You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাক্ষাৎকারঃ মেজর শামসুল হুদা বাচ্চু*

১৫ই-১৬ই অক্টোবর আমাকে আগরতলা নিয়ে আসা হয় ‘সি’ সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে। সে সময় সেখানে দুজন অফিসারকে পাই। তার মধ্যে একজন হচ্ছেন বজলুল রশিদ। তিনি পিএমএ-তে ছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি পাকিস্তান থেকে এসেছেন। আগরতলা আসার পর আমাকে ‘সি’ সেক্টরের কাছেই একটা কোম্পানী ছিল সেখানে পাঠানো হলো। সেখান থেকে বর্ডার মাইল দু’য়েক দূরে ছিল। এই কোম্পানীতে পুলিশ, বিডিয়ার সবাই ছিল। তাদের নিয়ে মাঝে মধ্যে বর্ডারে যেতাম। সামনেই একটা ডিফেন্স ছিল। সেখানে থাকা অবস্থায়ই একবার মার্চ করে মাইল পাঁচেক ভিতরে ঢুকেছিলাম কিন্তু বেশী সুবিধা করতে পারিনি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল রেইড করা কিন্তু তা করা সম্ভব হয়নি। কারণ প্রস্তুতি তেমন ছিল না এবং ট্রেনিংও পাকা হয়নি। তখন সেই সময় ব্রিগেডিয়ার নাসিম ১১তম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে তুলেনীবং আমাকে তাঁর রেজিমেণ্টে নিয়ে আসে। এই বেঙ্গলে ট্রেইন্ড লোক অনেক ছিল। মেজর নুরুদ্দিন, মেজর আবুল হোসেন এই বেঙ্গলে ছিলেন। নভেম্বরের শেষের দিকে ১১তম বেঙ্গল যখন পুরপুরি গড়ে উঠে তখন আমরা সেখান থেকে মার্চ করে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা। পুরো এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যসহ হেঁটে যখন আমরা ভৈরব পার হই তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়। সেখানে আহত হয় মেজর নাসিম, ৪জন ভারতীয় লোক, মেজর সাফায়েত জামিল ও ভারতীয় ১জন ক্যাপ্টেন। শত্রুদের সাথে জেনারেল শফিউল্লাহর হাতাহাতি যুদ্ধ হয়েছিল। এই সময়টা ছিল ডিসেম্বরের ৬ কি ৭ তারিখে। সেখানে যে মেজর নাসিম আহত হয়ে ছিলেন তার মূলে ছিল আমাদের একজন অফিসারের ভুল পরিকল্পনা। এরপর আমাদের ব্যাটালিয়নকে টেক অভার করেন মেজর মতিন। টেক ওভার করার পর যখন আমরা আশুগঞ্জ যাই তখন পাকিস্তানীদের সাথে সংঘর্ষ হয়।

পাকিস্তান আর্মিরা সকালবেলা আশুগঞ্জে যে ব্রীজটা ছিল সেটা উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই ইন্ডিয়ান আর্মি মনে করেছিল যে পাকিস্তানীরা আর আশুগঞ্জে নেই, নদীর ওপারে ভৈরবে চলে গেছে। তখন সেখানে ১০ম বিহার ব্যাটালিয়ন ছিল। তারা দেখতে একদম কালো ছিল। তাদের সাথে ছিল ২০তম রাজপুত। আশুগঞ্জে জায়গাটা এমন যে সেখানে ৩টা কি ৪টা তিনতলা দালান ছিল এবং সামনে একমাইল মত জায়গা ছিল একদম ফাঁকা। ভারতীয় আর্মির ধারনা ছিল যে, সেখানে পাকিস্তান আর্মি নেই কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল হয়তো পাকিস্তান আর্মি আছে। কথা ছিল ভারতীয়দের সাথে ১১তম বেঙ্গলের একটা কোম্পানী থাকবে কিন্তু পরে এসে বললো থাক তোমাদের যেতে হবেনা। তবুও আমাকে আমার কোম্পানী নিয়ে শহর থেকে আধ মাইল দূরে একটি উঁচু গ্রাম ছিল, সেখানে বসে থাকার জন্য আমার এডজুটেন্ট লেঃ নাসির বললেন। তখন সেখানে আমার সাথে ছিল ১০ম বিহারের মেজর গাঙ্গুলী (কোম্পানী কমান্ডার)। আমার কোম্পানী নিয়ে আমি সেখানে বসে আছি, তখন দেখি ভারতীয় সৈন্যের দুটি ব্যাটালিয়ন মার্চ করে মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে ছিল ছোট চারটা ট্যাংক। ভারতীয়রা যখন সেই দালানগুলির মাঝামাঝি চলে এসেছিল তখন আমরা ৪/৫ মিনিট গুলির শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাইনি। আমরা বুঝতেই পারছিলাম না যে এই গোলাগুলির আওয়াজ কোথা থেকে হচ্ছে। তারপর দেখলাম ভারতীয় সৈন্যরা খুড়িয়ে খুড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, কাউকে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে, কারো শরীর দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। ৫/১০ জন করে পিছনের দিকে আমরা যেখানে আছি সেই লাইনের দিকে সেই লাইনের দিকে সরে আসছে। সেখানে চারটা ছোট ট্যাংকের মধ্যে দুটো জ্বলে গিয়েছিল এবং দুটো ট্যাংক নিয়ে আসতে সক্ষম হয়ে ছিল ভারতীয়রা। তখন আমাকে ওয়ারলেসে বলা হলো যে তোমার কোম্পানী নিয়ে তুমি তাড়াতাড়ি পিছনে চলে এসো। আমরা যেখানে ছিলাম তার থেকে ২০০ গজ পিছনে আরেকটা উচু জায়গা ছিল এবং তারপর আধ মাইলের মত পরিষ্কার জায়গা এবং তারপরই গ্রাম শুরু হয়ে গেছে। এই সময় দেখি যে পাকিস্তান আর্মি সামনের ঐ জায়গা দিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ তখন পাকিস্তানী আর্মি আমাদের রেঞ্জের ভিতর। তখন আমরা উইড্র করে সামনে আসলাম। এর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে পিছনে ভারতীয় আর্মির যারা বেঁচে ছিল বা যারা চলতে পারে তারা সামনে চলে এসেছে। তখন এখানে এসে আমি জেনারেল শফিউল্লাহকে পেলাম। তিনি একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ভারতীয় আর্মি এত বড় একটা ভুল করে ফেলল যা কল্পনা করা যায় না। আমরা দ্রত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সাথে ভারতীয় সৈন্যরাও আছে। এর মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে এবং আশে পাশে অনেকজন পড়েও গেছে। তখন আমি শফিউল্লাহকে বললাম যে স্যার দৌড় দেন। আমি আর শফিউল্লাহ দৌড়ে ঐ দূরত্বটা পার হই এবং যখন দেখলাম যে গোলাগুলি খুব বেশী শুরু হয়ে গেছে তখন আমরা শুয়ে পড়লাম। ২/১ মিনিট শুয়ে থাকার পর আবার উঠে দৌড়ে যেখান থেকে গ্রাম শুরু হয়েছে সেখানে একটা পুল ছিল সেটা পার হয়ে গ্রামের সীমানার মধ্যে ঢুকে গেলাম। পরে আমরা শুনলাম আমরা প্রথমে যে জায়গায় ছিলাম পাকিস্তান আর্মিরা সে পর্যন্ত এসেছিল আর এগিয়ে যায়নি। তারপর দিন সকাল বেলা অর্ডার এলো তোমরা যাও। কারন আশুগঞ্জ থেকে পাকিস্তানী আর্মিরা চলে গেছে। তারপর আমরা আশুগঞ্জ গেলাম। গিয়ে দেখি ওরা চলে গেছে এবং জিনিসপত্র সব বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পাকিস্তান আর্মিরা সন্ধ্যার পরপরই নদী পার হয়ে ওপারে চলে গিয়েছিল। যে সব ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল তাদের লাশ পাকিস্তানীরা আগেই সরিয়ে ফেলেছিল। তবে সেখানে গিয়ে আমি মেজর মুখার্জীর লাশটা দেখেছিলাম। সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। এর মধ্যে ভৈরবের দিক থেকে শেলিং শুরু হয়ে গেছে। আমাদেরও কিছু আর্টিলারী চলে এসেছে। ইতিমধ্যে মুজিব ব্যাটারীও এসেছে, তারাও অপারেশন করছে। ভারতীয় বাহিনীও এসে গেছে। লেঃ কর্নেল আজিজও তখন এখানে আমাদের সাথে ছিলেন, আরও অনেক অফিসার ছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করে সেদিন সারাদিন প্রচুর ফাঁকা গুলি ও ফুর্তি হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির যারা ভৈরবে ছিল তারা ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সারেন্ডার করেনি। ১৯শে কি ২০শে ডিসেম্বর ভারতীয় জেনারেল গেলেন ভৈরবে, তারপর তারা সারেন্ডার করে। তারপর দুইদিন সময় লাগে পাকিস্তানীদের সরিয়ে জায়গা খালি করতে।

*১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক ১০-১০-১৯৭৯ তারিখে গৃহীত সাক্ষাৎকার।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!