শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
যুক্তরাষ্ট্রের উচিত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করাঃ হেরসটাস্কির বক্তৃতা ও প্রস্তাব | প্রতিনিধি পরিষদের কার্যবিবরণী | ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
এইচ ১২২০২ কংগ্রেসনাল রেকর্ড-হাউস ডিসেম্বর ৯, ১৯৭১
নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ
জনাব হেরসটাস্কি। মাননীয় স্পীকার, নতুন রাস্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানের উপর আমি আজকে একটা সাধারন হাউস প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছি।
আমার বক্তব্যের শেষে রেকর্ডে আমি আমার প্রস্তাবটি যুক্ত করে দিবো যেটা নিজেই নিজের হয়ে কথা বলে। আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক জনগনের উপর জঘন্য নির্যাতনের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার সেই অঞ্চলের নাগরিকদের যেকোন প্রকার আনুগত্যকেই অস্বীকার করেছে। গৃহযুদ্ধ যা ইয়াহিয়া খান দ্বারা ২৫ মার্চ শুরু হয়েছিল এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক শুরু হওয়া লড়াই এক রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের ভাগ্য বন্ধ করে দিয়েছে।
মাননীয় স্পীকার, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেই অঞ্চলের আজকের সকালের প্রতিবেদন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে একসময়ের পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ঘিরে এবং প্রায় পরাজিত করে ফেলেছে। খুব অল্পসময়ের মধ্যে এই শক্তির হাতে কেন বিজয় থাকবে না তার কোন কারন আমি খুঁজে পাই না।
বাস্তবতার উপর ব্যবস্থা নিলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এইসব সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো বিবেচনায় নেয়া এবং নতুন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়া। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনগুলো আমাদের সরকারের নির্যাতনকারী ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন দেয়ার নির্দয় নীতিকে উল্টে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তব জীবনযাত্রার মুখোমুখি দাড় করানো উচিত।
২৫ মার্চ থেকে আমাদের সরকার নিরবতার মাধ্যমে পূর্বের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের গনহত্যাকে সমর্থন করেছে। ভারতের প্রচন্ডভাবে প্রতিবাদ করেছে যে হোয়াইট হাউস এবং ফগি বটনের মাধ্যমে বধির ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ প্রয়োগ করেই এই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে যা কিনা এক কোটি শরণার্থীকে কলকাতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের সরকারের অসারতা এবং এর স্নায়ুযুদ্ধের প্রতি দুর্বলতা, যেখানে ইয়াহিয়া সরকারের অব্যাহত সমর্থন প্রয়োজন, একমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিরতা বৃদ্ধি করবে এবং ভারতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দিকে নিয়ে যাবে। গৃহযুদ্ধ শুরু অবার পর প্রশাসন কর্তৃক ৮ মাস পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহই ভালোভাবে উদাহরনসহ বুঝাতে পারে বাংলাদেশ ট্রাজেডির প্রতি আমাদের সরকারের দ্বিমুখী নীতির দৈন্যতাকে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার সুনাম পুনরুদ্ধার করতে চায় এবং সামনের দশকে যেকোন ধরনের প্রভাব আশা করে তবে আমাদের দ্ব্যর্থ এবং পাকিস্তানি সরকারের দমন নীতি শেষ হতেই হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক এবং সামরিক পরিস্থিতির আলোকেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে ইয়াহিয়ার একনায়কতন্ত্র থেকে আলাদা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাই দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার নীতি বদলানো উচিত। আমার আজকের পেশ করা প্রস্তাবটি একটি অবাধ ও নতুন দক্ষিণ এশিয়া নীতি কাঠামোর ধারনা দেয় যেটা যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করবে।
বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার জন্য সাহসী সংগ্রামকে বিলম্বিত আমেরিকার স্বীকৃতির বাইরে আমার প্রস্তাবনা দক্ষিণ এশিয়ার সকল ক্ষেত্র থেকে বিদেশী সৈন্যদের প্রত্যহারসহ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহবান জানাচ্ছে। অন্যান্যগুলোর মধ্যে এর মানে হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য এবং কাশ্মীর থেকে পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার। বর্তমানে বাংলাদেশে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকেও আমাদের অস্বীকার করা উচিত না। গত ৯ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নৃশংসতার আলোকে এটা বিস্ময়কর না যে বাংলাদেশে এই বেঁচে যাওয়াদের উপর প্রতিশোধ নেয়া শুরু হতে পারে। যদিও সাধারন নৈতিকতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাতে কোন প্রতিশোধের প্রয়োজন নেই। একইভাবে, আমার প্রস্তাবনা পাকিস্তানি সৈন্যদের তড়িৎ এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য আহবান জানাচ্ছে। বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত বাঙালীদের একইরকম ব্যবস্থার জন্য আমাদের অবশ্যই চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
এবং আমার প্রস্তাবনা অবশ্যই স্বীকৃতি দিচ্ছে যে বর্তমানে ভারতে লক্ষ লক্ষ গৃহহীন শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য অবিলম্বে প্রচেষ্টা করা উচিত। পৃথিবীতে ভুক্তভোগীদের ত্রাণ দেয়ার আমাদের ঐতিহ্যগত আমেরিকান নীতি বলে যে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টায় অনুদান এবং সামগ্রী সরবরাহে আমরা উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথমে আছি।
মাননীয় স্পীকার, আমি বিশ্বাস করি পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের জন্য সময় এবং বিলম্বিত চিন্তাবোধ বাংলাদেশকে স্বীকৃতির পথে নিয়ে যাবে। এমন একটা নীতি শুরু করতে পারি না কেন যে নতুন রাষ্ট্রের জনগণ যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের সাবেক সরকারের থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা? পররাষ্ট্র বিষয়ে আমাদের অবশ্যই ন্যায়বিচার এবং নৈতিকতা বোধকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের প্রতি আমাদের নীতির দীর্ঘ বিলম্বিত পরিমার্জনের মাধ্যমে আমরা শুরু করতে পারি।
প্রস্তাবনা
দক্ষিণ এশিয়ার সংকটের প্রতি সংসদের উৎকন্ঠা প্রকাশ করছি।
যেহেতু গত বছর পূর্ব বাংলার জনগণ অবিশ্বাস্যকরভাবে নিজ সংকল্প এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য ভোট দিয়েছিল, এবং
যেহেতু সেই অঞ্চলের বেসামরিক জনগণের উপর পাকিস্তান সরকার নির্দয় নির্যাতন চালিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং এক কোটি শরণার্থীকে ভারতের দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং
এর ফলে পাকিস্তানি সরকার যেহেতু পূর্ব বাংলারর উপর নৈতিক কর্তৃত্ব হারিয়েছে এবং স্থায়ীভাবে সেই অঞ্চলের জনগণদের আলাদা করে দিয়েছে, এবং
নৃশংস এবং অগণতান্ত্রিক পাকিস্তান সরকারের প্রতি সমর্থন বন্ধ করে নৈতিক কর্তব্য নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার যেহেতু ব্যর্থ হয়েছে, এবং
যেহেতু ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই বর্তমান সংকটকে বাড়িয়ে দিয়েছেঃ তাই-
হাউজের দৃশ্যপট এই যেঃ
(১) যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উচিত দক্ষিণ এশিয়া নীতি বিশেষভাবে পরিবর্তনের জন্য, বিশেষ করে ভারত সরকারের সাথে এর অবনমিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে, অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
(২) ভারত এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহে উপর বর্তমান নিষেধাজ্ঞা অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচিত দক্ষিণ এশিয়ায় যেকোন সামরিক সম্পৃক্ততা সুন্দরভাবে এড়িয়ে চলা।
(৩) রাষ্ট্রপতির উচিত মুক্ত এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়া।
(৪) কাশ্মীরসহ বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারত থেকে সকল বিদেশী সৈন্যদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারসহ দক্ষিণ এশিয়ায় সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উচিত চাপ প্রয়োগ করা।
(৫) সকল রাজবন্দী ও শরনারথীর শীঘ্র প্রত্যাবসান এবং বন্দীদের সাথে ব্যবহার ও যুদ্ধ পরিচালনা আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সম্পূর্ন সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
(৬) শান্তি পুনঃস্থাপনের সাথে সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য বাংলাদেশে স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত, এবং
(৭) এই প্রস্তাবনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা গ্রহন করা এবং পূর্ণ অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য সরবরাহ করা উচিত।