শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশে বায়াফ্রার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছেঃ সিনেটর পিয়ার্সের ভাষণ | সিনেটের কার্যবিবরণী | ৩০ জুলাই, ১৯৭১ |
এস ১২৬২৪ ৩০ জুলাই, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানঃ বায়াফ্রার ঘটনার পুনরাবৃত্তি
( সিনেটর মিঃ পিয়ারসনের ভাষণ)
মি. পিয়ার্সনঃ মিঃ প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তানের ধারাবাহিক অরাজকতার কারনে প্রায় দুই লাখ মানুষ তাদের জীবন হারিয়েছে, ষাট লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, এবং পূর্ব পাকিস্তানের রবি শষ্যের ফলনের সম্ভাবনা এতটাই কমে গিয়েছে যে তা সেখানকার মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য অপর্যাপ্ত। আসছে শরতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যপক দুর্ভিক্ষের যে মূর্তিমান আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তা বায়াফ্রার ঘটনার চেয়েও বেশিমাত্রায় প্রাণহানির সৃষ্টি করে নির্মমভাবে বাস্তবে ধরা দিতে পারে। যেহেতু এই ব্যপক প্রাণহানির ঘটনা প্রতিরোধ করা যেত তাই এটি সবাইকে আরো বেশি দুঃখভারাক্রান্ত করেছে। উদ্বৃত্ত খাদ্যের এই পৃথিবীতে রাজনৈতিক বিরোধের জন্য অনাহারে মানুষ মারা যাওয়াটা এক কথায় মানুষের প্রতি মানুষের চরম অসভ্যতা।
ত্বরিত পদক্ষেপ প্রতীয়মান হওয়া স্বত্বেও আমেরিকানদের কাছ থেকে পাকিস্তানিদের নিকট জরুরি খাদ্য সরবরাহ কেবলমাত্র খাদ্যদ্রব্য পরিহনের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। জনগণের কাছে খাদ্য পৌছানোর জন্য খাদ্য সরবরাহের স্বাভাবিক বণ্টনব্যবস্থাকে অবশ্যই পুনঃস্থাপন করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না পাকিস্তান সরকার ও পূর্ব পাকিস্তানের মতবিরোধ সৃষ্টিকারী বিষয়সমূহের রাজনৈতিক সমঝোতা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই যোগসূত্র পুনঃস্থাপন করা সম্ভব নয়। এটি দূর করার জন্য রাজনৈতিক মীমাংসার লক্ষ্যে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে সহজে ত্রাণ পৌছানোর উদ্দেশ্যে আমাদের সরকারকে অবশ্যই প্রতিটি আইনসংগত পথ অবলম্বনের জন্য সুসচেতন পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের মত একই ধরনের নৈতিক-রাজনৈতিক উভয় সঙ্কটে রয়েছে। একদিকে, আমেরিকানদের জন্য হাজার হাজার মানুষের অনাহারে অকারণ বীভৎস মৃত্যুর মাঝে চুপচাপ বসে থাকা নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। অপরদিকে, আমাদের এটাও অনুধাবন করা উচিত যে বিরোধী শক্তির সাথে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করা একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের সামিল।
তাহলে এখন কি আমরা পাকিস্তানের জনগণের জন্য আমাদের উদ্বেগকে পৃথিবীর যেকোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে আমাদের বিরত থাকার আকাঙ্ক্ষার সাথে সমতায়ন করব?
আমাদের পররাষ্ট্র নীতিমালার সাধারণ নীতি অনুযায়ী, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়টি দুটি মৌলিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমত, অন্য সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি দ্বারা আমেরিকার জনগণ কদাচিৎ সরাসরি প্রভাবিত হয়। দ্বিতীয়ত, আমেরিকা এটা অনুধাবন করতে পেরেছে যে বিশ্ববব্যাপী তাদের হস্তক্ষেপের ক্ষমতা সীমিত; যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই পৃথিবীর সকল মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য মধ্যস্থতা করতে পারে না।
যাইহোক, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এসব সাধারণ নীতিমালার কোনটিই বৈধ নয়। পূর্ব পাকিস্তানে অনাহারে মানুষের অনর্থক মৃত্যু আমেরিকার জনগণের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে, সম্ভবতঃ যার প্রভাব দৃষ্টি আকর্ষক বাইজেন্টাইনের চেয়েও বেশি, সরকারের সহিংস পরিবর্তন কূটনীতিকদের শক্তি ও সময় নিঃশেষ করে দেয়। প্রত্যেক আমেরিকান, যে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে অবগত, প্রতিদিনই একথা চিন্তা করে নিঃশেষিত হয়ে যায় যে তার সরকার সেখানকার অবস্থা দূর করতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
দ্বিতীয় নীতির কথা বিবেচনা করলে, এক্ষেত্রে বর্তমানে, পাকিস্তান সরকারের উপর যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সহযোগী দাতা দেশসমূহের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে অন্যান্য সহযোগী দাতা সংস্থাগুলোর সদস্যদের দ্বারা বৈদেশিক সাহায্যের আকারে সরবরাহকৃত পুঁজি ও দ্রব্যসামগ্রীর উপর পাকিস্তান সরকার নির্ভরশীল। আমেরিকা ও অন্যান্য দাতা দেশসমূহের করদাতাগণ নিশ্চয়ই এমন কোন সরকারকে অর্থনৈতিক সাহায্য করাকে, সামরিক সাহায্য তো নয়ই, উপেক্ষা করতে পারবে না যে কিনা তার জনগণের একাংশকে উক্ত সাহায্য থেকে বঞ্চিত রাখে বরং আরো খারাপভাবে জনগণকে হত্যার জন্য উক্ত অর্থ ব্যবহার করে। এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার, অন্যান্য সহযোগী দাতা সংস্থাগুলোকে সাথে নিয়ে, পাকিস্তান সরকারকে স্পষ্ট করা উচিত যে সাহায্য অব্যাহত রাখার বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তানে ধর্ম ও রাজনৈতিক যোগাযোগ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ হত্যা বন্ধ করা এবং সবাইকে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী সরবরাহের উপর নির্ভরশীল।
মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কি পাকিস্তানের জনগণকে একথা বুঝাতে ব্যর্থ হওয়া উচিত যে আমেরিকার অনেক মানুষ এই অপ্রয়োজনীয় অনাহার ও মানুষের এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞকে উপেক্ষা করতে পারছে না? কংগ্রেস, আইনসঙ্গতভাবেই, পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যকে বন্ধ করার প্রয়োজন বোধ করতে পারে।