You dont have javascript enabled! Please enable it!
বিষয় সূত্র তারিখ
ভারতে বাংলাদেশের শরনার্থীঃ কেনেডীর বক্তৃতা ও চিঠি সিনেটের কার্যবিবরনী ২ জুন, ১৯৭১

২ জুন ১৯৭১ এস ৮০০১
কংগ্রেসনাল রেকর্ড- সিনেট
ভারতে পাকিস্তানি শরনার্থী
জনাব কেনেডীঃ জনাব প্রেসিডেন্ট, ভারতগামী পূর্ব পাকিস্তানের শরনার্থী সংখ্যা এখন ৪ মিলিয়ন (৪০ লক্ষ)-এর বেশী, এবং এই সংখ্যা বেড়ে দৈনিক ১ মিলিয়ন (১০ লক্ষ) দাড়িয়েছে। এদের প্রায় ৩ মিলিয়ন (৩০ লক্ষ) শরনার্থী পশ্চীম-বঙ্গের কলকতায় অবস্থানরত রয়েছে এবং বাকিরা পূর্ব-পাকিস্তানের এবং ভারতের সীমান্তবর্তী জায়গায় অবস্থানরত; যার অধিকাংশ রয়েছে পশ্চীম ত্রিপুরাতে, জনসংখ্যা প্রায় ১.৫ মিলিয়নের কাছাকাছি, কিন্তু এই শরনার্থীদের কারনে, জনসংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে গেছে।
কিছু কিছু শরনার্থীদের তাদের আত্নীয়রা স্বাগত জানালেও, অধিকাংশের আশ্রয় হচ্ছে সীমান্ত নিকটবর্তী শরনার্থী শিবির, সরকারী বিল্ডিং যেমন, স্কুল অথবা খোলা মাঠে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত এসব শরনার্থীর ৭০ ভাগ মহিলা এবং শিশু। শরনার্থীদের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং চিকিৎসার চাহিদা ব্যপক। এবং তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।
এসব শরনার্থীদের ভরন-পোষোনের যাবতীয় খরচ উৎস এবং তার ব্যাবহৃত মানের সাথে পরিবর্তনশীল।
ভারত সরকার এই ৪ মিলিয়ন শরনার্থীদের খাওয়া বাবদ ৩ মাসের জন্য প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে, যা ৭৮ থেকে ৯২ বিলিয়ন ডলারে উন্বিত হয় প্রায় ৬ মাসের জন্য। এই খরচ ধরা হয়েছে, প্রতি শরনার্থী ২০০০ ক্যালোরী খাবারের দাম হিসাবে।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, এসব শরনার্থীদের খাবার বাবদ, ৩ মাসের জন্য ৩২-৩৬ মিলিয়ন ডলার এবং ৬ মাসের জন্য ৬৫-৭২ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দকৃত করেছে। এই হিসাব করা হয়েছে, জন প্রতি ১৬০০ ক্যালরী হিসাবে।
আমাদের নিজেদের সরকার, জন প্রতি ১৬০০ ক্যালরী খাবার হিসাবে, ৪ মিলিয়ন শরনার্থীর, তিন মাসে ৩০ মিলিয়ন ডলার এবং ৬ মাসে ৬০ মিলিয়ন ডলার হিসাব করেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট আমাকে জানিয়েছে যে, আমাদের সরকার এক খরচের অর্ধেক বহন করতে সক্ষম। যাইহোক, এখন পর্যন্ত মাত্র ২.৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। এই হিসাবে, আমেরিকার স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা, যেমন কেয়ার, ক্যাথলিক ত্রাণ সেবা এবং বিশ্ব চার্চ/বিশ্ব লুথার্ণ ফেডারেশন বর্তমানে ২ লক্ষ ৮০ হাজার শরনার্থীদের খাদ্য সরবরাহ করছে। কিন্তু পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহের শর্তে এসব সংস্থা, প্রায় ১.৫ মিলিয়ন শরনার্থীদের খাবার সরবরাহের ধারনক্ষমতা রাখে।
এপ্রিল মাসের ২৩ তারখে ইন্ডিয়ান সরকার জাতিসঙ্ঘের কাছে মানবিক সহোযগীতার জন্য আবেদন করেছে। আজকে, প্রায় ৬ সপ্তাহ পরও আন্তর্জাতিক ত্রান সরবারহ শুরু হয়নি, এবং আফসোসের সাথে জানাচ্ছি, অনুসন্ধানের জবাবে, না জাতিসংঘ, না আমাদের সরকার, কোন উত্তর প্রদানে আগ্রহ দেখায় নি, কবে নাগাদ এই ত্রান কার্যক্রম শুরু হতে পারে। ইতিমধ্যে, ইন্ডিয়ান সরকার, তাদের সীমিত সম্পদ এবং অন্যান্য ব্যাক্তিগত স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার সাহায্য নিয়ে, এসব শরনার্থীদের যতটা সম্ভব মানিবিক চাহিদা গুলো পূরন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
জনাব প্রেসিডেন্ট, দিন দিন এটা খুবই স্পষ্টতর যে, পূর্ব-পাকিস্তানের অস্থীরতা এবং সংঘাতের কারনে খুব বড় এক মানবিক বিপর্যয় সংঘটিত হচ্ছে। কতদিন বিশ্ববাসী এভাবে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকবে, যেখানে অঞ্চলটি দিন দিন বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে? আর কত দিন জাতিসঙ্ঘ, এভাবে সমস্যাগুলো পর্যবেক্ষন করবে যেখানে মানবিক চাহিদাগুলো এত সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত?
আর কতদিন আমাদের সরকার এমন নিস্ফল আন্তর্জাতিক ত্রান কার্যক্রম গঠনের প্রচেষ্টা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে যা কিনা এখন পর্যন্ত শুধু কাগজ-কলমে রয়ে গেছে? আর কত দিন, আমরা ভারতের তাবু, ত্রান সরবরাহের জন্য সি-১৩০ এবং হেলিকাপ্টারের আবেদনেকে সময়োপযোগী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবো, যেখানে পুরো দক্ষিণ-এশিয়াকে সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত মজুত আমেরিকার আছে?
আর যেখানে প্রতিদিন হাজারো শরনার্থী ভারতে পাড়ি দিচ্ছে, আর কতদিন পাকিস্তান সরকার দাবী করবে, পুর্ব-পাকিস্থানের অবস্থা স্থীতিশীল?
জনাব প্রেসিডেন্ট, এই আশংকাজনক অবস্থা আমাকে বাধ্য করেছে, রজার স্টেটের সচিবকে আবারো অনুরোধ করে চিঠি লিখতে, যেন আমাদের সরকার, পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের অবস্থা এবং ভারতে আশ্রয়রত শরনার্থীদের কথা সমবেদনার সাথে বিবেচনা করে; এবং যত দ্রুত সম্ভব অন্যদের সাথে মিলে, এই স্থানের প্রয়োজনীয় শান্তি এবং ত্রান সরবরাহে পদক্ষেপ নেয়। আমি চাই, ২৭ মে’র এই চিঠিতে উল্লেখিত বিষয়বস্তু সর্বসাধারনের সম্মতির সাপেক্ষে আমার মন্তব্যের অংশ হিসাবে নথিভুক্ত করা হোক!
২৭ মে ১৯৭১

মাননীয় উইলিয়াম পি রজার্স
স্টেট সচিব
ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট
ওয়াশিংটন ডিসি
জনাব সচিব মহাদয়, পূর্ব-পাকিস্তানের অবস্থা এবং ভারতে আশ্রয়রত বিপুল সংখ্যক শরনার্থী- বিষয়টি সর্বসাধারন এবং কংগ্রেশনাল উদ্বেগ হিযাবে এখন কার্জত রয়েছে। যেহেতু আপনি জানেন, আমি এই ব্যাপারটি নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন আছি, এবং এই বিপর্যয়ের সেই শুরু থেকে আমাদের সরকার এবং অন্যান্য রাষ্ট্র, বিশেষ করে জাতিসংঘের, রাজনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন এবং জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ সরবরাহের কার্যক্রমের প্রচেষ্টাকে খুব দৃঢ়ভাবে সম্মত এবং সমর্থন জানিয়ে এসেছি।
রেকর্ড বলছে খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। অবস্থা দিন দিন বেগতিক হচ্ছে। প্রায় সব প্রতিবেদন, এমনকি আমাদের সরকারের প্রেরিত গুলো, মানুষের চাহিদা, বিক্ষিপ্ত সামরিক দ্বন্দ, সরকারের সেবামুলক কাজের অভাব এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পুর্ব-পাকিস্তানের মানুষের দৃঢ় বিভেদের খবর জানাচ্ছে। ভারত এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অসন্তোষ প্রতিদিন বাড়ছে, যা ঐ এলাকার শান্তি এবং স্থিতীশীলতার জন্য হুমকি স্বরুপ। ভারতে গমনরত শরনার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা বর্তমানে দিনে ১ লক্ষে দাড়িয়েছে। ভারতে সর্বোমোট শরনার্থীদের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩.৫ মিলিয়নে দাড়িয়েছে। ২৩ শে এপ্রিল, ভারতের আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্যের আবেদন, এখন পর্যন্ত নাম মাত্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছে, কারন পৃথক সরকার এবং জাতিসংঘ, এরুপ বিরাট বিপর্যয়ে মন্থর হয়ে আছে।
খুব তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বিশেষ করে, অন্তত এই ৪ ক্ষেত্রে।
প্রথমত, কেন্দ্রিয় সরকার এবং পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতকবৃন্দের মধ্যে রাজনৈতিক অধিকার সহজতর করার লক্ষ্যে, দৃঢ় প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে করে ইন্ডিয়াতে পলায়নকৃত শরনার্থী প্রবাহ বন্ধ করা যায় এবং ইতিমধ্যে আশ্রয়কৃত শরনার্থীদের ফিরিয়ে আনা যায়।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রিয় সরকারকে আমারেকার পক্ষ থেকে সাধারন অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের শর্তে, পূর্ব-পকিস্তানে জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ সরবরাহে আমাদের সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এই লক্ষ্যে, আমাদের সরকারকে, পাকিস্তান সরকার এবং আন্তর্জাতিক কর্মীবৃন্দ দ্বারা, পাকিস্থান সরকারের বিবৃত খাদ্য এবং চিকিৎসার চাহিদা এবং ওই সকল ত্রান বিতরনের জন্য নদীবাহিত যান প্রদানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
তৃতীয়ত, পাকিস্তান এবং ভারতের মাঝে বিরাজকৃত রাজনৈতিক অস্থিরতা, যা কিনা শান্তি এবং স্থিতীশীলতার জন্য ঝুকিস্বরুপ, শান্ত করার জন্য আমাদের সরকার এবং অন্যান্য সরকারের যথাপোযক্ত কূটনেতিক পথ ধরে আগাতে হবে।
চতুর্থত, ২৩শে এপ্রিল ভারতের আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্যে প্রার্থনায় জাতিসঙ্ঘ নিরুত্তর বসে থাকলেও, আমরা এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। এখন পর্যন্ত, ভারতে জাতিসঙ্ঘের কোন ত্রাণ ব্যাবস্থা বাস্তবায়িত হয়নি। যতক্ষন পর্যন্ত এটা করা হয়, দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে, আমাদের সরকারের, ভারতের এই আবেদনে সাড়া দেয়া উচিত। ভারত ইতোমদ্ধ্যে তাদের মানবিক চাহিদাগুলোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছে; এবং একটি অসংহত আন্তির্জাতিক সংস্থায় আমাদের তহবিল বরাদ্দ, শুধুমাত্র ভারত সরকার কর্তৃক সম্মুখীত মানবিক সংকটের অবনতি ঘটায়।
আমি খুবই আশাবাদী যে আমাদের সরকার পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের অবস্থা এবং ভারতে আশ্রয়রত শরনার্থীদের কথা সমবেদনার সাথে বিবেচনা করবে; এবং যত দ্রুত সম্ভব অন্যদের সাথে মিলে, এই স্থানের প্রয়োজনীয় শান্তি এবং ত্রান সরবরাহে পদক্ষেপ নেবে।
বিনীত
এডওয়ার্ড এম কেনেডি
চেয়ারম্যান
শরণার্থী সংক্রান্ত সাবকমিটি
 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!