চন্দ্রপুর অপারেশন (কসবা ষ্টেশন থেকে তিন মাইল উত্তরে)
১৮ই নভেম্বর তারিখে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ‘তুলে’ আমাকে ডেকে বলেন যে, তারা যৌথ উদ্যোগে চন্দ্রপুর ও লাটুমুড়া হিল আক্রমণ করবে। সেখানে পাকিস্তানী সেনারা অবস্থান করছিল। আমাকে পরিকল্পনা করতে বলেন। আমি ব্রিগেডিয়ার সাহেবকেই পরিকল্পনা করার অনুরোধ জানালাম। তিনি পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার সাহেবের পরিকল্পনা আমার মনঃপুত হলো না। কারন চন্দ্রপুর গ্রামের সাথেই ছিল লাটুমুড়া হিল (পাহাড়)। আর চন্দ্রাপুর আক্রমণ করলে লাটুমুড়া হিল থেকে পাকসেনারা আমাদের অতিসহজেই ঘায়েল করতে পারবে। কিন্তু তিনি আমার কোন কথা না মেনে বলেন, আমাদের আক্রমণে পাকবাহিনী পালিয়ে যাবে। তিনি ট্যাঙ্ক নিয়ে এসে রাত্রিতে টহল দিতেন যাতে পাকসেনারা বুঝতে পারে এলাইড ফোরস এর প্রচুর ট্যাঙ্ক আছে। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চন্দ্র পুর আক্রমণ করা হলো। আমি তাকে অনুরোধ করলাম আমার দলের যে ক’জন সৈন্য যাবে আপনাদেরও ততজন সৈন্য যেতে হবে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন। ভারতীয় একটি কোম্পানীর নেতৃত্বে ছিলেন একজন মেজর। বাংলাদেশ বাহিনীর কোম্পানী পরিচালনা করেন লেঃ খন্দকার আব্দুল আজিজ। পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশ বাহিনীর সেনারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে এবং ভারতীয় বাহিনী ভারত সীমান্তের ভিতর দিয়ে ২২ শে নভেম্বর চন্দ্রপুর আক্রমণ করে। এই আক্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরাই শহীদ হয় বেশী। ভারতীয় বাহিনীর কোম্পানী কামান্ডার শিখ মেজর এবং তিনজন জুনিয়র কমিশন অফিসারসহ সর্বমোট ৪৫ জন সেনা ঐ যুদ্ধে শহীদ হয় এবং মুক্তিবাহিনীর শহীদ হয় ২২ জন। আহত হয় ৩৪ জন সৈন্য। আমাদের অফিসার লেঃ খন্দকার আবদুল আজিজ এই যুদ্ধে শহীদ হন। ২২ তারিখ রাত্রিতে চন্দ্রপুর আক্রমণ করলে পাকবাহিনীর সাথে সারারাত যুদ্ধ হয় এবং পাকবাহিনী শেষ পর্যায়ে পিছনের দিকে চলে যায়। পাকসেনা ও আমাদের যৌথ বাহিনী উভয়ই আরটিলারীর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের যৌথ বাহিনী যুদ্ধ করে চন্দ্রপুর দখল করে নেয় কিন্তু পুনরায় পাকবাহিনী চন্দ্রপুর দখল করে নেয়। ২৩ তারিখ বিকালে আমি চন্দ্রপুরে আহত ও নিহত সেনাদের আনবার জন্য কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠাই। কিন্তু তাদের কয়েকজন পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হয়। মাত্র ৮ জনের মৃতদেহ নিজ এলাকায় ফিরিয়ে আনতে মুক্তিবাহিনী সক্ষম হয়।
যুদ্ধশেষে পাকবাহিনীর সেনারা মুক্তিবাহিনীর মৃতদেহগুলি আখাউড়া নিয়ে গিয়ে জনতাকে দেখান যে তারা মুক্তিবাহিনীকে হত্যা করেছে। তারা গৌরব অনুভব করে। ভারতীয় গান পজিশনে ৬ জন সৈন্য শহীদ হয়। এতে বোঝা যায় পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণ ছিল খুব মাপের এবং দক্ষ সৈন্য দ্বারা পরিচালিত।
এই যুদ্ধের পর বাংলাদেশ বাহিনীর সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। কারন এমনভাবে শহীদ আর কোন রণাঙ্গনে হয় নাই। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
(২২ শে নভেম্বরের ঘটনা)