গিয়েছিল। আমরা ৬/৭ জন মারতে পেরেছিলাম আর কিছু আহত হয়েছিল, কেউ কেউ সরে পড়েছিল। সাথে সাথে বোমবার্ডমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। আমরা মারতে চাইনি জীবিত ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা বোমবার্ডমেন্ট লিফট আপ হবার পরে আসতে আসতে ফর্সা হতে লাগলো। ফর্সা হবার পরে আমরা অর্ডার পেলাম আমাদের পুল আউট করতে হবে।
প্রশ্নঃ আপনারা আর চার্জ করেননি?
উত্তরঃ আমরা আর চার্জ করিনি। এটাক করিনি। আমার মনে হয় এটাকিংটা এবানডেন্ট করে ফেললো। কেননা কেউতো বলে না কোন কিছুতে হেরে গেলে। যেহেতু আমরা ছিলাম বাঙ্গালী ফোর্স আর তারা ছিলেন ইন্ডিয়ান ফোর্স, এটা একটা লজ্জার ব্যাপার। আমরা দেখেছি আমাদের পাশ দিয়ে তাঁরা চলে এসেছে। তাতে বোঝা যায় তারা অবজেকটিভ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। আমরা বুঝতে পারলাম, এই অপারেশনে তারা কৃতকার্য হয়নি। তাঁরা যখন চলে যাচ্ছিল আমাদের পাশ দিয়ে তখন বলছিল ভাই এটা তোমাদেরই দেশ। যত রকম ঝুঁকি নেওয়ার তোমরা নাও, আমরা পারবো না- এই বলে চলে যাচ্ছিল। তারা যাবার পর আমরা পুল আউটের অর্ডার পেয়ে আমাদের পুরনো ছাউনি, যেখানে আমরা থাকতাম সেই পঞ্চবটিতে চলে এলাম। এরপর আর কোন অপারেশনে যাইনি। ব্যাটালিয়ন রেইজ করলো। আমি রিক্রুটমেন্টে ব্রিগেডিয়ার নাসিমকে সাহায্য করতাম। ১১ বেঙ্গল রেইজ করলো অর্থাৎ এস ফোর্সকে কমপ্লিট করার জন্য। রেগুলার ব্রিগেড তৈরি হলো।
প্রশ্নঃ আপনি কতোদিন রিক্রুটিং-এ কাজ করেছেন সেখানে?
উত্তরঃ ঠিক দিন মনে পড়বে না, তবে মূর্তিতে যোগদান করার আগ পর্যন্ত কাজ করেছি। সেখানে সেকেন্ড ব্যাচ ট্রেনিং শুরু হয়।
*১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। সাক্ষাৎকারটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক ৮-১০-১৯৭৯ তারিখে গৃহীত।