You dont have javascript enabled! Please enable it!

টাঙ্গাইলের নামকরণ
আলমগীর রেজা চৌধুরী

টাঙ্গাইলের ইতিহাস রচনা করা এক দুরূহ ব্যাপার, এই বিষয়ে কারো মতদ্বৈধতা নেই। প্রচলিত জনশ্রুতি, বিশ্বাস এবং কিংবদন্তি এগুলো এক করলেই ইতিহাস বের করা সম্ভব নয়। এগুলো যাচাই করে, সত্যাসত্য বিচার করেই সম্ভব অনুশীলন। সিদ্ধান্ত যাতে অভ্রান্ত হয় সেদিকেও রাখতে হয় প্রখর দৃষ্টি।

টাঙ্গাইলের নামকরণ নিয়েও বেশ কয়েকটি গল্প প্রচলিত। কিন্তু সত্যিকার কোনটা ঠিক বা আদৌ ঠিক কিনা তার কোন সঠিক প্রধাণ নেই৷ কথিত আছে জনৈক ইংরেজ সাহেব নাকি সন্তোষ জমিদারীতে রাজস্ব আদায় করতে এসেছিলেন। রাজস্ব আদায়ের পর ঢাকায় আসার পথে এক দল ঠগ রাজস্বের অর্থ লুটপাট করে নিয়ে যায় এবং সেই সঙ্গে তাকে মেরে টাংগিয়ে রেখে যায় – লৌহজংগের পূর্বপারে। আর তার থেকেই টাঙ্গাইল৷ আবার কারো কারো মতে, টান এবং ইল নামক দুইজন সাহেব এসেছিলন সন্তোষ জমিদারীতে স্থান নির্বাচন করার জন্য। তাদের নাম অনুসারেই নাকি স্থানের নাম হয় টাঙ্গাইল। আসলে এ দুটোই হচ্ছে কিংবদন্তি। কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই এ ব্যাপারে। কেউ কেউ মনে করেন বহুপূর্বে এখানকার অধিবাসীরা ‘টঙ্গ’ (উচ্চ ছনের ঘর) বেঁধে বসবাস করত বলে এ জায়গার নাম ‘টঙ্গ’ – এর সাথে ‘ইল’ যোগ করে টাঙ্গাইল হয়েছে। ‘ইল ‘ দিয়ে টাঙ্গাইলের অনেক গ্রাম রয়েছে – যেমন ঘাটাইল, ডুবাইল,বাসাইল, নড়াইল ইত্যাদি। কিন্তু এটাকেও নির্ভরযোগ্য মনে হয় না।

টাঙ্গাইল একটি জেলা এবং এর গোড়াপত্তন ১৮৬৯ সালে। এর পূর্বে টাঙ্গাইল কি ছিল তা রহস্যাবৃত। টাঙ্গাইল নামে কোন জমিদারী বা পরগণা ছিল না যে সরকারী দলিল দস্তাবেজ ঘেটে এর একটা বিহিত করা যাবে৷ জমিদারী ছিল আটিয়া ও কাগমারী নামে৷ কিন্তু আটিয়া ও কাগমারী সেরেস্তাও আজ অবলুপ্ত এবং কাগজপত্রও সব ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই টাঙ্গাইলের ইতিহাসের তথ্য খুঁজতে হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে।

প্রাচীন কালের বঙ্গ, পুন্ড্র ও কামরূপের সংযোগ স্থলেই আজকের টাঙ্গাইল জেলা। কাজেই, ধারণা করা যায়, যে যখন প্রবল হয়েছে সেই তখন এলাকার উপর এলাকার উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে৷ তবে মোটামুটি এটা পুন্ড্র বর্দ্ধন ভুক্তির অন্তর্গতই থেকেছে। কারণ যমুনা নদী তখনো ছিল না। মৌলান্ মিনহাযুদ্দিন৷ সিরাজের তারাকাত – ই – নাসিরী সূত্রে বিশ্বকোষে বা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তৎসহ স্থান সমূহ পর্যবেক্ষণে আধুনিক পন্ডিতরা বিশেষ করে ডঃ আহমদ হাসান দানী যে সব মন্তব্য করেছেন, তা থেকে বোঝা যায়, টাঙ্গাইলের কুহিস্থান (পাহাড়) এলাকা সহ অন্যান্য প্রায় অংশই পুন্ড্র নগর সংশ্লিষ্ট প্রদেশ পুন্ড্র বর্দ্ধনভুক্তি বা বারিন্দ্র ভূমির সঙ্গে এককালে বিশেষভাবে যুক্ত ছিল৷ উনিশ শতকের প্রথম দশকে বহ্মপুত্রের যমুনা শাখা নদীর প্রাবল্যে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

কেদারনাথ মজুমদার তার ময়মনসিংহের বিবরণে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেখা যায়, ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দের রেনেল সাহেব বংগ দেশের মানচিত্র তৈরী করেন। তাতে যমুনা নদীর কোন চিহ্ন তিনি দেখেননি। কিন্তু তার ত্রিশ বছর পর বুকানন হ্যামিল্টন যে মানচিত্র প্রকাশ করেন, তাতে সর্বপ্রথম যমুনা নদীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এর থেকে আমরা ধারণা করতে পারি, মধুপুর ও ভাওয়ালগড়ের মত টাঙ্গাইলও ছিল কায়েমী অঞ্চল।

সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ দেহলভীর (১৩০১-২২) মৃত্যুর পর বাংলাদেশ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে পূর্ববঙ্গ একটা আলাদা রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হতে থাকে। অর্থাৎ ১৩২২ খৃষ্টাব্দের পর শুরু হয় পূর্ববঙ্গের আলাদা অস্তিত্ব। রাজধানী হয় সোনার গাঁ। এই পূর্ব বঙ্গের আলাদা রাজ্য ১৩২২ খৃষ্টাব্দ থেকে ঈশা খাঁর (১৫৮৪- ৯৯ খৃঃ) ছেলে মুসা খাঁ (১৫৯৯ – ১৬০৮ খৃঃ) পর্যন্ত প্রাঢ পৌনে তিনশত বছরের মধ্যে সময় সময় খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেছে।

সোনারগাঁয়ের স্বাধীন জমিদার ঈশা খাঁ কে (১৫৮৪ – ৯৯ খৃঃ) বাদশাহ আকবর মসনদে আলা খেতাব দিল ২২ পরগনার স্বাধীন সুলতান বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সেই পরগনার মধ্যে ছিল আটিয়া ও কাগমারী পরগনা৷ ঈশা খাঁ ‘র পূর্বে কাগমারী ও আটিয়া পরগনা দুটো সরকার বাজুহার অন্তর্গত ছিলো বলেই অনেকের মত। মোগল আমলে তাদের সরকারের প্রশাসন কাঠামো ছিল – সাম্রাজ্য সুবা সরকার এবং পরগনা এভাবে। বর্তমানে দেশ, প্রদেশ, জেলা ও মহকুমা। এদিক দিয়ে কাগমারী ও আটিয়া পরগনা, সরকার বাজুহার অন্তর্গত বলে মনে করলেও ভুল হয় না। কারণ সরকার বাজুহাতে একাধিক পরগনা নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু আইন – ই – আকবরী গ্রন্থে কাগমারী বা আটীয়া পরগনার কোন উল্লেখ নেই। তাহলে যে সময়ে সোনার গাঁয়ে পূর্ব বঙ্গের রাজধানী, সে সময় আটীয়া বা কাগমারী এলাকা কি অবস্থায় ছিল – এটা একটা প্রশ্ন?

অনেকেরই মত যে আলী শাহেনশাহ বাবা আদম কাস্মীরি আটিয়ায় একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু যেখানে পূর্ব বঙ্গই ছিল অঙ্গ রাজ্য (গৌড়ের), সেখানে আবার একটি স্বাধীন রাজ্য কল্পনা করা বাতুলতার সামিল৷ বাবা আদম কাস্মীরি আটিয়ায় এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য, পরে তাকে হয়তো আটিয়ার পাহাড়াদার নিযুক্ত করা হয়েছিলো। এটা হয়েছিল গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের আমলে। এই আটিয়াতে আজও বাবা আদম কাস্মীরির মাজার ও একটি প্রাচীন মসজিদ আছে – যার থেকে এটা সত্য বলে মনে হয়।

এ এলাকার অনেকেরই মত, বাবা আদম কাস্মীরির ভাগিনেয় ছিলেন শাহ জামান সাহেব৷ তিনি ছিলেন কাগমারী পরগনার প্রশাসক৷ সন্তোষ জমিদার পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় টাঙ্গাইলের উকিল নীলাকান্ত বসু ‘কায়স্থ বংশাবলী ‘ নামে একখানা ইতিহাস লেখেন৷ এতে কাগমারী পরগনার সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশ এবং সন্তোষ জমিদারদের বংশের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়। সেখানেও বলা হয়েছে – শাহ জামান সাহেব কাগমারী পরগনার আদি শাসক৷

এই একই ইতিহাস পাওয়া যায় শাহ জামান সাহেবের পর তারই পালিত পুত্র এনায়েতুল্লাহ সাহেব কাগমারী পরগনার শাসক হন। এনায়েতুল্লাহ সাহেব মক্কায় হজ্বে গিয়ে মারা যান। সন্তোষ জমিদারদের পূর্ব পুরুষ সেই সুযোগে কাগমারীর জমিদারীর পথকে নিস্কন্টক করেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় – সন্তোষ জমিদারী যা পরবর্তিতে টাঙ্গাইল শহরের উৎপত্তিকে অনেক ত্বরান্বিত করে। প্রথমে থানা ও চৌকী – উঠে আসে আটিয়া হতে সন্তোষ জমিদারীর মধ্যে। এই স্থানান্তরের ইতিহাস আর আজ উদ্ধার সম্ভব নয়। তবে সম্ভবত বৃটিশ শাসক শ্রেণী প্রশাসনিক কারণে মুসলিম জমিদারের থেকে হিন্দু জমিদারদেরকেই অধিকতর বিশ্বস্ত মনে করতেন। সন্তোষ জমিদারের নায়েব, গোমস্তা, আমলা, ফয়লারা ছিল ইংরেজ সৃষ্ট সেই নতুন সমাজেরই ধারক। সেই নতুন সমাজটাকে অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা দানের জন্যই এই স্থানান্তর। আর আটীয়া পরগনার প্রাচীন জমিদার হচ্ছেন করটীয়ার পন্নী পরিবার। স্বভাবতই ইংরেজ বিদ্বেষী৷

সন্তোষ জমিদারীও ইতিমধ্যে ‘ছোট’ ও ‘বড়’ দুই তরফে বিভক্ত হয়ে যায়। এই দুই তরফের মধ্যে প্রতিযোগিতাও ছিল প্রবল। বড় তরফের কর্তৃত্ব ছিল জাহ্নবী চৌধুরীর হাতে এবং ছোট তরফের কর্তৃত্ব ছিল বিন্দুবাসিনঁী চৌধুরীর হাতে৷ জাহ্নবী চৌধুরীর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে তিনি জায়গা দিয়েছিলেন এই নতুন থানা এ চৌকির জন্য।

নতুন থানা ও চৌকীর জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল লৌহজঙ্গের পূর্ব পারে টাঙ্গাইলে৷ সন্তোষ কাগমারীতে বন্দর বা গন্জ থাকার পরেও থানা ওপারে গিয়েছিল একমাত্র এই প্রতিযোগিতার জন্যই। টাঙ্গাইল শহরে স্কুলও স্থাপন করেন বিন্দুবাসিনী চৌধুরীর ছেলে। পরবর্তী কালে লৌহজঙ্গ নদী শুকিয়ে গেলে কাগমারী বন্দর নষ্ট হয়ে যায় আর টাঙ্গাইলের প্রসারতা বেড়ে যায়৷ ১৯০৫ সালে এই থানা ও চৌকি মহকুমায় পরিণত হয় এবং ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।

টাঙ্গাইলকে জেলা করার স্বপ্ন প্রথম দেখেন ধনবাড়ীর জমিদার নবাব আলী চৌধুরী। সরকারীভাবে জেলার প্রস্তাব উঠে সর্বপ্রথম ১৮৭৬ সালে। প্রস্তাবিত উপস্থাপন করেন রিচার্ড ওটেম্পেলে। নওয়াব নবাব আলী চৌধুরীর পরিকল্পনা ছিল টাঙ্গাইল ও জামালপুর নিয়ে আলাদা একটি পৃথক জেলা করার। তখন তিনি বৃটিশ সরকারের শাসন পরিষদের সদস্য। অকস্মাৎ তার মৃত্যু ও সরকারী উদাসীনতার ফলে সে পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি৷

‘৪৭ এর দেশ ভাগাভাগির ২১ বছর পর ১ লা ডিসেম্বর টাঙ্গাইল পূর্ণাঙ্গ জেলায় পরিণত হয়।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!