শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৩নং সেক্টরের ও ‘এস’ ফোর্সের যুদ্ধ বিবরণ | সাক্ষাৎকারঃ মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ | ——–১৯৭১ |
কালেঙ্গা জঙ্গলে অ্যামবুশ- ২৪শে সেপ্টেম্বর
সিলেটের অভ্যন্তরে যে সমস্ত গেরিলা পাঠাতাম, তাদেরকে এই কালেঙ্গা জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই পাঠাতাম। পাক সেনাবাহিনী এ খবর পেয়ে কালেঙ্গা জঙ্গলে তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। তারা যাতে নিরাপদে চলফেরা না করতে পারে সেজন্য কালেঙ্গা রেস্ট হাউসের পাশে কিছুসংখ্যক এন্টি-পারসোনাল মাইন পুঁতে রাখা হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার জন্য লোক নিয়োগ করি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কিছু সৈনিক সেপ্টেম্বর মাসের ২০/২১ তারিখে কালেঙ্গা জঙ্গলে আসে এবং কিছুক্ষন ঘোরাফেরার পর তারা রেস্ট হাউসের দিকে ফিরে যায়। রেস্ট হাউসের দিকে ফিরে যাবার সময় তাদের পায়ের চাপে দু’খানা মাইন ফেটে যায় এবং তাতে একজন মারা যায় ও দু’তিনজন আহত হয়। পাকসেনারা সেখান থেকে সিন্দুরখানের দিকে চলে যায়। পরদিন বেশ কিছুসংখ্যক লোক আসে সে মাইন পরিস্কার করা এবং সেখানে ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করার জন্য। ঐ দিন যদিও আমাদের লোক সেখানে ছিল,সেদিন তাদের কোন বাধা দেয়া হয়নি। আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর মারাত্মক আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
২৪ শে সেপ্টেম্বর আমাদের সৈনিকরা সিন্দুরখান-কালেঙ্গা রাস্তার উপর ছোট ছোট পাহাড়ের উপর অ্যামবুশ লাগিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। ঐদিন পাকসেনারা বেশকিছু লোকসহ কালেঙ্গার দিকে আসছি। তাদের দলের সবচেয়ে আগে ছিল প্রায় ২০/২৫ জন বাঙ্গালী রাজাকার। তাদের পেছনেই ছিল পাকিস্তানী সৈন্য। দু’দিন আগে যখন তারা এখানে ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করার জন্য এসেছিল তখন কোন বাধা পায়নি। তাই ২৪ তারিখ যখন তারা কালেঙ্গার দিকে আসছিল সেদিন বেপরোয়াভাবেই অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের সৈনিকরাও তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে বসেছিল। রাজাকারের দল যখন আমাদের ফাঁদের ভিতর চলে আসে তখন তাদের কিছু বলা হয়নি। আমাদের সৈনিকরা শুধু পাকসেনাদের অপেক্ষায় ছিল। সে জায়গাতে আমাদের অ্যামবুশ ছিল সেখান থেকে পাকসেনাদের অগ্রসরমান সব সৈনিককেই দেখা যাচ্ছিল, তাই রাজাকারদের দল আমাদের ফাঁদের ভিতর থেকে যখন বেরিয়ে যায় তখন তাদের কিছু করা হয়নি। যখন পাকিস্তানী সেনারা আমাদের ফাঁদের ভিতরে ঢুকে পড়ে তখনি আমাদের সৈন্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং চারদিক থেকে তাদের উপর গোলাগুলি শুরু করে। তাদের দল্টি বিস্তীর্ণ এলাকার উপর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এতে সকল সৈনিক আমাদের ফাঁদের ভেতর পৌছাতে পারেনি। যারা ভিতরে প্রবেশ করেছিল, তারা প্রায় সবাই নিহত হয়। পেছনের যে সমস্ত পাকসেনা আমাদের ঘেরাওয়ের বাইরে ছিল,তারা তাদের বিপদগ্রস্থ সঙ্গীদের বাঁচাবার উদ্দেশ্য আমাদের সৈনিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। আমরা যেহেতু পরিখা খনন করে বসেছিলাম তাই শত্রুদের গোলাগুলি আমাদের কোনরূপ ক্ষতি করতে পারেনি। এমন সময় হটাৎ নায়েক আব্দুল মান্নান পরিখা থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করে ওঠে এবং এই বলে অগ্রসর হয় যে জীবিত পাকসেনাদের ধরে ক্যাপ্টেন সাহেবের(ক্যাপ্টেন আজিজ) সামনে হাজির করব এবং দেখব ক্যাপ্টেন সাব আমায় গলায় মালা পরান কিনা। তার দিন ফুরিয়ে গিয়েছিল তাই সে এরূপ বেপরোয়াভাবে পরিখা থেকে বেরিয়ে আসছিল। সে কিছুদূর অগ্রসর হবার পরই পাকসেনাদের মেশিনগানের গুলি তার বক্ষ এবং মস্তিস্ক ভেদ করে এবং সে কালেমা পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
এ যুদ্ধে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ৬১ জন সৈনিক নিহত হয়। এছাড়া কিছুসংখ্যক আহত হয়েছিল। কিন্তু তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।