শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে কংগ্রেস সদস্য মিঃ ই. গালাঘের বক্তৃতা | প্রতিনিধি পরিষদের কার্যবিবরণী | ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
০৮,ডিসেম্বর ১৯৭১ এইচ ১২০৩৯
প্রতিনিধি পরিষদের কার্যবিবরণী
উপমহাদেশের পরিস্থিতি
মিঃ গালাঘেরঃ মাননীয় স্পীকার,আমি এই বিষয়টি উত্থাপন করেছি ভারতীয় উপমাহদেশে পুঞ্জীভূত সঙ্কটের সমালোচনা নিয়ে বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত বিতর্কে আমার কিছু সহকর্মীর করা সুনির্দিষ্ট মন্তব্যের জবাব দিতে। এ বছরের মে তে আমিই প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট নিয়ে কংগ্রেস শুনানির আয়োজন করেছিলাম। কংগ্রেসের প্রথম সদস্য হিসেবে ভারতে শরনার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছি এবং প্রতিনিধি পরিষদে গৃহীত পাকিস্তান সরকারকে সকল প্রকার সাহায্যের নিষেধাজ্ঞা অনুমোদন করেছি। সেখানকার অগ্রগতি সম্পর্কে আমি প্রতিনিয়ত অবগত থেকেছি। আমি এখন ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু বিশেষ তথ্য ও এই বিষয়ের বেশ কিছু প্রমাণাদি নিয়ে কথা বলব। ভারতকে যেকোন দোষারোপ করার চেয়ে সত্যের অপলাপ আর কিছু হবে না। আর পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিয়োগান্তক বিভাজনের চেয়ে কিছুই ভারতীয় জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে না।
পটভূমি
এই সমস্যার মূল হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ফল পাল্টে দেয়ার জন্য পুর্ব পাকিস্তানে বর্বোরোচিত নির্যাতন শুরু করল যে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ দেশব্যাপী ৩১৩ টি আসনের মাঝে ১৬৭ টিতে জয় লাভ করে পাকিস্তানের উভয় অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং এর সমাধানও পুর্ব পাকিস্তানের ভেতরই প্রথিত আছে। ভারত এই সমস্যায় জড়িত পড়েছে কারণ বর্তমানে প্রায় ১০ মিলিয়ন শরনার্থী তার সীমান্তের ভেতর আবদ্ধ হয়েছে।
আমি শরনার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে যা দেখেছি শুধু বিতর্কের মাধ্যমে তা বোঝা যাবেনা। সংবাদপত্র,পত্রিকাগুলো চমৎকার বিবরণ এবং সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশনগুলোর বস্তুনিষ্ঠভাবে নির্মমতা ও ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য মানুষের দুর্দশা তুলে ধরেছে। ভারতে পালিয়ে আসা শরনার্থীদের আগুনে নিক্ষেপ করা ব্যতীত পুর্ব পাকিস্তানের ও তার নিজের দেশের সীমান্ত বন্ধ করার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন সভ্য সমাজ এধরনের কাজ করতে পারেনা। এই শরনার্থীরা ছিল সহায়হিণ,আতঙ্কিত তাদের কেউ কেউ ২৫০ মাইলের মত পায়ে হেটে এসেছে পাকিস্তানী সেনাদের থেকে পালিয়ে বাচতে যারা তাদের নিজের দেশের নিরীহ সাধারণ মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা,ধর্ষন আর লুণ্ঠন করছিল। পুর্ব পাকিস্তান চারদিক থেকে সম্পুর্নভাবে ভারতের সীমানা দ্বারা পরিবেষ্ঠিত এমনকি অনেক স্থানে চিহ্নিত করা উপায় নেই কোথায় পাকিস্থান সীমানা শেষ আর ভারতের সীমানা শুরু হয়েছে।
এই মানুষগুলোকে গ্রহন না করার একমাত্র বিকল্প ছিল সীমান্তের দিকে তাৎক্ষনিকভাবে মেশিনগান তাক করা এবং ৪-৫ মিলিয়ন শরনার্থীকে নির্মুল করে দেয়া। স্রষ্ঠাকে ধন্যবাদ যে ভারত ঐধরনের রাষ্ট্র নয় এবং তারা আতঙ্কিত অনাহারী বাঙ্গালীদের তার দেশে গ্রহণ করেছে। আমাকে প্রথম যখন উদ্ভুত হৃদয়বিদারক ঘটনার তথ্য সম্পর্কে অনুরোধ করা হয়েছিল তখন ১১ মে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিষয়ক উপকমিটির উদ্বোধনী ভাষনে বলেছিলাম,’’ ভিয়েতনাম ও বায়াফ্রার জঘন্য বৈশিষ্ট্যগুলো একত্রিত করুন।‘’ “ আমাকে বলা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কিছুই করা উচিত নয় কারণ আমরা চীন-সোভিয়েত —– এবং ভারতীয় উপমাহাদেশ এত জনবহুল যে সেখানে অতিরিক্ত ১০ মিলিয়ন মানুষ কোন পার্থক্য তৈরি করবেনা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের এক নেতা শেষ বিষয়টি আমার কাছে একটি চিঠিতে সবচেয়ে ভালভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি অধ্যাপক গ্যারেট হার্ডিন এবং আমার প্রতিক্রিয়া, উভয় বিষয়ের জন্য সহায়ক। ১৮ জুলাই প্রকাশিত আমাদের বিনিময়কৃত পত্র আমি আমার মন্তব্যের শেষে অন্তর্ভুক্ত করব।
ভারতঃ বেসামরিক আগ্রাসনের ভুক্তভোগী
মাননীয় স্পিকার, ভারতের অভ্যন্তরে শরনার্থী শিবিরগুলোতে পুর্বপাকিস্তানের শরনার্থীর সংখ্যা পৃথিবীর ৫৮ টি দেশের মোত জনসংখ্যার চেয়ে অধিক। সমগ্রমানব ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ স্থানান্তর এটি। ভারত শরনার্থীদের গ্রহণ করেছে একারণে নয় যে সে তাদের উৎসাহিত করেছে বা চেয়েছে। সে গ্রহন করেছে কারণ এছাড়া তার কোন উপায় ছিলনা।
সমগ্র পরিস্থিতির সবচেয়ে দুঃখজনক দিক হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর সরকার নির্বাচনে এক অভুতপুর্ব জয় পেয়েছে এবং তার দেশের ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সুদীর্ঘ গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শরনার্থীদের দেখভাল ও ভরনপোষনের ব্যয় ভারতের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানোর অগ্রগতিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।
সুতরাং আমরা পাকিস্তান সরকারের নীতির ফলাফল দেখতে পাচ্ছি- বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা ভীত সন্ত্রস্ত বাঙ্গালীদের একটি আন্তর্জাতিক সীমান্তের অপাড়ে ঠেলে দিচ্ছে যা ভারতের স্থিতিশীলতায় মারাত্নক হুমকি সৃষ্টি করছে।
এবং মাননীয় স্পীকার ভারত এখনো প্রায় ৮ মাস পর্যন্ত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। শরনার্থী সমস্যা চলমান ছিল এবং রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া পুর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা গোপন করতে কিছু বাহ্যিক পদক্ষেপ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলছে সেনা অভিযান তেমন সঙ্কটজনক কিছুই নয়। আমার মনে হয় চলমান অস্ত্র হস্তান্তরের মাধ্যমে দৃঢ় সমর্থন সম্ভবত রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়াকে আরও উৎসাহিত করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ভারত কিছুই করেনি কিন্তু শরনার্থীদের দেখভাল করেছে যদিও তার সরকার সম্পুর্ন ভুল মার্কিন অস্ত্র নীতির স্বীকার। কংগ্রেসের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আমি কিছু ভ্রান্ত তথ্য পেয়েছি এবং এটা হতে পারে ইচ্ছাকৃত তথ্যবিকৃতি অথবা না, সে বিষয় হচ্ছে অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্র চালান হস্তান্তর চলমান ছিল।
আমাদের কখনই ভুলে গেলে চলবেনা ভারত পৃথিবীর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সবচেয়ে বড়দেশ। প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর নির্বাচনী জয় তার জাতিকে নতুন আশা এবং তাদের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির উপর নতুন বিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। ভারতের প্রতি সতর্ক আচরণ কি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে না? আমাদের বহুল প্রচারিত সংস্কৃতির স্বার্থে ভারতের অবস্থান সহানুভূতি ও পারস্পারিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিবেচনা করা উচিত নয় কি? মাননীয় স্পীকার আমরা সেটা করিনি এমনকি ভারত সরকারের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক এখন সব সময়ের তুলনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ের। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই দুঃখজনক পরিস্থিতিতে ভারতের মর্যাদা ও গুরুত্ব হারানো দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ক্ষতির কারণ হয়ে থাকবে। যদি উন্নয়নশীল দেশগুলো সাম্যবাদ ও ফ্যাসিজমের কোন টেকসই বিকল্প খুজে পায় সেটা হবে গণতন্ত্র, কারণ গণতন্ত্র কার্যকর হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মত দেশে না হলেও ভারতের মত দেশে সবচেয়ে প্রতিকুল পরিবেশেও গণতন্ত্র আসলেই কাজ করেছে। এবং এটা এখনও কার্যকর রয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনা ভারতের অগ্রগতিকে স্থবির করে দিয়েছে এবং ভারতের সদ্য শুরু হওয়া অভ্যন্তরীণ নীতি যেগুলো ফলপ্রসু হতে যাচ্ছিল সেগুলো সম্পুর্নভাবে নস্যাৎ হতে বসেছে। ভারতের গণতান্ত্রিক সফলতার জন্য ফলাফলগুলো জরুরী। দুঃখজনক ঘটনার ভেতরে আরও একটি দুঃখজনক ঘটনা।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিদাতা হিসেবে বিবেচিত
দীর্ঘ ৮ মাসের ধৈর্য,সহমর্মীতা ও সহনশীলতার পর ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাঙ্গালীদের সহায়তা করতে তার সেনা পাঠিয়েছে। পুর্ব পাকিস্তানের জনগন যারা একটি পূর্ন আঞ্চলিক সায়ত্বশাসনের ভিত্তিতে ও পশ্চিম অংশের দীর্ঘ অর্থনৈতিক শোষনের বিরুদ্ধে একটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছে এবং ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনা অভিযান শুরুর পর তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নিবিড় সহযোগিতা করছে এবং মুক্তিবাহিনী ও স্বাধীনতাকামী মানুষের সাথে সমন্বয় করছে।
আমার ধারণা ভারত এখানে যুক্ত হয়েছে কারণ কোন ধরনের শক্তিশালী পদক্ষেপ ব্যতীত এই শরনার্থী মানুষদের ঘরে ফেরত পাঠাতে আর কোন সম্ভাব্য পথ দেখছিলনা। মাননীয় আমাকে বলতে দিন, আমি দুঃখিত যে ভারত এমনভাব তার জাতীয় নিরাপত্তা মুল্যায়ন করছে যেখানে সে সামরিক পদক্ষেপকে প্রয়োজনীয় বিবেচনা করেছে। এই যুদ্ধকে কেউ স্বাগত জানায়নি এবং সম্ভবত ভারতীয় নেতৃত্বর চেয়ে অধিক কেউই এর প্রয়োজনীয়তায় শংকিত হয়নি। নিশ্চিতভাবেই এই যুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর কাছে একটি অভিশাপ।
ভারতের পর্যাপ্ত ভুমি ও জনগোষ্ঠী রয়েছে তার নিশ্চয় এর বেশি প্রয়োজন নেই বা সে চায় না। একটি স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরে মারাত্নক সমস্যা তৈরি করতে পারে কারণ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী একই দিকে ধাবিত হতে পারে সুনির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিম বঙ্গ যেখানে ব্যাপক সংখ্যক শরনার্থী এই মুহুর্তে রয়েছে।
আমি আবারও বলছি ভারত পূর্ব পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হয়েছে কারণ তার নিকট ভবিষ্যতে ও অর্থনীতির উপর শরনার্থীর স্রোত থামাতে এটাই ছিল একমাত্র উপায়।
নির্বাচনে জয় পাওয়া ছিল বাঙ্গালীদের অপরাধ
মাননীয় স্পীকার আমাদের অবশ্যই বিস্মিত হওয়া উচিত যে এই যুদ্ধ যদি বৈশ্বিক রাজনীতিতে ঘৃণ্য ও বিদ্বেষী কর্মকান্ড হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে ভাঙ্গার জন্য হয়ে থাকে তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কেন প্রতিটি শহরে,গ্রামে মুক্তিদাতা হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। যদি পাকিস্তান সরকার এই ক্ষেত্রে আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে কেন আক্রমনকারী আর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাকিস্তানের মাটিতে ফুল আর উৎসাহ দেয়া হচ্ছে? কেন মাননীয় স্পীকার?
খুব সাধারণ, আমার মতে ভারত বাংলাদেশেরর বৈধ সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। আওয়ামীলীগ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করেছে এবং এটা তাদের সাড়া দেশে সংখাগরিষ্ঠতা দান করেছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি যে কংগ্রেসের আমার কিছু সহকর্মী অত্যন্ত নজিরবিহীনভাবে এধরণের ব্যাপক বিস্তৃত নির্বাচনের বিজয়কে অগ্রাহ্য করছেন। আমি হতবিহবল হয়ে যাচ্ছি আমরা যারা জনগনের ইচ্ছার উপর নির্ভর করি তারা কিভাবে পুর্ব পাকিস্তানের মানুষের এধরণের অসাধারণ জয়কে উপেক্ষা করছি।
.
যারা অবাধ , নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের দাবী জানিয়েছিল তাদের উপর রীতিমত হত্যা , ধর্ষণ, লুটতরাজ, জ্বালাও-পোড়াও করা হত আর সেজন্যই প্রায় ১০ লক্ষ্য বাঙালী ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল -যা আমার দৃষ্টিতে পাকিস্থানের অভ্যন্তরীণ আইনের সর্বস্বতা নিয়ে প্রশ্ন দূর করে ।বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী প্রয়োজনে যুদ্ধ করে ভোটাধিকার নিজেদের নিয়ন্ত্রনে আনতে চেয়েছিল শুধু রিফিউজিদের জন্য নয়, একটি মানব জাতির অভ্যন্তরীণ সর্বস্বতা রক্ষার জন্য । কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল অপ্রতিরোধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের যারা পূর্ব-পাকিস্থানকে পূর্নগঠিত করতে চেয়েছিল ।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিলেন যেন পরিকল্পনামাফিক তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে পিছুটানতে পারে আর যদি তারা সেটা করে শুধুমাত্র ঐক্যবদ্ধ পাকিস্থানের কারনেই করবে। কিন্তু প্রতিটি ধাপেই বাঙালীদের বিরোধীতার সম্মুখীন হল। তাই তিনি আঞ্চলিক এবং জাতীয় সমাবেশ করার জন্য কিছু পূর্ব-পাকিস্থানীদের নিয়োগ দিলেন ।যাদের অনেকেই আওয়ামীলীগের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে ।অথচ প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও তারা আওয়ামীলীগের বড় বড় নেতাদের সাথে লেনদেন করার চেষ্টা করেছিল ।কিন্তু তখনো বাংলার একচ্ছত্র মুখপাত্র ,আসল নেতা শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্থান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে কারারুদ্ধ ছিলেন।বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শেখ মুজিবকে বিনা-বাক্যে মুক্তি দেবার কথা বলাবলি হচ্ছিল যা প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেদিকে কর্ণপাত করেনি অথচ ভারতকে আক্রমণকারী হিসাবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছিল ।
উপেক্ষিত আলোচ্য বিষয়ঃ
মাননীয় স্পিকার , আজকে আমি বাংলাদেশের সংকটপূর্ণ অবস্থার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য দীর্ঘায়িত করতে চাইনা ।দলিল টা বিশ্বাসযোগ্য নয় কারন যখন ভারত সরকারের সাথে দমন , সমবেদনা , ধৈর্য্য ,রাষ্ট্রনায়কত্ব তুলনা করা হয় তখন বিশেষত উদ্ভট বলে মনে হয়েছে । তাছাড়া গোটা বিশ্বের নিকট জাতিকে যথেষ্ট দোষারোপ করা হয়েছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্থান সরকারকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগীতা করতে শুরু করলো আর এই সহযোগীতার হাত টা বাঙালীদের ধ্বংস করার কাজে লাগাতে লাগলো । মূলত ২৫ মার্চে পাকিস্থানের সেনাবাহিনীর পৈশাচিক আক্রমনের পরেই মূল সংগ্রাম শুরু হয় । এক পর্যায়ে “জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে” রূপধারণ করে । শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয় , চীনও তাদের সাহায্যের হাত বাড়ীয়ে দিয়েছিল নিরীহ বাঙালীদের ধ্বংস করার জন্য ।
উপসংহারঃ
সবশেষে আমি কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি –
প্রথমতঃ সংকট শুরু হয়েছে মূলত যখন ইয়াহিয়া খান তার সেনাদের অবাধ ,সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বাতিল করে বিজয়ী দল ও তার সমর্থকদের মেরে ফেলার আদেশ দেন ।
দ্বিতীয়তঃ প্রায় ১০ লক্ষ রিফিউজি ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং ভারত চাইলেই পূর্ব-পাকিস্থানের সীমানায় প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দিতে পারত ।
তৃতীয়তঃ ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সার্বিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে বেসামরিক লোকদের আগ্রাসনে ,তাছাড়া রিফিউজিদের জন্য মানবিক প্রয়াস অব্যাহত রাখা কঠিন ছিল বৈকি যেখানে জাতিসংঘ ও তার সদস্যরা বরাবরই উপেক্ষা করে গেছে ।
চতুর্থতঃ ভারত প্রায় ৮ মাস আমাদের জ্বালাতন ,অত্যচার সহ্য করেছে যা অনেকেই স্বীকার করেছেন ।
পঞ্চমতঃ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে খালাস দেবার কোন ইঙ্গিত তো দিলেন না বরং নিজেকে গোটা পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী দাবী করলেন ।তার সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সকল প্রচেষ্টা বাঙালীরা প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বিশ্বজুড়ে অনেক জ্ঞানীগুণী পর্যবেক্ষক এটাকে “ সৌন্দর্যবর্ধক” হিসাবে গ্রহন করল ।
ষষ্ঠতঃ ভারত যাদের সাহায্যের আবেদন উপেক্ষা করেছিল সেই অসহায় অতিরিক্ত রিফিউজি কষ্ট দুর্দশা থেকে পরিত্রান পাওয়ার একমাত্র উপায় হিসাবে অভিনয়কে বেছে নিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাঙালীদের জীবন বাচাতে । কারন সেখানে পাকিস্থানের সেনাবাহিনীদের দ্বারা বাঙালী হত্যার কোন অন্ত ছিল না । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আক্রান্তদের পাকিস্থানের নাগরিক হিসাবে উল্লেখ করতে লাগল । অথচ নিজের লোক দাবী করার পরেও সাধারণ জনসাধারণের উপর গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছেন ।
সপ্তমতঃ ভারতীয় সৈন্যদেরকে বাংলাদেশের লোকজন “মুক্তিদাতা” হিসাবে স্বাগত জানাচ্ছে ।
মাননীয় স্পিকার ,কোন ফলপ্রসূ ঘটনাই সংকট সৃষ্টির জন্য ভারতকে দায়ী করতে পারে না যদি গভীর ভাবে ভাবা যায় ।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিবেচনায় রেখে ভারতের মানহানী করার জন্য এমন কোন ঘটনা তৈরী করো এবং চলমান ট্র্যাজেডী যেন আরো বেগবান হতে থাকে ।