শিরোনামঃ বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের হুমকি মোকাবেলার জন্য সিনেটের কেনেডীর আহ্বান।
সূত্রঃ সিনেটের কার্যবিবরণী
তারিখঃ ৩ মে, ১৯৭১
৩ মে, ১৯৭১ কংগ্রেসিয় কার্যবিবরণীঃ সিনেট এস ৬০৮৯
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কিত ভাবনা
জনাব কেনেডি। প্রেসিডেন্ট, এই কক্ষে ১ এপ্রিলে আমার পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম।
দমিয়ে রাখা তথ্যসূত্র থেকে আমাদের সরকার অবগত হয় যে, চলমান সংগ্রামের কারণে সাধারন জনগণকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। কাহিনী গুলো অবিচারে হত্যার, ছাত্র ও ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার এবং লাখ লাখ নির্দোষ সাধারন মানুষের ভোগান্তির। এ কাহিনী পরিবারের বাসস্থান চ্যুত হওয়ার। এ কাহিনী সীমিত পানি ও খাবারের। এরপর এসবের সাথে যুক্ত হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের হঠকারিতা, হানাহানির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া এবং সরকারি সেবার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে জটিল পরিস্থিতির মাঝে আরও বাধা বিপত্তির। পরিস্থিতি লাখো মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ফেলে দিয়েছে। তার সাথে মহামারী আর রোগ শোকের হুমকি তো আছেই।
বিগত মাসে আমি আমার এই ভাবনার বিষয়ে পররাষ্ট্র অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছি। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে আমাদের সরকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জরুরি রাজনৈতিক এবং মানবিক সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনে আরও সোচ্চার এবং তৎপর হয়।
আফসোসের বিষয় যে, কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় যে তেমন কোন উদ্যোগই আসলে নেয়া হয়নি। এবং তাই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দশার ক্রমশ দুঃস্বপ্নের মত অবনতি ঘটছে আর সে সাথে আসছে আরো দুর্ভোগ ও লাখ লাখ মৃত্যু।
যদিও রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে সহিংস্রতা অনেকাংশে কমে গিয়েছে। রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায় যে জনগণ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাবাহিনীর মাঝে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। জনগণের এক বিরাট অংশ সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণে ইতোমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যা কিনা গত সপ্তাহে ঢাকায় ঘটে গেছে এবং বিক্ষিপ্তভাবে এখনো চলছে।
এছাড়াও রিপোর্টে আরও বলা আছে যে সেনাবাহিনী ঢাকা এবং যশোরের বাইরে খুব কম এলাকা দখল করে আছে। এবং এসব শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো, সরকারি দপ্তর এবং প্রশাসন প্রকৃতপক্ষে বিলুপ্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি গত শরতের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়া এলাকাতে পরিবহন এবং সহজলভ্য খাদ্য, চিকিৎসা সরবরাহ নিথর হয়ে পড়েছে। যদিও রক্ষণশীল প্রতিবেদন থেকে এটা ধারণা করা হয় যে প্রায় দশ লাখের মতো মানুষ ওসব জায়গায় শুধুমাত্র ত্রাণ সামগ্রির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী জনগণের এ দুর্ভোগ ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে ইতোমধ্যে প্রায় দশ লাখের উপর শরণার্থী আশ্রয় করে নিয়েছে।
সম্মানিত রাষ্ট্রপতি, পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার বা খুব সম্ভবত লাখ লাখ মানুষ ধীরে ধীরে অনাহার এবং মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা এ বিশ্বে এসব দুর্ভোগ ও অবিচার মেনে নিতে বাধ্য-বিশেষত আমাদের সময়ে যখন নৃশংসতা আর অরাজকতা অনেকগুলো অঞ্চলে বিরাজমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ ত্রয়োদশ খণ্ড ২৯৫
কিন্তু আমরা যে নতুন বিশ্বের সন্ধানে আছি সেটা আমরা যদি এসব নেতৃত্বের হুমকিকে এড়িয়ে যাই এবং অতীতের মতো জাগতিক আঙ্গিকে ও মনোভাবে শরণার্থী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি তবে সেই বিশ্ব কোনদিনই গঠিত হবে না।
পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে-সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যাওয়া জনগণের সাহায্যের জন্য়-আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে আমাদের সরকার এবং আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এখনো এই নির্মম পরিহাস মোকাবেলায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থা আর এড়িয়ে যাওয়া চলে না। এখানে শুলে চড়ে আছে মানুষের জীবন-নির্দোষ মানুষের জীবন- পাকিস্তানী হাজার অথবা লাখ মানুষের জীবন যা ধ্বংস হয়ে গেলে সমগ্র মানবজাতির উপর তার ভার এসে বর্তায়। যদি না এ অবস্থা উত্তরণে আরও বড় কিছু করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে অরাজকতা আর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে আক্ষেপ করা সহজ। ক্রমশ নিম্নগামী মানুষের দুর্দশা নিয়ে আক্ষেপ করাও সহজ। দুশ্চিন্তার জন্য কর্মপন্থা অবলম্বন করাও সহজ। সংঘর্ষ থেকে উন্নতি লাভ করার জন্য এবং মানুষের কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ পরিচালনা করাও সহজ।
কিন্তু এসব বাগাড়ম্বর কোনভাবেই প্রকৃত কাজের বিকল্প হতে পারে না। এবং আমি এটা দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, আমাদের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানবিক প্রয়োজনে যেসব করেছে, তা যতটুকু দরকার ছিল তার চেয়ে কমই। যেমনটা আমাদের নীতিবান এবং জনদরদি নেতারা সাম্প্রতিক বছরে কোন কৌশল, নতুনত্ব অথবা নিপীড়িতদের প্রয়োজনে গভীর সমবেদনা ছাড়াই করে এসেছেন।
এবং তাই আজকের দিনে, আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের মর্যাদা এবং রক্ষার জন্য এবং সচেতন আমেরিকান হিসেবে আমি জাতিসংঘের কাছে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানাচ্ছি। কিন্তু এই জাতিসংঘ এতদিন নেতৃত্বের চেয়ে নিরবতাকে প্রাধান্য দিয়েছে। আমি পাকিস্তানের শাসকদের কাছে, অন্যান্য রাষ্ট্রের পরিচালকদের কাছে, আমার দেশের সরকারের কাছে বিপর্যস্ত অঞ্চলে একটি করুণা মিশন এবং আকাশপথে সাহায্য পাঠানোর সমর্থন দেবার আবেদন জানাই। এবং আশা করা যায় যে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে শরণার্থীদের চাহিদা মেটাতে ভারত সরকারের আবেদন সংশ্লিষ্ট সকলের সহমর্মী প্রত্যুত্তর পাবে।
আসুন এই উদ্দেশ্য সফল করতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি। কিন্তু বর্তমান চাহিদা মেটাতে আসুন আমরা তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন করি এবং সেই সাথে মানবতার এই চরম সংকট মোকাবেলা করার জন্য যথার্থ আগ্রহ নিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করি।