শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
সংঘর্ষের মূল কারণ প্রশাসনকে অবশ্যই উপলব্ধি হবেঃ সিনেটর কেনেডী | সিনেটের কার্যবিবরণী | ৭ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সিনেটের কার্যবিবরণী-সিনেট এস ২০৭২১
দক্ষিণ এশিয়ার সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি
মি. কেনেডিঃ মি. প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণ এশিয়ার সংকটে প্রশাসনের নীতি বুদ্ধিবৃত্তিকে উপেক্ষা করে।
ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও সামরিক নির্যাতনের ৮ মাস পর- পুর্ব বাংলায় লাখ লাখ বেসামরিক লোক হত্যা ও এক কোটি উদ্বাস্তু ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর- হঠাৎ করে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব স্বীকার করে যে দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কখন এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে? কে এটি শুরু করেছে? কী নিন্দনীয় হওয়া উচিত? এবং এ সম্পর্কে আমরা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কী করা উচিত?
সম্ভবত অনেক আমেরিকানের মনে এই চিন্তা যে ভারত সংকট সৃষ্টি করেছে। কিন্তু প্রমাণ দেখায় যে, মি. প্রেসিডেন্ট, এই যুদ্ধ গত সপ্তাহে সুপরিচিত সামরিক সীমা পারাপারের মাধ্যমে শুরু হয়নি, না গতমাসে ভারত ও পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান কামানের গোলাগুলিতে শুরু হয়েছে; এই যুদ্ধ ২৫ শে মার্চের কালো রাতে পূর্ব বাংলায় হওয়া মুক্ত নির্বাচন দমন করতে পাকিস্তান সেনাদলের বর্বর অত্যাচারের দ্বারা শুরু হয়েছে। ২৫শে মার্চের পরের ঘটনাবলী পর্যালোচনা- আমাদের স্মৃতিতে দ্রুত আঘাত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাটি হল আজ, এবং একেবারে শুরু থেকেই ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনকারী সামরিক শক্তি ও পূর্ব বাংলায় নির্বাচিত বিরোধী বাঙ্গালিদের মাঝে রাজনৈতিক বিরোধ।
এই যুদ্ধ আরম্ভের দলিলকরণে প্রকৃত ঘটনাসমূহ, এবং কে এটি শুরু করেছে, তা খুবই ভয়ানক এবং সন্দেহে থাকার মত যথার্থ রিপোর্ট করা হয়েছে, এমনকি একটি প্রশাসনের দ্বারা যারা এসব উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছে। ২৫ মার্চ হতে পূর্ব বাংলায় যে রক্তাক্ত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তার সত্যায়ণ করে অসংখ্য প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের দ্বারা এখন শত শত নিবন্ধ লিখা হয়েছে ও হাজার হাজার ছবি তোলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, পররাষ্ট্র দপ্তরে আসা গোপনকৃত তারবার্তা শুরুতে পাকিস্তান সেনাদলের কর্মগুলোকে ‘গণহত্যা’ বলে চিহ্নিত করেছে। সামরিক কর্তৃপক্ষ বিদেশি সাংবাদিকদের বহিস্কার করেছে পাছে তারা এই মহাহত্যাকান্ড নথিভুক্ত করে, এবং বিদেশি ক্যামেরাম্যানদের ফিল্ম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
এটা শুধুমাত্র এপ্রিলে পূর্ব বাংলা থেকে উদ্বাস্তুদের ঢল নামায় এই নির্যাতনের গল্প ধীরে ধীরে একে অপরকে খুশি করতে পারে। এমনকি এখনও, এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পূর্ণমাত্রা পুরোপুরি জানা হয় নি। তথাপি, রাতে সেনাদলসমূহ ঢাকায় চড়াও হওয়ার পর, তারা নির্বিচারে আবাসিক এলাকায় গোলা নিক্ষেপ করেছে, বিশ্যবিদ্যালয় ছাত্রদের বাসস্থানে আক্রমণ করেছে, এবং যেসব সন্দেহভাজন আওয়ামীলীগারদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব তাদের তারা কারাগারে নিয়েছে অথবা হত্যা করেছে। হাজার হাজার পূর্ব বাঙ্গালি পুরাপুরিভাবে উদাও হয়েছে এবং তাদের কথা আবার শোনা যায়নি। হাজার হাজার লোক মরেছে এবং আরও অনেক হাজার লোক গ্রামে আশ্রয় খুঁজেছে। ঢাকা ২৪ ঘন্টার মাঝে ভুতুরে শহর হয়ে যায়, এবং তারপরের কয়েকসপ্তাহ এটি পদাবনত ও শূন্য থাকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী জনগণকে গ্রাম পর্যন্ত অনুসরণ করে। পর্যায়ক্রমে, ইয়াহিয়া শাসনের অনুগত এক পাকিস্তানি সাংবাদিকের মত, সৈন্যদলসমূহ আওয়ামীলীগের বিদ্রোহ দমন করতে এবং পুরো পূর্ব বাংলা জুড়ে আওয়ামী মিলিশিয়া নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করে।
৪২১
আওয়ামীলীগকে পিষ্ট করতে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর গ্রামাঞ্চলে যাওয়ার পর, ভারতে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তুরা হিন্দু হওয়াসহ সব প্রমাণ নির্দেশনা দেয় যে এই উদ্দেশ্যের সাথে সংখ্যালঘু হিন্দু জনসংখ্যার প্রতি প্রাথমিকভাবে পরিচালিত হওয়া সন্ত্রাসের নীতিও ছিল।
কিছু এলাকায়, গ্রীষ্মের শেষদিকে প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রতিবেদন অনুসারে, পাকিস্তান সৈন্যদল হিন্দু দোকানসমূহের উপর বড় হলুদ ‘এইচ H’ অংকন করে, যাতে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি চেনা যায়, আসলে যারা বিশেষ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। তারা হিন্দুদের মত দেখাতেনয় তারা অর্থাৎ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সদস্যরা-(যদিও তারা সেনাবাহিনির ত্রাস থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিল না) তাদের বাড়ি ও দোকানে “সব মুসলিম ঘর’ অংকন করে। এর ফলে, ছোট খ্রিষ্টান সম্প্রদায় তাদের দরজায় ক্রস লাগাচ্ছিল ও তাদের কাপড়ে লাল সুতায় ক্রস সেলাই করছিল। নাৎসীবাহিনীর খুব বেশি আগের ঘটনা নয় যখন জার্মানীতে অসংখ্য নাগরিককে জনসম্মুখে ধর্মীয় লেবেল প্রতিক দ্বারা চিহ্নিত করার হয়।
২৫শে মার্চের ধ্বংসাত্নক রাতের পর থেকে ভয় পূর্ব বাংলাকে ঘিরে ফেলে। বিশ্বব্যাংক মিশন, জুনের শুরুতে পূর্ব বাংলায় কিছুদিন ঘোরার পর, সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় যেঃ
সম্ভবত সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, লোকজন সামনে পা বাড়াতে ভয় পাচ্ছে, যার ফলে, বাণিজ্য আক্ষরিকভাবে বন্দি হয়েছে, এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম সাধারণভাবে খুবই মন্দায় আছে।
পরিষ্কারভাবে, কিছু এলাকায় উন্নতি সত্ত্বেও এবং পুরো প্রদেশ একসাথে নিলে, ভারি যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ের পরেও ব্যাপক ভয় জনগণের মাঝে বিদ্যমান আছে। এটা প্রতীয়মান হয় যে এটা শুধু গ্রামাঞ্চলে ও মূলসড়কের গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সহগামী নয়, যদিও এই পর্যায়ে কেবল সৈন্যদলের উপস্থিতি প্রায়ই আতঙ্ক তৈরির জন্য যথেষ্ট মনে হয়। যাইহোক, কোন প্রশ্ন নেই যে সেনাবাহিনী তার শাস্তিমূলক কর্মকান্ড বজায় রাখছে, এমনকি যদি নির্দিষ্ট শক্তির দিকে পরিচালিত হয় (যেমন পরিচিত অথবা সন্দেহভাজন আওয়ামীলীগ সদস্য, ছাত্র, অথবা হিন্দু)। বিস্তির্ণ জনসংখ্যায় ভয় উৎপাদনে এগুলোর প্রভাব রয়েছে।
গ্রীষ্মের মাসসমূহ জুড়ে প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনি হয়- গত আগস্টে নতুন উদ্বাস্তু যাদের আমি ও মাঠ পর্যায়ের উদ্বাস্তু উপকমিটির সদস্যরা সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাদের সাক্ষাতকারসহ ভারতে থাকা শত শত উদ্বাস্তুদের সাক্ষাৎকারেও একই কথার প্রতিধ্বনি হয়।
এই সময়কাল জুড়ে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব এই দুঃখজনক ঘটনা নীরবে দেখেছে, প্রেসিডেন্টসহ আমাদের সরকারের কোন কর্মকর্তা পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই বর্বরতা ও পর্যায়ক্রমিক অত্যাচারের নিন্দা করেনি- যে অত্যাচারে আমেরিকান বন্দুক ও বুলেট এবং বিমানের অংশগ্রহণ রয়েছে। এবং এমনকি গত কিছু সপ্তাহে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন নাটকীয়ভাবে তার সন্ত্রাস ও অত্যাচার বৃদ্ধি করেছে, তখন আমাদের জাতি নীরব অসাড় হয়ে বসে রয়েছে।
এখন ২৫ শে মার্চের ৮ মাস পর প্রশাসন আমাদের বলে যে- আমাদের উচিৎ নিন্দা করা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার নয়, ভারতের সীমান্তে ক্রমশ বেপরোয়া পরিস্থিতির প্রতি ভারতের প্রতিক্রিয়াকে। একটি পরিস্থিতি যাকে আমাদের দেশে হিসাব করেই উপেক্ষা করেছে। নিশ্চিতভাবেই, নিন্দাকরণ সমর্থনযোগ্য; কিন্তু আমাদের কী সমালোচনা করা উচিৎ?
৪২২
আমাদের নেতৃত্বের নীরবতাকে ,আমাদের নিন্দা করা উচিৎ, মি. প্রেসিডেন্ট। আমাদের দেশ যার পক্ষে দাঁড়ায় তার প্রতি কি আমরা এমনই অনুভূতিহীন যে আমাদের সরকার প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে সামরিক শাসকদের বর্বর দমনকে সমর্থন করে পাশাপাশি তার জন্যে ক্ষমা চায়? আমরা কি এমনই অন্ধ যে আমরা একটি সরকারকে উপেক্ষা করতে পারি যে একজন রাজনৈতিক নেতাকে জেলে নিক্ষেপ করে, যার একমাত্র অপরাধ মুক্ত নির্বাচনে জয়লাভ করা?
মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের উচিৎ বিশ্বের নীরবতা এবং ভারতে উদ্বাস্তু প্রবাহের কারণে যে ব্যাপক মানব ভুগান্তি হয়েছে তার প্রতি অবহেলাকে নিন্দা করা। শুরু থেকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া অযৌক্তিকভাবে নিশ্চেষ্ট ও পুরাপুরি অযথার্থ। আধুনিক সময়ে মানব দূর্ভোগের স্রোতে অসমান এই ব্যাপারটিতে কম গরজ দেখানো হয়েছে ও কম গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। উদ্বাস্তুদের চাহিদা অবহেলা করে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের অর্থনৈতিক স্থীতি ও কল্যাণকে বিপদাপন্ন করে ভারতের জনগণকেও বিচ্ছিন্ন করেছি।
আমাদের আরও উচিৎ আমাদের অবহেলা ও অসাড়তাকে নিন্দা করা যার ফলে খাবার ও আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন ৪,৩০০ উদ্বাস্তু শিশু মারা যাচ্ছে। আমাদের উচিৎ পরিস্থিতিকে সমালোচনা করা যা আরও মিলিয়ন মিলিয়ন লোকের মৃত্যু ও দুর্ভোগের কারণ হয়েছে কারণ ভারতে রিলিফ এজেন্সিদের জন্য অপর্যাপ্ত তহবিল তৈরি করা হয়েছে।
মি. প্রেসিডেন্ট, ইসলামাবাদের সাথে সুবিধা বজায় রাখার জন্য পাকিস্তানকে নিন্দা করার অস্বীকৃতিকে ন্যয্যতা প্রদান করেছে। উদ্বাস্তুদের উপর উপকমিটির সামনে শুনানি, এবং অন্যখানে কংগ্রেস ও আমেরিকার জনগণকে বারবার ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে যখন আমাদের সুবিধা ও কূটনীতি কার্যকর হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, মুক্ত ও অন্য জায়গায় খুব কম নথি রয়েছে যেখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে অনেক সুবিধাই নেয়া হয়েছে। এবং উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হিসেবে আমেরিকান সামরিক যোগান পরিবহনের লাইসেন্স বাতিলের ক্ষেত্রে- সুবিধাটি শেষ করা হয়েছে মাত্র মাস খানেক আগে, কিন্তু শুধুমাত্র ইসলামাবাদের সাথে পূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে।
এবং তাই রেকর্ড পরিষ্কার যে- সমস্যা বৃদ্ধিকালীন মাস জুড়ে- আমাদের সরকার একটি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছিল যে শুধুমাত্র একটি নির্বাচনকেই চাপা দেয়নি বরং এই প্রক্রিয়ায় এমন সব নীতি ধ্বংস করেছে যার জন্য আমাদের দেশ মাত্র ২,০০০ মাইল দূরে ভিয়েতনামে অনেক সময় ধরে অনেক কিছু বিসর্জন দিচ্ছে। সম্ভবত ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের মাঝে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে পাকিস্তানে আমরা নীতিসমূহের সমর্থনের ছুতা ধরছি না, যাতে করে, কার্যকর ক্ষেত্রে, কোন নীতিই ভঙ্গ হতে পারে না।
এবং এখন- পূর্ব বাংলায় গত কয়েকমাস জুড়ে সহিংসতার উপর পাকিস্তানি অনুভূতির সাথে সূক্ষ্ম তুলনায় আমাদের পার্থক্য হচ্ছে- আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব হঠাৎ করে ভারতকে নিন্দা করে। আমরা তাকে আমাদের হতাশা ও ব্যর্থতা, এবং পাকিস্তানের প্রতি আমাদের নীতির দেউলিয়াত্বের বলির পাঠা বানিয়েছি। আমরা শুধুমাত্র ভারতের প্রতি সামরিক সাহায্যই বন্ধ করিনি- যার উপর কেউই ঝগড়া করবে না- বরং আমরা অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য বন্ধেরও হুমকি দিচ্ছি।
প্রকৃতপক্ষে, গতকাল আমাদের সরকার প্রায় ৮৭.৬ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার উন্নয়ন ঋণ স্থগিত করেছে, যা শুধুমাত্র শাস্তিমূলক পদক্ষেপরূপেই ব্যাখ্যা করা যায়।
এই প্রশাসন মানবজাতির একপঞ্চমাংশের অধিকারী চীনের সাথে সম্পর্ক পূনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টার সঠিক গৌরব গ্রহন করেছে। কিন্তু আমরা কি একসঙ্গে মানবজাতির এক-ষষ্ঠমাংশের অধিকারী ভারতকে বিচ্ছিন্ন করতে চাচ্ছি- যা একটি গণতান্ত্রিক দেশ যাদের সাথে আমাদের অনেক বছরের উৎপাদনশীল সম্পর্ক রয়েছে?
৪২৩
মি. প্রেসিডেন্ট, শেষ সপ্তাহে প্রশাসন বিলম্বিতভাবে জাতিসংঘের দিকে মুখ ফিরিয়েছে, তার কাছে শান্তিরক্ষার পদ্ধতির প্রয়োগ চেয়েছে- একটি পদক্ষেপ যা আমদের অধিকাংশই মাসখানেক আগে সমর্থন করেছে। আমরা সবাইই আশা করি অবশেষে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও স্বস্তি আনতে যা প্রয়োজন আমাদের দেশ তা করবে।
মি. প্রেসিডেন্ট, আমি প্রশ্ন করি যখন এই উদ্বাস্তুদের সৃষ্টি হচ্ছিল তখন কেন আমরা জাতিসংঘে যাচ্ছিলাম না? কেন আমরা জাতিসংঘে যাচ্ছিলাম না যখন পূর্ব বাংলায় জনগনের উপর নিয়মানুযায়ী অত্যাচার ও নির্যাতন চল ছিল? জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে, কেন আমরা এটি উপস্থাপন করিনি এবং গত ৩৬ ঘন্টায় যেসব বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে তার সাথে এটি অনুসরণ করিনি? বাঙ্গালিদের মানবিক প্রয়োজনীয়তার সময় কেন আমরা আমাদের চিহ্নিত করিনি? কেন আমরা ঐ সময় এই অত্যাচারের নিন্দা করিনি যে অত্যাচারের মানে হল অনেক হাজার লোকের হত্যা বা খুন? ঐ সময় আমরা কোথায় ছিলাম? এখন ভারতের কাজের নিন্দা করতে আমরা জাতিসংঘে যাচ্ছি।
নিরাপত্তা পরিষদে আমাদের সমর্থিত রেজ্যুলুশন আমরা যেসব উদ্দেশ্য খুজছি তার সহায়তা করে না। আমাদের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার এটি সহ কোন রেজ্যুলুশনই উদ্বাস্তু আন্দোলনের কারণসমূহ মোকাবেলা করে না, ভারত থেকে স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তনের সাথে জড়িত প্রয়োজনীয় জিনিসসমূহও মোকাবেলা করে না।
এটিই হল এই সংঘর্ষের ভিত্তি যা এখন বর্তমান আছে- ১০ মিলিয়ন উদ্বাস্তু তৈরির কারণ, পৃথিবীর এই অংশে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে তহবিল অপসারণ অনুসারে উদ্বাস্তুরা ভয়ানক ঝুকি উপস্থাপন করে, পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও যা জড়িত আছে। এই বড় উদ্বাস্তু স্রোতের পেছনের কারণ নিয়ে টু শব্দটিও হয়নি। এটিই হল এই সমস্যার ভিত্তি। জাতিসংঘে আমাদের রেজ্যুলুশনে, কিভাবে উদ্বাস্তু তৈরি হয়েছে তা নিয়ে একটিও শব্দ নেই।
সমস্যা হল আমাদের সমর্থিত কোণ রেজ্যুলুশনই এই সংকটের মূল কারণ, বাংলাদেশ শক্তিসমূহের আগ্রহ, অথবা আশু প্রয়জনীয়তা, ইসলামাবাদ ও তার বাঙ্গালি বিরোধীদের মাঝে রাজনৈতিক দরকষাকষির সমঝোতার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেনি। রেজ্যুলুশনের মূল অংশে কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ বিরতির আবেদন করেছে, অনিবার্য কারণস্বরূপ এই যুদ্ধ চলছে- যে এই সংঘর্ষের উৎস এখনও পুঁজপূর্ণ।
এটা এমন একটি নিষ্ঠুর বিদ্রুপ যে সাউথ এশিয়া ও ভিয়েতনামে আত্মনির্ধারণ নিয়ে আমরা কথা বলি। আমরা ৫৫,০০০ আমেরিকান হারিয়েছি যারা সেখানে নিহত হয়েছে কারণ আমরা চাই যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের লোকেরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা নির্ধারণে সক্ষম হোক।
আমরা জানি যে পূর্ব বাংলার লোকেরা নির্বাচনে গিয়েছিল। এই নির্বাচনী মার্শাল ল’ এর অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, শেখ মুজিব এবং আওয়ামীলীগ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে। এটা গণতান্ত্রিকভাবে হওয়া একটি নির্বাচনী, তাকে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করার যথার্থ সমর্থনসহ। তথাপি, কী ঘটল? তাকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছে কারণ তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। এখন আমরা আমাদেরকে চিহ্নিত করছি সামরিক শাসকদের সাথে যারা তাকে জেলে পুড়েছে। এরকম একটি নির্বাচনী নিশ্চিত করার জন্য ভিয়েতনামে ৫৫,০০০ আমেরিকান মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। তথাপি আমরা আমাদের চিহ্নিত করছি এমন একটি শাসকের সাথে যে যথাযথ নির্বাচিত কর্মকর্তাকে কোন নাগরিক বিচারের ছুতা ছাড়াই অথবা নির্বাচনে তার সাফল্যের স্বীকৃতি ছাড়াই তাকে জেলে পুড়েছে।
৪২৪
মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের সরকার ও জাতিসংঘকে অবশ্যই বুঝতে হবে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাদলের কর্মকান্ডই শক্তিগুলোর উন্মোচন করেছে যা দক্ষিণ এশিয়ায় এই যুদ্ধ তৈরি করেছে।
দক্ষিণ এশিয়া থেকে কোন পর্যবেক্ষকই এই গভীর অনুভূতি ছাড়া বের হতে পারবে না যে এই শক্তিসমূহ- জাতীয়য়াবাদ ও আত্মনির্ধারণ- অস্ত্রের শক্তি দ্বারা সফলভাবে আটকে রাখা যাবে না। পূর্ব বাংলার জন্য আত্মনির্ধারনের অধিকার- যার জন্য পূর্ব বাঙ্গালিরা শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচিত করেছে, এবং যার জন্য তারা এখন লড়ে ও মরে- কোন সন্দেহ ছাড়াই ঘটনাক্রমে অর্জন করা যাবে। শুধুমাত্র গঠন ও পরিস্থিতিই সন্দেহে থাকে।
গত মে’র মত যত প্রথমদিকে সম্ভব, আমাদের সরকারের প্রতি দাপ্তরিক প্রতিবেদন বলে যে পুর্ব বাংলার জনগণের বিশাল অংশ সম্ভবত চিরদিনের জন্য, পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তারপরের ঘটনাসমূহ এইসব প্রাথমিক প্রতিবেদনের অভ্রান্ততা নিশ্চিত করেছে। এবং কারণ অনেক রক্ত ঝরেছে, খুব কম সন্দেহই আছে যে পূর্ব বাংলার জনগণ ও তার নেতৃত্ব ২৫ মার্চের আগে বিদ্যমান থাকা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আবারও গ্রহন করবে।
এখনই ‘বাংলাদেশ’ অস্তিত্বশীল এই সত্য আমাদের সবার স্বীকার করে নেওয়ার সময়। শুধুমাত্র বাঙ্গালি সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনেই নয়, বরং বর্তমান ঘটনাসমূহের বাস্তবতায়।
যদি আমরা সত্যিকারভাবেই এই সত্যকে স্বীকৃতি দেই- এবং পূর্ব বাংলা জুড়ে ক্রমবর্ধমান মানব-দুর্ভোগ ও প্রতিহিংসার রক্তপাত এড়াতে চাই- শান্তি ও স্বস্তির জন্য শর্ত হিসেবে নিম্নোক্ত আন্তঃসংযুক্ত পদক্ষেপসমূহ অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করে।
প্রথমত, আমাদের অবশ্যই অনুমোদিত ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতায় পরিদর্শিত সকল সমরদলের তাৎক্ষণিক অচল যুদ্ধবিরতি খোঁজা দরকার। ১৫ থেকে ৩০ দিনের একটি সময়সীমা দেওয়া উচিৎ যা ‘শীতলকরণ’ সময়কালে সকল দলের অংশগ্রহনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুসমূহ সমাধানের প্রয়োজনে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, আমাদের অবশ্যই ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে এবং পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তার বাঙ্গালি বিরোধীদের মাঝে তাৎক্ষণিক ও যুগপত আলাপ-আলোচনা খোঁজা দরকার।
ভারত-পাকিস্তান আলোচনার উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ পশ্চিম ফ্রন্টে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি ফিরিয়ে আনা, এবং বর্তমান সামরিক বিরোধীতা থেকে সাধারণভাবে তৈরি হওয়া নতুন ইস্যুসমূহ সমাধান করা। পশ্চিম পাকিস্তানি-বাঙ্গালি আলাপআলোচনার উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ মর্যাদা নির্ধারণ, এবং ঐ পরিস্থিতি যা ভারত থেকে ১০ মিলিয়ন বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেয়।
এবং আমাকে এখানে চাপ প্রয়োগের সুযোগ দেন, মি. প্রেসিডেন্ট, যে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যত মর্যাদা যাই হোক- স্বাধীন অথবা স্বশাসনের যে রূপেই হোক- এটা সংকটপূর্ণ যে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিসমূহের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের জন্য আলোচনার সময় সকল দলের মাঝে একটি চুক্তিতে পৌছা উচিৎ। এই যুদ্ধে বন্দী হওয়া সকল পক্ষেরই জিম্মি রয়েছে। পাকিস্তান সেনাদল এখন অগণিত বাঙ্গালি গেরিলা এবং নির্বাচিত আওয়ামীলীগ কর্মকর্তা আটক করে রেখেছে। পালাক্রমে, এটা অনুমেয় যে অতিশীঘ্রই বাঙ্গালি গেরিলারা তাদের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপাদান আটক রাখবে। তদোপরি,
৪২৫
৭ থেকে ৮ মিলিয়ন বিহারী সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় পুর্ব বাংলায় রয়েছে, যখন, অবশই, শেখ মুজিবুরসহ প্রায় ১০ মিলিয়ন বাঙ্গালি পাকিস্তানে আছে।
যদি প্রতিশোধ ও সাম্প্রদায়িক-ধর্মীয় সংঘর্ষের একটি ভয়ানক, বোধহীন রক্তপাত এড়াতে হয়, তবে এই লড়াইয়ের সব দলকে অবশ্যই এই লড়াইয়ের সব জিম্মিদের সংরক্ষিত রাখতে হবে এবং সমবেদনা ও সংবরণের জ্ঞান এবং জেনেভা কনভেনশন মেনে চলতে হবে। জেনেভা কনভেনশনের প্রযোজ্যতা স্বীকৃতির ঘোষণার দ্বারা ভারত সরকার এই পথে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহন করেছে।
তৃতীয়ত, যুদ্ধের ফলে বাস্তচ্যুত হওয়া দুর্ভিক্ষের হুমকিতে থাকা মিলিয়ন মিলিয়ন লোকের স্বার্থে আমাদের অবশ্যই পূর্ব বাংলায় জাতিসংঘ রিলিফ মিশনের তাৎক্ষণিক পুনঃপ্রবর্তনের জন্য প্ররোচনা দিতে হবে।
পূর্ব বাংলায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টা সবসমই কার্যকর মাঠ কার্য থেকে আশা ও অনুপ্রেরণাই বেশি। এটার প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র তখনই আসবে যখন বাংলার গ্রামাঞ্চলে শান্তি ফেরানো হবে।
তবুও, আগুয়ান পুনর্বাসন ও ত্রাণ সমস্যার সমাধানে এখনই চিন্তা শুরু করার দ্বারা আমাদের জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই পূর্ব বাংলার পুনর্গঠনে আমাদের দ্বায়িত্বকে স্বীকার করতে হবে। একসময় যখন আমাদের সরকার নিন্দায় ও দক্ষিণ এশিয়া সহায়তা বন্ধে বেশি আগ্রহী দেখা যায়। আমি আশা করি আমাদের জাতীয় আগ্রহ খুব শীঘ্রই ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতি খুঁজে পাবে অথবা এই অঞ্চলের সব জাতি আমাদের বিদেশ নীতি ও আমাদের মানবিক বোধের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
মি. প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণ এশিয়ায় মানব বঞ্চনা ও সংঘাতের ভুত সদর্পে চলার সময় আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব দীর্ঘ ৮ মাস ধরে নীরব এবং প্রায় অসাড় ছিল। এটি এখন সংকটের শেষ ধাপে আছে- সাথে এমনকি এখন আরও বেশি উদ্বাস্তু বাড়ছে কারণ এই এলাকা জুড়ে সংঘাত বেড়েছে- কিন্তু আমি অনুভব করি আমাদের সরকারের জন্য এই অঞ্চলের শান্তি ও স্বস্তিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ এখনও আছে। তাই আমি প্রশাসনকে প্ররোচনা দেই তার নীতি পরিবর্তন করতে। তাদের অবশ্যই এই সংঘাতের উৎস বিবেচনা করতে হবে, এবং পূর্ব বাংলায় মৌলিক রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এর থেকে কোন কিছু কম হওয়ার মানে হল আরও যুদ্ধ, আরও উদ্বাস্তু, আরও বোধহীন মৃত্যু…