You dont have javascript enabled! Please enable it! শালদা নদীর যুদ্ধ | সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ* ১৯৭৪-১৯৭৫ - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২ নম্বর সেক্টর ও ‘কে’ ফোর্সের যুদ্ধের বিবরণ সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ* ১৯৭৪-১৯৭৫ ………১৯৭১

 
শালদা নদীর যুদ্ধ

শালদা নদী এলাকায় শত্রুদের ঘাঁটিটি খুবই শক্তিশালী ছিল। এই ঘাঁটির উত্তর দিক দিয়ে শালদা নদী প্রবাহিত হওয়ায় শত্রুদের উত্তর দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ ছিল। পূর্ব দিকে রেলওয়ে ষ্টেশন উঁচু রেললাইন সম্মুখবর্তী এলাকায় শত্রুদের নিরাপত্তার প্রাধান্য বিস্তার করে। পশ্চিমের গুদামঘরের উঁচু ভূমি তাদের শক্তিশালী ঘাঁটির নিরাপত্তার বেশ সহায়ক ছিল। এই অবস্থানটিকে নিয়মিত প্রথায় আক্রমণ করে সফল হওয়া দুষ্কর ছিল। শত্রুঘাঁটির এই সকল বৈশিষ্ট্য তাদের পক্ষে সহায়ক হওয়ার আমরা এই ঘাঁটিটিতে নিয়মিত প্রথায় আক্রমণ না করে অনিয়মিত পদ্ধতিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই। শত্রুদের ঘাঁটিটি পর্যবেক্ষণের পর আমরা আরো জানতে পারি যে; শালদা নদীর তীর বরাবর আমাদের ঠিক সামনে তারা তারা চারটি বড় পরিখা খানন করেছিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘাঁটিটিকে তিনদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন গাফফার ও নায়েব সুবেদার সিরাজের নেতৃত্ব একটি প্লাটুন শালদা নদী রেলস্টেশনের পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয়। সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে আরেকটি প্লাটুন শালদা নদীতে শত্রুর ঘাঁটির বিপরীত দিকে অবস্থান নেয়। পাকসেনা যাতে আক্রমণের সময় আমাদের পেছন থেকে আঘাত না হানতে পারে সেজন্য সুবেদার ওয়াহেবের নেতৃত্বে একটি কম্পানী মঙ্গল মিয়ার অবস্থানের পেছনে নিরাপত্তা মূলক অবস্থান গ্রহন করে। এছাড়া পাকসেনাদের মনোযোগ অন্যদিকে আকর্ষণ করার জন্য চারটি ছোট রেইডিং পার্টিকে বড় ধুশিয়া , চান্দলা , গোবিন্দপুর , কায়েমপুর প্রভৃতি শত্রুঘাঁটির দিকে পাঠানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এইসব রেইডিং পার্টিগুলো ১৫ই নভেম্বর রাতে পাকসেনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য শত্রুঘাঁটির উপর আক্রমন চালায়। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা শালদা নদী থেকে রেইডিং পার্টির উপর কামান ও মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করে। এই গোলাবর্ষণ সমস্ত রাত ধরে চলে এবং ভোরের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের আক্রমণ শেষ হয়ে গেছে ভেবে পাকসেনারা পরদিন সকালে কিছুটা অসতর্ক হয়ে পরে এবং বিশ্রামের সুযোগ নেয়। এই সময় তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহগুলো রাজাকার এবং ইপকাফ এর প্রহরাধীন ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যেঃ শত্রুরা সাধারণত রাতের বেলায় আমাদের সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য যতটা সতর্ক থাকত দিনের বেলায় ততটা প্রস্তুত থাকত না।

এমতাবস্থায় আমরা তাদের এই অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে সকাল ৮ টার দিকে তাদের উপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ি প্রচন্ড আক্রমন চালাই।

সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি পশ্চিম দিক থেকে শালদা নদী গুদামঘরের পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর এবং নায়েব সুবেদার রিয়াজ পূর্বদিকের পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান থেকে নদীর অপর দিকের পরিখাগুলোতে আর আর এর সাহায্যে শত্রুদের চারটি পরিখা ধ্বংস করে দেয়। এতে আমাদের যথেষ্ট সুবিধা হয় এবং পাকসেনারা সম্মুখবর্তী পরিখা ছেড়ে পিছু হটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার বেলায়েত তাঁর সৈন্যদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে এবং সাঁতরিয়ে অপর তীরে শত্রুদের সম্মুখবর্তী পরিত্যক্ত পরিখাগুলো দখল করে নেয় এবং কিছু সৈনিক সেইসব পরিখাতে রেখে সামনের দিকে আরো অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে সুবেদার বেলায়েত শত্রুসেনা কর্তৃক অতর্কিত আক্রান্ত হয়। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সুবেদার বেলায়েত বীরবিক্রমে সম্মুখভাগের শত্রু পরিখার ওপর গ্রেনেড চার্জ করে আরো কয়েকটি শত্রু বাঙ্কার ধ্বংস করে এবং শত্রু সৈন্য নিহত করে। সুবেদার বেলায়েত ও তার দলের প্রচন্ড আক্রমনে শালদা নদী তীরবর্তী এলাকা সম্পূর্ণ রূপে শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। ফলে শালদা নদী রেলস্টেশনে অবস্থানরত পাকসেনাদের সঙ্গে শালদা নদী গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনাদের যোগাযগ সম্পূর্ণ রূপে বিছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। পাকসেনারা আমাদের ওপর কামান কিংবা মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করার সুযোগ পাচ্ছিল না। কেননা আমাদের সৈনিক তাদের দু দলের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছে যাওয়ায় তাদের গোলাবর্ষণে নিজেদের ই ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনারা বুঝতে পারে যে, তারা দু দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রনের স্বীকার হয়ে মূল ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে এবং তাদের পক্ষে এই আক্রমনের মুখে বেশীক্ষন টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই সময় পাকসেনাদের একটি ওয়ারলেস মেসেজ আমাদের কাছে ধরা পরে। এতে তারা কর্তৃপক্ষকে জানায় যে মুক্তিবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ন তাদের উপর প্রচন্ড আক্রমন চালাচ্ছ। তাদের পক্ষে এই ঘাঁটিতে বেশিক্ষন টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এই ম্যাসেজ পাওয়ার পর পাকসেনাদের দুর্বলতা সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারি। তাদের মনোবল যে একেবারেই ভেঙ্গে পরেছে তা বেশ বোঝা যায়। সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে তার আক্রমণ আরো জোরদার করার নির্দেশ দেই। এই প্রচন্ড আক্রমনে টিকতে না পেরে গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনারা নয়নপুর রেলস্টেশনের দিকে পালাতে থাকে। সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি গুদামঘর এলাকা দখল করে নেয়। আরো কিছুক্ষন যুদ্ধ চলার পর সুবেদার বেলায়েত এবং নায়েব সুবেদার সিরাজের প্রচন্ড আক্রমনে শালদা নদী রেলস্টেশনে অবস্থানকারী পাকসেনারাও রেললাইন ধরে নয়নপুরের দিকে পালাতে থাকে। আমাদের সৈনিকরা পলায়নপর পাকসেনাদের উপর গুলি চালিয়ে অনেককে হতাহত করে। দুপুর নাগাদ সমস্ত শালদা নদী এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনাধিনে আসে। পাকসেনারা যাতে আবার এই এলাকাটি দখল করে নিতে না পারে সেজন্য আমাদের অবস্থানটিকে শক্তিশালী করে তোলা হয়। পাকসেনারা নয়াপুর রেলস্টেশনের ঘাঁটি থেকে বেশ কয়েকবার এই অবস্থানের ওপর মর্টার ও কামানের আক্রমণ চালায় এবং এই অবস্থান টি পুনর্দখলের জন্য শালদী নদী গুদামঘরের দক্ষিনে কিচুসংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করে। এই খবর পেয়ে সুবেদার বেলায়েত একটি দল নিয়ে পাকসেনাদের আক্রমণ কে প্রতিহত করার জন্য গুদামঘর এলাকায় আক্রমন চালায়। পাকসেনাদের আক্রমন প্রতিহত হয় এবং তারা পালিয়ে যা। কিন্তু একজন পাকসেনা আড়াল থেকে সুবেদার বেলায়েত কে লক্ষ্য করে গুঁলি ছোঁড়ে। সুবেদার বেলায়েতের মাথায় গুলি বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে চিকিতসার জন্য ২ নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই সে শাহাদাৎ বরণ করে। তার মত বীর সৈনিকের শহীদ হওয়াতে আমরা সবাই মর্মাহত হয়ে পরি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশ একজন মহান বীরকে হারালো। সুবেদার বেলায়েতের কীর্তি ও বিক্রমের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

শালদা নদী এলাকা দখল করা একটি দুঃসাহসী পরিকল্পনা ছিল। এই পরিকল্পনা অত্যন্ত অপ্রচলিত কৌশলের একটি বিরাট সাফল্য। এর ফলে কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন গাফফার এবং শহীদ বেলায়েতকে কৃতিত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করেন। এই যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। এগুলার মধ্যে ২১ টা রাইফেল ৫ টা এল এম জি ৩ টা এম জি এই ৩ মেশিনগান ৩১ টা হাল্কা মেশিনগান ম্যাগাজিন ৪ টা রকেট লঞ্চার ১ টা এস এম জি ১ টা ওয়ারলেস সেট ২০২৫০ টি গুলি ২০০ টি ২” মর্টার বোমা ৩ টা টিলিফোন সেট ১ টা জেনারেল ২ টা এম জি ব্যারেল অনেক রেশন কাপড় চোপড় ম্যাপ ও বিভিন্ন ধরনের নথিপত্র আমাদের দখলে আসে। এই সব দলিলপত্র থেকে জানা যায় ৩০ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বি কোম্পানি ও ডি কোম্পানি পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষাব্যুহ নিয়োজিত ছিল। এই সংঘর্ষে প্রায় ৮০ / ৯০ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং ১২ জন পাকসেনা আমাদের হাতে জীবন্ত ধরা পরে। ভোর ৫ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত ১৬ ঘন্টা যুদ্ধে আমাদের ২ জন শহীদ ও ৮ জন আহত হয়।

শালদা নদী কমপ্লেক্স আমাদের হস্তগত হওয়ার পর পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এই এলাকা পুনর্দখলের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। পাকসেনারা চান্দলার নিকটে অন্যান্য এলাকা থেকে প্রচুর সৈন্য এনে সমাবেশ ঘটায়। ১৬ ই নভেম্বর রাত ২-১৫ মিনিটে পাকসেনারা প্রায় ২ ব্যাটেলিয়ন সৈন্যশক্তি নিয়ে আমাদের শালদা নদী মন্দভাগ কামালপুর মঙ্গল প্রভৃতি উস্থানের ওপর গোলন্দাজ বাহিনী ও মর্টারের সহায়তায় প্রচন্ড আক্রমন চালা। এই আক্রমন প্রায় ৩ / ৪ ঘন্টা ধরে চলতে থাকে। চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পাকসেনাদের এই প্রচন্ড আক্রমন কে প্রতিহত করে। সকাল পর্যন্ত যুদ্ধে পাকসেনাদের বিপুলসংখ্যক সেনা হতাহত হয় এবং উপায়ন্তর না দেখে পাকসেনারা আক্রমন পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। এর একদিন পর আমাদের একটি ছোট দল মঙ্গলপুরের নিকট পাক সেনাদের ঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ১৭ জন পাকসেনাকে নিহত ও অনেককে আহত করে। আরেকটি রেইডিং পার্ট কাইয়ুমপুরে পাকসেনাদের অবস্থানের দুটি বাঙ্কার আর আর দিয়ে ধ্বংস করে দিয়ে ১৪ জন পাকসেনাকে নিহত করে। ২০ শে এবং ২১ শে নভেম্বর চতুর্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানী এবং বি কোম্পানী মঙ্গলপুর এবং কায়েমপুরের উপর তাদের চাপ বাড়িয়ে তোলে। ২১ তারিখ সকাল ৯ টার সময় এই দুই কোম্পানী পাক অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমন চালায়। এই আক্রমনে ১৬ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৯ জনকে আহত করে। ১০৬ আর আর এর সাহায্যে পাকসেনাদের বেশ কটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়া হয়। আমাদের সৈনিকরা অনেক অস্ত্র শস্ত্রও দখল করে নেয়। ২৩ শে নভেম্বর পাকসেনারা আমাদের মন্দভাগ অবস্থানটি পুনর্দখলের জন্য আবার তাদের সৈন্য একত্রিত করতে থাকে। দুপুর দুটোর সময় আমাদের একটি কোম্পানী পাকসেনাদের সমাবেশের উপর আক্রমন চালায়। ফলে পাকসেনাদের শালদা নদির নিকটে মনোরা রেলসেতুর নিকটবর্তী আমাদের অবস্থানগুলোর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। মেশিনগান ১০৬ আর আর ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনারা অবস্থানের একটি বাঙ্কার ধ্বংস করতে সমর্থ হয়। আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের আক্রমনকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয় এবং তাদের বহু সৈনিক হতাহত হয়। আমাদের একজন সৈনিক শহীদ ও ৪ জন আহত হয়। একটি মেশিনগান গোলন্দাজ বাহিনির গুলিতে নষ্ট হয়ে যায়। ২৩শে নভেম্বর থেকে পাকসেনাদের সঙ্গে বেশ কটি খন্ডযুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা শত্রুদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়। এই এলাকায় শত্রুরা পর্যুদস্ত হয়ে বুড়িচং ও কুমিল্লার দিকে সরে যায়।

কয়েকদিন পর ৪র্থ বেঙ্গল কে শালদা নদী থেকে ফেনীর দিকে আক্রমণ চালানোর জন্য কে ফোরস এর অধীনে বেলুনিয়াতে স্থানান্তর করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কামালের অধীনে কয়েকটি সেক্টর কোম্পানি শালদা নদীতে রেখে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেত্রৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল বেলুনিয়াতে কে ফরস এ যোগাযগ করে। ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট রাজনগরে তাদের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের পর তাদেরকে দু সপ্তাহের জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যপক প্রশিক্ষনের পর বেলুনিয়াতে পুনরায় তাদেরকে পুরানো প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলতে পাঠানো হয়। এবং এই সেক্টরে তৎপরতা বাড়ানর নির্দেশ দেয়া হয়। এই সময় ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে মেজর জাফর ইমাম নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পুনরায় রনক্ষেত্রে পৌছানোর পর ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ১৫ ই অক্টবর ১০ম বেঙ্গলের অনন্তপুর প্রতিরক্ষাব্যুহের সামনে পরশুরাম চিতলিয়া প্রভৃতি জায়গায় পাকসেনাদের ঘাঁটিগুলির ওপর ছোট ছোত আক্রমন চালিয়ে ২৪ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৩০ জন কে আহত করে। পাকসেনাদের ৩ টি বাঙ্কারো তারা ধ্বংস করে দেয় ১৮ ই অক্টোবর সকাল ৬ টার সময় পাকসেনাদের একটি প্লাটুন আমাদের ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হবার পথে বেলুনিয়া নদীর পূর্ব তীরে আমাদের সৈনিকদের এম্বুশে পরে। ফলে ১২ জন পাকসেনা নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়। ফুলগাজীর নিকট ১০ ম বেঙ্গলের পাইওনিয়ার প্লাটুন ঐ দিন ই রাস্তায় মাইন পুঁতে সকাল ১০ টার সময় পাকসেনাদের একটি ট্রাক ধ্বংস করে দেয়। ৭ জন পাকসেনা নিহত এবং ৩ জন আহত হয়। ২০ শে অক্টোবর আমাদের মর্টার ডিপারমেন্ট সন্ধ্যা ৬ টায় পাকসেনাদের অবস্থানে অনুপ্রবেশ করে চিতলিয়া অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ১২ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৭ জন কে আহত করে। ২৫ অক্টোবর আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের চিতলিয়া ঘাটির ওপর আক্রমন চালায়। ফলে ২ টি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২৬ শে অক্টোবর ভোর ৫ টার সময় ফুলগাজীর নিকট আমাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের টহলদারী দলকে এম্বুশ করে ৯ জন পাকসেনা নিহত ও ৬ জন কে আহত করে। এই যুদ্ধে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা কুটি মিয়া শহিদ হয়। ঐদিন ই পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল আমাদের ঘাঁটির সামনে এসে মাইন পোঁতার চেষ্টা করে। কিন্তু পাকসেনাদের এই দলটির সঙ্গে আমাদের একটি দলের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ১২ জন পাকসেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা আহত ও নিহতদের ফেলে ও অস্ত্র শস্ত্র রেখেই পালিয়ে যায়। ১০ম বেঙ্গলের তৎপরতার কারনে এই এলাকায় পাকসেনাদের বিপুল সমাবেশ ঘটানো হয়। তারা ১০ ম বেঙ্গলকে ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। ২৭ শে অক্টোবর চিতলিয়ার নিকট এক ব্যাটেলিয়নের অধিক শক্তির সমাবেশ ঘটায়। সন্ধ্যা ৬ টার সময় গোলন্দাজ বাহিনীর সয়ায়তায় পাকসেনাদের দুটো কোম্পানী অগ্রসর হয়ে আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি নীলক্ষ্মীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমনে বাধা দেয়। কিন্তু প্রচন্ড আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসে। পাকসেনারা নিলক্ষ্মী অগ্রবর্তী ঘাটিটি দখল করে নেয়। পরদিন সকালে ১০ম বেঙ্গলের তিন কোম্পানী আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় নীলক্ষ্মীর ওপর পালটা আক্রমণ চালায়। সকাল ১০ টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলে। প্রচন্ড চাপে পাকসেনারা টিকতে না পেরে নিলক্ষ্মী ঘাঁটি পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। আমাদের সৈনিকরা নিলক্ষ্মী পুনর্দখলের পর প্রতিরক্ষাব্যুহ (মালিবিলদ) ও গাবতলী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে। পরদিন সন্ধ্যা ৬ টায় আমাদের একটি প্লাটুন দুবলার চাঙ্গের নিকট একটি এম্বুশ পেতে বসে থাকে। পাকসেনাদের একটি দল বেলুনিয়া যাবার পথে সেই এম্বুশ এ পরে। আমাদের প্লাটুনটি পাকসেনাদের আক্রমন চালিয়ে ১৩ জন পাকসেনাকে নিহত করে এবং ২ জন পাকসেনাকে জীবিত বন্দী করে। এছাড়া অনেক অস্ত্র শস্ত্র দখল করে নেয়। নিলক্ষ্মীতে পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ার পর পুনঃআক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। ২৯ শে অক্টোবর ভোর ৪ টার সময় পাকসেনারা শালদার নয়াপুর এবং ফুলগাজি থেকে আমাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর কামানের সাহায্যে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমাদের কামানগুলিও পাকসেনাদের গোলার প্রত্যুত্তর দেয়। সকালে পাকসেনারা তিন দিক থেকে আমাদের ঘাঁটির উপর আক্রমন চালায়। প্রায় ৫ ঘন্টা যুদ্ধের পর আমাদের পালটা আক্রমণের মুখে পাকসেনাদের আক্রমণ বিপর্যস্ত হয়ে পরে। প্রচন্ড বাধার সামনে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছন দিকে পালিয়ে যায়। সংঘর্ষে ৪০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। অনেক অস্ত্র শস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ হয়।

এই সময় পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি চিতলিয়া পরশুরাম ও বেলুনিয়া থানার নিকট ছিল। এসব ঘাঁটিগুলতে রেলওয়ে ত্রলির সাহায্যে পাকসেনারা ফেনী থেকে রসদ যোগাত। ৫ ই নভেম্বর রাতে আমাদের একটি রেইডিং পার্টি চিতলিয়ার দক্ষিনে রেলোয়ে লাইনের উপর এম্বুশ পাতে। ৬ ই নভেম্বর সকাল ৭ টায় পাকসেনাদের একটি ট্রলি আমাদের হেডিং পার্টির এম্বুশ এর আওতায় এসে যায়। ট্রলিটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ চারজন সৈনিক নিহত হয়। আমাদের রেইডিং পার্টি একটি হালকা মেশিনগান একটি রাইফেল একটি স্টেনগান একটি ব্লেন্ডিসাইড ২০০০ রাউন্ড গুলি ও ১০ টি ব্লেনডিসাইড গোলা হস্তগত করে। ১০ম বেঙ্গল পাকসেনাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করার পর বেলুনিয়া থেকে পাকসেনাদের সম্পূর্ণ রূপে বিতাড়িত করার জন্য পালটা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে পরশুরাম ও চিতলিয়ার মাঝে পাকসেনাদের সরবরাহ লাইনের সড়কটি বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তুতি নেয়। ৬ ই নভেম্বর ১০ম বেঙ্গলের একটি কোম্পানী গোলন্দাজ বাহিনী ও মর্টারের সহায়তায় চিতলিয়ার উত্তরাংশে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘন্টা যুদ্ধের যুদ্ধের পর ১০ম বেঙ্গলের কোম্পানী টি চিতলিয়ার উত্তরাংশ দখল করে নিয়ে সালিয়া এবং ধানীকুন্ডার মাঝখানে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পরশুরাম ও ফেনীর মধ্যে যোগাযগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সমর্থ হয়। এর ফলে বেলুনিয়ার উত্তরাংশের পাকসেনারা অবরুদ্ধ হয়ে পরে। একজন অফিসার সহ ১২ জন পাকসেনা যুদ্ধে নিহত এবং ৫ জন বন্দী হয়। অফিসারের পকেট থেকে প্রাপ্ত এম ও ফর্ম থেকে জানা যায় ১৫ তম বেলুচ জজিমেন্তের ক্যাপ্তেন এবং বেলুনিয়াতে সে সময় ১৫ তম বেলুচ রেজিমেন্ত আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে আমাদের মর্টার প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার ইয়ার আহমদ শহীদ হয় এবং আরো ৫ জন আহত হয়। পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পরে। পাকসেনারা চিতলিয়ার দক্ষিনে পশ্চাদপসরন করে। বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের চিতলিয়ার অবস্থানটি পুনর্দখলের জন্য পাকসেনারা ভোর ৫ টায় দু কোম্পানী সৈন্য নিয়ে প্রচন্ড আক্রমন চালায়। আমাদের কোম্পানীটি গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় অসীম সাহসের সঙ্গে এই আক্রমনের মোকাবিলা করে। আপ্রান চেষটাসত্বেও আমাদের সৈনিকদের গুলির সামনে এবং গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার মুখে পাকসেনাদের এই আক্রমণ টি ব্যর্থ হয়ে যায়। ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অনেক আহত হয়। কয়েকটি হালকা মেশিন গান সহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা ছত্রভংগ হয়ে পিছু হটে যায়।