শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩নং সেক্টরের ও ‘এস’ ফোর্সের যুদ্ধ বিবরণ | সাক্ষাৎকারঃ মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ | ——–১৯৭১ |
মনোহরদী অবরোধ- ২১ শে অক্টোবর
অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমাদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়াতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের ছোটখাটো দলকে (ডিটাচমেন্ট) থানা হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল। প্রত্যেক থানা হেডকোয়ার্টারের সৈন্যসংখ্যা এক কোম্পানির কম রাখতে সাহস পেত নাহ। এক কোম্পানী করে সৈন্য প্রত্যেক থানাতে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। কারণ কোন কোন স্থানে সৈন্যসংখ্যা এক ব্যাটালিয়নেরও বেশি রাখতে হত।
২৫শে মার্চ রাতে পাক সেনাবাহিনী পিলখানাস্থ ইপিয়ার ক্যাম্প আক্রমণ করে প্রায় ৭০০ থেকে এক হাজার ইপিয়ার-এর বাঙ্গালী সৈন্যকে জেলখানাতে আটকে রাখে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস পর্যন্ত তাদের উপর নানারকম নির্যাতন চালায় এবং তাদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নেয় যে তারা কখনো পাক সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে না এবং তাদের সুযোগ দেওয়া হবে আনুগত্য প্রমাণ করার জন্য। এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে কিছুসংখ্যক ইপিআর সৈনিকদের পাকিস্তানী সেনাদের নেতৃত্বাধীনে তাদের থানায় থানায় মোতায়েন করা হয়। আমাদের এলাকায় যে সমস্ত জায়গায় তাদের মোতায়েন করা হয়েছিল সেসব জায়গা হল রায়পুরা, নরসিংদী, শিবপুর, মনোহরদী, কাপাসিয়া ওঁ কালীগঞ্জ ইত্যাদ। এসব জায়গাতে ইপিআর এবং পাক বাহিনীর লোকদের প্রায় সমান সমান ছিল। আমরা যেসব গেরিলা বেইস তৈরি করেছিলাম তারা প্রায় সবাই ইপিআর এর বাঙ্গালী সৈনিকদের সাথে যোগাযোগ করে ই-পি-আর এর সৈনিকদের আমাদের সাথে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে বললে তারা বলে যে তারা সংখ্যায় খুব কম। বেশিরভাগ এখনো জেলে আছে। তারা যদি পাকবাহিনীর কাছে আনুগত্য প্রমাণ করতে পারে তাহলে বাকী সৈনিকদেরও ছেড়ে দেওয়া হবে। এখন যদি তারা গেরিলাদের সাথে যোগ দেয়,তাহলে যে সমস্ত ইপিআর-এর লোক জেলে আছে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। এমতাবস্থায় পাক সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছেড়ে আসার সময় এখনো হয়নি। তবে সময় আসলে তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে থাকবে বলে নিশ্চয়তা দেয়।
মনোহরদীতেও ছিল অনুরূপ এক ক্যাম্প। সেখানে পাকসেনাদের সংখ্যা ছিল ৩৬ জন এবং প্রাত্তন ই-পিআর-এর লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ জন। ২১শে অক্টোবরের আগে থেকেই আমাদের গেরিলা বেইস যেটা মনোহরদীতে ছিল তাদের সাথে যোগসূত্র কায়েম হয় এবং এই প্রতিশ্রুতি নেয়া হয় যে যখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ করবে তখন তারা আমাদের সাথে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়বে। ২১ শে অক্টোবর হাবিলদার আকমল প্রায় এক কোম্পানি গেরিলা নিয়ে মনোহরদীতে পাকিস্তানী বেইস অবরোধ করে। এই অবরোধের সময় ইপিআর- এর যেসব লোক পাকিস্তানীদের সাথে ছিল তারা হাবিলদার আকমলের পক্ষে চলে আসে এবং যুদ্ধ শুরু হয়।
এ যুদ্ধ প্রায় কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হয়। অবশেষে পাকবাহিনীর প্রায় ২৫ জনের মত সৈনিক মারা যায়। বাকী ১১ জন আমাদের সৈনিকদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সৈন্যদের বেঁধে আমার হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবার সময় পথিমধ্যে ক্রুদ্ধ জনতা অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং মাত্র ৪ জনকে আমারা হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এ যুদ্ধে হাবিলদার আকমলের কার্যাবলী অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এ যুদ্ধে এটাই প্রমাণিত হয়েছিল যে,বাঙ্গালীরা যে যেখানেই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো।
এ সমস্ত উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছাড়া আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন আমার সৈনিকরা সাফল্যজনকভাবে সমাধান করেছে। তার সংখ্যা এত বেশি যেসব বর্ণনা করা সম্ভব নয়। জুলাই মাসের ৭/৮ তারিখে মুজিব নগরে সেক্টর কমান্ডারদের যে কনফারেন্স হয়েছিল সে কনফারেন্সে-এ তদানীন্তন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর প্রধান যেসব নির্দেশাবলী আমাদের দিয়েছিলেন সেগুলো আমরা যথাযথ ভাবে পালন করতে সক্ষম হই। তা নিদর্শন নিম্নে দেয়া হলঃ
গেরিলা তৎপরতা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটি তৈরি করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সে পরিপ্রেক্ষিতে আমার নিয়ন্ত্রাণাদিন এলাকার মধ্যে যে গেরিলা ঘাঁটি ছিল সেগুলো হলোঃ ১। সিলেটের চুনারুঘাট,হবিগঞ্জ এবং বানিয়াচং,২। ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমাতে নাসিরবগর,সরাইল,মুকুন্দপুর এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ৩। কুমিল্লাতে নবীনগর থানা, ৪। ঢাকা জেলায় রায়পুর, শিবপুর, নরসিংদী, কাপাসিয়া, কালিয়াকৈর, মনোহরদী, জয়দেবপুর এবং কালীগঞ্জ, ৫। ময়মনসিংহে গফরগাঁও এবং ভালুকা, ৬। কিশোরগঞ্জ মহকুমাতে কিশোরগঞ্জ, কুলিয়ার চর, বাজিতপুর, কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া এবং হোসেনপুর।
এই ঘাঁটিগুলোর প্রায় সবগুলোতে কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর লোক ছিল এবং বাকি সব ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা ছিল। এই সমস্ত ঘাঁটিগুলোর সাথে হেডকোর্টারের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য লোক (রানার) নিয়োগ করা হয়েছিল। এ সমস্ত ‘রানার’ ছাড়াও রায়পুরা এবং মনোহরদীতে অবস্থিত দুটো ওয়ারলেস সেট-এর মাধ্যমে হেডকোর্টারের খবরাখবর দেওয়া হত।
প্রত্যেকটি গেরিলা বেইস-এ দু’জন করে রাজনীতিক উপদেষ্টা ছিল, যারা গেরিলাদের রাজনীতিক নির্দেশাবলী দিত। এই রাজনীতিক উপদেষ্টারা প্রত্যেক মাসেই আমার হেডকোর্টারে এসে যোগাযোগ করত। ভিতরে অবস্থিত ঘাঁটিগুলোর গেরিলা এবং নিয়মিত বাহিনীর বেতন-ভাতা রাজনীতিক উপদেষ্টা এবং ঘাঁটির কমান্ডারদের মাধ্যমে পাঠানো হত। তারা প্রতি মাসে এসে বিল দিয়ে যেত এবং পরের মাসে টাকা নিয়ে যেত।
আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের গেরিলা তৎপরতা এত তীব্র এবং ব্যাপক হয়ে উঠেছিল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকেরা ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চলফেরা করতে সাহস পেত না। যে সকল স্থানে তাদের ঘাঁটি ছিল সে সমস্ত ঘাঁটির চারিদিকে বাঙ্গালী রাজাকার দিয়ে প্রথম এবং দ্বিতীয় বেষ্টনী তৈরি করে রাখতো যাতে ঘাঁটি আক্রান্ত হলে প্রথমেই বাঙ্গালীদের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয় এবং তারা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। এতে বোঝা যায় যে, পাক সেনাবাহিনী মনোবল বেশ ভেঙ্গে পড়েছিল। তারা এমন ভীত সস্ত্রস্ত ছিল যে, ওসব ঘাঁটির নিকটবর্তী এলাকার কোন প্রকার আওয়াজ বা শব্দ শুনলেই তারা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে চিৎকার করে বলে উঠত’মুক্তি আগেয়া’।
গারি, ট্রেন,ষ্টীমার এবং লঞ্চ চলাচল এক রকম বন্ধই ছিল। হাট-বাজার,স্কুল-কলেজ স্বাভাবিক আকারে কখনো আসতে পারেনি। এমনকি বড় বড় শহরে,যেখানে পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল সেখানেও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ছিল নাহ বললেই চলে। অপরপক্ষে যেসব এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল সেখানে জীবনযাত্রায় কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি।
আগস্ট মাসের শেষের দিকে মুজিব নগর হেডকোয়ার্টার থেকে আমার কাছে এক নির্দেশ এসেছিল যে গেরিলা বাহিনীর সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলার জন্য যেন প্রস্তুত হই। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম তারিখে আমি আমার সেক্টরকে ( ৩নং সেক্টরকে )তিন ভাবে ভাগ করি এবং আমার বাহিনীকে পুনর্গঠিত করি। ৩নং সেক্টরে যেসব লোক ছিল তাদের দ্বারাই এটা করা হয়। ৩নং সেক্টরে,২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই দুই বাহিনীতে পরিনত করা হয়।
একটি হল ৩নং সেক্টর বাহিনী যা দশটি কোম্পানী দ্বারা গঠিত। সেক্টর হেডকোয়ার্টার থাকে হেজামারাতে,আর একটি ‘এস’ ফোর্স হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় ফটিকছড়াতে। এই ‘এস’ ফোর্স হেডকোয়ার্টারের অধীনে ২ এবং ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল।
এসব হেডকোয়ার্টার এবং ব্যাটালিয়নে নিম্নলিখিত অফিসাররা ছিলঃ
১। ‘এস’ ফোর্স হেডকোয়ার্টারঃ কমান্ডার-লেঃ কর্নেল সফিউল্লাহ। খ)বি,এম (বিগ্রেড মেজর)-ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান গ) ডি,কিউ- ক্যাপ্টেন আবুল হোসেন। ঘ) সিগন্যাল অফিসার- ফ্লাইট লেঃ রউফ।
২। ২ ইষ্ট বেঙ্গলঃ ক) কমান্ডিং অফিসার- মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। খ) কোম্পানি কমান্ডারগন হলেনঃ এ কোম্পানি- মেজর মতিউর রহমান এবং লেঃ আনিসুল হাসান, বি কোম্পানি-লেঃ বদিউজ্জামান এবং লেঃ সেলিম মোঃ কামরুল হাসান, সি কম্পানি-লেঃ মোহাম্মদ ইব্রাহীম, ডি কোম্পানি-লেঃ গোলাম হেলাল মোরশেদ। গ) এডজুট্যান্ট-লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ সাঈদ। ঘ) মেডিক্যাল অফিসার- লেফটেন্যান্ট আবুল হোসেন।
৩। ১১ ইষ্ট বেঙ্গলঃ ক) কমান্ডিং অফিসার-মেজর মোহাম্মদ নাসিম। খ) কোম্পানি কমান্ডারগণঃ বি কোম্পানি-মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া এবং লেঃ আবুল হোসেন, ডি কোম্পানি-লেফটেন্যান্ট নাসের, সি কোম্পানি-লেফটেন্যান্ট নজরুল ইস্লাম, এ কোম্পানি- লেফটেন্যান্ট শামসুল হুদা বাচ্চু।গ) এডজুট্যান্ট- লেফটেন্যান্ট কবির। ঘ) মেডিক্যাল অফিসার- মইনুল হোসেন।
৪। ৩নং সেক্টরঃ ক) কমান্দার-মেজর নুরুজ্জামান খ) সিভিলিয়ান স্টাফ অফিসার-নুরুউদ্দিন মাহমুদ ও এম,এ,মহী। গ) কোম্পানি কমান্ডারগণ হলেনঃ মেজর মতিন,ক্যাপ্টেন এজাজা আহমদ চৌধুরী,লেঃ সাদেক,লেঃ মজুমদার, লেঃ জাহাঙ্গীর (এরা প্রত্যেকে দুটো করে কোম্পানি পরিচালনা করত)। অ্যাসিস্ট্যান্ট সিভিলিয়ান অফিসার-আলকাস মিয়া এবং আশেক হোসেন।
৩ নং সেক্টরকে আমি ‘এস’ ফোর্স- থেকে পৃথক করে দেই যাতে তারা সীমান্ত এলাকায় বহাল রাখতে পারে। ‘এস’ ফোর্স- কে পৃথক জায়গায় নিয়ে যাই যাতে তারা কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার- এর জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও যেহেতু ব্যাটালিয়নে লোকসংখ্যা কম ছিল সেহেতু তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য নতুন করে লোক নিয়োগ করা দরকার ছিল। এ ব্যাটালিয়নগুলোর শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমি ১২০০ নতুন লোক ভর্তি করি। এ ভর্তি শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত তাদের ‘নিয়মিত’ যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এই ট্রেনিং-এর সময় আমাকে ২ ইষ্ট বেঙ্গল থেকে এক কোম্পানি সৈন্য পাঠাতে হয়েছিল বেলুনিয়ার যুদ্ধে ১০ ইষ্ট বেঙ্গলের সাথে ২ নং সেক্টরে যুদ্ধ করার জন্য। নভেম্বর মাসের ২১/২২ তারিখের দিকে এই যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এবং বেলুনিয়া সেক্টর আমাদের হস্তগত হবার পর নভেম্বর মাসের ২৮ তারিখে আমি তাদেরকে আমার এলাকায় ফিরিয়ে আনি এবং আখাউড়া আক্রমণের পরিকল্পনা নেই।
‘আখাউড়া যুদ্ধের’ জন্য আমি দুই ব্যাটালিয়ন সৈনিক নিয়োগ করেছিলাম। এক ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ ১১ ইষ্ট বেঙ্গলকে (এই ব্যাটালিয়ন-এর সৈনিকদের ১৫৭ জন ব্যতীত সবই নতুন ছিল) এ ভার দেওয়া হয় যে, তারা যেন পাকিস্তানী কোন সৈনিককে সিলেটের দিক থেকে অগ্রসর হতে না দেয়। আর ২ ইষ্ট বেঙ্গলকে এ কাজ দেওয়া হয় তারা যেন সিংগারবিল থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সমস্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করে। এ দু ব্যাটালিয়ন সৈন্য ছাড়াও আমি ৩নং সেক্টর থেকে দু কোম্পানি সৈন্য মোতায়েন করি যাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা আগরতলা বিমানবন্দরের দিক থেকে আক্রমণ করে ২য় ইষ্ট বেঙ্গলের কোন ক্ষতি না করতে পারে।
এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হয় ৩০ শে নভেম্বর/১লা ডিসেম্বর রাতে.৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত আমার সৈন্যগণ এভাবে মোতায়েন করা হয়:
১১ ইষ্ট বেঙ্গল,মুকুন্দপুর,হরশপুর এলাকাগুলো তাদের নিয়ন্ত্রাধীনে আনে। এ ব্যাটালিয়নে নেতৃত্ব দেন মেজর নাসিম(বর্তমানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)।
তিন নং সেক্টরে যে দুটো কোম্পানি নিয়োগ করা হয়েছিল তারা আগরতলা বিমানবন্দরের উত্তর পশ্চিমাংশে খনন করে তাদের অবস্থা শক্তিশালী করে। এ কোম্পানি দুটোর নেতৃত্ব দেন মেজর মতিন।
দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রমণের জন্য তাদের স্টার্ট লাইনে তৈরি। এ ব্যাটালিয়নে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হলেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এবং কোম্পানি কমান্ডারের মধ্যে ছিলেন-এ কম্পানি-মেজর মতিয়র, বি কোম্পানি-লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান,সি কোম্পানি- লেফটেন্যান্ট ইব্রাহীম, ডি কোম্পানি লেফটেন্যান্ট মোরশেদ।
আক্রমণের সময় ছিল রাত ১টা। ১লা ডিসেম্বরের সকাল ৬ টা পর্যন্ত ব্যাটালিয়ন যুদ্ধ করে আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনের উত্তরাংশ পর্যন্ত দখল করে। বেলা প্রায় তিনটা পর্যন্ত আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন এবং তার দক্ষিণাংশ আমাদের হস্তগত হয়। ১লা/২রা ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আজমপুর অবস্থানরত আমাদের সৈনিকদের উপর আক্রমণ চালায় এবং এতে আমাদের সৈনিকদের পিছু আসতে বাধ্য হয়। ২রা ডিসেম্বর পুনরায় আক্রমণ চালিয়ে রেলওয়ে স্টেশন আমরা পুনর্দখল করি। কিন্ত রেলওয়ে স্টেশনের সম্মুখভাবে পাকিস্তানীদের বাঙ্কার এতো মজবুত ছিল যে সম্পূর্ণ এলাকা স্বল্পসংখ্যক সৈন্য এবং স্বল্প পরিমান ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দখল খুবই কষ্টকর ছিল। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার ৪ ঠা ডিসেম্বর ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে আমাদের সাথে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়াতে দক্ষিন এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে আখাউড়াকে অবরোধ করে। অবশেষে পাক বাহিনী ৫ই ডিসেম্বর আখাউড়াতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে আমাদের যে সব সৈনিক শহীদ হয়েছেন তারা হলেন ১। নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী খান। ২। সিপাহী আমীর হোসেন। ৩। লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান। ৪। সিপাহী রুহুল আমীন। ৫। সিপাহী শাহাব উদ্দিন। ৬। সিপাহী মুস্তাফিজুর রহমান। আখাউড়া পতনের পর কিছুসংখ্যক সৈন্য ব্রাক্ষণবাড়ীয়াতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পলায়নের সময় বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্য আমাদের হাতে নিহত হয় এবং ধরা পড়ে।
এরপর ব্রাক্ষণবাড়ীয়াকে অতি সত্বর আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ আক্রমণ ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার দুই দিক থেকে পরিচালিত হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একদিক হল ব্রাক্ষণবাড়ীয়াকে দক্ষিন দিক থেকে ব্রাক্ষণবাড়ীয়া শহর এবং অপরদিক হল উত্তর দিক থেকে সিলেট সড়ক দিয়ে ব্রাক্ষণবাড়ীয়া শহর পর্যন্ত। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়া ব্রাক্ষণবাড়ীয়া রেললাইন এবং উজানিস্যা ব্রাক্ষণবাড়ীয়া সড়ক দিয়ে অগ্রসর হবে এবং আমার এস ফোর্স সিলেট ব্রাক্ষণবাড়ীয়া সড়ক দিয়ে অগ্রসর হবে। ৫ই ডিসেম্বর আমি আমার ফোর্সকে নিম্নলখিত নির্দেশ দেইঃ
৫ই ডিসেম্বর রাতে আমাদের যাত্রা শুরু হবে এবং বাহিনীর সামনে থাকবে ১১ ইষ্ট বেঙ্গল। আর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল তাদের অনুসরণ করবে। তিন নং সেক্টরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে সে যেন তার সেক্টর কোম্পানি নিয়ে তেলিপাড়া ও মনতলা দখল করে নেয়। তাদের (১১ ইষ্ট বেঙ্গলকে)যে কাজ দেওয়া হয়েছিল তা হল চান্দুরার উত্তরাংশে একটি রোড ব্লক তৈরি করা যাতে সিলেট থেকে পশ্চাদপসারণকারীরা এ রাস্তায় না আসতে পারে। দ্বিতীয় কাজ হলো চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করা। এ নির্দেশ পালনের জন্য ব্যাটালিয়ান কমান্ডার নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেনঃ
তিনি এক কোম্পানি সৈন্য মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে চান্দুরার উত্তরাংশে রোড ব্লাক তৈরি করার জন্য পাঠিয়ে দেন এবং বাকী ব্যাটালিয়নকে চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে অগ্রসর হবার আদেশ দেন। এ ব্যাটালিয়ন হরশপুর দিয়ে চান্দুরার দিকে অগ্রসর হয়। মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়ার যে কোম্পানিকে চান্দুরার উত্তরাংশে রোড ব্লক তৈরি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সে কোম্পানি রোড ব্লক তৈরি করে খবর পাঠায়। তখন ব্যাটালিয়নের বাকী সব লোক চান্দুরার নিকটবর্তী এলাকা পাইকপাড়াতে ছিল। রোড ব্লক তৈরির খবর পাবার পর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর নাসিম ব্যাটালিয়ন এর বাকী সবাইকে চান্দুরা হয়ে শাহবাজপুর সরাইল এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হবার জন্য আদেশ দেন।
বেলা তখন প্রায় ১২টা। অপারেশনের অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করার জন্য আমিও তখন পাইকপাড়াতে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে পৌঁছি। আমার সাথে ছিল আমার রানার। এই প্রায় এক হাজার গজ পেছনে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার এ কোম্পানিকে অনুসরণ করছিল। আমিও ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের সাথে সাথে অগ্রসর হই। চান্দুরাতে যে পর্যন্ত পাকিস্তানী সৈন্য ছিল তারা পশ্চাদপসরণ করে শাহবাজপুরে আস্তানা তৈরি করে। ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে আমি নির্দেশ দেই যে যতো শীঘ্র সম্ভব শাহাবাজপুরে তিতাস নদীর উপরস্থ পুল দখল করতে,যাতে শত্রু সৈন্যরা সেটা ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের অগ্রগতি রোধ করতে না পারে। তাই অগ্রসরমান কোম্পানি দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে আমিও আমার রানারসহ ৮ জন লোক ছিলাম।
এই হেডকোয়ার্টার যখন ইসলামপুরের নিকট পৌঁছে তখন পেছন থেকে একখান ট্রাক আসতে দেখা যায়। ট্রাকখানা যে রঙ্গের ছিল সে রকম একখান গাড়ী ১১ ইষ্ট বেঙ্গলেরও ছিল। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার গাড়ীখানা দূর থেকে দেখে আমাকে বলে ‘স্যার তেলিয়াপাড়া নিশ্চয়ই আমাদের হস্তগত হয়েছে এবং আমার গাড়ীও চলে আসছে। ’এখানে বলে রাখা দরকার যে গাড়ী একমাত্র তেলিয়াপাড়া হয়ে আসতে পারতো। আমাদের গাড়ী ছাড়া অন্য কোন গাড়ী আসতে পারবে বলে বিশ্বাস ছিল নাহ। কেননা চান্দুরা এবং মাধবপুরের মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের রোড ব্লক ছিল,যার কমান্ডার ছিল মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া। গাড়ী আমাদের কাছে আসতেই ড্রাইভারকে ইশারা দিয়ে আসতে বলা হয় এবং গাড়ী থেমে যায়। আশ্চর্যের বিষয় যে গাড়ী আমাদের ছিল না। সে গাড়ীতে পাকিস্তানী সৈন্য বোঝাই ছিল। তারা তেলিয়াপাড়া থেকে পশ্চাদপসরণ করে আসছিল। গাড়ীতে পাকিস্তানী সৈন্য দেখে তাদের আত্মসমর্পণ এর নির্দেশ দেই। দু’চারজন অস্ত্র রেখে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায় এবং তার মধ্য থেকে দুই একজন আমাদের সংখ্যা কম দেখে গুলাগুলি শুরু করে এবং গাড়ীর চারিদিকে লাফিয়ে পড়ে। গাড়ীর সামনের সিটে বসা ছিল একজন সুবেদার। সেও গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। বাকি সৈন্যরা গাড়ী থেকে নেমে রাস্তার অপর পাশে চলে যায়। এসব সৈনিকদের অধিকাংশ ছিল পাঠান এবং মিলিশিয়া পোশাক পরিহিত।
আমরা ইসলামপুরের যে স্থানে ছিলাম সেখানে থেকে এক হাজার গজ দূরে শাহবাজপরের দিকে ছিল এক কোম্পানি সৈন্য। এবং আমাদের প্রায় মাইলখানেক পিছনে পাইকপাড়া থেকে ক্রস কানট্রি হয়ে চান্দুরার দিকে অগ্রসরমান বাকী সৈন্য। গাড়ীর দক্ষিন পার্শে এবং পেছনে আমাদের লোক অস্ত্র উঠিয়ে ছিল। গাড়ীর উত্তর পাশ দিয়ে লাফিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামের দিকে পালিয়ে যায় এবং সেখানে গুলাগুলি ছোড়ে। সুবেদার সামনের সিটে দক্ষিন পার্শে বসা ছিল। সে গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। সুবেদার এর কাছে ছিল পিস্তল। আমার কাছেও ছিল পিস্তল। দুইজনের পিস্তল ছিল ‘পাউচ’এর মধ্যে। আমার এসএমজিটা আমার রানারের কাছে। রানার ছিল আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। সুবেদার এবং আমার মাঝে ধস্তাধস্তি প্রচণ্ড। কেউ কারোর পিস্তল বের করার সুযোগ পাচ্ছিলাম নাহ। ইতিমধ্যে আমার রানার কয়েকবার সুবেদারকে লক্ষ্য করে গুলি করতে চেয়েছিল। হটাৎ আমার রানারের পায়ে গুলি লাগে এবং সে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে গুলি করার চেষ্টা করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে মেজর নাসিমও গুলিবদ্ধ হয় এবং আহত হয়ে পড়ে যায়। আমি অবশেষে জুডো কায়দায় তার বেষ্টনী থেকে মুক্তি পাই এবং আমি জোরের সাথে তার মুখের চোয়ালে এক ঘুষি মারি। তাতে সে পড়ে যায় এবং গিয়ে আমার রানারকে ধরে ফেলে এবং স্টেন দিয়েই আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তার এবং আমার মাঝে ব্যবধান ছিল মাত্র খুব বেশি হলে এক গজ। গুলি যে বেরিয়ে গেছে সেটা আমি দেখেছি কিন্ত কোথায় লেগেছে তা লক্ষ্য করিনি।
সে সময় আমাদের ‘একজন সৈন্য সেখানে রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি তার কাছ থেকে রাইফেলটা নিয়ে সে সুবেদারের মাথায় বাড়ি দেই। সুবেদার মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আমি রাইফেল দিয়ে তার মাথায় কয়েকবার আঘাত করেছিলাম। সে সময় আমাদের কোন সৈন্যই অবস্থানে ছিল না। তাদের সবার অবর্তমানে। ঐ সুবেদারকে মেরেছিলাম। আমরা যখন ধস্তাধস্তি, গোলাগুলিতে ব্যস্ত ছিলাম তখন আমাদের সম্মুখে যে কোম্পানি অগ্রসর হচ্ছিল তারা পেছনের দিকে আসে এবং যারা পেছন থেকে আসে তারাও সম্মুখে অগ্রসর হ। ঠিক এ সময় আমি দেখি যে আর একখান গাড়ী পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা একটা বাস ছিল। সে বাস থেকে অবতরণ করছিল পাকিস্তানী সৈন্য। আমি তা দেখে রাইফেল উঁচিয়ে তাদের উপর গুলি করার প্রস্তুতি নেই। কিন্তু দেখলাম যে রাইফেলটা ভেঙ্গে গেছে। রাইফেলটা ছুড়ে ফেলে আমি চিৎকার করে বলি আমার স্টেন কোথায়? এবং সাথে সাথে পিস্তল বের করি। পিস্তল বের করে দেখি সেটাও বিকল হয়ে গেছে। তখন বুঝতে পারলাম সুবেদার যখন আমাকে এসএমজি দিয়ে গুলি করেছিল তা পিস্তলে লেগেছিল। পিস্তলে দুটো গুলির আঘাত বিদ্যমান ছিল। পিস্তলটাকে আমি আবার পাউচ-এর ভিতর রেখে কোন উপায় না দেখে এক ডোবার ভিতর লাফিয়ে পড়ি। আমার পরনে ছিল অলিভ গ্রীন পোশাক। ডোবায় ছিল কাদা। অলিভ গ্রীন আর কাদা মিলে দেখতে প্রায় মিলিশিয়া পোশাকের মতোই হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন দেখছিলাম যে গাড়ী থেকে প্রায় ২০/২৫ জন লোক নেমে ঐ গ্রামের চারদিকে অবস্থান নিচ্ছে। আমি যে ডাবার মাঝে ছিলাম তা তারা দেখেছিল। বুঝতে পারলাম যে কোন মুহূর্তে তারা আমাকে গুলি করবে। ভাবছিলাম কাদাপূর্ণ ডোবার ভিতর মরার চেয়ে আর একবার চেষ্টা করে দেখা যাক। তাই আমি ডোবার মধ্য থেকে উঠেই তাদের মধ্য দিয়েই চলে যাই এবং এক বাড়িতে ঢুকে পড়ি। ঐ বাড়িতে একটা খোলা ঘরের ভিতরে ঢুকে সেখানে বসে পড়ি এবং মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। কারণ সে বাড়ির চারিদিকেই পাকিস্তানী সৈন্য মোতায়েন ছিল। আমি যখন ঘরের ভিতর বসেছিলাম তখন আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানী বাহিনীর দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। বেলা তখন প্রায় ৪টা।
এ আক্রমণে পাকিস্তানী সৈন্যদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পিছনে হটতে থাকে। পশ্চাদপসরণকালে সবাই ধরা পড়ে। এ খন্ডযুদ্ধে পাকিস্তানীদের ২৫ জন মারা যায় এবং ঐ দিন ১১ জনকে জীবিত অবস্থায় ধরা হয়। পরের দিন আরও তিনজনকে ধরা হয়। আমাদের দুইজন শহীদ হয় এবং ১১ জন আহত হয়। এই খন্ডযুদ্ধে যারা সাহসের পরিচয় দিয়েছিল তারা হলঃ ১। লেফটেন্যান্ট নজরুল ইসলাম। ২। নায়েক মুস্তফা আলী। ৩। হাবিলদার আবুল কালাম। ৪। হাবিলদার রফিক (শহীদ)।
এ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন হাবিলদার রফিক এবং সিপাহী মুজিবর রহমান। আমাদের ডাক্তার লেফটেন্যান্ট মইনুল ইসলাম আহত হন। তাই আহতদের পাকিস্তানী ট্রাকে (আমাদের দ্বারা দখলকৃত) করে চান্দুরার দিকে নিয়ে যাই। সাথে কোন ড্রাইভার না থাকায় আমি নিজে গাড়ী চালিয়ে চান্দুরার দিকে নিয়ে যাই।এ ঘটনা এতো অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছিল যে, পেছনে থেকে যারা অগ্রসর হচ্ছিল তারা ঘটনাস্থলে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারেনি। আমি যখন গাড়ী চালিয়ে চান্দুরার দিকে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের লোক মনে করেছিল যে শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে। তখন তারা আমাদের উপর মেশিন গান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। আল্লাহ অপার করুণায় তাদের মধ্যে কেউ হয়ত আমাকে চিনতে পারে এবং গুলিবর্ষণ বন্ধ করে। আমি কোম্পানি লোকদের ভিতর দিয়ে গাড়ী যখন চান্দুরার দিকে যাচ্ছিলাম তখন পেছনের সর্বশেষ যে কোম্পানি (আমাদের) ছিল তারা ভেবেছিল যে শত্রু এই কোম্পানির হাত থেকেই রক্ষা পেতে সক্ষম হয়েছে।তাই তারাও আমার উপর বেপ্রোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে।এতে গাড়ীর উইন্ড স্ক্রীন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। কিন্ত এবার খোদার অসীম কৃপায় পূর্বের মতো বেঁচে যাই। তারপর চান্দুরায় পৌঁছে আহতদের চিকিৎসা ব্যবস্থা করি। যেহেতু সবাই গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল,তাই খুব দ্রুত তাদের হাসপাতালে পৌঁছাবার ব্যবস্থা নেই। সবাইকে স্ট্রেচারে করে আগরতলা পাঠিয়ে দেই।
ব্যাটালিয়ন কমান্ডার নাসিম এ খন্ডযুদ্ধে আহত হন। তার পরবর্তী সিনিয়র সুবেদ আলী ভূঁইয়ার উপর থেকে আমার আস্থা চলে গিয়েছিল এজন্য যে, সে রোড ব্লক করা সত্তেও কিভাবে শত্রুরা আমাদের পেছনে চলে আসলো? আমার রিয়ার হেড কোয়ার্টার এর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না।কারন এ যুদ্ধে অয়ারলেসটাও নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমি অন্য কোন অফিসার এনে এ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার পদে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এ ব্যাটালিয়ন শতকরা ৮০জন সৈনিক ছিল নতুন শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং এটাই ছিল খন্ডযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের প্রথম অপারেশন। যুদ্ধে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আহত হওয়াতে সৈনিকদের মনোবল একটু দমে যায়। আমি আবার পাইকপাড়ার দিকে ফিরে আসার সময় লে. নাসিমকে ব্যাটালিয়ন নিয়ন্ত্রনে রাখতে নির্দেশ দিয়ে আসি এবং তাঁকে এও বলে আসি যে আমি অফিসার নিয়ে আসছি। পাইকপাড়ায় পৌঁছে আমি সিদ্ধান্ত নেই যে যতো শীঘ্র হোক আমাকে পেছনে যেতে হবে এবং সেখান থেকে অফিসার আনতে হবে। আমি পেছনে না গেলে হয়তো অন্য কোন অফিসারকে আনা সম্ভব নয়। কারণ তারা কোন না কোন কমান্ড-এ আছে। এই অসুবিধার জন্য আমি সেদিন রাতেই রিয়ার হেডকোয়ার্টারে চলে যাই এবং সেক্টর কোম্পানী কমান্ডার মেজর মতিনকে এবং আমার বিএম ক্যাপ্টেন আজিজকে এই ব্যাটালিয়নে যোগ দিতে নির্দেশ দেই। মেজর মতিনকে ব্যাটালিয়নের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করি।
৭ই ডিসেম্বর সকালে এ দুইজন অফিসার নিয়ে আমি পাইকপাড়া ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারের উদ্দেশ্য যাত্রা করি এবং বেলা প্রায় দুটোর দিকে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে পৌঁছি।
মেজর মতিনকে নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার নিয়োগ করে তাকে ব্যাটালিয়নের ভার গ্রহণ করতে বলি
এবং আমাদের অগ্রগতি যেন রোধ না হয় সে জন্য সামনে অগ্রসর হবার জন্য নির্দেশ দেই।বলা বাহুল্য, ৬ই ডিসেম্বর আমরা ইসলামপুরের খন্ডযুদ্ধে লিপ্ত থাকাতে শাহবাজপুরের তিতাস নদীর উপর সময় মতো দখল না পারায় পাকবাহিনী সে পুলটি ভেঙ্গে দেয়।
পুলটি ভেঙ্গে যাওয়াতে নদীর ওপারে পাকিস্তানী সৈন্যসংখ্যা কি পরিমান ছিল তা না জেনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে আমি শিগগির পাক বাহিনীর আস্তানা সম্বন্ধে খবর নেওয়ার নির্দেশ দেই।ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ব্যাটালিয়নে একেবারে নতুন এবং পৌঁছেছিল প্রায় বিকেলের দিকে। তাই তাকেও খবরাখবর নেওয়ার জন্য একটু সময় দিতে হয়েছিল। ৭ই ডিসেম্বর রাতে এক কোম্পানী সৈন্য শাহবাজপুরের দিকে পাঠানো হয় এবং রাতের মধ্যেই যখন খবর পাওয়া গেল যে সেখানে সৈন্যসংখ্যা কম তখন সে কোম্পানী নদীর অপর পার দখল করে নেয়। এ সংবাদ পাওয়া গেল ৮ই ডিসেম্বর সকালে। খবর পাবার সাথে সাথেই ব্যাটালিয়নের বাকী কোম্পানী শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়।
যে কোম্পানী ৭/৮ ডিসেম্বর রাতে শাহবাজপুর দখল করেছিল তার অধিনায়ক ছিল মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া। আমি ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে নির্দেশ দেই,মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া যেন তার কোম্পানী নিয়ে সরাইলের দিকে অগ্রসর হয়। কোম্পানী সরাইল পর্যন্ত পাকিস্তানীদের কোন বাঁধা পায়নি।আমার এস ফোর্সের অগ্রভাগ যখন সরাইলে পৌঁছে তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে পৌঁছে গিয়েছিল। ব্রাক্ষণবাড়িয়া শত্রু না থাকাতে কোন যুদ্ধ হয়নি। পাকবাহিনী ব্রাক্ষণবাড়িয়া এবং সরাইল ত্যাগ করে আশুগঞ্জ এবং ভৈরববাজারে একত্রিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি সময় নষ্ট না করে ব্রাক্ষণবাড়িয়া দিকে অগ্রসর না হয়ে আমার ফোর্সকে নির্দেশ দেই আশুগঞ্জের দিকে রওনা হবার জন্য। ৮ই ডিসেম্বর বিকাল পর্যন্ত আমার ফোর্সকে আজমপুর এবং দুর্গাপুর পৌঁছে। আমার ফোর্স-এর অগ্রভাগে তখন পর্যন্ত ছিল ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঐ দিন ছিল শাহবাজপুরে।
আমার হেডকোয়ার্টার আমি তৈরি করে সরাইলে,যেখানে ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২ কোম্পানী সৈন্য ছিল। ১১ ইষ্ট বেঙ্গলের বাকী দুই কোম্পানী সৈন্য আজমপুর এবং দুর্গাপুরে ছিল। শাহবাজপুরে কোম্পানী নেতৃত্ব দিয়েছিল মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া এবং দুর্গাপুরে লে.নাসের। আমার ফোর্স যখন আজমপুর এবং দুর্গাপুরে অবস্থান করছিল তখন ভারতীয় ৩১১ মাউন্টেন ডিভিশনের তিনটি ব্যাটালিয়ন নিম্নলিখিত স্থানে মোতায়েন ছিল ১০,বিহার রেজিমেন্ট দুর্গাপুরের দক্ষিনে, ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট তালশহর এবং দুর্গাপুরের মাঝামাঝি জায়গায়,৪ গার্ড তালশহরে এবং ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে।
আশুগঞ্জের সন্নিকটবর্তী হবার পর আমরা সামনে অগ্রসর হতে পারছিলাম নাহ। কারণ পাক বাহিনী ভৈরব বাজার থেকে আমাদের উপর দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষণ করছিল অবিশ্রান্তভাবে। কিন্ত ভারতীয় দূর পাল্লার কামান তখন আগরতলা এবং সিঙ্গারবিলের আশেপাশে ছিল। আগরতলা এবং সিঙ্গারবিল থেকে তাদের গোলা ভৈরব পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। তাই আমাদের অগ্রগতিতে বাঁধা পড়ে। ৮ই ডিসেম্বর এভাবে অতিবাহিত হয়। ৯ই ডিসেম্বর আমার সৈনিকরা আজমপুর এবং দুর্গাপুর থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ভারতীয় ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডও অনুরুপভাবে অগ্রসর হচ্ছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আশুগঞ্জ এবং ভৈরবের ঘাঁটি খুবই শক্তিশালী ছিল। কারণ আখাউড়া,তেলিয়াপাড়া এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া এসব স্থানে তাদের ১৪, ডিভিশন ছিল। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে পশ্চাদপসরণ করে। সমস্ত ফোর্স ভৈরব এবং আশুগঞ্জ একত্রিত করে। যদিও তারা আমাদের চেয়ে বেশি ছিল তবুও তাদের মনোবল ছিল না বললেই চলে। ৯ই ডিসেম্বর এভাবে দূরপাল্লার কামানের গোলাগুলি চলে। ১০ই ডিসেম্বর ভোরের দিকে ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পাকিস্তানী প্রতিরক্ষাব্যূহের ভিতর ঢুকে পড়ে এবং এক প্রকার পাকিস্তানী ফাঁদের ভিতর পড়ে যায়। তাই ১০ বিহার রেজিমেন্টর এবং আমার ফোর্স ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর দুটো কোম্পানী তাদের সে ফাঁদ থেকে মুক্ত করার জন্য দুর্গাপুরের দিক থেকে আশুগঞ্জ আক্রমণ চালায়। যখন এ আক্রমণ চলছিল তখন আমি দুর্গাপুরে। বেলা প্রায় সাড়ে দশটায় পাকিস্তানী সৈনিকরা ভৈরব পুলের আশুগঞ্জের সংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দ্বারা উড়িয়ে দেয়। ভারতীয় এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকও দুর্গাপুরের দিক থেকে এ আক্রমণে অংশ নেয়। যেহেতু ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদের ভেতর ছিল,তাদের সে ফাঁদ থেকে উদ্ধার করার জন্য বেপ্রোয়াভাবে আক্রমণ চালাতে হয়। ভারতীয় ট্যাংকগুলিও পাকিস্তানী ট্যাংকবিধ্বংসী ফাঁদের ভিতর পড়ে যায়। ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদ থেকে মুক্ত হবার সুযোগ পায়। কিন্ত উভয় দলেরই ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ যুদ্ধে পদাতিক ছাড়াও ভারতীয় ৪টি ট্যাংক বিধ্বংস হয়। ১০ তারিখের এই যুদ্ধের পর আমরা আবার পিছনে ফিরে আসি এবং আশুগঞ্জ ও ভৈরব আক্রমণের জন্য পরিকল্পনা নেই। ১০/১১ ডিসেম্বর রাতে যে সব পাকিস্তানী সৈন্য আশুগঞ্জ ছিল,তারা ভৈরব চলে যায়। ১১ই ডিসেম্বর ভারতীয় ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানী হেলিকপ্টারযোগে নদীর অপর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ দিনই বেলা প্রায় সারে এগারোটায় ভৈরব পুলের ভৈরব সংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এবং তার সাথে আশুগঞ্জ আমাদের হস্তগত হয়। ভৈরব তখন অবরোধ অবস্থায় থাকে।
সম্মিলিত কমান্ডারে হেডকোয়ার্টারে তখন এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ভৈরব অবরোধ অবস্থাতে থাকবে। এ অবরোধ আমার এক ব্যাটালিয়ন এবং ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেড থাকবে। আর বাকী ভরতীয় ৩১১মাউন্টেন ব্রিগেড এবং আমার বাকী সৈন্য ভৈরবকে পাশ কাটিয়ে নরসিংদী দখল করার জন্য ৪ গার্ড রেজিমেন্টকে নির্দেশ দেওয়া হল এবং তাদেরকে হেলিকপ্টারযোগে নরসিংদীতে অবতরণ করানো হল। ৩১১ মাউন্টেন ব্রিগেডের বাকী ব্যাটালিয়নকে (১০,বিহার এবং ১৮ রাজপুত) পদব্রজে নরসিংদীতে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ভৈরব এবং আশুগঞ্জে অবরোধের নির্দেশ দিয়ে তাদের মোতায়েন করি। ২য় ইষ্ট বেঙ্গল এবং সেক্টর ট্রুপসদের নির্দেশ দেই যে তারা যেন পদব্রজে নরসিংদীর দিকে রওনা দেয়।
১২ই ডিসেম্বর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল ব্রাক্ষণবাড়িয়ার লালপুর হয়ে মেঘনা নদী অতিক্রম করে রায়পুরাতে পৌঁছে। আমি আমার হেডকোয়ার্টার ২য় ইষ্ট বেঙ্গলের সাথে রাখি। ১২ই ডিসেম্বর রাত আমরা রায়পুরাতে কাটাই। ১৩ই ডিসেম্বর সকালে আমরা নরসিংদী অভিমুখে রওনা হই।সেদিনই বিকেলে আমরা নরসিংদী পৌঁছি। নরসিংদী পৌঁছে আমরা শুনতে যে ৪ গার্ড রেজিমেন্ট নরসিংদী দখল করেছে। তারা এখানে হেলিকপ্টারযোগে এসেছিল। ১৩ই ডিসেম্বর আমরা নরসিংদীতে অবস্থান করি। যেহেতু ৪,গার্ড রেজিমেন্ট নরসিংদীতে সর্ব প্রথম পৌঁছেছিল,তাই নরসিংদীর সমস্ত গারী,যানবাহন তাদের হস্তগত হয়। ১৪ই ডিসেম্বর যখন আমরা ঢাকা অভিমুখে রওনা হই তখন আমাদের কাছে কোন যানবাহন ছিল না। তাই আবার আমরা পদব্রজে ঢাকা অভিমুখে রওনা হই। এ অভিযানে ৪,গার্ড রেজিমেন্ট সম্মুখভাবে ছিল। তারা নরসিংদী ডেমরা সড়ক দিয়ে বড় পা পর্যন্ত পৌঁছে। আমি তাদের অনুসরণ না করে ২য় ইষ্ট বেঙ্গলকে নির্দেশ দিলাম যে তারা যেন তারাবোর দিকে না গিয়ে ভুলতা থেকে মুরাপাড়া রুপগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। ১৪ই ডিসেম্বর আমার সমস্ত ফোর্স মুড়াপাড়া পৌঁছে যায়। এবং শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে বালু নদীর পাড়ে পৌঁছে যায়। ১০ বিহার রেজিমেন্ট ঐ দিন রূপসী পৌঁছেছিল। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের অবস্থান নিম্নরুপ ছিলঃ গার্ড এবং ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ডেমরার পূর্ব পাড় তারাবোতে,১০ বিহার রেজিমেন্ট শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে রূপসীতে। আমার ফোর্স-এর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পাড় গাঁও এবং বালু নদীর পশ্চিম পাড়ে ডেমরার পেছনে ছিল। সেক্টর ট্রপস বাসাবোর আশেপাশে। ১৪,১৫ এবং ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধ হয়। ১৬ই ডিসেম্বর বেলা প্রায় ১০টা থেকে ডেমরা ঢাকা রোড আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। ডেমরাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় অবরোধ অবস্থায় ছিল। ১৬ই ডিসেম্বর সকাল থেকেই কথা হচ্ছিল যে পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবে। কিন্ত বেলা বারোটা পর্যন্ত যুদ্ধও অব্যাহত থাকে। বেলা সাড়ে বারোটায় পাকিস্তানীরা ডেমরা-ঢাকা সড়কের উপর অস্ত্র সংবরণ করে। ডেমরা-ঢাকার যুদ্ধে পাকিস্তানীরা যদিও ফ্রেশ ট্রুপস ( সীমান্ত এলাকার সৈনিকরা ঢাকা আসার আগেই অবরোধ অবস্থায় ছিল এবং ঢাকাতে অবস্থানরত সৈনিকরা ঐ দিন পর্যন্ত কোন যুদ্ধে লিপ্ত হয় নাই,তাই যুদ্ধক্লান্ত ছিল না)। ব্যবহার করেছিল,কিন্ত তবুও তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি এ জন্য যে,তাদের নিকট দূরপাল্লার কামান ছিল না। সে গুলোর প্রায় সবগুলোই সীমান্ত এলাকায় ছিল। কিন্ত অপরদিকে ভারতীয় ট্যাংক এবং দূরপাল্লার কামান ঢাকার আশেপাশে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এখানে বলে রাখা দরকার যে,আগরতলা থেকে ঢাকা শহর পর্যন্ত আমাদের অভিযানে বিশেষ করে আমার এস ফোর্স কোন যানবাহন পায়নি। তাই সমস্ত রাস্তাটুকু তাদের পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল। পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছে ঠিকই তবুও তারা ক্লান্তি অনুভব করছিল না। কারণ তারা সবাই জানতো যে পাকিস্তানীদের পতন হচ্ছে এবং ঢাকার পতন অত্যাসন্ন। আমরা আগরতলা থেকে অগ্রসর হই,তখন অস্ত্র শস্ত্র গোলাবারুদ ছাড়া আর কিছুই আমাদের সাথে আনিনি এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সবগুলোই জনসাধারন ঢাকা পর্যন্ত বহন করে নিয়ে এসেছিল। শুধু আমাদেরই নয়,ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও এভাবে করে আনা হয়।
৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দশ দিন আমরা কোন প্রকার রসদ সাথে বহন করিনী। কিন্ত আমরা এক বেলাও না খেয়ে থাকিনি।আমাদের খাবারের ব্যবস্থা জনসাধারণ করেছিল। আমাদের খাবারের ব্যবস্থার কথা কাউকে বলতেও হয়নি। কোন কোন জায়গায় এমনও হয়েছে যে,খাবারের প্রস্তুতির দেরী দেখে আমরা সামনে অগ্রসর হয়েছি এবং জনসাধারণ পড়ে পেছনে থেকে মাথায় করে চার পাঁচ মাইল দূর পর্যন্ত খাবার বহন করে নিয়ে এসেছে আমাদের খাওয়ানোর জন্য।
১৬ই ডিসেম্বর বেলা প্রায় দুটায় ডেমরাতে পাকবাহিনী আমাদের বাংলাদেশে- ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে অস্ত্র সংবরণ করে। ঐ সময় আমাকে সংবাদ দেয়া হয় যে,বেলা সাড়ে তিনটায় আমি যেন ঢাকা বিমান বন্দরে উপস্থিত থাকি। কারণ সে সময় লেঃ জেনারেল অরোরা আসছেন এবং লেঃ জেনারেল নিয়াজীও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমি যেন উপস্থিত থাকি। যদিও ডেমরাতে পাকসেনা আত্মসমর্পণ করেছিল তবুও ডেমরা ও ঢাকার মধ্যবর্তী এলাকা মাতুয়াইলে তখনো পাকসেনারা তাদের অবস্থান রক্ষা করছিল। বেলা তখন প্রায় ২ টা। আমাকে সাড়ে তিনটায় বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতে হবে। তাই ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর মইনকে ব্যাটালিয়ন নিয়ে ঢাকা চলে আসার নির্দেশ দেই। পাকিস্তানী ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল খিলজীকে বলি যে,আমাকে বিমানবন্দর যেতে হবে। এবং তোমার সৈনিকরা যারা মাতুয়াইলে আছে তাদেরকে তুমি গোলাগুলি বন্ধ করতে নির্দেশ দাও। আমরা একই জীপে ডেমরা থেকে মাতুয়াইলের দিকে দিকে যাই এবং কর্নেল খিলজীকে আগে পাঠিয়ে দেই সে যেন তার সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। সৈনিককে নিয়ন্ত্রণে আনতে খিলজীকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অবশেষে সে তার সৈনিকদের আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হয়।
মাতুয়াইলে আত্মসমর্পণের পর আমি এবং ডেল্টা সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং ঢাকা বিমানবন্দর অভিমুখে রওয়ানা হই এবং সাড়ে তিনটার মধ্যে আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখতে পাই যে, সেখানে জেনারেল নিয়াজী এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল জেকব,জেনারেল স্বাগত সিং,জেনারেল নাগ্রা ও আরো অনেকে উপস্থিত রয়েছেন। আমি বিমান বন্দরে পৌঁছে তাদের সাথে কথা বলি এবং জেনারেল নিয়াজীকে জিজ্ঞাসা করি,’ স্যার ডু ইউ রিমেম্বার মি?আই এ্যাম এক্স-মেজর শফিউল্লাহ অব টু ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অ্যান্ড নাউ কর্নেল শফিউল্লাহ অব বাংলাদেশ আর্মি।
জেনারেল নিয়াজীকে খুবই চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি আমার কোন কথার জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলেন যে তিনি আমাকে চিনছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারযোগে জেনারেল আরোরা তাঁর দলবলসহ বিমান বন্দরে পৌঁছেন। এরপর বিমানবন্দর থেকে আমরা তদানীন্তন রমনা রেসকোর্স( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছি। সেখানে সেদিন বহু লোকের সমাগম হয়েছিল। জেনারেল আরোরার সাথে গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে এয়ার কমোডোর ) খোন্দকারও এসেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকার জন্য।
বেলা প্রায় পাঁচটার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জেনারেল নিয়াজী যৌথ কমান্ডের (বাংলাদেশ ভারত) নিকট আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষর করেন। এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমান এয়ার কমোডর) খোন্দকার এবং আমি উপস্থিত ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৯শে মার্চ ময়মনসিংহে ঢাকা দখলের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম তা ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
ঢাকা দখলের যে গৌরব তা আমার ফোর্সের প্রথম ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে পাঁচটায় আমার ফোর্স ঢাকা স্টেডিয়ামে শিবির স্থাপন করে। ১৬ই ডিসেম্বর আমার হেডকোয়ার্টার ঢাকাতে পৌঁছে যায়। প্রথম সেটা স্থাপিত হয় স্টেডিয়ামের পাবনা এম্পোরিয়ামের তেতলার এবং ১৭ই ডিসেম্বর সেটা আমি ৩৫,মিন্টু রোড-এ স্থানান্তর করি। ঢাকা সেনানিবাসে হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরিত করার পূর্ব পর্যন্ত আমার হেডকোয়ার্টার ৩৫, মিন্টু রোডে থেকে যায়। ২য় ইষ্ট বেঙ্গল তখন সোহরাওয়ারর্দী উদ্যানে অবস্থান করে। ভৈরবে আত্মসমর্পণের পর ১১ ইষ্ট বেঙ্গল ভৈরব থেকে ঢাকা চলে আসে এবং ভিকারুন্নিসা বালিকা বিদ্যালয়ে তারা প্রথম কয়েকদিন অবস্থান করে। সেক্টর ট্রুপসদের জায়গা দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থানে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ,আজিমপুর ইত্যাদি স্থানে। এই সেক্টর ট্রুপস পরে ১৬ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে পরিচিত।
এ স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার সেক্টর যে সব যুদ্ধ সংক্রান্ত কার্যকলাপ হতো সেগুলো আমি কখনো পাবলিসিটি করতে দেইনি। কারণ ৩০শে মার্চ ১৯৭১-এ আমি যখন ভৈরব ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে পৌঁছি তখন কিছু সংখ্যক বিদেশী এবং ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে আমার দেখা হয়। তারা আমাকে কিছু প্রশ্ন করেছিল এবং সে প্রশ্নের জবাব তাঁর কিছুদিন পর ভারতীয় সংবাদপত্রে দেখতে পাই। যেমন আমার ব্যাটালিয়ন কোন দিক থেকে,কোথা থেকে এসেছে? সৈন্য সংখ্যা কত ও কতজন অফিসার এবং কি করতে যাচ্ছি? এ সমস্ত গোপন তথ্য আমি পত্রিকাতে দেখতে পেয়ে সাংবাদিকদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলি। এবং পরবর্তীতে নয় মাসের যুদ্ধে কোন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেইনি। এতে যদিও গোপন তথ্য গোপন রাখতে পেরেছি কিন্ত আমার মনে হয় আমার সেক্টরের ছেলেরা যেভাবে কাজ করেছে তা বাংলাদেশের কেউ জানে না। কিন্ত আমার বিশ্বাস সত্য কখনো গোপন থাকে না। আমার ছেলেরা যে উত্তম কাজ করেছে তা যারা স্বচক্ষে দেখেছে,তারাই লোকদের যতোটুকু বলেছে,সেটাই আমি অনেক বেশি মনে করি। এ সেক্টরের কার্যকলাপ আমি লোকমুখে যতোটুকু শুনতে পাই তা এতটুকুও অতিরঞ্জিত নয়।
ভারতে থাকাকালীন ভারতীয় হাসপাতালের সাহায্য ছাড়াও আমি দুখানা হাসপাতাল তৈরি করেছিলাম।এর একটা ছিল আমার হেডকোয়ার্টার হেজামারাতে,সেটা ছিল ৩০ বেডের। অপরটি ছিল আশ্রম বাড়ীতে। সেটা ছিল ১০ বেডের। আমাদের সৈনিকদের এবং গণবাহিনীর চিকিৎসা ছাড়াও নিকটবর্তী গ্রামবাসীরাও এ হাসপাতালের চিকিৎসা লাভ করতো। এ নয় মাসের সংগ্রামে আমাদের প্রতিবেশী ভারত সরকার আমাদের যে ভাবে সাহায্য করেছিল তা হয়তো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা ছিল তারা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। সমস্ত সীমান্ত এলাকাতে লাখ লাখ শরণার্থীদের থাকার,খাবার পরার ব্যবস্থা যে সুশৃঙ্খলভাবে করা হয়েছিল তা কোন শরণার্থী ভুলতে পারবে না। শুধু শরণার্থী নয়,আমরা যারা সামরিক বাহিনীর লোক ছিলাম আমাদের সবাইকে টাকা-কড়ি,অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদপত্র ইত্যাদি আমাদের প্রয়োজনুপাতে তারা দিতে চেষ্টা করেছিল। তারা যতোটুকু দিয়েছে এটা না দিলে আমাদের হয়তো খুবই অসুবিধা হতো।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নয় মাসের মধ্যেই শেষ হয়েছে। তাও শুধু তাদের অংশগ্রহণের জন্য। যদি তারা এ সংগ্রামে শেষের দিকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হত,তাহলে আমাদের আরও কিছুদিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হতো। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে দেশ স্বাধীন হবেই। বাংলাদেশের জনগণও দেশ স্বাধীন করার পক্ষে ছিল।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধে অংশগ্রহনে আমাদের স্বাধীনতা লাভ একটু তরান্বিত হয়েছে মাত্র। যদি তা না হতো তা হলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হত, হয়ত কিছুদিন সময় লাগতো।