সাক্ষাৎকারঃ মেজর শহীদুল ইসলাম
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ভারতের একিনপুর (বিএসএফ ক্যাম্প) যাই। সেখানে অনেক এমসিএ, সাধারণ লোক, ইপিআর, পুলিশ সবাইকে দেখলাম। ফেনীর উত্তর অঞ্চল এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন চলে আসে। পাকবাহিনী এসব এলাকার লোকদের নৃসংভাবে হত্যা করেছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। ওখানে ৭০৮০ জন লোক নিয়ে ছোটখাট কোম্পানী গঠন করি। আমার সাথে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রউফ ছিলেন। ওখানে আমরা গেরিলা কার্যকলাপ শুরু করে দেই মে মাস পর্যন্ত। আমরা পাকবাহিনীকে অতর্কিতে আক্রমণ করতাম, আবার ঘাঁটিতে ফিরে আসতাম। এখানে-ওখানে পাকবাহিনীকে ব্যতিবস্ত করে তুললাম। ভারতীয় কর্নেল (৯১ বিএসএফ) গুপ্ত, ক্যাপ্টেন মুখার্জী, মেজর প্রধান আমাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছেন। মেলাঘর-২ সেক্টরের অধীনে একিনপুর সাবসেক্টরে কাজ করতে থাকি। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (বর্তমান মেজর) কিছু সেনা নিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দেন। ফেনীর মধ্যে সরিষাদি, বন্দুরা, মুন্সীরহাট, ফুলগাজি, ফেনী জুন মাস পর্যন্ত এসব এলাকাতে ব্যপকভাবে গেরিলা আক্রমণ আক্রমণ চালানো হয়। জুন মাসে আমরা সাবেক বিভিন্ন ইপিআর বিওপিতে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাকে হত্যা করেছি। আমরা হঠাৎ করে আক্রমণ করতাম- লোক ক্ষয় করে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে আবার ঘাঁটিতে ফিরে আসতাম। আমরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যেতাম, মাঝখানে থাকতো মর্টার। নির্দিষ্ট সময়ে মর্টার শেলিং শুরু হলে পাকবাহিনীরা পালাতে শুরু করলে আমরা গুলি শুরু করতাম। এভাবে বহু পাকসেনা মাঝে মাঝে মারা যেত। আমাদের কোন ক্ষতি ওরা করতে পারতো না। এত আকস্মিক আক্রমণ আমরা করতাম যে ওরা বুঝতেই বা ভাবতেই পারতো না। ২নং সেক্টরের প্রধান ছিলেন মেজর খালেদ মোশারফ। তিনি আমাদের হুকুম দেন ছাগলনাইয়াতে যাবার জন্য। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমরা সমরগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে যাই। তারা আমাদের সাদরে অর্ভ্যর্থনা করলো। সরগঞ্জ থেকে ছাগলনাইয়ার বাঁশপারাতে (ফেনী) ঘাঁটি গাড়ি। বাঁশপাড়াতে আমরা প্রায় ১২০ জনের মতো ছিলাম। জুন মাসের শেষের দিকে আমরা ফেনীর দিকে মুখ করে শক্ত ঘাঁটি গড়লাম। প্রথম দিন যাবার দিনই পাঞ্জাবী সৈন্যের গুলি শুনতে পেলাম। পাঞ্চাবীরা ঐ পথেই এগিয়ে আসছিল গুলি করতে করতে। আমরা ভারী অস্ত্রের সাহায্যে গুলি শুরু করলে পাঞ্চাবীরা পালিয়ে যায়। আমরা নির্দিষ্ট স্থানে চলে আসি।
বেসামরিক লোকেরা আমাদের সার্বিকভাবে সাহায্য করে। চাল ও অন্যান্য জিনিসপত্র তুলে আমাদের জন্য নিয়ে আসতো। তারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিল। জুন মাসের শেষের দিকে পাকবাহিনী ১৫/১৬টি গাড়ি করে আমাদের আক্রমণ করে। আমরা আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রায় দেড়শত সৈন্য দু’টি ভাগে ভাগ করে নেই- ডেপথ-এ মেজর জাফর ইমাম এবং আমি সামনে। আমি ভারী অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করি। পাকবাহিনী ৫০০ গজের মধ্যে চলে আসে। আমি সামনে থেকে ওদেরকে বেশ দেখতে পাচ্ছি। সারাদিন যুদ্ধ হবার পর পাকবাহিনী ফিরে যায়। ওদের পক্ষে ৬০৭০ জন মরতে দেখি। অদেখা আরও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তবে সামরিক সূত্রে অনেক লোক মারা গেছে শুনলাম। আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। জুলাই মাসের প্রথমেই পাকবাহিনী প্রচণ্ড আর্টিলারী এবং বহু সেনা নিয়ে আমাদের আক্রমণ করে। আমরা তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে থাকি। আমি আগে, তার পাশে একটি এবং আমার পিছনে একটি রাখি আমার সাহায্যের জন্য। আমরা যখন ফায়ারিং শুরু করি তখন পাকবাহিনী আমাদেরকে সামনে ব্যস্ত রেখে দু’দিকে দুটো কোম্পানী ঘিরে ফেলতে থাকে। আমরা কিছুই জানতাম না। প্রায় পাশাপাশি যখন এসেছে তখন ওরা ফায়ারিং শুরু করে। আমরা আমাদের বিপদ বুঝতে পারি। সামনে দু’একজন সৈন্য সামান্য অস্ত্র রেখে বাকি সবাইকে আস্তে আস্তে পিছনে হাটতে বলি। আমরা যে পিছনে হটছি তা তারা বুঝতে পারেনি। কারণ দু’একজন অনবরত গুলি করেই যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে পিছনের দলটি আমাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। আমি তাকে বাধা দিয়ে পিছনে সরে যেতে বলি। আমরা পিছনে একটি ভাল জায়গা দেখে পুনরায় ঘাঁটি গাড়ি। পাকবাহিনী এগিয়ে আসে পুল অতিক্রম করে। পাকসেনারা বাঁশপাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম ছাগলনাইয়া, বেলুনিয়া, ছাগলনাইয়া, বাজার, কুমা সমস্ত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সম্পূর্ণ র্ধ্বস করে। বহু মানুষ গুলি করে হত্যা, মারধর করে। বহুকে ধরে নিয়ে যায়। আমরা পিছনে গিয়ে সবাই একত্র হয়ে ওদের উপর আক্রমণ করি তখন ওরা আর অগ্রসর হয়নি। জুলাই মাসেই আবার পাকবাহিনী আক্রমণ করে। দু’দিন ধরে যুদ্ধ হয় সবসময়। আমরা যেতে পারেনি, এমনকি পানি খাবারও অবসর ছিল না। সবসময় ব্যাপকভাবে ফায়ারিং চলছিল। আমরা টিকতে না পেরে পিছু হটি এবং ছাগলনাইয়ার বিত্তপিতে দীঘির ধারে ঘাঁটি ঘারি। দু’তিন দিন পর আবার সংঘর্ষ শুরু হয়। এখানেও আমরা টিকতে পারিনি, তারপর সমরগঞ্জের দু’তিন মাইল দক্ষিণে আমাদের সামরিক ছাউনি ছিল ওখানে চলে যাই। ওখানে এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেই। কারণ একমাস যাবৎ গোসল ছিল না, খাওয়া-দাওয়া পায় তেমনি আছে। জুলাইআগস্ট মাসে আমরা আবার মধুগ্রামে পজিশন নেই। শুভপুর এবং ছাগলনাইয়ার মাঝামাঝি স্থান ছিল মধুগ্রাম। ১৫১৬ দিন ওখানে ছিলাম। একদিন পাকবাহিনীর একটি টহলদার পার্টিকে যারা ট্রাকে করে এসেছিল আক্রমণ করে সম্পূর্ণ শেষ করে দেই।
ওখানে দু’তিন দিন থাকি। তারপর আর একদিন আমরা পাকবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হলাম। সামনে মেজর (বর্তমান কর্নেল) জিয়ার বাহিনী, পেছনে আমরা। পাকবাহিনীর সামনের দলকে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলে এবং এই সংঘর্ষে আমাদের বহু সৈন্য শহীদ হয়। আমরা যখন খবর পাই তখন আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি- আমরা পিছু হটে সামরিক ছাউনিতে ফিরে আসি।
আমরা আবার মধুগ্রামে অবস্থান নেই। তারপর সেখান থেকে মুন্সিরহাট। সমগ্র এলাকাটিকে কেন্দ্র করে আমরা পজিশন নেই। কুতুবপুর জাম্পপুরা বেলুনিয়া রেলওয়ে পর্যন্ত আমার দায়িত্ব ছিল। মাসটি বোধহয় আগস্ট হবে। ৩৪ দিন বাঙ্কার করতে চলে যায়। সামনে একটি সেকশন রাখি। বন্দুরা পুলের ওখানে একটি ছোট টিম রাখি। একদিন সকালে পাকসেনারা পুল অতিক্রম করে যাচ্ছিল। আমরা হঠাৎ আক্রমণ করে ১০১২ জন পাকসেনাকে হত্যা করি। পাকসেনারা ফিরে গিয়ে অধিক শক্তি নিয়ে পুনরায় আসে। আমরা পুরো রাস্তা মাইন পুতে রেখে ছিলাম- যাতে ট্যাঙ্ক পর্যন্ত আসতে না পারে। কিন্তু তবুও পাকবাহিনী আক্রমণ চালালো। ১০ টার দিকে আক্রমণ করে। পাকবাহিনী ইয়া আলী বলে অগ্রসর হচ্ছিল। আমরা সামনা সামনি ওদের দেখছিলাম। বহু পাকবাহিনী মারা যায় তবুও সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা ছাড়েনি। আমাদের ৫৬ জন শহীদ হলো। কিছু আহত হয়। ওদেরকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। আমার সাথে লোকমান বলে এক সিপাই ছিল। সাথে এলএমজি ছিল। বাঙ্কারের চিদ্র দিয়ে ব্রাষ্ট এসে তারা মাথা সম্পূর্ণ উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে তৎক্ষণাৎ মৃত্যৃবরণ করে। আমি বেঁচে যাই।
সেদিন পাকবাহিনী কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। বেলা ২টার দিকে ওরা ওখানেই পাকা বাঙ্কার করতে শুরু করে। বাঙ্কার করতে গেলেই আমরা গুলি করতাম। ওরা বাঙ্কার বন্ধ রাখেতো। এ সময় প্রায় মুষল ধারে বৃষ্টি হতো । আমরা বৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধ করে যেতাম। একাই জমা ভিজতো আবার শুকাতো। ৫০০ গজের মধ্যে পাকবাহিনী এবং আমরা সামসমনি ১৫২০ দিন যুদ্ধ করি। ছোট খাট দুটো দেশের সামনসামনি যুদ্ধ বলা যেতে পারে। পাকবাহিনী পাকা বাঙ্কার করে আমাদের উপর দিনে রাতে অন্যান্য দিক দিয়ে বিভিন্নভাবে আক্রমণ চালায় কিন্তু সমস্ত জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনী ছিল। সবরকমের চেষ্টা করেও আমাদের ডিফেন্স ওরা ভাঙ্গাতে ওরা পারেনি।
পাকসেনা এবং আমরা সামনসামনি থাকি। তখন পুরো বর্ষা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুই দেখা যায় না। পাকসোনারা এ অবস্থার সুযোগ নেয়। তারা দুটি দিয়ে ৬৭ গানবোটে সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। পর পর চার হেলিকাপ্টারযোগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭ থেকে ৮টার সময় আমাদের পিছনে সৈন্য নামিয়া দেয়। সামনে তো পাকসেনা ছিলোই। আমার বিপদে পড়–লাম কারুণ আমাদের গানপয়েন্ট ফেনীর দিকে সামনে, পিছনে, পাশে এবং গানবোট সব ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা মেসেজ পেলাম পিছু হাটবার জন্য। কারণ এখানে থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু ছিল। আমি আমার বাহিনী নিয়ে চলে গেলাম। আর যারা ছিল তারাও চলে আসে। আমার সংবাদ যারা বিশেষ পায় তারা আসার পথে পকিস্তানীদের গুলিতে আমার বাহিনীর ৪৫ জন আহত হয়।, তবে কেউ মারা যায়নি। আমরা সবাই একত্রিত হয়ে পুনরায় ভবিষ্যাৎ কর্মপন্থা ঠিক করি। ঠিক সময়ই আমাদের উপর হুকুম হয় সিগনালস টিম গঠন করার জন্য। কারণ, আসলে আমি সিগনালের মানুষ। আমি চলে আসি আগরতলাতে। ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য আমি সিগনাল কোর গঠন করতে থাকি। সিগনালের অভাবেই অধিকাংশ যুদ্ধু সময়দানে আমার মার খাচ্ছিলাম। পরদিন যুদ্ধ করবার জন্য পুরো ব্রিগেডের জন্য সিগনাল টিম গঠন করি। ‘কে’ ফোর্স এবং এস ও ‘জেড’ ফোর্স’ নামে তিনটি ব্রিগেড গঠিত হয়। ‘কে ফোর্স এবং ‘এস ফোর্সের এবং সেই সঙ্গে জেড ফোর্সের জন্যও লোকজন সংগ্রহ করা হয়। ফ্লাইং অফিসার রউফ থাকেন এস ফোর্সের সাথে। আমি থাকি ‘কে’ ফোর্সের সাথে। আক্রমণ চালাই একযোগ। ফেনী মুক্ত করে ফেলী। পরবতীকালে ১০ম বেঙ্গলে আবার অস্ত্র ধরি সেকেন্ড হিসেবে। ক্রমশঃ অগ্রসর হতে থাকি। তারপর একের পর এক দখল করে চলি। চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। পুরো বিগ্রড নিয়ে চলিলাম। আমাদের সাথে ভারতীয় অনেক কোম্পানী ছিল। আমার আমরা ফৌজাদারহাট পর্যন্ত যাই- তখন যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আমরা ওখানেই থেকে থেকে যাই। টিবি হাসপাতালের ২০ মাইলের মধ্যে চট্টগ্রাম। ওখানে পাকবাহিনী সাথে তার ব্যাপক বাহিনীর হারায়।
আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি। পাকবাহিনী গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে, লুট করেছে, নারী ধ্বংস করেছে। গ্রামগুলোতে রাজত্ব কায়েম করেছিলো
স্বাক্ষরঃ শহীদুল ইসলাম
২৩.৩.৭৩
**১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে এ সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। মেজর শহীদুল ইসলাম একাত্তর সালে ক্যাপ্টেন পদে ছিলেন।