You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
নৌ বাহিনীর গঠন ও তার যুদ্ধ তৎপরতা সূত্রঃ বাংলা একাডেমির দলিলপত্র ১৯৭১

 

সাক্ষাৎকার: মো: বদিউল আলম
১১-৬-৭৯

প্রথম আক্রমণঃ আমাদের নৌ-পথে বাংলাদেশ প্রথম কর্মতৎপরতা শুরু হয় আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে প্রথম দিকে।আমি কিছু সংখ্যক ছেলেসহ কলিকাতা হয়ে আগরতলায় আসি হিন্দুস্তান বোমারু বিমানে চড়ে। আগড়তলা থেকে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদসহ আমার সংগে বিশজন ছেলে নিয়ে আমি কুমিল্লা অভিমুখে রওনা দিই। আমার টারগেট ছিল কুমিল্লা-চাঁদপুর ফেরীঘাটসহ জাহাজ বিধ্বস্ত করা।

বিশজনের একটি গেরিলা দল নিয়ে আমি বকশনগর বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। পথটি ছিল পাহাড়ি ও বন্ধুর। দুই পাশে পাকসেনার প্রহরাশিবিরের মধ্যদিয়ে গভীর রাতে আমরা পাড়ি জমাই।স্থানীয় গ্রামবাসীরা এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। সীমানা পার হয়ে আমি প্রথমে আমাদের বাংলাদেশে পদার্পণ করি এবং পূর্ণ উদ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে চলি। কোথাও ধানক্ষেত, কোথাও বনজঙ্গল, কোথাও আবার ডোবা নালা বিল।অতি সংগোপনে আমরা সি -এন্ড রি বড় রাস্তা পার হয়ে নৌকা নিয়ে চলতে থাকি। এইভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা পায়ে হেটে ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলাম। এমন সময় সকাল হয়ে গেল। আমরা এক মাস্টার সাহেবের বাড়িতে উঠলাম।মাস্টার সাহেব আমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন।সন্ধ্যার প্রারম্ভে আবার আমরা যাত্রা শুরু করি এবং চাঁদপুরের নিকট সফরমানী গ্রামে ইব্রাহিম মাস্টার (বি-টি) সাহেবের বাড়িতে এসে উঠি।মাস্টার সাহেবের দুই ছেলে সাজু ও দুলু আমার সঙ্গে ছিল।এর পরদিন আমরা ওখান থেকে গিয়ে উঠি এমসি মিজানুর হরমানের বাড়িতে। ওখানে নিরাপত্তাবোধ না হওয়ায় আমরা আবার এসে উঠি এক বিখ্যাত মুসলিম লীগ নেতার বাড়িতে। সেখানে জোরপূর্বক তার বড় ছেলেকে জিম্মা হিসাবে আটক রেখে এই হুশিয়ারী দিই যে, আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিলে আমরা তার ছেলেকে হত্যা করবো।এতে বেশ কাজ হয়। আমরা মাঝির ছদ্মবেশে রাতে চাঁদপুরের নিকট দিয়ে নদী পাড়ি দিই।এমন সময় আমরা ঝড়ের মুখে পতিত হই।এর ফলে আমাদেরকে চরের মধ্যে বেশ কিছু সময় নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল।রাত্র ১১ টা থেকে ৩টা পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলার কথা ছিল।আমরা ঠিক সময় আমাদের অভিযান আরম্ভ করি,কিন্তু দু:খের বিষয় ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন ছিল না।সবই আল্লাহর ইচ্ছা।অবশ্য আমাদের অভিযানের সংকেতধ্বনি বাজানো হয়েছিল তখনকার বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে।আমাদের সংকেত ছিল পঙ্কজ মলিকের লেখা একটি গানের কলি-বধূ আসবে পালকি চড়ে ইত্যাদি। আমাদের অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাত্রে কিন্তু ঐ দিনটি মেঘাচ্ছন্ন দুর্যোগপূর্ণ থাকায় আর তাছাড়া আমাদের পৌঁছানোর নিরাপত্তা না থাকায় অভিযান দুইদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

১৭ই আগস্ট রাত ১১ টায় আমি আমার প্রথম অভিযান চালাই। এর আগে আমি দিনের বেলায় চাঁদপুর শহর ও নদীপথ ভালভাবে পরিদর্শক করে আসি যাকে রেকি বলা হয়। আমি ছেলেদের ছয়টি দলে ভাগ করে প্রত্যেককে একটি করে লিমপেট মাইন পেটে বেধে উল্টাপথে সাতার দিয়ে টারগেটের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিই।সংগে আমিও পিছনে রওনা দেই দুইটি মাইনসহ।দুজন ছাড়া সবাই তাদের টারগেটে মাইন লাগাতে সমর্থ হয়।আমার লক্ষ ছিল সবচাইতে বড় একটি গমের জাহাজ। এজন্য আমি দুটি মাইন নিয়ে অন্য দুজন ছেলেসহ প্রথমে গমের জাহাজের নিচে ডুব দিয়ে নিজ হাতে মাইন লাগাই এবং সংগে আমার সংগী দুজন ও মাইন লাগায়।এরপর সাতরিয়ে পদ্মার মুখে এসে পড়ি।এমন সময় সৈন্যবাহী জাহাজ গাজী আমাদেরকে সম্মুখে বাধা দেয়।তখন এদিকে জাহাজে লাগানো মাইন ধুম ধুম শব্দে ফুটতে শুরু করেছে।জাহাজের ভিতরে তখন হৈ হুল্লোড় চিৎকার শুরু হয়ে গিয়াছে।দুই ধার থেকে তখন প্রহরা বাহিনী নদীর মধ্যে অজস্র গুলি ছুড়তে আরম্ভ করেছে।আমার দল তখন গুলির মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার দিকে সম্ভব আত্নরক্ষার জন্য দ্রুত সরে পড়ে।অন্য দুই দলসহ আমরা ছয়জন তখন পদ্মা নদীরমুখে গাজী জাহাজের সামনে বাধা প্রাপ্ত হই।তখন আমি একটা বার্জ এর গা ধরে কিছু সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখি। প্রায় ভোর হয়ে আসছিল। এদিকে জাহাজ ও আর সরে না,আমরাও আমাদের পথ চলতে পারিনা।কিছু সময় অপেক্ষা করার পর আমার দলের শেষে লাগানো একটি মাইন জেটির কাছে বিষ্ফোরিত হয় এবং গাজী তাড়াতাড়ি নদীর মুখে থেকে নদীর ভিতরে চলে যায়। তখন আমরা ঐ সুযোগে তাড়াতাড়ি পদ্মার মুখ পার হয়ে এক পাটক্ষেতের পাশে ঢুকে পড়ি।এমন সময় সকাল হয়ে গেছে।আমরা তখন ৬জন মাত্র একত্রে আছি বাকী যে যার মত পেরেছে নিজেকে বাচানোর জন্য ছুটে গেছে।পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক যেখানে আমাদের কে নৌকায় ঊঠার কথা ছিল সেই পূর্বনির্ধারিত স্থানে নৌকা না পাওয়ায় আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়ি।আমাদের তখন শূন্য হাত,কোন অস্ত্র নেই।আছে শুধু সাতার কাটার জন্য পায়ে ফিন। এ অবস্থায় আমি দলবলসহ এক পাশের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং জোরপূর্বক এক নৌকায় উঠে বসি।নৌকার মালিক আমাদের দেখে জোরে চিৎকার দেয়।আমরা নৌকা নিয়ে অল্প কিছুদূর এসেছি মাত্র এমন সময় চারদিক থেকে আমাদেরকে প্রায় ১০০ নৌকা ঘিরে ফেলে।নৌকাগুলো ঐ সময় নদীতে ইলিশ মাছ ধরছিল। মাঝিরা আমাদেরকে ঘেরাও করে আমাদের দিকে আসতে থাকে। নিকটে আসার পর আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে আমাদেরকে ডুবুরী বলে চিৎকার দেয় এবং হিন্দুস্থানী বলে চিহ্নিত করে।আমরা নৌকা প্রায় ধর পড়ার উপক্রম। সামনে পিছনে সবব দিকে পথ বন্ধ।সব নৌকার মাঝিরা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।তখন বেলা উঠেছে, আমাদেরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।এমন সময় আমাদের মাথায় উপস্থিত বুদ্ধি খেলে যায়।আমি আমমাদের ছেলেদেরকে সবগুলি ফিন উপরের দিকে উচিয়ে ধরতে বলি যে বলা সেই কাজ।আমি তখন চিৎকার করে বলি আমাদেরকে পথ ছাড় নতুবা আমরা তোমাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলবো। আমার হাতে টর্চ লাইট থাকায় সেটা তাদের দিকে উচিয়ে ধরি এবং পথ ছাড়তে বলি।ওদিকে অনবরত চাঁদপুর বন্দরে আমাদের লাগানো মাইন ফাটা আরম্ভ হয়েছে।আমি তাদেরকে ভয় দেখিয়ে বলি ঐ যে শব্দ শুনতে পারছ,আর এই যে আমাদের কাছে বোমা দেখছো, এটা তোমাদের উপর ছেড়ে দেব। যেমন বলা আর যায় কোথায়, সবাই তখন নৌকা নিয়ে যার দিকে পালাতে শুরু করলো। এর ফলে আমরা নৌকা বদল করে নান্নু নামক এক ছেলের অন্য এক নৌকায় উঠি। পরে শুনতে পাই আমাদের কে সাহায্য করার জন্য ছেলেটিকে পাকবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে।

এরপর আমি সোজা পশ্চিম দিকে নৌকা চালিয়ে কলমচোরা গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হই।ওখানকার চেয়ারম্যান দেওয়ান সাহেব তার বাড়িতে দুপুর বারোটার সময় আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন।ক্ষুধায় আমাদের তখন জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমাদের পরনে তখন মাত্র একটা জাংগিয়া ছাড়া আর কিছু ছিল না। অবশ্য তিনি আমাদের প্রত্যেককে একখানা করে লুঙ্গি দিয়েছিলেন আর কাউকে বা গেঞ্জি আর কাউকে বা শার্ট। আমাকে আগেই নান্নু ছেলেটা তার একটা গামছা ও গায়ের শার্ট খুলে দিয়েছিল। আমরা খাওয়ার সময় সংবাদ পাই যে,আমাদের ধরার জন্য পাকসেনা ও বেশ কিছু রাজাকার আমাদের দিকে আসছে। এমতাবস্থায় আমরা তাড়াতাড়ি অল্প কিছু নাকে মুখে দিয়ে ওখান থেকে সরে পড়ি।সন্ধ্যার সময় স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং রাত্রি যাপন করি অন্য এক বাড়িতে। সারারাত কোন রকম অনিদ্রায় কাটিয়ে দিই।সকাল হওয়ার সংগে সংগে আমি ছেলেদের খোজে বের হই।অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুজনের দেখা পাই এবং তাদেরকে সংগে করে আমি চলে আসি সফরমানী গ্রামে ইব্রাহীম (হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক) সাহেবের বাড়িতে।এসে শুনতে পাই গতকাল্য চাঁদপুর বন্দরে যে অভিযান চালানো হয় তার জন্য মাস্টার সাহেবকে পাকবাহিনী দায়ী করে এবং পরের দিন গুলি করে হত্যা করে।বাড়িতে যা কিছু মালামাল ছিল সব কিছু লুট করে নিয়ে যায়।নারী নির্যাতন করতেও ছাড়ে নাই।ঘটনা শুনে মনে ভীষন ব্যাথা পাই এবং প্রতিজ্ঞা করি যে,এর প্রতিশোধ নেবই নেব খোদা যদি বাঁচিয়ে রাখেন।মাস্টার সাহেবের দুই ছেলে সাজু ও নিলুসহ আমি আমাদের শিবির আগরতলায় যাওয়ার জন্য তৈরী হতে থাকি।এমন সময় আরও দুজন বিমান বাহিনীর লোক আমার সংগে যোগ দেয়।

শিবিরে এসে শুনতে পাই আমি পাকসেনাদের হাতে ধরা পরেছি এবং আমি তাদের নিকট আত্নসমর্পন করেছি। এই খবর পাকিস্তান রেডিও থেকে জোরে ফলাও করে প্রচার হয়েছিল। অবশ্য প্রথম অভিযানের দীর্ঘ ১১দিন আমার কোন খোঁজখবর ছিল না। এতে আমার শিবিরের সকলের মনে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। আমার আগমনে সবাই এক সংগে হর্ষধ্বনি দিয়ে আমাকে ঘাড়ে উঠিয়ে আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করলো।দুদিন যেতে না যেতে আমার ডাক পরে কলিকাতা ফিরে যাওয়ার জন্য। আমাকে বোমারু বিমানে করে কলিকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। কলিকাতায় এসে শুনতে পেলাম অন্যান্য নৌ-অভিযানের মধ্যে সবচাইতে বেশি জাহাজ চাঁদপুর ডুবেছিল এবং চাঁদপুরের সংবাদ বিবিসি সংবাদ সংস্থা পর্যন্ত পরিবেশন করে ছিল।

দ্বিতীয় আক্রমণঃ কলিকাতা থেকে আবার পলাশী শিবিরে চলে আসে। ইতিমধ্যে আমার জন্য করে অভিযান চার্ট তৈরী করে রাখা হয়েছে। আমাকে খুলনার মঙ্গলা পোর্ট অপারেশন করতে হবে।এর আগে যে দলকে আমরা মঙ্গলা পোর্ট অপারেশন করতে দিয়েছিলাম তারা বেশী একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। প্রথম মঙ্গলা দলের অধিনায়ক ছিলেন আমার বন্ধু আহসানুল্লাহ।

আমি এবার ৩০ জন ছেলে সংগে করে মঙ্গলা অপারেশন এর জন্য তৈরী হতে লাগলাম। আগস্ট মাসের শেষদিন আমি ৩০জন ছেলেসহ কলিকাতার ব্যারাকপুর চলে আসি।ওখানে আমাদের জন্য বিশ্রাম শিবির তৈয়ার করা ছিল।ব্যারাকপুর থেকে আমরা প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ সহ ৯নং সেক্টর মেজর জলিল সাহেবের সংগে যোগ দিই।আমাকে সাহায্য করার জন্য মেজর জলিল আমাকে লে:শামসুল আরেফিন সাহেবকে সংগে দেন।আরও দেন ২০০জন স্থল গেরিলা বাহিনী। স্থল গেরিলা বাহিনী আমাদেরকে সাহায্য করবে আর প্রয়োজনবোধে পাকবাহিনীর সংগে যুদ্ধ চালাবে।বাকুন্দিয়া শিবির থেকে আমরা আবার হিঙ্গলগঞ্জ শিবিরে চলে আসি।এখানে দুদিন অপেক্ষা করার পর লে:শামসুল আরেফিন সহ আমি দলবল নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি।

আমরা সাধারণত রাত্রিবেলায় চলাফেরা করতাম। দিনের বেলায় কোন জংগলে অথবা গ্রামের নির্জন বাড়িতে শিবির করতাম,এবং সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতাম যাতে পাকবাহিনী আমাদেরকে আক্রমণ করলে আমরা তার মোকাবেলা করতে পারি।এভাবে দুদিনে ৮০ মাইল পথ পেরিয়ে প্রায় ৩০০ লোকের একটা গেরিলা দল নিয়ে আমরা মঙ্গলা পোর্টের কাছে কৈলাশখালী গ্রামে আমাদের শিবির স্থাপন করি।

কৈলাশখালী গ্রামে লোকজন বেশী ছিলনা। অধিকাংশ বাড়ি ছিল পরিত্যক্ত। আমরা সুন্দরবনের ধারে এক হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়িতে আশ্রয় নিই।আর অন্যান্য স্থলবাহিনী ছেলেদেরকে আমরা কয়েক ভাগে ভাগ করে পরিত্যক্ত বাড়িতে রাখি,যাতে আমাদের উপর হঠাৎ পাকসেনা আক্রমণ করলে সুবিধা করে উঠতে না পারে।

কৈলাশখালী গ্রামে একদিন বিশ্রামের পর আমি ও আমার বন্ধু শামসুল আরেফিনসহ আমরা মঙ্গলা পোর্টে রেকি করার জন্য যাই ছোট এক নৌকাযোগে। ঐসময় খিজির নামে এক মুক্তিযোদ্ধার সংগে আমাদের পরিচয় হয়।মঙ্গলা পোর্ট-এর নিকট সে আগে থেকেই গেরিলা তৎপরতা চালাচ্ছিল। আমাদের পেয়ে সে আরো সাহস অর্জন করলো খিজির ওখানকার বাসিন্দা হওয়ায় আমাদের রাস্তাঘাট চলাচলে সুবিধা হয়েছিল।আরেফিন আমি খিজির ও নৌকা চালানোর জন্য আরও কয়েকজন ছেলেসহ আমরা ঠিক সন্ধ্যার আগে মঙ্গলা পোর্ট রেকি করে আসি। পরদিন আমরা সন্ধ্যার সময় বড় বড় ছ’খানা নৌকায় মঙ্গলা পোর্টের কাছে এসে উঠি।স্থলবাহিনীকে আমরা তিন জায়গায় পজিশন মত বসিয়ে রাখি। যদি কোনরূপ আক্রমণ হয় তারা পাল্টা জবাব দেবে।অবশ্য আরেফিন সাহেব এসব বন্দোবস্ত করেন।আমি আমার নৌ কমান্ডো ছেলেদেরকে বুকে বাধা মাইনসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে নিজে এক দলসহ নদীতে সাতার দেই। আমাদের সংগে থাকতো শুধু ছোট একটি ছুরি,এক জোড়া ফিন আর একটা লিমপেট মাইন।আর গ্রুপ লিডারের কাছে থাকতো একটি অথবা দুটি করে হাতবোমা।কোন জাহাজে চারজন, কোন জাহাজে ছয়জন এভাবে ভাগ করা ছিল।আমার সংগে ছিল চারজন। আমার যে জাহাজটাতে মাইন লাগানোর কথা তা নদীর অপর প্রান্তে বাধা ছিল।যাদের টার্গেট নিকটবর্তী ছিল তারা সেখানে তা লাগিয়ে যে যারমত নিজেকে নিয়ে কেটে পড়ে। আমার জাহাজে যখন পৌঁছি তখন আমার একজন ছেলে তীব্র স্রোতের মধ্যে আমাদের দল ছাড়া হয়ে যায়।আমি ডুব জাহাজের গায়ে যখন মাইন লাগাচ্ছিলাম, তখন অন্য দল দ্বারা পূর্বে লাগানো মাইন বাস্ট হয়ে নদীর মধ্য জাহাজ ডুবতে শুরু করে করেছে।আমি দ্রুত আমার কাজ শেষ করে অন্য ছেলে দুটিসহ ফিরে আসার চেষ্টা করি।এমন সময় জাহাজ থেকে খুব জোরে হুইসেল বাজানো আরম্ভ হয়।অনবরত এস ও এস (সেভ আওয়ার সোল)সংকেত ধ্বনি হতে থাকে।সংগে সংগে বন্দররক্ষী বাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে নদীর মধ্যে গুলি ছুড়তে শুরু করে।নদীর মধ্যে বৃষ্টির গুলি চলছে।আমাদের মোতায়েন স্থলবাহিনী ও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। উভয় পক্ষে ভীষণ রকম গোলাগুলি। নদীর উপরে আকাশ লালে লাল।সমস্ত বন্দরের আলো নেভানো। আমি আমার দলসহ নদীর কিনারায় আসতেই আমার উপর উঠে পরে একটি ছোট উদ্ধারকারী লঞ্চ। লঞ্চটির আলো বন্ধ ছিল।আর আমি উল্টোভাবে সাতার দিচ্ছিলাম। আমার মাথায় লঞ্চটি জোরে আঘাত করে।জোরে আঘাত পাওয়ায় আমার জ্ঞান হারানোর অবস্থা হয়।আমি তখন জোরে ডুব দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্য শ্রোতের অণুকুলে পানির নিচে চলতে আরম্ভ করি।জাহাজের নিচ থেকে নিজেকে রক্ষা করার পর পানির উপর ভেসে উঠে আমার কোন সংগী পেলাম না।তখন প্রায় একা একা স্রোতের প্রতিকুলে গা ভাসিয়ে সাতার কাটতে থাকি। রাত্রি প্রায় তিনটার সময় আমার পায়ের নিচে মাটি লাগে তখন আমি সাতার ছেড়ে বুকে ভর দিয়ে নদীর কিনারায় উঠে বসি।এমন সময় আমার কানের পাশদিয়ে শো শো শব্দে গুলি চলে যায়।আবার মাটিতে শুয়ে পড়ি।লক্ষ্য করে দেখি আমার থেকে মাত্র বিশ ত্রিশ গজ দূরে পাকসেনাদের বাংকার।ওর মধ্যে থেকে অনবরত আমার দিকে গুলি আসছে।কোন উপায় না দেখে আমার কোমর থেকে শেষ গ্রেনেডটি বার করলাম। গ্রেনেডের চাবি দাত দিয়ে খুলে ফেললাম এবং জোরে বাংকারের মুখ লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলাম এবং নিচের দিকে গড়িয়ে পরলাম। আমার গ্রেনেড শব্দ করে ওঠার সংগে সংগে বাংকার থেকে গুলি ছোড়া বন্ধ হয়ে যায়।আমি তাড়াতাড়ি উঠে আমাদের নৌকা যেদিকে ছিল সেদিকে দৌড় দিই। যাওয়ার পর আমার সংগে একজন ছেলের দেখা হয়,ওকে সংগে করে আমি আবার পথ চলতে শুরু করি। এদিকে নদীর উভয় পাশ থেকে ভীষণ গোলাগুলি চলছে।আমরা মাথা নিচু করে নৌকার দিকে আসতে থাকি।প্রকৃত পক্ষে আমি এত দূরে চলে গিয়েছিলাম যে নির্দিষ্ট স্থানে আসতে প্রায় দুঘণ্টা লাগে।আমার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নদীতে ছটার মধ্যে পাচটা জাহাজ ডুবে গেছে আর একটি জাহাজ কাত হয়ে পড়ে আছে।

আমাকে পাওয়ার সংগে শামসুল আরেফিন ও খিজির সংগে সংগে গোলাগুলি বন্ধ করার জন্য আমাদের বাহিনীকে নির্দেশ দেন।গেরিলা বাহিনী একত্র করার পর লোজ গণনাকালে আমার দুইজন নৌকমান্ডো কম দেখতে পাই।তাদের জন্য আরও প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করা হলো।এদিকে পূর্ব আকাশ একেবারে ফর্সা হয়ে আসছে।আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয় দেখে আমি নৌকা ছাড়ার জন্য নির্দেশ দেই। পাকসেনার আওতার বাইরে এসে এক নারিকেল বাগানে এসে কিছু ডাব ও নারিকেল পেড়ে খেয়ে সকালের নাস্তা সেরে দুপুরে শিবিরে ফিরে দেখি আমার ছেড়ে আসা ছেলে দুটি আমার আগেই শিবিরে পৌঁছেছে। ঐদিন বিকালবেলা পোস্ট মাস্টার সাহেব আমাদেরকে জানান যে পাকসেনাদের মনোবল খুবই ভেঙ্গে পড়েছে। আরও জানাগেল, গোলাবারুদ ভর্তি দুটি জাহাজ চিটাগাং বন্দরে পাঠানোর জন্য একেবারে নদীর ধারে রাখ হয়েছে। এ ছাড়া আশে পাশে কয়েকখানা খাদ্য জাহাজও আছে।

আমি বিকাল বেলা আমার অন্য সহকর্মী দ্বিতীয় কমান্ডার মালেকের সংগে অল্প কয়েকজন বাছা বাছা নৌ কমান্ডো ছেলে এবং আরেফিন ও খিজিরের একটি গ্রুপসহ মাত্র বারটা লিমপেট মাইন নিয়ে দুইটি নৌকা করে আবার নদীর ধারে চলে আসি।আগের দিন আমাদের আক্রমণ উল্টা দিক থেকে চালানো হয়েছিল। এবার বনের পাশ ঘেষে সন্ধ্যার আগেই সি-এন্ড বি রাস্তায় এসে পড়ি।রাস্তা থেকে জাহাজের সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে পাই।তাতে মনে হলো, আমাদের কাজ খুব সহজ হবে।তিনটি জাহাজের উপর মাত্র কয়েকজন লোক দেখলাম।

আমার দ্বিতীয় কমান্ডার মালেক জাহাজ তিনটির অপারেশনে নিজে সংগে থাকার অনুমতি চাইল। কাল বিলম্ব না করে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে সে অন্য দুইদলসহ চারটি করে মাইন নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে।দূরত্ব বেশী না থাকায় ১৫মিনিটের মধ্যে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে নিকট ফিরে আসে। তাদেরকে নৌকায় যেতে নির্দেশ দিয়ে আমরা গাছের আড়ালে আত্নগোপন করে মাইন ফাটার অপেক্ষায় থাকলাম। এত তাড়াতাড়ি যে আমরা তিনটি জাহাজে মাইন লাগাতে পারবো তা ধারনা করতে পারিনি। বেশী সময় অপেক্ষা করতে হল না।১৫ মিনিটের মধ্যেই গোলাবারুদ ভর্তি জাহাজ প্রথম মাইন বিস্ফোরিত হয়।সংগে সংগে বিকট আওয়াজ করে তিনটি জাহাজ প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে ডুবতে আরম্ভ করে।যখন বন্দররক্ষীদের নিকট থেকে গুলি ছোড়া আরম্ভ হয় তখন আমরা আমাদের অবস্থান গোপন রাখার জন্য পাল্টা গুলি ছুড়তে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নিষেধ করি। ওখানে আর কাল বিলম্ব না করে দলবল সহ শিবিরে ফিরে আসি।পরদিন দুপুরে কোন রকমে চারটা পেটে দিয়ে আমরা ওখান থেকে নৌকাযোগে সরে পড়ি এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য পুনরায় বাকুন্দিয়া শিবিরে মেজর জলিল সাহেবের নিকট ফিরে আসি। মেজর জলিল আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং অশেষ ধন্যবাদ দেন।তিনি পরদিন আমাকে বারাকপুরে যেতে নির্দেশ দেন।

মঙ্গলা পোর্টে পর পর দুইটি অপারেশন এ নয়টি জাহাজ ডুবেছিল। এ সংবাদ বড় বড় অক্ষরে আনন্দ বাজার পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়।তাছাড়া পৃথিবীর অন্যন্য সংবাদ সংস্থা যেমন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা থেকেও নাকি প্রচার করা হয়েছিল।তখন হিন্দুস্থান নেভী নাকি এস ও এর সংকেত ডায়মন্ড হারবার থেকে শুনতে পেয়েছিল।

আমরা চালনা বন্দরেও ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে অপারেশন চালাতাম। ছোট নৌকা আমাদের কাছে যথেষ্ট ছিল।ছোট নৌকায় যেমন দ্রুত চলাচল করা যেত তেমনি নিরাপত্তা ও ছিল।আমরা যে জায়গায় থাকতাম, সেখানথেকে অনেকদূরে গিয়ে অপারেশন করে চলে আসতাম।ফলে আমাদের অবস্থান পাকসেনাদের দৃষ্টিগোচর হতো না।একদিন দিনের বেলে মাঝি সেজে এক জাহাজে মাইন লাগিয়ে চলে আসি।এক ঘণ্টাপর জাহাজখানা ডুবে যায়।একদিন সংবাদ পেলাম যে দুইখানা আমেরিকান জাহাজ পোর্টের মধ্যে নোংগর করেছে,তার মধ্যে একখানা বোমা ও একখানা অস্ত্র গোলাবারুদ রয়েছে।এ কথা শোনার পর ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হলো।যেমন করে হোক জাহাজ দুইটি ডুবাইতেই হবে।ঐ রাত্রে আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।প্রবল বেগে বাতাস বইতেছিল। নদীতে খুব বড় বড় ঢেউ উঠছিল। এই সময় আমাদের লক্ষ্যর চন্য উপযুক্ত মনে করে সন্ধ্যার পরপরই ২৪জন ছেলেসহ আমি নিজে তৈরী হলাম।রহমত উল্লা,আরেফিনও নদীর ধারে পজিশন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।

বনের মধ্যে থেকে বের হয়ে আমাদের ছোট নৌকা বিলের মধ্য দিয়ে পোর্টের দিকে অগ্রসর হতে লাগল।লক্ষ্যের নিকটবর্তী হয়ে আমরা কিছু সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম। এর মধ্যে স্থলবাহিনীকে বিভিন্ন পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণের জন্য তৈরী থাকতে বললাম। এদিকে পোর্ট থেকে সার্চলাইট চারদিকে নজর রাখা হচ্ছে।কিছু সময় অপেক্ষা করার পর এক সুযোগ নেমে পড়ি চার ভাগে ভাগ হয়ে ৪টা জাহাজ ডুবানোর জন্য।আমার জাহাজটা ছিল একটু দূরে।ঐ জাহাজটাতে ছিল অনেক গোলাবারুদ তাতে কড়া পাহারা ছিল।কোন ছেলে ঐ জাহাজটাতে যেতে সাহস পেল না।আমি ৬জন সাহসী ছেলেসহ নিজে রওয়ানা দিলাম। এদিকে বাকী তিনটি জাহাজে ছেলেরা প্রায় পৌঁছে গেছে।আমি জাহাজের নিকট পৌঁছা মাত্রই আমার উপর সার্চলাইট এসে পড়ে।পাহারারত সাস্ত্রী আমাকে দেখতে পেয়ে আমার দিকে গুলি চালায়।গুলিটি আমার বাম হাতের কুনুইয়ে লেগে যায়।তখন আমি আমার কোমর থেকে একটা গ্রেনেড বের করে দাত দিয়ে পিনটা খুলে ফেলি।গুলি করার সংগে সংগে আমি পানিতে ডুব দিয়েছিলাম। ফলে বাকী গুলি আমার আর লাগেনি। তখন উপর থেকে আমাদের উপর ডেপথ চার্জ করা হয়।এবং পাহারাদার চিৎকার করে বলতে থাকে ক্যাপ্টেন সাহাব,মুক্তি আ’রাহা হাঁয়।আমি আমার গ্রেনেড জাহাজের উপর ছুড়ে মারি।সংগে সংগে জাহাজে আগুন ধরে যায়।এদিকে সার্চ লাইট লক্ষ্য করে আমার দল গুলি চালায়, ফলে সার্চলাইট বন্ধ হয়ে যায় আমার দুটি ছেলে ডেপথ চার্জের ফলে ভীষণভাবে আহত।আমি তখন বাকী ৪জনসহ ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে মাইন লাগিয়ে দিই।তখন আমার মৃত্যুভয় চলে গেলে।মরার আগে আমি জাহাজকে ডুবিয়ে মরবো। গ্রেনেড মারার ফলে জাহাজে আগুন ধরে যাওয়ার আমাদের উপর আর আক্রমণ হয়নি।তদুপরি আমাদের স্থলবাহিনী ওপর থেকে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছিল। ভীষণ গোলাগুলি চলতে থাকে।পোর্টে ব্ল্যাক আউট ঘোষণা করে আমাদেরকে ধরার জন্য স্পীডবোট নিয়ে নদীর মধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয় পাকসেনারা।আমি তখনও জাহাজের গা ধরে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে জাহাজের নিচে অপেক্ষা করছিলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারলাম না।কেননা,আমার নির্দিষ্ট সময় পার হয়েগেলে মাইন ফেটে যাবে।আমার মাইন এর সময় ছিল ৪৫ মিনিট। এসময়ের মধ্যে ৫০০ গজ ডূরে না যেতে পারলে মাইন এর শব্দে বুক ফেটে মারা যাবো।আর দেরী করা নিরাপদ নয় দেখে বাধ্য হয়ে ওখান থেকে আহত ছেলে দুটোকে সংগে করে রওয়ানা দিতে গিয়ে দেখি তারা তখনও মাইন লাগাতে পারেনি।ফিরে চেয়ে দেখি আমার সঙ্গী বাকী ৪জন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।আহত ছেলে দুটির অবস্থা এতবেশি খারাপ হয়ে গেছিল যে ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে মাইন লাগানোর মত ক্ষমতা ছিল না।তাড়াতাড়ি মাইন দুটি নিয়ে জাহাজের গায়ে লাগিয়ে দিই।এবং দুইজনকে আমার সংগে আমার বাহুতে এক হাত রেখে সাতার দিতে বলি।তারা এত দুর্বল ছিল যে,সাতারের ক্ষমতা তাদের রহিত হয়ে গিয়েছিল।আমারও বাম বাহু থেকে রক্ত বার হচ্ছিল।কিছুদূর সাতার কাটার পর আমিও ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ি। এমন সময় আমার দিকে একখানা স্পীডবোট আসতে দেখে ৩জন মিলে ডুব দিই।স্রোত এত বেশী ছিল যে,ডুব দেওয়ার পর আমরা দলছাড়া হয়ে পড়ি।তখন ছেলে দুটি যে কোন দিকে চলে গেল দেখতে পেলাম না।স্পীডবোট উপর দিয়ে চলে গেলে আমি পানির উপর উঠে আর সাথী, হতে পারলাম না।তখন একই কুলে গিয়ে উঠি। তখনও উভয় পক্ষে ভীষণ গোলাগুলি চলছে।খুব বেশী রক্ত ঝরাতে আমিও প্রায় অবশ হয়ে পড়ি।ছেলে দুটোকে রক্ষা করতে না পেরে মনের অজান্তে চোখ দিয়া অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বেশ কিছু সময় বিশ্রাম নেয়ার পর কোমরের গামছা ছিড়ে হাতে বাধন দিই,তাতে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে যায়।ছেলে দুটোকে রক্ষা করতে না পেরে ভারাক্রান্ত মনে ওয়াপদা বাধ পার হয়ে আমরা নির্দিষ্ট জায়গার দিকে এগোতে থাকি।এমন সময় নদীর মধ্যে মাইন ফাটা আরম্ভ হয়ে গেছে।এস ও এস শব্দে সারা পোর্ট ধ্বনিত হয়ে উঠছে।

শিবিরে ফেরার পর আমরা বেশ কয়েক দিনের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি।তখন বনের পার্শ্ববর্তী নদীমুখ গানবোট দিয়ে পাকবাহিনী পাহারা দিতে আরম্ভ করেছিল।বেশ কয়েকটি গানের আমাদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের ঐ সময় গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এ সময় পাকিস্তানীরা ঘোষণা করে যে, মংলা বন্দরে কোন জাহাজ ৭২ মাইলের মধ্যে আসতে পারবে না। যে জাহাজগুলি ঐ সময় ছিল সেগুলিকেও সমুদ্রের মধ্যে চলে যেতে নির্দেশ দেয় পাক সরকার। তখন বন্দর খালি হয়ে যায়।ঐ সময় গানবোট ও প্রয়োজনীয় জাহাজ ছাড়া আর কোন জাহাজ বন্দরে ছিল না।

আমাদের তৎপরতায় মংলা বন্দরে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।আমরাও প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি।তাছাড়া আমাদের গোলাবারুদ ও শেষ হয়ে যাওয়াতে অপারেশন একরুপ বন্ধ হয়ে যায়।এই অবস্থায়ও আমি পাক জাহাজ অর্থাৎ গানবোটের উপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করি,কিন্তু গোলাবারুদ কম থাকায় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে আমরা কলাগাছে মাইন বেধে জোয়ারের সংগে ছেড়ে দিতাম।কিছু সময় পর জোয়ারের স্রোতের সংগে ভেসে গিয়ে মাইন নদীর মধ্যে ফেটে যেতো। এতে পাকসেনারা ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো। আমরা কচুরিপানা একত্র করে তাতে ডিলো পেন্সিল সেট করে জোয়ারের সংগে ভাসিয়ে দিতাম।কিছু সময় পর নদীর মধ্যে বন্দরের কাছে গিয়ে তাতে আগুন ধরে যেতো, এতে সারা নদীতেই আগুন ধরে যেত।এইভাবে আমরা পাকসেনাদের মনে প্যানিক সৃষ্টি করি।

আমাদের তৎপরতায় পাকসেনারা অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের জোর অনুসন্ধান চালাতে আরম্ভ করে।হেলিকপ্টারযোগে বনের উপর দিয়ে ভয়ে ভয়ে আমাদের সন্ধান করতে থাকে।পরে আমাদের গোপন শিবিরের জানতে পেয়ে আমাদের উপর একদিন হঠাৎ বিমান আক্রমণ চালায়।এতে আমাদের বেশ কয়েকটি ছেলে আহত।আমরা শিবির পরিবর্তন করে আরও গভীর বনের মধ্যে চলে যাই এবং নতুন শিবির স্থাপন করি।গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসায় আমি এসময় রহমতউল্লাহ সাহেবকে শিবিরে রেখে আবার মেজর জলিলের নিকট চলে যাই গোলাবারুদ সংগ্রহ করার জন্য। আমাকে তখন কলিকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।আমি কলিকাতা চলে আসি।৮নং থিয়েটার রোডে ওসমানী সাহেবের সংগে আমাকে দেখা করিয়ে দেওয়া হয়।তখন ওসমানী সাহেব আমাকে আমাদের চৌধুরী সাহেব ও নজরুলের সংগে মিলিয়ে দেন এবং আমাদেরকে শিবিরে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন।আমি কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর কল্যাণী শিবিরে চলে আসি।ওখান থেকে আবার আমাদের পলাশী শিবিরে প্রেরণ করা হয়।পলাশীতে এসে দেখতে পেলাম শিবিরে আমার জন্য ২০০ছেলে অপেক্ষা করছে ফুলছড়িঘাট অপারেশন করার জন্য। আরও শুনতে পেলাম ফুলছড়িঘাটে আমার বন্ধু রকিব অপারেশন করতে গিয়ে মারা পড়েছেন।শুনতে পেলাম চলতি জাহাজে মাইন লাগাতে গিয়ে জাহাজের নিচে পড়ে তিনি মারা যান।রকিব আমার বিশিষ্ট বন্ধু ছিল।তার মৃত্যুতে আমার ভীষণ আঘাত লাগলো। বেশ কয়েকদিন পর আবার আমি তৈরী হতে থাকি।এমন সময় এক সন্ধ্যায় শুনতে পেলাম পাক সরকার হিন্দুস্থানের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।

স্বাঃ বদিউল আলম
১১-৬-৭৯

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!