You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.22 | আমেরিকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সিনেটর কেনেডির বক্তৃতা | প্রেস বিজ্ঞপ্তি - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
আমেরিকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সিনেটর কেনেডির বক্তৃতা প্রেস বিজ্ঞপ্তি ২২ আগষ্ট, ১৯৭১

ম্যাসাচুসেটস এর সিনেটর এডওয়ার্ড এম. কেনেডি-র কার্যালয় থেকে
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সিনেটর এডওয়ার্ড এম. কেনেডি-র বক্তৃতা
আগস্ট ২৬, ১৯৭১
ভারতে আমার সপ্তাহব্যাপী শরণার্থী শিবির ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যদের সাথে ভাগ করতে পারছি বলে আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি| যে দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করেছি বর্তমানে এর চেয়ে আতঙ্ককর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই|
এপ্রিলের শুরুতে পূর্ববঙ্গে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৮,০০০,০০০ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে এসেছে| এই বিবাদের রেশ ধরে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছে, হয়েছে গৃহহীন| আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিনিয়ত আতঙ্ক, ব্যাধি আর ক্ষুধার সাথে লড়ছে| তাৎক্ষণিকভাবে ত্রাণের ব্যবস্থা না হলে যার হাত থেকে তাদের পরিত্রাণ নেই|
এই সার সত্য কথাটা সারা পৃথিবী এখনো বুঝতে পারছে না| যদিও শুরু থেকেই আমার এবং সিনেটর উপ-কমিটির জন্য এটি উদ্বেগের বিষয় ছিল, তাও আমি বলব নিজ চোখে না দেখা পর্যন্ত কেউ এর ভয়াবহতা আঁচও করতে পারবে না| একমাত্র সেখানে উপস্থিত হয়েই তাদের সঙ্কটাপন্ন দশা বোঝা যায়| কী ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে প্রতিনিয়ত শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এবং হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে তা উপলব্ধি করা যায়|
ভারতে গিয়ে আমি পূর্বে ত্রিপুরার আগরতলা, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে জলপাইগুড়িসহ সীমান্তবর্তী সকল শরণার্থী শিবিরে গিয়েছিলাম| সেখানে গিয়ে আমি শিবিরে জড়ো হওয়া শরণার্থীদের কথা শুনেছি, শুনেছি কীভাবে তারা খোলা মাঠে বা পাবলিক বিল্ডিং এর পিছনে দিনাতিপাত করছে, কীভাবে তারা পশ্চিমবঙ্গের রাস্তা ধরে দিনের পর দিন ক্লান্তিভরে হেঁটে আসছে| তাদের সে করুণ কাহিনী মানবতার জন্য লজ্জাস্বরূপ |
আমি লক্ষ্য করেছি, শিবির থেকে শিবিরে বিস্তর ফারাক|কিন্তু অধিকাংশের অবস্থাই বর্ণনাতীত| সাহায্যের অপ্রতুলতা, শৌচাগারের অভাব, ঘনবসতির কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগছে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু এবং বৃদ্ধরা| যা সাহায্য আসছে তা দিয়ে কেবলমাত্র পঞ্চাশ শতাংশ শরণার্থীকে সাহায্য করা সম্ভব| ইতোমধ্যে অনেক শিশু এবং বৃদ্ধের মৃত্যু ঘটেছে| অনেককে দেখেই তার ক্ষীণ আয়ু অনুমান করা যাচ্ছে|
আপনার এমন সব কঙ্কালসার শিশুদের চোখে পড়বে যাদের মাথা নাড়ানোর শক্তি পর্যন্ত নেই| অপুষ্টিতে অনেকের হাত-পায়ে পানি এসেছে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে মায়ের কোলে| ভিটামিনের অভাবে অনেক শিশু অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ঘা শুকোচ্ছে না| তাদের বাবা-মায়ের চোখে কেবলি হতাশা| সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যখন আপনার চোখে পড়বে গতরাত্রে মারা যাওয়া শিশুর মৃতদেহ|
শিবির থেকে শিবিরে একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি এবং দিন দিন পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে| সীমিত স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে মৃত্যুহার কমানো যাচ্ছে না| অধিকাংশ আহত ব্যক্তি আসছে অন্য শরণার্থীর মাধ্যমে| এছাড়া সীমান্তবর্তী অনেক ভারতীয় জনপদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণের শিকার হচ্ছে, পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে নির্যাতিত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ|
ভারতীয় সরকার শুরতেই শরণার্থীদের আসা রোধ করতে সীমান্ত ঘেরাও করতে পারত| কিন্তু তা না করে সহানুভূতির পথ বেছে নেওয়াতে তাদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে| শরণার্থীদের স্থান করে দিতে তারা যে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে তা অবিস্মরণীয়|
কিন্তু এই দুর্যোগে যে পরিমাণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা সামাল দিতে গিয়ে এই মহান কর্মযজ্ঞও হার মেনে যাচ্ছে| দুমাস আগে প্রতিদিন শরণার্থী আগমনের হার ছিল ১,৫০,০০০| এখনও প্রতিদিন প্রায় ২৫,০০০ জন করে আসছে| পালিয়ে আসা প্রত্যেকের হৃদয়স্পর্শী কাহিনী কল্পনাকেও হার মানায়|
এক পঞ্চান্ন বছর বয়সী মুসলিম রেলওয়ে কর্মী যিনি ৩৫ বছর ধরে চাকরি করে আসছিলেন, রেলওয়ে স্টেশনে পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণের কথা বলতে গিয়ে বলেন, “আমাকে গুলি করার কী কারণ থাকতে পারে আমি জানি না| আমি রাজনীতি করি না, আমি সামান্য একজন রেলের কর্মী মাত্র|” এখন তিনি আর্থিক দৈনতার মধ্য দিয়ে শরণার্থী শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন| আগামী মাস থেকেই উনার সরকারি পেনশন পাওয়ার যে কথা ছিল তা নিয়ে আজ আর তার কোন আশা নেই|

সহজ-সরল, নিরক্ষর গ্রামবাসীর অবস্থা আরো করুণ| উত্তর কলকাতার বয়রা-বনগাঁ রোডের শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার এভাবে তাদের দুর্দশার করুণ চিত্র উঠে আসে|
যেদিন আমরা এই ২০ মাইল দীর্ঘ রাস্তাটি ধরে অগ্রসর হয়েছিলাম, কমপক্ষে ৭০০০ নতুন শরণার্থী বয়রা নদীর পাড় বেয়ে আসছিল| তাদের অধিকাংশই খেটে খাওয়া কৃষক| তাদের মধ্যে বেশির ভাগই হিন্দু , তারা আসছিল ঢাকার দক্ষিণস্থ খুলনা এবং বরিশাল থেকে; গত বন্যায় যে স্থানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল|
এই ক্লান্তিকর দিন-রাত্রির যাত্রায় সবচেয়ে বেশি পরিশ্রান্ত শিশু এবং বৃদ্ধরা| অধিকাংশের চোখে কেবলি শূণ্যতা, অসহায়ভাবে বসে আছে রাস্তার পাশে| তারা কেউই জানে না তাদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে| পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্মমতা, গণহত্যা, লুন্ঠন, নির্যাতনের করুণ কাহিনীর প্রতিচ্ছবি তারা |বহু শিশু পথিমধ্যে মারা গেছে, তাদের বাবা-মায়ের কণ্ঠে কেবল করুণ আর্তি আর সাহায্যের জন্য প্রার্থনা| মৌসুমী বৃষ্টিতে গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় তাদের দুর্ভোগ আরো বাড়ছে| বৃষ্টির দিন আমাদের কাছে বাইরে যাওয়া মানে কেবল এক প্রস্থ কাপড় পাল্টে নেওয়া| কিন্তু এসব মানুষের কাছে সেটি খাদ্য, বিশ্রাম, আশ্রয় ছাড়া আরো একটি করুণ দিন।
.
বেশভূষার পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু হত না। কিন্তু এই মানুষদের কাছে আরেকটি বিশ্রাম, খাদ্য এবং আশ্রয় বিহীন রাত ছাড়া বৃষ্টির আর কোন মানে ছিল না।
কোমরের নিচ থেকে অবশ হয়ে যাওয়া কোন শিশুর মুখ যে কখনো হাঁটতে পারবে না, কিংবা বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে নিজের চোখের সামনে হত্যা হতে দেখা শিশুটি যে একটি ছোট তাঁবুর মেঝেতে চাদরের উপর ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে, অথবা দশ বছর বয়সী বালিকার হন্তদন্ত হয়ে আমাদের আসার একটু আগে কলেরায় মারা যাওয়া তাঁর শিশু ভাইকে ঢাকার জন্য ছুটে বেড়ানো- এর কোনটাই চাইলেও মন থেকে মুছে ফেলা অনেক কঠিন। যখন একটি শরণার্থী শিবির পরিচালককে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে কোন বিষয়টা আপনার এখানে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়, যার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “শ্মশান”। তিনি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি শরণার্থী শিবিরের পরিচালক ছিলেন। মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষের কথা মাথায় রেখে এটি তৈরি করা হয়েছিল এবং বর্তমানে এখানে প্রায় ১৭০০০০ এর মত শরণার্থী বাস করছে।
সময় এসেছে… সময় আসলে পার হয়ে গেছে… এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় কিভাবে সম্ভব হল সেটা আমেরিকানদের বুঝা উচিৎ এবং আমাদের দেশের দেউলিয়া প্রতিক্রিয়া স্বীকার করে নেয়া উচিৎ।
প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা হল স্বনিয়ন্ত্রন এবং গণতান্ত্রিক নীতি। এত বছর ধরে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের পর…এত বছর ধরে সামরিক শাসন ও অপূর্ণ রাখা রাজনৈতিক ওয়াদার পর… অবশেষে বিগত ৭ ডিসেম্বর পুরো পাকিস্তানে একটি সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক আইনের অধীনেই নির্বাচনটি হয় এবং সেই সময়ে ইয়াহিয়া খানের সরকার একে জোরে সোরে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে ঘোষণা দেয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানে অভাবনীয় ৮০% ভোট পায় আওয়ামী লীগ ও এর নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
আসন্ন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ অধিবেশনে তাই আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় যে তারা নতুন করে সংবিধান প্রস্তুত করে দেশকে নাগরিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করবে। কিন্তু এরপরে একের পর এক বিলম্ব ও প্রহসন তৈরি হতে লাগল, যার পর আবার সামরিক আইন জারি করা হল। লীগের ছয় দফা দাবীর আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যকার সমঝোতা দীর্ঘায়িত হতে থাকল এবং ক্রমশ অবনতি ঘটল… যা আচমকা ২৫ মার্চ রাতে অরাজকতা ও রক্তপাতের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
যখন পূর্ব পাকিস্তানিরা গণতন্ত্র আর স্বায়ত্বশাসন নিয়ে সমঝোতা করছিল, তখন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিপীড়ন ও সংঘবদ্ধ হামলার পরিকল্পনা করছিল। ২৫ মার্চ থেকে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছে। ভারতে আমি গত সপ্তাহে যা দেখেছি তা হল সেই ভয়াল রাত ও এর পরবর্তী দিনগুলোর হিংস্রতায় আতংকিত মানুষের ধ্বংসাবশেষ। সামরিক হত্যাযজ্ঞের সাথে সামরিক আইনও তখন জারি ছিল। “সমন্বিত দায়িত্ব” … একটি নীতি যা দিয়ে আওয়ামী লীগ বা বাঙ্গালী গেরিলাদের লুকিয়ে রাখার সন্দেহে পুরো গ্রাম উজাড় করে দেয়া হত… সামরিক আইন এখন এটাকে অনুমোদন দিয়েছে। এবং ক্রমাগত শরণার্থীদের আগমন থেকেও সেটা স্পষ্ট বুঝা যায়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও ক বছর আগে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার যে ভাবমূর্তি ছিল এখন দক্ষিণ এশিয়াতে সেই মনোভাব খুব একটা ভিন্ন নয়। এই ভাবমূর্তি এমন যে আমেরিকা সামরিক নিপীড়ন কে সমর্থন দেয় এবং সামরিক হিংস্রতাকে মদদ যোগায়। ভাবমূর্তিটা এমন যে আমেরিকা স্বৈরাচারী শাসকদের সাথে সহজেই হাত মিলাচ্ছে। বা এমন একটি আমেরিকা যা তাদের বিপ্লবী অতীতকে স্মরন করছে এবং সর্বদা তাদের স্বনিয়ন্ত্রনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বড়াই করছে কিন্তু অপরদিকে তারা মানুষের চেতনা দমিয়ে রাখতে, পরিবর্তন ঠেকাতে সামরিক জান্তাদের সাহায্য করে যাচ্ছে।
.
পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির কারণে আমেরিকানদের মর্মপীড়া হওয়া উচিত, কেননা এগুলো আমাদের সামরিক যন্ত্রপাতি। আমাদের বন্দুক, ট্যাংক এবং আকাশযান একদশকের বেশী সময় ধরে দেওয়া হচ্ছে। আর এসবই এই ভোগান্তির সৃষ্টির পেছনে দায়ী। আরো বড় দুঃখের বিষয় হলো স্পষ্টত আমাদের এখানকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নির্দেশে এই সামরিক সরবরাহ এখনও চলমান। আমেরিকান বন্দর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের জন্য আমেরিকান সামরিক সরবরাহ ভর্তি পাকিস্তানী জাহাজ ত্যাগ করা চলমান রয়েছে। এগুলো সবই লজ্জাজনক এবং দুঃখের। এগুলো সামান্য একটা কলমের খোঁচায় বন্ধ করা সম্ভব।
এটা যুক্তি দেখানো হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানে এই চলমান সামরিক সাহায্য পূর্ব বাংলায় গঠনগতভাবে পাকিস্তানী সামরিক নীতি বজায় রাখতে কোনভাবে আমাদের ক্ষমতা প্রদান করে। ভালো, তাহলে কোথায় সেই ক্ষমতা? আমেরিকান অস্ত্র যা উদ্বাস্তু আর বেসামরিক ক্ষতিগ্রস্তের পরিমাণ বাড়াচ্ছে তা বন্ধ করার সে ক্ষমতা কোথায়? এইসব ক্ষতিগ্রস্তদের সমর্থন দেওয়ার সেই ক্ষমতা কোথায়? শেখ মুজিবর রহমান, যার একমাত্র অপরাধ কিনা নির্বাচনে জেতা তার গোপন বিচার বন্ধ করার ক্ষমতা কোথায়? কোথায় সেই ক্ষমতা যখন আমেরিকান মানবিক সাহায্য সামরিক যন্ত্রে–আমেরিকান ত্রাণের জাহাজ যুদ্ধজাহাযে রূপ নিচ্ছে তা বন্ধ করার? যদি পাকিস্তান সরকারকে প্রভাবিত করার সেই ক্ষমতাই থাকত, তাহলে আমাদের এই মহান রাষ্ট্র কেন হীন এবং লজ্জাজনক কাজে সাহায্য করছে?
এখন সময় আমেরিকানদের তাদের নেতা জিজ্ঞেস করা, “কি ধরণের সরকারকে আমরা প্রভাবিত করতে চাইছি এবং কিইবা উদ্দেশ্য?”
দশ বছরেরও বেশী বেদনায়ক সময় ধরে আমাদের সমুদ্র সৈকত থেকে দশহাজার মাইল দূরে আমেরিকাদের জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং গণতান্ত্রিক নীতির ধারণাকে তুলে ধরার জন্য ১০০ বিলিয়ন অর্থ এবং ৪৫,০০০ জীবন দিতে হয়েছে। আজ বারোহাজার মাইল দূরে এবং পাঁচগুণের বেশী জনসংখ্যা সমৃদ্ধ দেশের নেতারা আমেরিকার নিকট থেকে জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দমনে সাহায্য চাচ্ছে। অবাধ নির্বাচনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে সমর্থন দেওয়ার জন্য সাহায্য চাচ্ছে।
আরেকটা তুচ্ছ সমন্তরাল ঘটনা দেখুনঃ দক্ষিণ ভিয়েতনামে আমাদের সর্বোপরি ত্যাগ এবং প্রচেষ্টা। আমরা সেখানে সম্মুখীন হই এক তথাকথিত “গণতান্ত্রিক” শাসকের সাথে, যে এখনও একটা মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন দিতে পারেনা। এরা এমন একটা নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছিল যেটি সব গুরুত্বপূর্ণ বিরোধই দলকে বাদ দিয়ে দলমুক্ত নির্বাচন। আর এখন, সাইগন থেকে দুইহাজার মাইলেরও কমদূরে পূর্ববাংলায় একটা অবাধ নির্বাচন দিতে উপেক্ষা করি।
আপনারা বলতে পারেন যে আমাদের জড়িত মতো ব্যাপার এখানে নেই। আমরা সারা পৃথিবীকে পাহাড়া দিতে পারি না। এগুলো সত্য হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা ইতিমধ্যে পূর্ব বাংলার সাথে জড়িত হয়ে গিয়েছি। আমাদের অস্ত্র জড়িত, আমাদের অর্থ দুইদশক ধরে অর্থনৈতিক সহযোগিতা হিসেবে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আমরা জড়িত কিনা সেই প্রশ্ন এখন নয় বরং আমাদের জড়িত হওয়া উচিত। আমরা তহবিল জোগাবো কিনা এটাও কোন প্রশ্ন নয়। বরং আমরা তহবিল কোন খাতে খরচ করব সেটাই আসল। একটি নিদারুণ সমস্যাযুক্ত এলাকায় শান্তি এবং মুক্তি আনতে আমরা কি বন্দুক সরবরাহ করব নাকি মানবিক প্রকল্পে সাহায্য করব?
আমি পূর্ব বাংলার কিছু নেতা যারা নিজেরা বাংলাদেশের সরকার হিসেবে গঠিত হয়েছে তাদের সাথে কথা বলে তাদের কন্ঠে একধরণের বিদ্রুপ লক্ষ্য করেছি। এই নেতা গুলো আমেরিকাতে সাহায্য চাইতে আসবে না। একজন আওয়ামী লীগ নেতার কথা অনুযায়ী, “অনেক রাষ্ট্র এবং মানুষ আরো অস্ত্রের জন্য বিলিয়ন বিলয়ন ডলার চাইতে আমেরিকায় আসে।

আমরা বাঙালিরা চাই শুধু আপনারা যেন উভয়পক্ষকে অর্থ-অস্ত্র-কোন কিছু প্রদান না করেন। আপনারা শুধু নিরপেক্ষ থাকুন।“ আমার কাছে দুটোই আসলে রাজনৈতিক এবং নৈতিক অবস্থান হিসেবে ভালো। দক্ষিণ এশিয়ার সৈন্যদলের সাথে পুরোনো অভ্যাস অনুযায়ী অমানবিক এবং অযথা কর্মকান্ডের চেয়ে বরং নিরপেক্ষতা আমাদের দিতে পারে প্রকৃত ও কার্যকর সুবিধা।
ঐ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো আজ অনেক ঝামেলার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার অর্জনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমেরিকায় বসে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনা কিভাবে গণতন্ত্রের চেতনা সেখানে ছড়িয়ে পড়বে? কয়েকমাসে আগে ভারতে চতুর্থবারের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নির্বাচন হয়ে গেল। পাকিস্তান একটি অবাধ নির্বাচনের অনেক সময় নিয়েছে। কিন্তু গত ডিসেম্বরের ভোটের গুরুত্ব কারো কাছে কম নয় এমনকি যারা পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেছিল। তারা গর্বভরে এবং ন্যয়ত এই নির্বাচনকে পাকিস্তানের ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করে। এই নির্বাচন প্রথম পাকিস্তানকে আঞ্চলিক বিভাগগুলো মধ্যে সেতু গড়ে তোলার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের প্রথম সুযোগ করে দিয়েছিল।
এটা ছিল পাকিস্তানে উদিত এমন বেসামরিক নেতৃত্ব যা পাকিস্তানের অঞ্চল গুলোর একতা এবং স্থায়িত্ব রক্ষায় সক্ষম। একতার সবচেয়ে ভালো আশা জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষ যা ঠিক করেছিল তা পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়া দেখেই বুঝতে পারা যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মুর্খতা।
যদি কোন রাজনৈতিক সমাধানে না পৌছানো যায় এবং এই উত্তপ্ত অবস্থা ঠান্ডা করার জন্য কোন প্রক্রিয়া না পাওয়া যায় তাহলে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান এবং পূর্ব ভারতের ভেতরে ক্যান্সার হিসেবে রূপ নেবে। ১৯৪৭ সালের পরে এরচেয়ে বড় ঐক্যনাশক প্রভাব এই উপমহাদেশে পড়েনি।
আমেরিকার বৈদেশিক নীতির অর্থ স্পষ্ট।
প্রথমত, পাকিস্তান এবং ভারতে চলমান মানব বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে জাগাতে হবে। পূর্ব বাংলার এই বিপর্যয় শুধু পাকিস্তান বা ভারতের নয়। এটা পুরো বিশ্বসম্প্রদায়ের এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের দায়িত্ব এই সংকট দূর করার জন্য একত্রে চেষ্টা চালানো। যদি আমেরিকা মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে নেতার আসনে বসতে চায়, তবে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও ত্রাণ এই লক্ষ লক্ষ শরনার্থী এবং সংঘর্ষের ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পৌছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকাকে অবশ্যই নেতৃত্ব দিতে হবে।
যাই হোক, আমরা জানি আমেরিকা এবং আনর্জাতিক সম্প্রদায় এই কর্মকান্ড থেকে অনেক দূরে। আজ পর্যন্ত জাতিসংঘ ১৫০ মিলিয়নের চেয়ে কম ত্রাণ দিয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকা ৮০০ মিলিয়নের মত দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছে।
প্রশাসন গর্বের সাথে উল্লেখ করেছেন, আমরা গোটা বিশ্বের সবগুলো দেশ যোগ করলে যা হয় তার চেয়ে বেশি দিতে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। কিন্তু এই গর্ব খুব তাড়াতাড়ি গায়েব হয়ে যায় যখন দেখি শুধু ভারত সরকার এবং ভারতের জনগণ এককভাবে এখন এরকম বিশাল বড় একটা বোঝা বহন করে যাচ্ছে। আমরা যখন দেখি ভারতের পরবর্তী বাজেটে শুধু শরণার্থী ত্রাণের জন্যই ৫০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন বুঝতে পারি বাইরের বিশ্ব আসলে কতটা ক্ষুদ্র কাজ করছে এবং আমেরিকার অবদান কতটা তুচ্ছ।
সাধারণ মানবিকতায় বলে যে আমেরিকা এবং জাতিসংঘকে এই সত্য মেনে নিতে হবে এবং এই বিপুল বোঝা শুধু ভারতের কাঁধে ছেড়ে না দিয়ে পুরো বিশ্বকে বহন করতে হবে।

ঐতিহ্যগতভাবে আমরা অতীতে অবিরতভাবে অর্থনৈতিক সমর্থনসহ জাতিসংঘে সাহায্য ও ত্রাণকর্মে অংশ নিয়েছি এবং বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে যে সাহায্য বিশ্বের সেই অংশে দিচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্রকে কমপক্ষে ৩০-৪০ ভাগ পূর্ববাংলার ত্রাণ কর্মকান্ডের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি জাতিসংঘের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয়, তাহলে আমেরিকার শুধু জাতিসংঘের চাহিদাপূরণের সাহসীকতা নয়, আমেরিকান অবদান হিসেবে ৩০০/৪০০ মিলিয়ন ডলারও প্রদান করতে হবে। সেপ্টেম্বরে আবার যখন সভা হবে, আমি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথাপোযুক্ত আইন প্রণয়নের প্রস্তাব প্রদান করব।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ঐ অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে উল্টো দিকে ঘুরে দাড়াতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের ভারতর প্রতি “নিয়ন্ত্রণ”এমন প্রচার বন্ধ করে পাকিস্তানের প্রতি “নিয়ন্ত্রণ” প্রদর্শন করতে হবে। জরুরীভাবে আমাদের পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে প্রেরিত সকল আমেরিকান অস্ত্র চালান বন্ধ করতে হবে। যারা মানবিকতার প্রাথমিক শর্তগুলো ভেঙ্গে ফেলছে তাদের সকল অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করতে হবে। আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলদের তথা পুরো বিশ্বের মানুষকে জানাতে হবে পূর্ববাংলার উপর বর্ষিত পর্বত প্রমাণ হত্যাকান্ডের প্রতি আমেরিকার রয়েছে তীব্র এবং স্থায়ী ঘৃণা।
গত সপ্তাহের মাঠের অভিজ্ঞতা আমার মতামতকে তীব্র ভাবে শক্তিশালী করেছে। যেসব আমেরিকান দেখেছে যে বাচ্চারা এতই দুর্বল যে কাঁদতে পারছে না, এতই ক্লান্ত যে জীবন-যাপন করতে পারছে না, এত শোকাহত যে কোনকিছু খেয়ালই করছে না, তারা এর চেয়ে কম কিছু করতে রাজি হবে না। প্রত্যেক আমেরিকনাই এই সরকারের বিরুদ্ধে এর চেয়ে কম বিরুদ্ধতা সমর্থন করবে না, কেননা এই সরকার অবাধ নির্বাচনে জেতার অপরাধে গোপনে একজন রাজনৈতিক নেতাকে যত ইচ্ছা ভয় দেখিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আমেরিকার নাগরিকেরা কার্জতভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে কারণে জীবন বিলিয়ে দিয়ছে তার সম্পূর্ণ ভিন্ন নীতি দ্বারা পরিচালিত কোন অঞ্চলকে আমেরিকানঅরা সমর্থন দেবে না।
আমি বলব না যে পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক এই মূহুর্ত থেকে ছিন্ন করা হোক।
আসুন আমরা জরুরীভিত্তিতে কথা বলি। আমরা আমাদের স্পষ্ট মতামত প্রকাশ করি। আমরা প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে প্রেসিডেন্ট ইহাহিয়া খানের সাথে এই সঙ্কটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথা বলতে বলি। অবরুদ্ধ ভারতকে বলব, আমাদের পুনরায় আমাদের সেই বিশ্বাসকে নিশ্চায়তা দিন যেন আমরা সবখানে একত্রে সংকট মোকাবেলা করতে পারি।
তৃতীয়ত, পূর্ব বাংলাকে দমানোর জন্য গৃহীত নিষ্ঠুর নীতির পরিবর্তনে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারকে যতটা সম্ভব চাপ প্রদান করার জন্য আমেরিকার উচিত দক্ষিণ এশিয়া চুক্তি সংস্থার কাঠামোর মধ্যে কাজ করা। যদি কোনভাবেই তাড়াতাড়ি এই নীতির পরিবর্তন না হয়, তাহলে সংগঠনে পাকিস্তানের সদস্যপদ বিরোধী অন্য সিয়াটো সদস্যরাষ্ট্রেকে আমেরিকার নেতৃত্ব দেওয়া উচিত।
একইভাবে, আমাদের পাকিস্তানের সাথে স্থাপিত প্রত্যেক দ্বিদেশীয় এবং বহুদেশীয় সম্পর্ক আবার পরীক্ষা করতে হবে। এই রাষ্ট্রের কোন ফোরাম কিংবা এই বিশ্বের ফোরামের দক্ষিণ এশিয়ায় সংগঠিত সন্ত্রাস এবং অমানবিকতার বিকট দুঃস্বপ্নের তথ্যভিত্তিক মতামতের উল্লেখযোগ্যতার ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে দ্বিধা করা উচিত না। শরণার্থী বিষয়ক উপকমিটির সভাপতি হিসেবে, আমি আমার সাম্প্রতিক তদন্তের ফলাফলগুলোর একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরিকল্পনা করছি। আমাদের উপকমিটি সেপ্টেম্বরের শেষে চুড়ান্ত শুনানি পরিচালনা করবে। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও মুক্তি আনতে প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব প্রদানে আমাদের সরকার কি করছে, কি করতে প্রস্তুত আছে এবং কি করতে সক্ষম এই শুনানি হবে তা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা।
পূর্ব বাংলার মানুষের প্রার্থনা ও স্বপ্ন যেন এক প্রজন্ম আগে বাঙালির সবচেয়ে বড় কবি ও দার্শনিক ঠাকুরের চমৎকার পংক্তির মধ্যে অলংকৃত। পুর্ব বাংলার আকাঙ্ক্ষা আজ শব্দে অলংকৃত করা যায় ঠাকুরের এক অমর শান্তি ও মুক্তির গাঁথার সাথে,
“চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,

ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।
এই শব্দগুলোকে অনুপ্রেরণা করে আমেরিকা এই স্বপ্নপূরণের সংকল্প খুঁজে পেতে পারে।