You dont have javascript enabled! Please enable it!

অতীতের স্মৃতি
– ইবরাহীম খাঁ

প্রথম মহাযুদ্ধের বছর দুই পর কলকাতার একটি কয়লার কারবারের বড় সাহেব ছিলেন ইংরেজ কারবারে নিযুক্ত বহু বাঙালী কর্মচারীর মধ্যে একটি যুবক সাহেবের নজরে পড়ে। দেহের জোর, কথার জোর, মনের জোরের সমস্ত মিলে যুবকটিকে এক মায়াময় ব্যক্তিত্ব দান করেছিল।

একদিন বিকালে কয়লার সাহেব তার বৈঠকখানায় একা বসে কাগজ পড়ছেন৷ এমন সময় সেই বাঙালী যুবকটি তার সামনে এসে হাজির।
ফলঃ সাহেব আমাকে মস্ত একটা উপকার করতে হবে। সাহেব একটু চেষ্টা করলেই তা পারেন। সাহেব বললেন – কি চাও যুবক খুলে বল। যুবকটি বললঃ আমাকে একটা স্বপ্ন পাগল করে তুলেছে৷ আমাকে বার বার বলছে তোমাকে একটি হাসপাতাল করতে হবে। আমি সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে স্বীকার করেছি, হ্যাঁ হাসপাতাল আমি করব – আমি করব। কিন্তু তার জন্য আমার টাকা পয়সা কিছুই নেই। তাই আমি বহু চিন্তা করে ঠিক করেছি, ১ লাখ টাকার একটা জীবন বীমা করব। আপনি হবেন এসাইনী। মাস খানেকের মধ্যে আমি আত্মহত্যা করব। সেই টাকা দিয়ে আপনি আমার মায়ের নামে একটা হাসপাতাল করবেন। সাহেব তার পানে অপলক চোখে নিমেষের জন্য চেয়ে রইলেন। তারপর প্রশান্ত কন্ঠে বললেনঃ আত্মহত্যা তোমাকে করতে হবে না যুবক। তুমি তোমার নিজের পয়সা দিয়েই হাসপাতাল করতে পারবে এবং তোমার আয়ের পথ আমিই করে দেব।

অঞ্জনের নতুন পথে লক্ষ লক্ষ টাকা তার দুয়ারে ঢেলে পড়তে লাগল এবং সে সম্পদ তিনি অকাতরে ব্যয় করে একটি প্রথম শ্রেণীর হাসপাতাল স্থাপন করেন। সেই সঙ্গে মির্জাপুরে স্থাপন করেন তিনি একটি প্রথম শ্রেণীর আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়, এ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের খোরাক, পোশাক সহ সমস্ত খরচ তিনি বহন করতেন।

মির্জাপুরের এই হাসপাতাল এবং বালিকা বিদ্যালয়ের কীর্তি কথা দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও তিনি টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ দুটি কলেজ স্থাপন করেন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা ও শিক্ষা প্রচার কাজে তিনি প্রায় বিশ কোটি টাকা দান করে যান।

এই অদ্ভুত কর্মী মানুষটিই হচ্ছেন রনদা প্রাসাদ সাহা। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে। তার পিতামহ ছিলেন আশানন্দ সাহা। বাড়িতে থাকাকালীন তিনি অতিথি ছাড়া অন্ন গ্রহন করতেন না।

কিশোর জীবনেই রনদা সাহার অসাধারণ শারীরিক শক্তি ও মনোবলের কথা পরিচিত মহলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়ে তিনি বাগদাদ চলে যান। এখানে বৃটিশ বাহিনী তুর্ক যোদ্ধাদের হাতে পরজিত হয়ে বন্দী হয়। রনদা সাহা এই বন্দীদের অন্যতম ছিলেন।

একদিন হঠাৎ বন্দীদের হাসপাতালে আগুন লেগে গেল। হাসপাতালে তখন অনেক আহত যোদ্ধা। আগুন সহসা দাউ দাউ করে হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়ায় সে আহত সৈন্যদের উদ্ধার করতে যেতে কেউ সাহস পেল না। রনদা সাহা তখন কোন কাজে একটু দূরে ছিলেন। আগুন দেখে হাসপাতালের কাছে ছুটে এলেন এবং হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করার অনুমতি চাইলেন। তুর্কী সেনাপতি বললেন – এই আগুনের ভিতরে এখন যাওয়া মানে মৃত্যু বরণ! আমি সে মৃত্যু বরণের অনুমতি দিতে পারি না। রনদা সাহা ব্যগ্র কন্ঠে সেনাপতিকে বললেন – স্যার, এ দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। আমি মরলে একটি লোকও চোখের জল ফেলবে না। আমাকে যেতে দিন। আমিও আহত সেনাদের নামিয়ে আনি? অবশেষে সেনাপতি অনুমতি দিলেন। ‘রনদা সাহা তরতর সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। মুহূর্ত কালের মধ্যে একটি আহত সৈন্যকে পিঠে বহন করে নীচে নামিয়ে নিয়ে এলেন। তিনি আবার হাসপাতালের উপরে গেলেন। উৎসাহিত হয়ে দুইটি সৈন্য তার সাথী হলেন, তারা তিনজন আহতকে পিঠে করে ফেরত এলেন। তখনও উপরে একটি আহত সৈন্য। রনদা সাহা সেই সৈন্যের পানে চলে গেলেন এবং তাকে নিয়ে ফিরে এসে বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সমস্ত সৈন্যদলের মধ্যে রনদা সাহার নামে জয়জয় পড়ে গেল।

বাংলাদেশের যেখানে দুর্ভিক্ষ, মহামারী কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটছে, সেখানেই রনদা সাহার দানের হাত প্রসারিত হয়েছে।

দুস্থ মানুষের সেবাকে আর পি সাহা যে একান্ত চিত্তে নারায়ণের সেবা জ্ঞানে বিশ্বাস করেছেন তা আমরা বহুবার নিজ চোখেই দেখার সুযোগ পেয়েছি৷ বিগত স্বাধীনতা সংগ্রাম কালে বর্বর পাক বাহিনীর হাতে এই আর পি সাহার জীবন অবসান ঘটে৷

আর পি সাহা আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার কীর্তি মানব হিতৈষী ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

মওলানা ভাসানী

মওলানা ভাসানী সম্পর্কে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, তিনি ‘ভাসানী ‘ নামটা পেলেন কোথায়? উত্তরে আমি বলেছি, কর্মস্রোতে ইনি বাংলা আসামের বহু স্থানে ভেসে বেড়িয়েছেন, বোধ হয় সেই জন্য। শুনেছি ভাসানী নামটি পেয়েছেন আসামের একটি চর থেকে। চরটি নদীর স্রোতে মাঝে মাঝে ভেঙে ডুবে যেত, আবার নদীর বুকে ভেসে উঠত। লোকে জায়গাটার নাম দিল ভাসানীর চর। এ চরে কয়েক বছর থেকে মওলানা আবদুল হামিদ খান জনসেবার কাজ করেন, তখন লোকে তার নাম দেয় ভাসানীর মওলানা।

আমার সঙ্গে মওলানা সাহেবের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে বন্যা বিপন্ন মানুষের ত্রাণকার্য উপলক্ষে।

উপলক্ষটা বলিঃ আমি করটিয়া কলেজ অফিসে বসা, এমন সময় একজন ভদ্রলোক এসে আচ্ছালামু আলাকুম বলে বসলেন। বললেনঃ আমার নাম আবদুল হামিদ খান। বাড়ি আমার আগে বাংলাদেশেই ছিল, তারপর যাই আসামে। এ দেশের বন্যার কথা শুনে কিছু ধান নিয়ে এলাম। শুনলাম আপনি বন্যা বিদ্ধস্ত এলাকায় রিলিফের কাজ করছেন। তাই আপনার সাথে পরামর্শ করে আমার নৌকার ধানগুলি বিতরণ করতে চাই।

এক সঙ্গে বসে দুটো খেলাম৷ রিলিফ সম্পর্কে অনেক কথা হল। তারপর তিনি বন্যা বিদ্ধস্ত গ্যাবসারার চর অঞ্চলে চলে গেলেন।

সেখানে তার সেবা ও যত্নে বাসিন্দারা মুগ্ধ হয়ে গেল। তাদের মধ্যে নানান কথা বলাবলি শুরু হল। যেমনঃ লোকটা কে রে ভাই? রিলিফের এত টাকা পায় কোথায়? জানিস না? উনি যে ভাসানীর মওলানা। মস্ত ফকির। জিনে ওর টাকা যোগায়।

ভাসানী সাহেবের পানি পড়ার জন্য বেশুমার নাম পড়ে গেল। দলে দলে লোক পানি পড়ার জন্য হাজির হতে লাগল।

একদিন তিনি টাঙ্গাইলে এক বাড়িতে এক রাত ছিলেন। খুব ভোরে চলে গেছেন৷ পানি পড়ার জন্য লোকে এসে ভিড় করল। বাড়ির একজন তমাসা করে বললঃ মওলানা সাহেব এক গ্লাস পানি পড়ে ঐ ইন্দিরার পানি নিলেই চলবে। ইন্দিরার পানি নেয়া শুরু হল। ইন্দিরা শুকিয়ে গেল। লোকে কাদা তুলতে শুরু করল। বাড়িওয়ালা তাদের কাছে হাত জোর করে বললঃ দোহাই আল্লার, আমার ইন্দিরাটা রক্ষা কর, আরো কাদা তুললে ইন্দিরাটা পড়ে যাবে।

টাঙ্গাইলের অদূরে সন্তোষ জমিদার বাড়ি। জমিদার হিন্দু কিন্তু তাদের হেফাজতে আছে এক পীড়ের দরগা। লোকে বলে, এই পীড়ের জমিদারীই ফাঁকি দিয়ে হিন্দু জমিদাররা দখল করে খাচ্ছে।

ভাসানী সাহেব রুখে দাড়ালেন। বললেন – এই জমিদারী মুসলমান সমাজের সম্পত্তি, কাজেই তাদেরই ফেরত দিতে হবে। প্রজাকুল বার আনাই মুসলমান। তারা মওলানা সাহেবের সমর্থনে হুংকার ছেড়ে দাড়াল।

জমিদাররা সরকারকে ধরে মওলানা সাহেবকে আসামে পাঠিয়ে দিল৷ সেখানে মওলানা সাহেব সমাজ সেবার কাজে লেগে গেলেন এবং তারই নামে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা স্থাপন করলেন। কিছুদিন পর মওলানা সাহেব সন্তোষের জমিদারি দখলে আত্মনিয়োগ করলেন। জমিদাররা ভয়ে কলকাতায় চলে গেল।

মওলানা সাহেবের ভৃত্য রা তাকে বললঃ হুজুর এই জমিদার বাড়িতে বাস করতে থাকুন। অন্য কাউকে আমরা এখানে শিকড় গাড়তে দেবো না৷

ভাসানী সাহেব দুস্থ কাঙাল দের চিরবন্ধু। তাদের সার্থের পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বহুবার জেলে গিয়েছেন কিন্তু এত জুলুমের মধ্যেও তার মন দমেনি৷ তার অক্লান্ত আন্দোলনের ফলে বাংলার অবজ্ঞাত নিরন্নরা নতুন জীবন লাভ করে। তাই বাংলার জনগণের চোখে মওলানা ভাসানী জালেমের দুশমন আবার মজলুমের অকৃত্রিম বন্ধু।

ভাসানী সাহেবের বয়স ‘শ য়ের কাছাকাছি। তার দেহে বার্ধক্য দেখা দিয়েছে কিন্তু সভায় দাড়ালে এখন তার উচ্ছসিত বক্তৃতায় আগুন ঝরে – শ্রোতারা পাগল হয়ে ওঠে। অনেক দিন আগে আমার লেখা বাতায়নে ভাসানী সম্পর্কে আমি যা লিখেছি, তারই পুনরুল্লেখ করিঃ

আমার মনে হয় ভাসানী সাহেব বাংলার কালবৈশাখী। প্রচন্ড তার শক্তি, ততোধিক প্রচন্ড তার বেগ। যেদিকে চলে তার দাপটে আধমরা ডাল ভাঙ্গে। জরাজীর্ণ গাছ উপরে যায়, বাসি পাতা খসে হাওয়ায় ওড়ে, বুড়ো ঘর দুয়ার ভূমিস্মাৎ হয়। তারপর কালবৈশাখী কোথাও চলে যায়। নতুন ঘর তোলার কাজ অন্য লোকের, নতুন চারা লাগানোর ভার অন্য মালীর, নতুন পাতা পল্লব জাগিয়ে তোলার কর্তব্য নব বসন্তের।

যাদু সম্রাট পিসি সোরকার

সে আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথা। আমি টাঙ্গাইল থেকে করটিয়ার পথে চলেছি, পথের পাশে একটা ছোট ফিটফাট বাড়ী থেকে আমাকে ডেকে থামালেন। এক ভদ্রলোক। নাম তার ভগবান সরকার। বললেনঃ কয়েকটি সন্তান, সংসারে অর্থ সমস্যা আছে, এই ছেলেটি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে৷ কলেজী শিক্ষার জন্য ওকে আপনার হাতে তুলে দিতে চাই। এই বলে একটি বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার চটপটে ছেলেকে আমার সামনে ধরলেন। আমি ছেলেটির মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললামঃ ও ভর্তি হওয়ার পর থেকে কিন্তু আমারই ছেলে হয়ে যাবে। পিতার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠলো।

ছেলেটির নাম প্রতুল চন্দ্র সরকার। এই ই পরে হয়ে ওঠে প্রখ্যাত যাদু সম্রাট পিসি সোরকার। পরীক্ষার ফল বের হল, প্রতুল করোটিয়ার সাদত কলেজে ভর্তি হয়ে গেল।

এর কিছু দিন পর টাঙ্গাইল শহরে একজন বিখ্যাত জাদুকর এলেন। প্রায় দুই সপ্তাহকাল পর্যন্ত তার যাদু দেখতে টাঙ্গাইলে লোকে লোকারণ্য হয়ে রইল৷ যাদু শুরু হওয়ার দিন পাঁচেক পর আমি দেখতে গেলাম। সে জনতার ভেতর থেকে প্রতুল দৌড়ে এসে দাড়াল এবং আমার সেবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসা করলামঃ যাদু দেখতে তুমি আজই প্রথম এলে? বললঃ না স্যার, আমি পয়লা দিন থেকেই রোজ যাদু দেখতে আসি। যাদুকর মশাই আমাকে খুব ভালবাসেন। আমি তার শিষ্য দলে এক রকম ভর্তি হয়েই গেছি। যাদুকর টাঙ্গাইল ছেড়ে তার তলপীতলপা নিয়ে চলে গেলেও, কিন্তু তার যাদুতে প্রতুলের সমস্ত চিত্ত ভরে রইল। এরপর লক্ষ্য করলাম, প্রতুল ক্লাসে বইপত্র যত পড়ে, যদুর বই নিয়ে থাকে তার চেয়ে বেশী।

কিছুদিন পর কলেজ পরিদর্শনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সপেক্টর ডঃ হরেন মুখার্জি এবং তার সঙ্গে কলকাতার আলীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হারলে সাহেব কলেজ দেখতে আসলেন। প্রতুল আমাকে ধরলঃ স্যার, অনুমতি দেন, আমি ওদের একটু যাদু দেখাই।

প্রতুল ভাল কিছু ম্যাজিক দেখাতে পারবে এ আমার বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আগ্রহে ডগমগ ছেলে, আমি তাকে নিরাশ করতে পারলাম না।

অভ্যর্থনা সভায় আমি প্রতুলকে ওদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলাম।

প্রতুল অতিথিদ্বয়কে তার যাদু দেখাল। ওরা উভয়ই অত্যন্ত খুশী হয়ে বললেনঃ বয়স আন্দাজে ছেলেটি চমৎকার দেখিয়েছে।

কি জানি কেন, আমার মনে দৃঢ বিশ্বাস জন্মাল যে প্রতুলের যাদুকর্মের ভবিষ্যৎ উজ্জল। আমি তাকে খুব উৎসাহ দিলাম। মাসেককাল যায়, প্রতুল এসে আমাকে বললঃ স্যার, মোটে দুটো জাদুর বই হাতে পেয়েছিলাম, তা তো পড়ে শেষ করলাম, এখন তো বইয়ের অভাবে মরি।

বললামঃ যাদুর বিষয়ে তোমার যে কয়খানা বই লাগে, তার একটা লিস্ট আমাকে লিখে দাও, আমি সেগুলো কলেজ লাইব্রেরীর জন্য কিনব এবং তোমাকে পড়তে দেব। প্রতুল আনন্দে নেচে উঠল।

আমি সেই ব্যবস্থাই করে দিলাম। সে অত্যন্ত ক্ষিধে নিয়ে বইয়ের কথাগুলো যেন গিলতে লাগল।

ক্লাসের পড়া যাতে একদম বাদ না দেয়, তার জন্য প্রতুলের উপর কড়া দৃষ্টিও রাখতে লাগলাম।

প্রতুল সময় মত আই, এ পাস করল।

একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বংসের উপাধি সরকার বাদ দিয়ে সোরকার করলে কেন? উত্তরে বললঃ আমার একটু বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য। বললামঃ কর্মজীবনেও নিজ বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে পারবে তো? উচ্ছ্বসিত কন্ঠে উত্তর দিলঃ আশির্বাদ করবেন স্যার, সেই চেষ্টাই করব।

করটিয়ায় তখনো ডিগ্রী খোলা হয়নি। তাই সে গিয়ে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হল।

সে সেখান থেকে আমার সঙ্গে পত্র মারফত যোগাযোগ রক্ষা করতে লাগল।

দুই বছর পর প্রতুল করটিয়ায় এসে আমাকে ধরল। স্যার ডিগ্রী পরীক্ষায় ফেল করেছি। আবার যে পরীক্ষার জন্য তৈয়ার হব, তার খরচ নেই। এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আপনার পরামর্শ নিতে এলাম।

বললামঃ তোমার বাবা কি বলেন, চল আমরা তাই মেনে চলি।

প্রতুলের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনা করে আমি বললামঃ আমার বিবেচনায় যাদুর ইন্দ্রজাল দিয়েই তোমার ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সহজ হবে। কাজেই পরীক্ষায় পাস করার জন্য আর সময়, শক্তি ও অর্থ খরচ করা সঙ্গত হবে না। প্রতুল বললঃ তবে আপনার এই উপদেশই মাথায় তুলে নিলাম স্যার।

এর অনেক বছর পরের কথা। আমি তখন ঢাকায় উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের চেয়ারম্যান। শো দেখাতে প্রতুল ঢাকায় এল। তার যাদুর প্রশংসায় শহর মেতে ওঠল। এক দিন শো দেখতে গেলাম।

আসরে সে এক লোকের জিহ্বা কেটে ফেলল। দেখে আমার পাশে বসা একটি যুবক ফিট হয়ে গেল।

শো অন্তে প্রতুলকে বললামঃ আমি ভুয়াপুরে কলেজ করেছি। গরীব কৃষকদের এলাকা, কলেজে টাকার অভাব। একটা বেনিফিট নাইট দিতে পার? বললঃ নিতান্ত আনন্দের সঙ্গে দিতাম স্যার, কিন্তু আমার ওপর পাকিস্তান সরকারের কড়া হুকুমঃ তিন দিনের মধ্যে আমাকে ফিরে যেতে হবে। আর এই তিন দিন আমি চুক্তিতে আবদ্ধ।

এরপর প্রতুলের সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নি। দূর থেকে শুনেছি পিসি সোরকার যাদুর ওস্তাদ। কিছুদিন পর শুনেছি পিসি সোরকার যাদুর রাজা। অবশেষে শুনেছি পিসি সোরকার যাদুর সম্রাট।

এমনিভাবে অনেক বছর গেল, হঠাৎ শুনতে পেলাম সে জাপানে গিয়েছিল, সেখানে সে পরলোক গমন করেছে।

বুদ্ধির আলোকে প্রদীপ মন সৌজন্যের মনোরম প্রভায় হাস্যময় মুখ, যাদু বিদ্যার উন্নয়নে অতন্দ্র তপস্যা এই নিয়ে পিসি সোরকার আমাদের চিত্তে একজন অবিস্মরণীয় স্মৃতি।

***

অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ
– ডঃ এম, এন, হুদা

১৯৬৯ সনের ১ লা ডিসেম্বর টাঙ্গাইল স্বতন্ত্র জেলা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই নতুন জেলার আয়তন নদীসহ ১৩০৯ বর্গমাইলের বেশী। আর বর্তমান লোক সংখ্যা ২৫ লক্ষ্যের মত, প্রতি বর্গমাইলে আনুমানিক ৬৬৫ জন লোকের বাস। জেলার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে শাল গজারীর বন – মধুপুরের গড়, ঢাকা জেলার ভাওয়াল- জয়দেবপুরে এসে মিশেছে। পশ্চিমে যমুনা নদী অধ্যুষিত চর জমি, উত্তর থেকে দক্ষিণে আস্তে আস্তে নীচু হয়ে এসেছে। এক কালে বহু ছোট বড় নদী নালা, খাল বিলে ভর্ত্তি ছিল, এখন প্রায় সবই শুকিয়ে গেছে, কিছু কিছু বিলের তলদেশ ছাড়া। কৃষিকার্যই লোকের প্রধান জীবন জীবিকা আগেও ছিল, এখনও আছে। এক সময়ে উন্নত কুটির শিল্প ছিল – শাড়ী, কাঁসার বাসন, বেতের পাটি। এখন প্রায় সবই ধ্বংস মুখী। সাম্প্রতিক কালে একটা কাপড়ের কল বসেছে জেলার দক্ষিণ প্রান্তে। একটা বড় রাস্তাও গিয়েছে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ – টাঙ্গাইল হয়ে। যে কোন এলাকার ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে বর্তমানকে কেন্দ্র করেই। টাঙ্গাইলের বেলায়ও সেই একই নিয়ম চলবে। বর্তমানে সেখানে কি কি মাল মসলা আছে, তা সঠিক ভাবে জানাটাই হচ্ছে প্রথম প্রয়োজন। কৃষিজাত জমি কতোখানি, কৃষি উপযোগী জমি আরো বাড়ানো যায় কিনা, কোন ফসল কতখানি হয়, আর কি কি বাড়ানো যায়, শীতের সময় পানি সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে নতুন ফসল কি কি উৎপাদন করা যায়, বন এলাকায় কি হয় এবং কি হতে পারে এসব সম্পর্কেই সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। বিভিন্ন থানা ও ইউনিয়নের নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তিরা এ বিষয়ে মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করতে পারবেন। আমার মনে হয় জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিলে এবং সব এলাকায় লোকের সহযোগিতা কামনা করলে এ সব তথ্য সংগ্রহ সহজ হবে।

এই সব তথ্যের ভিত্তি করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে। পরিকল্পনায় কৃষিরই থাকবে অগ্রাধিকার, জেলার খাদ্য ঘাটতি পূরণে সবচেয়ে প্রথমে প্রয়োজন।

কৃষির সল্পমেয়াদী পরিকল্পনায় উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক, ওষুধ ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে এবং সমবায় ভিত্তিতে দেশের কিছু কিছু জায়গায় যেভাবে কাজ হচ্ছে, সেইভাবে কাজ হবে। পাওয়ার পাম্প ও টিউবওয়েল লাগিয়ে শীতের মওসুমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করলে প্রায় সর্বত্রই দ্বিতীয় ফসল উৎপাদন করা যাবে। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে পড়বে নদী নালাগুলোর পুনঃখনন, ফলে বন্যার তীব্রতা কমে আসবে এবং শীতকালে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি রাখারও ব্যবস্থা হবে। টাঙ্গাইলে ধান পাটের একর প্রতি যা উৎপাদন, তার চেয়েও অনেক বেশী উৎপাদিত হচ্ছে দেশের কোন কোন জায়গায়। সমবেত প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইলেও শস্যের ফলন বাড়ানো যাবে৷

নতুন ফসল কি ফলানো যায়, তা ঠিক করতে অবশ্য কিছু সময় লাগবে। কৃষি বিজ্ঞানের অনেক বেশি উন্নতি হয়েছে, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে এ পরিকল্পনায় তবে বনজ সম্পদ নিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব।

মধুপুর গড়কে ভিত্তি করে শাল – গজারীর উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য একটা বড় রকমের কাঠের কারখানা স্থাপিত হতে পারে। বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনকে এ ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।

টাঙ্গাইলে এক সময় কুটির শিল্প হিসাবে বেতের পাটির আলাদা আদর ছিল – এখন প্রায় এই শিল্প মরণোন্মুখ। এই শিল্পের সব মাল – মসলা টাঙ্গাইলেই আছে। আমার মনে হয় একটু নজর দিলে একে বেশ উন্নত শিল্প হিসাবে গড়ে তোলা যায়। সাধারণ পাটির চাহিদা গ্রাম দেশেই বেশ আছে। মিহি বেতের শীতল পাটির আদর শহরেও কম নয়। তাতে আমাদের নিজস্ব কারুকার্য্য আঁকলে অনেক লোক – দেশী এবং বিদেশী – এ রকম পাটি মেঝে ও দেয়াল ঢাকবার জন্য ব্যবহার করবে।

কাঁসার বাসনের দিন বোধহয় আর ফিরে আসবে না। তবে ফুলদানী, ফুলের টব, ঘর সাজাবার অনেক ছোট খাটো জিনিস এ থেকে তৈরী করা যেতে পারে। এ সবের চাহিদা আজ কাল বাড়ছে। কাঁসার জিনিস তৈরীর মাল মসলা পাওয়া মুশকিল – এ সব ভেবে চিন্তে এ পথে এগুতে হবে।

টাঙ্গাইল শাড়ীর উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র শিল্প কর্পোরেশন কিছু কাজ করছেন – দেশে এবং বিদেশে এই শাড়ীর আরো অনেক বেশী প্রচলন হতে পারে। ভালো সুতা, ভালো ডিজাইন, ভালো ঋণ ব্যবস্থা করতে পারলে তাঁতি ভাইয়েরা অনেক ভালো কাজ করে অনেক ভালো মানে শাড়ী বাজারে আনতে পারবেন। পাড় এর ডিজাইন এবং রং এর দিকে আমাদের বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিদেশীরা যাতে তাদের পোশাক বানাতে পারেন সেই দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের শাড়ীর উন্নতি করতে হবে, ঠিক ভাবে উন্নত করতে পারলে আমরা শাড়ী থেকে বেশ কিছুটা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি।

টাঙ্গাইলে একটা পাটের কল অবিলম্বে স্থাপন করা প্রয়োজন। টাঙ্গাইলে যে পরিমাণ এবং যে মানের পাট জন্মে তাতে একটা মিল অনায়াসে চলতে পারে। নদী পথের তেমন সুবিধা না থাকলেও ঢাকা – টাঙ্গাইল – ময়মনসিংহ রাস্তার ধারে মিল বসলে আশেপাশের লোকই সেখানে কাঁচা পাট নিয়ে আসতে পারবে। কাপড়ের কল যেমন হচ্ছে তেমনি পাটের কলও হতে পারে। পাট শিল্প কর্পোরেশন এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি। টাঙ্গাইলের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিছু কিছু কাজ অনতিবিলম্বেই শুরু করা যায় আর কিছু কিছু কাজের জন্য গবেষণা ও পরিকল্পনা করতে হবে।

প্রয়োজন জাগ্রত জনমত, বাস্তব মুখী নেতৃত্ব ও সুষ্ঠু সরকারী নীতি ও কার্যক্রম – এ তিনের সমন্বয়ের মধ্যেই নিহিত রয়েছে টাঙ্গাইলের ভবিষ্যৎ।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1976.01.16-bichitra-maruf-muktadir.pdf” title=”1976.01.16 bichitra maruf muktadir”]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!