You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.12.09 | জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকার | দৈনিক বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৮। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অনুসৃত রণনীতি ও রণকৌশল দৈনিক বাংলা ৪-৯ ডিসেম্বর, ১৯৭২ ……

 

জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকার
হেয়াদেত হোসাইন মোরশেদ

প্রশ্নঃ মুক্তিবাহিনী কিভাবে সংগঠিত হয়েছিল এবং ২৬শে মার্চের পর থেকে ৩রা ডিসেম্বর তারা কোন ধরনের রণনীতি ও রণকৌশল অবলম্বন করেছিলেন?
জেনারেল ওসমানীঃ আপনাদের মনে আছে ২৬শে মার্চ থেকে শত্রুকে প্রতিরোধ এবং বাঙ্গালীকে দমনে শত্রুদের কার্যক্রম প্রতিরোধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর বাঙ্গালী সৈনিক, প্রাক্তন ই-পি-আর -এর বীর বাঙ্গালীরা এবং আনসার, মোজাহেদ, ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বীর জওয়ানেরা। সঙ্গে সঙ্গে এদের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন যুবক ও ছাত্ররা।

সর্বপ্রথমে যুদ্ধ হয় নিয়মিত পদ্ধতিতে। আর এ পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালু থাকে মে মাস পর্যন্ত। শত্রুকে ছাউনিতে যথাসম্ভব আবদ্ধ রাখা এবং যোগাযোগ কেন্দ্রসমূহ তাকে কব্জা করতে না দেয়ার জন্য নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতিতে যুদ্ধ করা হয়েছিল। এ জন্য পদ্ধতি ছিল- যত বেশী বাধা সৃষ্টি করা যায় তা সৃষ্টি করা হবে; যেসব ন্যাচারাল অবস্টাকল বা প্রতিবন্ধক রয়েছে তা রক্ষা করতে হবে, এর সাথে সাথে শত্রুর প্রান্তভাগে ও যোগাযোগের পথে আঘাত হানা হবে। মূলতঃ এই পদ্ধতি ছিলো নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতি। আর সংখ্যায় কম হওয়াসত্ত্বেও নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সাথে এই পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে। এই পর্যায়ে বেশকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ রয়েছে। যথাঃ – ভৈরব-আশুগঞ্জের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টার শত্রুবাহিনীকে চারদিন আটকে রাখা হয়।

তবে একটা বিষয় আমি আলোকপাত করতে চাই। নিয়মিত বাহিনীর যেটা স্বাভাবিক কৌশল, তা আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার জন্য কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছিল। আমরা ছোট ছোট অংশে অর্থাৎ ছোট ছোট পেট্রোল বা ছোট ছোট কোম্পানী প্লাটুনের অংশ দিয়ে শত্রুবাহিনীর তুলনামূলক অধিকসংখ্যক লোককে রুদ্ধ করে রাখি এবং সাথে সাথে শত্রুর উপর আঘাত হানতে থাকি। এভাবে চট্টগ্রাম ও অন্যান্য সর্বপ্রথমে যুদ্ধ শুরু হয়।

সে সময় আমার ও আমার অধিনায়কদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আমরা কেবলমাত্র নিয়মিত বাহিনীর পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে চলতে পারব না। কারণ আমাদের সংখ্যা তখন সর্বমোট মাত্র ৫টি ব্যাটালিয়ন। এছাড়া আমাদের সাথে প্রাক্তন ই-পি-আর-এর বাঙ্গালী জোয়ানেরা, আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ ও যুবকরাও ছিলেন। যুবকদের অস্ত্র দেয়া একতু কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমরা ভেতর থেকে যে অস্ত্রগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম সেগুলো দিয়ে তাদেরকে তাড়াতাড়ি মোটামুটি প্রশিক্ষণ নিয়ে দাঁড় করিয়েছিলাম। আমাদের বিরুদ্ধে তখন শত্রুবাহিনীর ছিলো তিন-চারটি ডিভিশন। এই তিনটি ডিভিশনকেই নিতম সংখ্যা হিসাবে ধরে নিয়ে আমরা দেখতে পেলাম যে এদেরকে প্রতিরোধ করা, ধ্বংস করা সোজা নয়, সম্ভব নয়। তাই এপ্রিল মাস নাগাদ এটি আমার কাছে পরিষ্কার ছিল যে আমাদের একটি বিরাট গণবাহিনী এ রকম হতে হবে যেমন মানুষের পেটের অস্ত্রের মধ্যে একটি শক্তিশালী জীবানু অস্ত্রটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে ভেতর থেকে শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী শত্রুর অস্ত্রগুলো বিনিষ্ট করে দেবে। শত্রুকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে না। কারণ তাদের সংখ্যা বেশী, তাদের অস্ত্র বেশী, তাদের বিমান রয়েছে, আর আমাদের কাছে বিমান ছিলোনা। এছাড়া সম্বল তাদের অনেক বেশী।

কিন্তু এই সাথে সাথে পরিষ্কার ছিলো যে বাইরে লেখা ক্লাসিক্যাল ওয়ারফেয়ার করে দেশ মুক্ত করতে হলে বহুদিন যুদ্ধ করতে হবে, ইতিমধ্যে আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের সবচেয়ে বড় জনসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে। আর বিশেষ কিছু উদ্ধার করার থাকবেনা। সেজন্য এপ্রিল মাসের শেষের দিকে এটাও আমার কাছে পরিষ্কার ছিলো যে আমাদের একটি নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে সময় কমাবার জন্য। সেই পদ্ধতিতে বড় একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করে ভেতর থেকে শত্রুকে আঘাত করতে হবে এবং সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীর ছোট ছোট ইউনিট কোম্পানী বা প্লাটুন দিয়ে শত্রুকে আঘাত করতে হবে এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য তাকে বাধ্য করতে হবে-সে যেন কনসেন্ট্রেটেড না থেকে ডিসর্ডারড হয়। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতাজনিত শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সে ছোট ছোট সংযোগের রাস্তা, তার রিএনফোর্সমেন্টের রাস্তা ধ্বংস করে তাকে ছোট ছোট পকেটে আইসোলেট বা বিচ্ছিন্ন করা যাবে।

এজন্য আমার অনেক নিয়মিত বাহিনীরও প্রয়োজন ছিলো। এই প্রয়োজনের কথা আমি মে মাসের শুরুতে সরকারকে লিখিতভাবে জানাই। এবং এর ভিত্তিতে মিত্রদের কাছ থেকে সাহায্যও চাই। তাতে আমার উদ্দেশ্য ছিলো – (ক) কমপক্ষে ৬০ থেকে ৮০ হাজার গেরিলা বাহিনী ও (খ) ২৫ হাজারফের মত নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এই বাহিনী সত্বর গড়ে তুলতে হবে। কারণ, একদিকে গেরিলা পদ্ধতি এবং সঙ্গে সঙ্গে শত্রুকে নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডো ধরনের রণকৌশল দিয়ে শক্তি বন্টন করার বাধ্য করতে হবে যাতে তার শক্তি হ্রাস পায়।

এই পদ্ধতি আমরা কার্যে পরিণত করি। ক্রমশঃ গড়ে উঠলো একটি বিরাট গণবাহিনী – গেরিলা বাহিনী। জুন মাসের শেষের দিক থেকে গেরিলাদের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। প্রথমে বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি বানানো হয় এবং জুন মাসের শেষের দিক থেকে আমাদের গণবাহিনী বা গেরিলা বাহিনী এ্যাকশনে নামে। তবে, জুলাই-আগস্ট মাসের আগ পর্যন্ত শত্রুবাহিনী তাদের উপর গেরিলা বাহিনীর প্রবল চাপ বুঝতে পারেনি। যদিও শুরু থেকে আমরা কিছু সংখ্যক যুবককে ট্রেনিং দিয়ে ভেতরে পাঠিয়েছিলাম। তারা চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়েছিলো, ঢাকায়ও এসেছিলো। তবে গেরিলাদের শত্রুরা জুলাই মাস থেকে অনুভব শুরু করে।

এর সাথে আরেক দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ হয়। আমাদের নৌবাহিনী ছিলো না। আমার কাছে নিয়মিত বাহিনীর বহু অফিসার, ওয়ারেন্ট অফিসার ও নাবিক আসেন। ফ্রান্সের মত জায়গা থেকে কয়েকজন পাকিস্তানের ডুবোজাহাজ ছেড়ে আমাদের সঙ্গে যোগদান করেন। আমি তাদেরকে ভিত্তি করে এবং আমাদের বড় শক্তি যুবকদের ব্যবহার করে নৌকম্যাণ্ডো গঠন করি। এই নৌকম্যাণ্ডো জলপথে শত্রুর চলাচল ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে আমাদের এই নৌকম্যাণ্ডোদের আক্রমণ শুরু হয়। তারা যে বীরত্ব কৃতিত্ব দেখিয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর নেই। তারা মঙ্গলায় বহু জাহাজ ডুবায়। তার শত্রুর জন্য বিভিন্ন অস্ত্র-সামান নিয়ে যেসব জাহাজ আসছিল চট্টগ্রামে, সেগুলো ধ্বংস করে। এজন্য অত্যন্ত দুঃসাহসের প্রয়োজন ছিলো। তারা শত্রুর দুটি বন্দর বন্ধ করে দেয় এবং নদীপথেও তাদের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়।

আমাদের কৌশল অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়। সেপ্টেম্বরের শেষনাগাদ শত্রু রক্তহীন হয়ে উঠে। তার ২৫ হাজারের মত সৈন্য বিনষ্ট হয়। বহু যানবাহনের লোক্সান হয়। ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত শত্রুর এই অবস্থা দাঁড়ায় যে একজন ব্রক্রার রিং-এর দ্বিতীয় রাউন্ডে ক্লান্ত হয়ে ঘুরছে এবং একটা কড়া ঘুষি খলে পড়ে যাবে- তার যোগাযোগ অবস্থা সম্পূর্নভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। যেভাবে আময়ার উদ্দেশ্য ছিলো সেভাবে বিভিন্ন জায়গায় তারা ছোট ছোট পকেট বানিয়েছিলো। তারা কোতি কোটি টাকা খরচ করে রি-ইনফোর্স কংক্রিটের বাংকার বানিয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে তারা ঢুকে ছিলো। রাতের বেলাত বেরুতোই না-ই, দিনের বালায়ও বেশীসংখ্যক লোক ছাড়া বেরুতো না। শত্রুর তখন এই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল।

অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই শত্রু যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। যাতে তাদের জান বাচে, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের পর একটা যুদ্ধবিরতি হয়, অবজারভার এসে যায় এবং জাতিসংঘের কাছে সমস্যাতি দিয়ে তাদের জান রক্ষা হয়- শত্রুপক্ষের এই ছিলো প্রসেষ্টা। কারণ, তখন তারা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো যে তাদের পরাজয় একেবারে অনিবার্য। জাতিসংঘ যখন হস্তক্ষেপ করলো না তখন তারা একটা আন্তর্জাতিক যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালালো যাতে জাতিসংঘ এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। প্রথমে তারা আমাদের ঘাঁটি, পজিশন ও বেসগুলোর অপর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা করে। সাথে সাথে তারা পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাঞ্চলেও গোলাগুলি শুরু করে।

আরেকটি ব্যাপার আমি বলতে চাই। আমার কাছে বিমান ছিলো না। তবে শেষের দিকে কয়েকতি বিমান নিয়ে আমি ছোটখাটো একটি বিমানবাহিনী গঠন করেছিলাম। আমি যা বিমান পেয়েছিলাম তা ছিলো, দু’টি হেলকপ্টার, একটি অটার এবং আমার যানবাহনস্বরুপ একটি ডাকোটা। সেই অটার ও হেলকপ্টারগুলোতে মেশিনগান লাগিয়ে বেশ সজ্জিত করা হলো। আমাদের যেসব বৈমানিক স্থলযুদ্ধে রত ছিলেন তাদের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে একটি ছোট বিমান বাহিনী গঠন করা হলো। এই বাহিনীর কৌশল ছিলো গুরুত্বপূর্ন কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা করা এবং ইন্টারডিকশন অর্থাৎ শত্রুর যোগাযোগের পথকে বন্ধ করে দেবার জন্য লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানা।

আপনারা জানেন কিনা জানিনা, শত্রুর উপর প্রথম যে বিমান হামলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের বীর বৈমানিকরা করেছে। ২৬শে মার্চ থেকে ৩রা ডিসেম্বর পর্যন্ত যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে যদিও আমাদের কাছে বিমান ছিলো না কিন্তু আমরা বিমান ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হেনেছি। শেষের দিকে একজন মুক্তিযোদ্ধা সিলেট বিমা ঘাঁটিতে একটি সি-১৩০ বিমানের ওপর অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মেশিনগান চালায়। মেশিনগানের গুলিতে যদিও সি-১৩০ বিমানটি পড়ে যায়নি, তবে কোন রকমে ঢুলু ঢুলু করে চলে গিয়ে শমসেরনগরে নেমেছিলো এবং পরে অনেকদিন মেরামতে ছিল।

প্রশ্নঃ ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সম্মিলিত বাহিনীর রণনীতি রণকৌশল কি ছিলো?
জেনারেল ওসমানীঃ প্রথমেই এই কথা বলে নিচ্ছি, শেষের দিকে অর্থাৎ ডিসেম্বরের আগে শেষ পর্যায়ে শত্রুবাহিনী ভারতের উপর যথেষ্ট পরিমান হামলা শুরু করলো। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে ভারতীয়দের যুদ্ধে নামতে হবে-যদিও উপর থেকে তারা তখনো নির্দেশ পাননি। এমন কি শেষের দিকে যখন যশোর সীমান্তে ভারতের উপর হামলা হয়েছে তখনো উপর থেকে ক্লিয়ারেন্স আসেনি।

একদিনের কথা আমার মনে পড়েছে। সেই অঞ্চলে যুদ্ধরত আমার মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ হচ্ছে। আমাদের ট্যাঙ্ক ছিলো না। পাকিস্তানী ট্যাঙ্কগুলো ভারতীয় অঞ্চলের উপরও গোলাবর্ষণ করছে। আমি তখনোদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এর জবাব দিচ্ছেন না কেন? তারা বললেন, “পলিটিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নেই।” তখন আমার নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীর যোদ্ধারা অতি বীরত্ব ও কৃতিত্বের সহিত মোকাবেলা করেছে।

ভারতীয় বাহিনী ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধে নামে। এবং শত্র্য আত্মসমর্পন না করা পর্যন্ত ১৩ দিন যুদ্ধ করেছিলেন। অবশ্য এর আগে তারা আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। ভারতীয় বাহিনীর যখন যুদ্ধে নেমে আসার সম্ভাবনা দেখা দিলো, তখন আমরা সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা করে একটি রণনীতি অবলম্বন করি। সেই নীতি ছিলো, যেহেতু ভারতীয়দের কাছে ট্যাঙ্ক, কামান, ও বিমান রয়েছে সেজন্য যেখানে শক্তিশালী প্রতিরোধ রয়েছে এবং বড় অস্ত্রশক্তি প্রয়োজন সেখানে তারা প্রথম লক্ষ্য দেবেন এবং আমাদের বাহিনী শত্রুকে ‘আউটফ্লাঙ্ক’ অর্থাৎ দু’পাশ দিয়ে অতিক্রম করে- ‘ক্রস কান্ট্রি’ দিয়ে গিয়ে ব্যূহের পার্শ্বভাগে আক্রমণ করবে অথবা ভারতীয়রা সামনের দিক দিয়ে শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখবে এবং আমাদের বাহিনী ‘আউটফ্লাঙ্ক’ করে পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে। যেহেতু অঞ্চলগুলো সম্পর্কে আমাদের বাহিনীর অভিজ্ঞতা ছিলো, আমার বাহিনী হাল্কা ছিলো ও ক্ষিপ্রতার সাথে রণাঙ্গনে চলাচলে সক্ষম এবং যেহেতু অঞ্চলগুলো সম্পর্কে আমাদের বাহিনী সম্পূর্ন সজাগ ছিলো। সে জন্যে এই কাজগুলো করার দায়িত্ব ছিলো আমাদের উপর। যেখানে অধিকসংখ্যক গোলাবারুদ, বিমান বা ট্যাঙ্কের আক্রমণ করতে হবে সেখানে ভারতীয় বাহিনী শক্তি নিয়োগ করবে।

যেসব অঞ্চল কেবলমাত্র বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী অর্থাৎ মুক্তিবাহিনী মুক্ত করেছিলো সেখানে আমাদের বাহিনী সম্পূর্নভাবে আমাদের নিজেদের পরিকল্পিত পদ্ধতিতেই যুদ্ধ করেন। আমাদের বাহিনী যেসব অঞ্চল এভাবে মুক্ত করে তারমধ্যে উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চল, সিলেটের সুনামগঞ্জ, ও দুতিক অঞ্চল, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরাঞ্চল, চট্টগ্রামের করেহাট, হায়াকু, হাটহাজারী অঞ্চলের ‘এক্সেস অব এডভ্যান্স’, কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ও মেহেরপুর অঞ্চল, যশোরের মনিরামপুর ও অভয়নগর অঞ্চল, খুলনার বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও কালিগঞ্জ অঞ্চল, ফরিদপুর সদর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ অঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চল এবং ঢাকা পৌছার শেষ পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, নরসিংদী, ঢাকা-এই ‘এক্সেস অব এডভান্স’ রয়েছে। শেষপর্যন্ত মিত্ররাও এই পদ্ধতিটি বেশী কার্যকর বলে মেনে নিয়েছিলেন। এই পদ্ধতি ছিলো – শত্রুর যেখানে পাকা বাঙ্কার বা রি-ইনফোর্সড কংক্রিটের শক্তিশালী ব্যূহ বা স্ট্রং পয়েন্ট রয়েছে, সেখানে গিয়ে সরাসরি ঢুঁ মারা বুরবাকের কাজ। এ ক্ষেত্রে যা করতে হবে তা ১৯৪২ সালে জাপানীরা বৃটিশ বাহিনীকে (যাতে আমিও ছিলাম) শিখিয়েছিলো। এক্ষেত্রে সামনে দিয়ে শত্রুকে ব্যস্ত রাখতে হবে এবং ‘আউটফ্লাঙ্ক’ করে ওর পেছনে গিয়ে স্ট্রং পয়েন্ট বানিয়ে বসুন। সে যাবে কোথায় এবং ওর রি-এনফোর্সমেন্ট ও গোলাবারুদ, রসদ, ইত্যাদি আসবে কোত্থুকে? এভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করে তার বুহ্যের পেছনে ও পার্শ্বভাগে আঘাত করুন। প্রথম প্রথম মিত্রদের অনেকে ভাবতেন আমরা কি ভীতু নাকি! তারপর একটি অভিজ্ঞতা হওয়ার পর বুঝলেন যে আমাদের পদ্ধতিই একমাত্র কার্যকর রণপদ্ধতি। এইভাবে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কেবল একটি ব্যাটালিয়ন শত্রুর ১৪নং ডিভিশনকে আশুগঞ্জের যুদ্ধের পর ঘেরাও করে অকেজো করে দেয়।

তাই যেসব অঞ্চলে আমরা একা যুদ্ধ করেছি সেখানে আমাদের পদ্ধতি ছিলো, শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটিকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে সম্মুখভাগে ব্যস্ত রেখে তাকে ‘আউটফ্লাঙ্ক’ করে পেছনে গিয়ে বসা এবং তারপর পার্শ্বভাগ ও পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করে তাকে ধ্বংস করা। অভ্যন্তর ভাগের গেরিলাদের (গণবাহিনীর) ও আমাদের নিয়মিত বাহিনীর আক্রমণের সামঞ্জস্য বিধান করা। নির্দেশ থাকতো, গেরিলারা যখন অমুক জায়গায় আক্রমণ করবে তখন দৃষ্টিকে অন্যদিকে ধাবিত করতে হবে এবং শত্রুর যাতে গোলাগুলি ও রি-ইনফোর্সমেন্ট না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করবে। গেরিলারা অনুম জায়গায় অমুক পুলটি উড়াবেন। তবে আমরা বড় বড় পুলগুলোতে হাত দেইনি। সেই পুলগুলো শত্রুরাই আত্মসমর্পণের আগে ভেঙ্গেছিলো।

যেখানে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছি সেখানে কৌশল ছিলো যেখানে অধিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, ট্যাঙ্ক ব্যাবহারের প্রয়োজন দেখা দিবে, ‘এক্সেস অব এডভ্যান্স’-এ ভার শত্রুর স্ট্রং পয়েন্টের উপর চাপ প্রোয়োগ করবে এবং বাংলাদেশ বাহিনী ‘আউটফ্লাঙ্ক’ করে গিয়ে পার্শ্বভাগে বা পেছনের দিক থেকে আক্রমণ করবে।

এর সঙ্গে এটাও সুস্পষ্ট নীতি ছিলো যে, স্ট্রং পয়েন্টগুলো ‘ক্লিয়ার’ করার পরবর্তী পর্যায় শত্রুর অন্য পজিশনগুলো আয়াত্ব করতে হবে, সেখানে মুক্তিবাহিনী অর্থাৎ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এগোবে। তাদের অগ্রাভিযানে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী যতটুকু সাপোর্ট দেয়ার ঠিক তততুকু দেবে।

প্রশ্নঃ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যখন একসাথে এগোতো তখন অগ্রবর্তী দল হিসাবে মুক্তিবাহিনী যেত এবং সাপোর্ট আসতো ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে – তাই কি?
জেনারেল ওসমানীঃ দু’রকমের ছিল। সেটা হয়েছে প্রথমে ‘স্ট্রং’ পয়েন্টটি ক্লিয়ার করার পরে। মনে করুন শক্রুর খুব শক্তিশালী একটা ঘাঁটি রয়েছে। সেই ঘাঁটির উপর ভারতীয় বাহিনী ট্যাঙ্ক কামান দিয়ে হামলা করতো। সেই সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ‘ক্রস কান্ট্রি’ দিয়ে গিয়ে ‘অটোফ্লাঙ্ক’ করতো। ক্রস কান্ট্রি এগিয়ে যাওয়ার বিশেষ দক্ষতা মুক্তিবাহিনীর ছিল। এর দুটো কারণ ছিল- প্রথমতঃ আমরা ন”মাস নিজের অঞ্চলে যুদ্ধ করে আসছি এবং আমাদের বাহিনী তুলনায় হালকা ছিল। দ্বিতিয়তঃ আমাদের সংযোগ ছিল স্থানীয় লোকের সাথে, আমাদের প্রতি তাদের ছিলো পুরো সমর্থন। সেজন্য আমরা সঙ্গে সঙ্গে আউটফ্লাঙ্ক করে শক্রুপারশ্বভাগ ও পেছনে থেকে আক্রমণ করতাম যাতে সে আর টিকতে না পারে। তৎপর যখন অগ্রবর্তী অন্যান্য শক্রুপজিশন আক্রমণ করতে হতো বা এগিয়ে যেতে হতো তখন আমাদের বাহিনী অগ্রসর হতো ও আক্রমণ করতো কারণ অঞ্চলের পথঘাটগুলো আমাদের জানা ছিলো, শক্রুর পজিশন সম্পর্কে প্রতি মুহূর্তের খবর আমাদের দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত আমাদের সেলগুলোর থাকতো এবং গেরিলাদের সাথে আমাদের সমন্বয় ও সংযোগ ছিল। আবার এখানেও প্রয়োজন হলে ভারতীয় বাহিনী আমাদেরকে আর্টিলারী বা ভারী কামানের দ্বারা সাপোর্ট দিত।

প্রশ্নঃ ক’টি সেক্টর ছিল? হেডকোয়ার্টার কোথায় ছিল ?
জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশকে আমি ১১টি সেক্টরে ভাগ করেছিলাম। ১১টি সেক্টর একেকজন অধিনায়কের অধীনে ছিল। এবং প্রত্যেক অধিনায়কের একটি সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। এবং এই সেক্টর হেডকোয়ার্টারগুলি বাংলাদেশের ভিতরেই ছিল। এই সেক্টরগুলোর উপর ভিত্তি করে আমি যুদ্ধটি লড়েছি। কারণ, বাংলাদেশের মত এত বড় একটা ‘থিয়েটার’ অর্থাৎ দেশব্যাপী রণক্ষেত্র-যার ১১টি সেক্টরের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নদীনালা ও ব্যাপক দুরত্ব-কেন্দ্রীভুতভাবে দৈনন্দিন যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে যুক্ত সামরিক সদর দফতর, উপযুক্ত পরিমান অফিসার স্টাফ, যগাযোগ ব্যাবস্থা ও সম্পদ এবং সঙ্গতির প্রয়োজন তা সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার ছিল মাত্র ১০ জন অফিসার বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র সশস্ত বাহিনীর রণ পরিচালনার হেডকোয়ার্টার। এছাড়া, এতবড় একটা বিরাট অঞ্চলব্যাপী সামগ্রিক যুদ্ধে পরিচালনা আমাদের তখনকার পরিস্থিতিতে শুধু অসম্ভব নয়, অবাস্তবও ছিল। তাই আমি আমার চিফ ওব স্টাফ ও অন্যান্য কামান্ডারদের কাছে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য, আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক বিবেচ্য বিষয়ের সঠিক মুল্যায়ন এবং আমাদের ও শক্রুর কাছে কার্যক্রমের কোন কোন পথ উন্মুক্ত রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক চিত্র তুলে ধরি। আমাদের সামরিক লক্ষ্য ও সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুদ্ধ পরিচালনা সম্পর্কিত আমাদের নির্দেশের (অপারেশনাল ইন্সট্রাকশন ও অপারেশনাল ডাইরেকটিভ) মাধ্যমে সাধারনভাবে আমাদের বাহিনীর করনীয়, প্রত্যেক সেক্টরে তাদের বিশেষ করনীয়, বিভিন্ন সেক্টরের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন এবং সাংগঠনিক ও যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে জানতাম। আমার এইসব নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি সেক্টর কামান্ডারদের সাথে আমি লিয়াজো অফিসার ও মুক্তিযুদ্ধাদের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। এছারা আমার কামান্ডারদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা এবং যুদ্ধের অবস্থা সমন্ধে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের জন্য আমি এক সেক্টর থেকে যেতাম অন্য সেক্টরে। সে অবস্থায় আমি যখন যে সেক্টরে থাকতাম, সে সেক্টরের হেডকোয়ার্টারই হতো আমার হেডকোয়ার্টার। এভাবে প্রত্যক্ষভাবে পরিস্থিতির সঠিক মুল্যায়ন করতাম ও সে অনুযায়ী নির্দেশ দিতাম। এছাড়া যুদ্ধকালীন মন্ত্রসভাকেও আমি যুদ্ধের অগ্রগতি ও সামরিক পরিস্থিতির সম্বন্ধে অবহিত রাখতাম।

যখন বাংলাদেশ সরকার আমাকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করেন তখন আমি তাদের অনুমোদন লেঃ কর্নেল ( বর্তমান মেজর জেনারেল) এম, এ, রবকে চীফ অব স্টাফ নিয়োগ করি। তিনি আমার পরে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন। তিনি গনপরিষদেরও সদস্য।

বিভিন্ন সেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করিঃ (১) এক নম্বর সেক্টরে প্রথম মেজর ( বর্তমানে কর্নেল ) জিয়াউর রহমান, পরে মেজর রফিক । (২) দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ পরে তিনি যখন কে ফোরসের কমান্ডার হয়ে যান তখন বেশ কিছুদিন তিনি দুটাই কমান্ড করেছিলেন, তিনি আহত হওয়ার পরে মেজর আবু সালেক চৌধুরী কমান্ড করেন কে ফোরস এবং ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দার। (৩) তিন নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন প্রথমে ( বর্তমানে কর্নেল) মেজর শফিউল্লাহ পরে যখন তিনি এস ফোরসের কমান্ডার হয়ে যান তখন মেজর ( বর্তমানে লেঃ কর্নেল ) শফিউল্লাহ নুরুজ্জামান বর্তমানে যিনি জাতীয় রক্ষী বাহিনীর ডাইরেক্টর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। (৪) চার নম্বর সেক্টরে কমান্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে কর্নেল ) চিতরঞ্জন দত্ত, যিনি সকল নিয়মিত অফিসার যারা চাকুরীতে রয়েছেন সকলের মধ্যে সিনিয়র। আইয়ূব আমলে তাকে সুপারসিড করা হয়েছিল। (৫) পাঁচ নম্বর সেক্টরে ছিলেন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) মীর শওকত আলী যিনি যুদ্ধের প্রারম্ভে চট্টগ্রামে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধ করেন। (৬) ছয় নম্বর সেক্টরে ছিলেন উইং কমান্ডার (বর্তমানে গ্রুপ ক্যাপ্টেন) বাশার, তিনি বৈমানিক কিন্তু স্থলে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন। (৭) সাত নম্বর সেক্টরে কমান্ডার ছিলেন মেজর (পরে লেঃ কর্নেল ) কাজী নুরুজ্জামান। তিনি পেনশনে ছিলেন ও আমার মত যুদ্ধাবস্থায় একটিভ লিস্টে কাজে যোগদান করেছিলেন। আবার পেনশনেও চলে গেছেন। (৮) আট নম্বর সেক্টরের শুরুতে কমান্ডার ছিলেন মেজর (বর্তমানে কর্নেল) ওসমান চৌধুরী এবং আগস্ট মাস থেকে মেজর (বর্তমানে কর্নেল) মনজুর। (৯) নয় নম্বর সেক্টরে কমান্ডার ছিলেন প্রায় শেষের দিক পর্যন্ত মেজর এম এ জলিল। তিনি এখন চাকুরীতে নেই। তারপর ছিলেন মেজর জয়নাল আবেদীন। (১০) দশ নম্বর সেক্টর (নৌকমান্ডো সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও আভ্যন্তরীন নৌপথ)। এতে নৌ কমান্ডোর বিভিন্ন সেক্টরে নির্দিষ্ট মিশনে সংশ্লিষ্ট কমান্ডারের অধীনে কাজ করতেন। (১১) এগারো নম্বর সেক্টরে ছিলেন মেজর (পরে লেঃ কর্নেল) আবু তাহের, ইনি জখমের জন্য বোর্ড আউট হয়েছেন। এছাড়া তিনটি ব্রিগেড ফোরস যেড ফোরস ও এস ফোরস কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ ও শফিউল্লাহ। হেডকোয়ার্টারে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে এয়ার কমান্ডার) এ কে খন্দকার। চীফ অফ স্টাফ রব সাহেব পূর্বাঞ্চলে থাকতেন। ওখানে আমার হেডকোয়ারটারের একটি অংশ ছিল। ওখানে যতগুলো সমস্যা প্রশাসন ও রণপরিচালনা সম্পর্কিত তিনি সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন যেটা নীতি গ্রহণ সম্পর্কিত হত সে বিষয়ে আমার নির্দেশ চাওয়া হত।

প্রশ্নঃ নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা কত ছিল এবং কি ধরনের অস্ত্রে তারা সজ্জিত ছিল? গণবাহিনীর মোট সংখ্যা কত দাঁড়িয়েছিল?
জেনারেল ওসমানীঃ নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা বাড়াতে বেগ পেতে হয়েছিল। অস্ত্র নিয়ে বেগ পেতে হত। বেশীর ভাগ সময় সকলের সদিচ্ছা থাকলেও অনেক জিনিস আমরা পেতাম না। আমার চেষ্টা ও চিন্তা এই ছিল যে, আমি বিভিন্ন অস্ত্র কত তাড়াতাড়ি জোগাড় করতে পারি। কারণ ভারতীয়রা যদি ৩ রা ডিসেম্বর যুদ্ধে না নামত তাহলে তখন যে পরিস্থিতি ছিল তাতে আমাকে আরো ছয় মাস যুদ্ধ করতে হত। এসে দেশের আরো অনেক ক্ষতি হত। এজন্য শত্রুকে আরো সত্বর ধ্বংস করার জন্য অনেকগুলো অস্ত্রের আমাদের প্রয়োজন ছিল। সর্বশেষ একটি দেশের সাথে আমার সংযোগ হয়েছিল।সেই দেশটি তখনি অস্ত্র দিতে প্রস্তুত ছিল যদি আমার নিজের বিমান ঘাঁটি থাকত। সেজন্য আমি যেড ফোরস কে ( বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম ব্রিগেড) সিলেট পাঠিয়েছিলাম। অনেকেই জানতেন না হঠাত কেন যেড ফোরস কে সিলেটের উপর চাপালাম। তারা কেবলমাত্র স্ট্রাটেজিক কারন ই জানতেন। আমার উদ্দেশ্য ছিল দুটো বিমানঘাঁটি যত তাড়াতাড়ি পাই তত তাড়াতাড়ি আমি হয়ত অনেক জিনিস সরাসরি আনতে সক্ষম হব। এছাড়া শত্রুর শক্তিকে অন্যদিকে আকর্ষণ করাও আমার উদ্দেশ্য ছিল।

যাহোক যুদ্ধের শুরুতে খুব তাড়াতাড়ি একটা বিরাট বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব মনে হত না। কিন্তু আমার মুক্তিবাহিনীর সৈনিকদের নিয়মিত অফিসার ও অধিনায়কদের চেষ্টায় আমি যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত প্রায় কুড়ি থেকে বাইশ হাজার সৈন্য সম্বলিত নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলেছিলাম। তারা সাধারন ইনফ্যান্ট্রি অস্ত্রে সজ্জিত ছিলেন।

দুটো গোলন্দাজ ব্যাটারী আমরা গড়ে তুলেছিলাম। ভারতীয়দের প্রাচীন কিছু কামান ছিল। ওগুলো দিয়ে প্রথম ব্যাটারীটি গড়ে উঠেছিল। ওটার নাম দিয়েছিলাম ‘নম্বর ওয়ান মুজিব ব্যা্টারি’। এই ব্যাটারি যুদ্ধেও ছিল। এর পরে আমরা দ্বিতীয় ব্যাটারী গঠন করি। আগেরটির চেয়ে একটু ভাল কামান দিয়ে এটি সজ্জিত ছিল। এ ব্যাটারীও যুদ্ধ করে।

আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করি প্রায় ৫ টি ব্যাটেলিয়ন সৈন্য দিয়ে। যুদ্ধের শুরুতেই অনেকগুলোর সংখ্যা পুরন করতে হয়েছে। যেমন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন একটি অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী পুরানো পল্টন। মাত্র ১৮৮ জনকে আমি পেয়েছিলাম। বাকিরা নিহত কিংবা আহত হয়েছিলেন যশরের যুদ্ধে। তাদের সংখ্যা পুরন করতে হল। শেষ পর্যন্ত আমি ৫ টি ব্যটেলিয়ন থেক্রে ৮ টি ব্যাটেলিয়নে উন্নীত করি। এগুলো ছিল ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের এক দুই তিন চার আট নয় দশ এগারো নাম্বার ব্যাটেলিয়ন। নয় দশ এগারো নম্বর ছিল নতুন।

এছাড়া সেক্টর ট্রুপ্স গড়ে তুলি। সেক্টর ট্রুপ্স এর সংখ্যা শেষ পর্যন্ত ছিল দশ হাজার। যারা প্রাক্তন ই পি আর এবং নিয়মিত বাহিনীর বিভিন্ন ব্রাঞ্চ থেকে এসেছিলেন তাদেরকে ১১ টি সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সেক্টর ট্রুপস হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। কোন সেক্টরে চারটি কোম্পানী কোন সেক্টরে পাঁচটি কোম্পানী কোন সেক্টরে ছটি কোম্পানী এভাবে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন সেক্টুরে সংখ্যা বিভিন্ন ছিল। তারা সেক্টর কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করতেন।

নিয়মিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যটেলিয়ন নিয়ে গঠিত হয়েছিল ব্রিগেড। ব্রগেডগুলোকে আমি ফোরস নাম দিয়েছিলাম। যেড ফোরস কে ফোরস এস ফোরস। ব্রিগেডগুলোর কমান্ডারদের নামে এই নামকরন হয়েছিল। যেড ফোরস কমান্ড করতেন জিয়াউর রহমান কে ফোরস খালেদ মোশাররফ ও এস ফোরস শফিউল্লাহ।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের আগে যে অর্গানাইজেশন ছিল আমরা তার পরিবর্তন পরিবর্তন করিনি। এই অর্গানাইজেশন অনেক চিন্তা করে বিগত দশ বছরে শান্তি ও যুদ্ধে পরীক্ষার ভিত্তিতে গড়া হয়েছিল এর সঙ্গে আমি ঘনিষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলাম সেটা ভারতীয় অর্গানাইজেশনের চেয়ে একটু স্বতন্ত্র। আমি মনে করি আমাদেরটা সুষ্ঠু। সেই অর্গানাইজেশনের ভিত্তিতে আমাদের ব্যাটেলিয়নদের সাধারন অস্ত্রসজ্জা ছিল। অন্যান্য দেশের ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নের যা সাধারন অস্ত্র থাকে এখানেও তাই ছিল তবে ফায়ার পাওয়ারটা এই অর্গানাইজেশনের কিছুটা বেশী। যেমন সাধারনত একটি সেকশনে একটি লাইট মেশিনগান থাকে আমাদের ছিল দুটো মেশিনগান। আর অস্ত্র ছিল যা স্বাভাবিক ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নে থাকে গ্রেনেড রাইফেল লাইট মেশিনগান মিডিয়াম মেশিনগান দুই ইঞ্চি এবং তিন ইঞ্চি বা ৮১ মিলিমিটার মর্টার এবং ট্যাঙ্কবিদ্ধ্বংসী কামান।

সেক্টর ট্রুপস এর অস্ত্র অ প্রায় এ ধরনের ছিল। তবে ওদের স্কেল ছিল আলাদা। ওদের কাজ ঠিক নিয়মিত বাহিনীর মত ছিল না। তাদের ভুমিকা ছিল প্রথমে তারা ঘাঁটি করবেন। সেই ঘাঁটি থেকে গেরিলা ভেতরে পাঠানো হবে এবং গেরিলদের সাথে সম্মিলিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শত্রুর উপর বিভিন্ন হামলা ও অন্যান্য কাজ করবেন। তাই তাদের অস্ত্রের পরিমান বা স্কেল একটিভ ব্যাটেলিয়নের চেয়ে কিছুটা পৃথক ছিল কিছু কিছু কম ছিল।

এবার গণবাহিনীর কথায় আসছি। সর্বমোট প্রায় ৮০ হাজারের মত ছিল গণবাহিনীর সদস্য। আমি ৬০ থেকে ৭০ হাজার গণবাহিনী কাজে নিয়োগ করছিলাম। এছাড়া কয়েক হাজার প্রশিক্ষনরত ছিল। এদের অস্ত্র যা দিতে চেয়েছিলাম যে স্কেল আমরা তৈরী করেছিলাম ঠিক সেই পরিমান অস্ত্র আমরা সবসময় দিতে পারিনি। অস্ত্রের অভাব ই ছিল এর কারন। যা হোক গণবাহিনীর বীর গেরিলাদের অস্ত্র ছিল প্রত্যেকের হাতে গ্রেনেড কয়েকজনের হাতে স্টেনগান। এছাড়া ছিল রাইফেল যদিও গেরিলাদের জন্য রাইফেল সন্তোষজনক অস্ত্র নয়। কিন্তু যেহেতু আমাদের কাছে সম্বল ছিল না তাই যা পেতাম তাই ব্যবহার করতে হত। এছাড়া ছিল অল্প কয়েকটি পিস্তল ও এস এল আর। খাই হাতেও তারা যুদ্ধ করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন নির্দিষ্ট ধরনের অপারেশনের জন্যে থাকতো বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক। নৌ কমাণ্ডদের আত্মরক্ষার জন্য হালকা অস্ত্র থাকতো, বেশীরভাগ সময়ই গ্রেনেড। আর থাকতো অপারেশনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যেমন – লিম্পেট মাইন।

যুদ্ধ শেষ হওয়া আমার তাই সৈন্যসংখ্যা ছিল ২০-২৫ হাজার নিয়মিত বাহিনী এবং ৭০/৮০ হাজার গণবাহিনী।

প্রশ্নঃ গণবাহিনীর কোন আলাদা সেক্টর ছিল কিনা? সি-ইন-সি স্পেশাল সংগঠনটিও বা কি ছিল?
জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর নাম ছিল মুক্তিবাহিনী। এর ভেতর স্থল, জল, বিমান তিনটিই অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেকে মুক্তিবাহিনী শব্দে ভুল করেন। তারা মনে করেন শুধু গেরিলাদের বুঝি মুক্তিবাহিনী বলা হতো। আসলে তা নয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পুরোটা মিলিয়ে ছিল মুক্তিবাহিনী। এর দুটি অংশ ছিল – (১) নিয়মিত বাহিনী এবং (২) গণবাহিনী ও গেরিলা বাহিনী বা অনিয়মিত বাহিনী। ভারতীয়রা এর শেষোক্ত অংশকে বলতেন এফ-এফ অর্থাৎ ‘ফ্রীডম ফাইটার’। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তো সবাই। আর গণবাহিনীর ও নিয়মিত বাহিনীর সেক্টর একই ছিল।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকারকারী সকলেই এই ১১টি সেক্টরের কোন না কোন একটি সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।

সি-এন-সি স্পেশাল সম্পর্কে এবার বলছি। শুরুতেই গেরিলাদের দু’সপ্তাহের ট্রেনিং দেয়া হতো। কিন্তু এটা যথেষ্ট ছিলো না। পরে মেয়াদ খানিকটা বাড়ানো হলো। তখন তিন সপ্তাহের মতো সাধারন গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হত। এছাড়া আমি কিছুসংখ্যক গেরিলার জন্যে একটি বিশেষ কোর্সের বন্দোবস্ত করেছিলাম। একে বলা হত স্পেশাল কোর্স। ওটা ছয় সপ্তাহের ছিল। এই কোর্সে গেরিলা লীডারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এবং আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ার অর্থাৎ শহরাঞ্চলে আবাসিক এলাকায় যুদ্ধ করার পদ্ধতিও তাদের শেখানো হতো। এদের ভুমিকা ছিলো গেরিলাদের নায়কত্ব করা এবং সাধারন গেরিলাদের দিয়ে সম্ভব নয় এমন সব কাজ সম্পন্ন করা। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল খুব কম। চাকুলিয়া নামে এক জায়গায় তাদের ট্রেনিং দেয়া হতো। এসব গেরিলারা বিশেষভাবে সিলেট হয়ে যেতো এবং এদের সিলেকশনের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে লোক নিয়োগ করেছিলাম। তাই এদের নামকেই বলতো সি-এন-সি স্পেশাল। আসলে এ নামে স্বতন্ত্র বাহিনী ছিল না।

প্রশ্নঃ যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ অর্থাৎ অপারেশনাল ইন্সট্রাকশন বা ডাইরেকটিভস সম্পর্কে কিছু বলুন।
জেনারেল ওসমানীঃ সরকার গঠনের আগে আমি সর্বপ্রথমে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছি মুখে বলে, যোগাযোগ করে। তারপর আমি কমান্ডারদের আমাদের লক্ষ্য বা অবজেক্টিভ এবং প্রত্যেক সেক্টরে কি ফলাফল অর্জন করতে হবে তা জানিয়েছি।

এ জন্যে আমি সাধারনতঃ অপারেশনাল ইন্সট্রাকশন দিতাম। তাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অধিনায়কের উপর দায়িত্ব যথেষ্ট বিকেন্দ্রীকরন করা হতো। সাধারন লক্ষ্য এবং সেই বিশেষ বিশেষ লক্ষ্য ও দায়িত্বের কথা এই হুকুমনামা বা ইন্সট্রাকশনে লেখা থাকতো। এছাড়া আমি একটি জিনিস ব্যাবহার করেছিলাম যা নতুন ছিল এবং আমার জানা মতে এর আগে কোন সামরিক বাহিনীতে তা ব্যবহার করা হয়নি। সেটা ছিল অপারেশনাল ডাইরেকটিভস নির্দেশ এবং উপদেশ। পরিস্থিতি যাচাই ও বিবেচনা করে কি পরিমাণ এই ডাইরেকটিভস একজন অধিনায়ক অনুসরণ করবেন তা তার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কারণ তা না হলে আমরা যুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারতাম না। তবে মৌলিক কয়েকটি বিষয় বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়নি।

সব সময়ই মন্ত্রীসভাকে- মাসে অন্তত একবার- রণাঙ্গনের মূল্যায়ন অবহিত করতাম।

এছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ভিত্তিক যে নির্দেশ মন্ত্রীসভা আমাকে দিতেন তা আমার অধিনায়কদের কাছে পৌঁছে দিতাম।

প্রশ্নঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়?
জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু থেকেই আমরা ঘাঁটিগুলো গড়ে তুলেছিলাম। গণবাহিনী কাজ শুরু করার পর এই ঘাটিগুলি অধিকতর সক্রিয় হয়। ঢাকা নগরীতেও কয়েকটি ঘাঁটি ছিল। ঘাঁটি প্রায়ই পরিবর্তন করা হতো। কয়েকটি ঘাঁটি শত্রুর হাতে ধরাও পড়েছিল। ঘাঁটিগুলোতে যে কেবল মুক্তিযোদ্ধা ছিল তা নয়, এতে আমাদের ‘কনট্যাক্ট’ এবং কোরিয়াররাও ছিলেন। একটা কোরিয়ার সার্ভিস পরিচালিত হতো। ছিল ওয়ারলেস যোগাযোগ। কোরিয়ার-এর আসা যাওয়ার রাস্তা পরিবর্তন করা হতো। কোরিয়ার এর মাধ্যমে ভেতরের ঘাঁটিগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা হতো। ঘাঁটি সাধারনত তিন রকমেন্র ছিল – (১) যেখানে অস্ত্র জমা থাকতো, (২) যেখানে তথ্যাবলী সংগ্রহ করা হতো ও যেখান থেকে পাঠানো হতো, এবং (৩) যেখান থেকে শত্রুর উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়া হতো।

এছাড়া ভেতরে অনেকে ছিলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে বাইরে না গিয়ে ভেতরে থেকে সহযোগিতা করেছেন।

প্রশ্নঃ অধিকৃত এলাকার জনগণের কাছ থেকে কি ধরনের সাড়া পেয়েছিলেন?
জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে আন্তরিক ও অকুন্ঠ সমর্থন আমরা পেয়েছি-কেবলমাত্র গুটি কয়েক লোক ছাড়া। বাংলাদেশের লোক ২৬শে মার্চ থেকে সম্পূর্ন সমর্থন দিয়ে এসেছেন। অনেকসময় নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন। এটা অবশ্য সত্য-যারা দালালী করেছেন-রাজাকার আর বদরের যুদ্ধে অনেক জায়গায় পেয়েছি। তারা বেশীর ভাগ সাহস সেখানে যুদ্ধ করতে দেখিয়েছে যেখানে তাদের মালিক পাঞ্জাবীরা ছিল, আর তা না হলে তারা মুক্তিবাহিনী দেখামাত্র পালিয়ে যেতো। তবে অনেক জায়গায় শত্রুর একটা প্লাটুন থাকতো আর একশো-দুশোজন রাজাকার, আল-বদর হতো। জনগণের সাথে শুরু থেকেই যোগাযোগ ছিল। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্পূর্ন সমর্থন ছিলো। আমার, আমার অধিনায়ক ও মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের সব সময় এমন মনে হতো যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আমাদের সঙ্গে শ্বাস নিচ্ছে।

প্রশ্নঃ অধিকৃত সময়ে আপনি কি কখনো ঢাকা এসেছিলেন?
জেনারেল ওসমানীঃ ঢাকায় আসিনি। আমি জানি, অনেকে বলেছেন, আমি ঢাকায় এসেছিলাম। সেটা ঠিক নয়। আমি অন্যান্য অঞ্চলে এসেছি ও ঘুরেছি। কিন্তু ঢাকায় আসিনি এবং ঢাকায় আসা ঠিক সম্ভবপর ছিলো না। আরেকটি কথা জনগণের সমর্থনের প্রসঙ্গে আমি বলছি। যোগাযোগ আমাদের সব জায়গায় ছিল সশরীরে- সব জায়গায়, সব শহরে। আপনারা জানেন কি না জানি না, অমুক তারিখে হাজির হতে হবে বলে টিক্কা খান আমাকে যখন সময় দিলেন তখন তার জওয়াব আমি দিয়েছিলাম। সেই জওয়াব টিক্কা খানের কাছে পৌছানো হয়। আমার হাতের লেখা জওয়াব। টিক্কা খানের বাড়ীর দেয়ালে একটি বালক গিয়ে সেই জওয়াবের কাগজ লাগিয়ে দিয়েছিল। পরের দিন সেই কাগজটি নাকি টিক্কা খানকে দেখাবার পর সে বলেছিল-হ্যা, এটি ঐ… এর হাতের লেখা।

জেনারেল ওসমানী সাক্ষাৎকারে প্রবাসী বাঙ্গালী ও প্রবাসী বাঙ্গালীদের মেডিক্যাল সমিতির চিকিৎসা সাহায্য, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক হাসপাতালসমূহের চিকিৎসা ও সেবা কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ভারতীয় জনগণের ও সরকারের প্রতিও তার কৃতজ্ঞতার কথা জানান। তিনি বলেন, তাদের অবদানের কথা ভুলবার নয়। ভারতীয় বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি তিনি তাঁর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।