শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
সিনেটর জে ডাবলু ফুলব্রাইট কে লেখা লিখিত পররাষ্ট্র দপ্তর কর্মকর্তার পত্রগুচ্ছ | সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির রিপোর্টের পরিশিষ্ট | মে ১৩, ১৯৭১ |
(সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির রিপোর্টের পরিশিষ্ট- মে ১৩, ১৯৭১। পাকিস্থানে মিলিটারি সাহায্য প্রদান বন্ধ করার ব্যাপারে)
পররাষ্ট্র দপ্তর
ওয়াশিংটন ডিসি, এপ্রিল ২৩, ১৯৭১।
সন্মানিত জে ডাবলু ফুলব্রাইট
সভাপতি, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি
ইউ এস সিনেট
প্রিয় সভাপতি, মাননিয় মন্ত্রী আমাকে আপনার এপ্রিল ৬, ১৯৭১ এর চিঠির উত্তর দিতে বলেছেন যে চিঠিতে আপনি পূর্ব পাকিস্থানের অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আপনি আপনার চিঠিতে পূর্ব পাকিস্থানে দেয়া আমেরিকার মিলিটারি সাপ্লাইয়ের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আপনি আরও জানতে চেয়েছেন পাকিস্থান সরকারের সাথে মিলিটারি সরঞ্জাম বিক্রির ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার অবস্থা। যদি বর্তমানে কোন চালান থাকে সেটার সম্পর্কেও আপনি জানতে চেয়েছেন।
আমরাও আপনার সাথে উদ্বিগ্ন যে আমেরিকার দেয়া অস্ত্র পূর্ব পাকিস্থানে ব্যবহার করা হয়েছে এবং আমরা এই ব্যাপারে নিশ্চুপ নই। ২৫ শে মার্চ মিলিটারি একশন শুরু হবার পর থেকেই আমাদের মুখপাত্র সেখানে আমেরিকান অস্ত্রের ব্যবহারের ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ জানিয়েছে , এবং যে উদ্বেগ গোপনে আমরা পাকিস্থানকেও জানিয়েছি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব পাকিস্থানে কিছু M-24 ট্যাংক এবং F-86 বিমানের ব্যবহার হয়েছে। এমনও মনে হয় যে পাকিস্থানে দেয়া চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশের অস্ত্রপাতিও পূর্ব পাকিস্থানে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের এসব তথ্য সরাসরি ঢাকা এবং চট্রগ্রাম থেকে প্রাপ্ত।
আমেরিকার তৈরি এই অস্ত্রগুলো সম্ভবত ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে পাকিস্থানের সাথে আমাদের ‘সামরিক সহযোগিতা প্রোগ্রামের’ অধীনে দেয়া হয়েছে। আপনি জানেন হয়তো, ওই প্রোগ্রামে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার জন্য পাকিস্থানকে সেসব অস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ১৯৫৯-এর চুক্তি অনুযায়ী জাতীয় সার্বভৌম এবং বাইরের আক্রমন থেকে রক্ষার জন্যেও সেসব অস্ত্র পাকিস্থান ব্যবহার করতে পারবে। আমরা শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্থান অংশের জন্য অস্ত্র সরবারহ করেছি, কারন প্রদেশটির উত্তর-পশ্চিম অংশেই নিরাপত্তা ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে মনে হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্থান আর্মির জন্য কোন অস্ত্র দেয়া হয়নি। যায়হোক, পাকিস্থান কর্তৃপক্ষ পশ্চিম পাকিস্থান থেকে পূর্ব পাকিস্থানে অস্ত্র নিয়ে যাবার ব্যাপারে আমাদের সাথে আলোচনা করতে বাধ্য নয়। যদিও আমাদের বলা হয়নি, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমেরিকার দেয়া কিছু অস্ত্র পশ্চিম থেকে পূর্ব পাকিস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশেষত M-24 ট্যাংকের মত কিছু পুরনো অস্ত্র।
MAP সহযোগিতা শেষ হবার পর থেকে এবং ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্থানে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার পর থেকে আমরা পাকিস্থানে আর কোন মারণাস্ত্র পাঠায় নি। ১৯৬৬-৬৭ তে খুবই সীমিত আকারে দেশ দুটিতে অস্ত্র বিক্রি শুরু করার পর থেকে পাকিস্থানে নামসর্বস্ব কিছু অস্ত্র আমরা নগদ টাকার বিনিময়ে সাপ্লাই দিয়েছি যা আগে দেয়া অস্ত্রের গোলাবারুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া যোগাযোগের জন্য কিছু জীপ, ট্রাক এবং ডাক্তারি কিছু যন্ত্রপাতি আমরা সেখানে পাঠিয়েছি। আমরা পাকিস্থানে গোলাবারুদ এখনো বিক্রি করছি যাতে করে আমেরিকার দেয়া অস্ত্রপাতিগুলো সচল থাকে এবং যাতে করে পাকিস্থান আরও টাকা-পয়সা খরচ করে আধুনিক অস্ত্র কিনতে বাধ্য না হয় যে টাকা পয়সা তারা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করতে পারত ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে যে ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্থানে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে পাকিস্থান সরকার বা তার কোন প্রতিনিধিকে কোন মিলিটারি জিনিসপত্র দেয়া হয়নি এবং এমন কোন চালান যাবার জন্য প্রস্তুতও নেই। আমরা দ্রুততার সাথে আমাদের মিলিটারি বিক্রয় প্রোগ্রাম পর্যালোচনা করছি।
আপনি জানেন যে, গত অক্টোবরে আমরা আমদের মিলিটারি সরবারহ পলিসিতে একবারের জন্য ব্যতিক্রম আনার ঘোষণা দিয়েছিলাম যাতে করে পাকিস্থানে আমরা সশস্ত্র জনবল বহনের গাড়ি, বোমারু বিমান এবং কিছু সামুদ্রিক টহল বিমান বিক্রি করতে পারি। এখনো এর কিছুই সরবারহ করা হয়নি, এবং এটা সরবারহ করার ব্যাপারে কোন কথাও গত ছয় সপ্তাহে হয়নি। এই ব্যাপারটাও পর্যালোচনাধীন রাখা হয়েছে।
সিনেটের কিছু সদস্য যে পাকিস্থানে আমাদের মিলিটারি সরবরাহ পলিসির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন সে ব্যাপারে আমরা পূর্ণ সচেতন আছি। মন্ত্রনালয়ের অফিসাররা এ ব্যপারে আপনাকে এবং সিনেটের বাকি সদস্যদের যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত আছে।
পূর্ব পাকিস্থানের অবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বিবৃতির একটি সংকলন আমি দিয়ে দিচ্ছি, যে সংকলনে মিলিটারি সাপ্লাই, পাকিস্থানে জীবনহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে অফিসিয়াল বিবৃতি , এইসব ঘটনার শিকার মানুষগুলোর প্রতি সমবেদনা, খাদ্য পরিস্থিতির তথ্য, শান্তিপূর্ণ অবস্থার পুনস্থাপনের ব্যাপারে তথ্য ইত্যাদি দেয়া আছে।
আপনার একান্ত
ডেভিড এম এবশায়ার
সহকারী সচিব, কঙগ্রেশনাল রিলেশনশিপ
পররাষ্ট্র দপ্তর
ওয়াশিংটন ডিসি, এপ্রিল ২৯, ১৯৭১।
সন্মানিত জে ডাবলু ফুলব্রাইট
সভাপতি, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি
ইউ এস সিনেট
প্রিয় সভাপতি, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি আমাকে আপনার ২৩শে এপ্রিল ১৯৭১ এর চিঠিটার জবাব দিতে বলেছেন, যে চিঠিতে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্থানের বর্তমান সংকট সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আমরা আপনার চিঠিটি খুবই যত্নের সাথে বিবেচনা করেছি। আমি আশা করি আপনি বুঝবেন যে মন্ত্রণালয় প্রচলিত নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে আপনার অনুরোধ রাখতে পারবেনা যা আমি আপনাকে ১৯৭০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে উল্ল্যেখ করেছি। উপ-সহকারি সেক্রেটারি আগামীকালের সেশনে পাকিস্থানের ব্যাপারে কথা বলবেন। আমার তখন কমিটির সবাই সবকিছু জানতে পারবেন।
আপনার একান্ত
ডেভিড এম এবশায়ার
সহকারী সচিব, কঙগ্রেশনাল রিলেশনশিপ
পররাষ্ট্র দপ্তর
ওয়াশিংটন ডিসি, এপ্রিল ২৯, ১৯৭১।
সন্মানিত জে ডাবলু ফুলব্রাইট
সভাপতি, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি
ইউ এস সিনেট
প্রিয় সভাপতি, মাননীয় সেক্রেটারি আমাকে আপনার ১৯শে এপ্রিলের চিঠির উত্তর দিতে বলেছেন যেখানে কার্যনির্বাহী কমিটির বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছে যেটাতে পাকিস্থানে সমস্ত আমারিকান মিলিটারি সহযোগিতা প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছে, এমনকি পাকিস্থানে অস্ত্র বিক্রির সব লাইসেন্সও বাতিল করতে বলা হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত “যতক্ষন পর্যন্ত পাকিস্থানের সংঘাত শেষ না হয়”।
আমি প্রথমেই বলতে চাই যে কমিটির মতই আমরাও পূর্ব পাকিস্থানের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নিয়ে ব্যথিত, যে দেশটির সাথে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলেছি। যেমনটা আমি আপনাকে আমার ২২শে এপ্রিলের চিঠিতে লিখেছিলাম, মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আমেরিকার অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে জনসম্মুখে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । এবং একই উদ্বেগ গোপনে আমরা পাকিস্থান সরকারকেও জানিয়েছি।
এপ্রিল ২২এর চিঠিতে আপনাকে যেমনটা বলেছিলাম, আমাদের মিলিটারি সহযোগিতা প্রোগ্রাম পাকিস্থানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও বাইরে থেকে প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রের ব্যবহারের ব্যাপারটি স্বীকৃতি দেয়।
যায়হোক, চলমান ঘটনাই প্রকাশ করা উদ্বেগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনেক কিছুই ইতিমধ্যে করা হয়ে গেছে। আপনি জানেন, ১৯৬৫ সালের ইন্ডিয়া-পাকিস্থান যুদ্ধের পর দেশ দুটির সাথে আমরা সমস্ত সামরিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছি। তারপর থেকেই দেশ দুটিতে আমরা কোন অস্ত্র সরবারহ করিনি। আমরা ১৯৬৫ সাল থেকে শুধুমাত্র সামান্য কিছু মিলিটারি ট্রেইনিং চালু রেখেছি যা দেশ দুইটিতে দুই লক্ষ ডলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । আমরা বিশ্বাস করি যে এই প্রোগ্রাম পাকিস্থান এবং আমেরিকার সামরিক বাহিনীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে। আমরা আশা করি যে এই প্রোগ্রামটা চালু থাকবে এবং আমরা এটার বিরতি বা শেষ চাইনা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে যে ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্থানে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে পাকিস্থান সরকার বা তার কোন প্রতিনিধিকে কোন মিলিটারি জিনিসপত্র দেয়া হয়নি এবং এ ধরনের সরবরাহের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
তাই চলমান ঘটনা প্রবাহে মিলিটারি প্রোগ্রাম পুরোপুরি প্রত্যাহার করলে পূর্ব পাকিস্থানে সামরিক অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হবেনা এবং এটা পাকিস্থানের সাথে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটাতে পারে। তাই আমাদের মনে হয় পাকিস্থানের সাথে সামরিক সরবারহ প্রোগ্রাম চালু রাখার ব্যাপারে আমাদের কিছুটা নমনীয় হওয়া উচিত যাতে করে আমরা পাকিস্থানের সাথে একটা টেকসই সম্পর্ক চালু রাখতে পারি, যে সম্পর্ক সাম্প্রতিক যুদ্ধে বিপন্ন মানুষ গুলোকে সহযোগিতা করতে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
তাই আমাদের মনে হয় পাকিস্থান কে সীমিত পরিমাণে মিলিটারি সরঞ্জাম দেওয়া চালু রাখা উচিত যাতে করে আমাদের দ্বীপাক্ষীয় সম্পর্ক গঠনমূলক ভাবে চালু থাকে এবং পাকিস্থান অন্য দেশের উপর নির্ভর হতে বাধ্য না হয়।
তাই আমাদের মনে হয় “পূর্ব পাকিস্থানের সমস্যা যতদিন শেষ না হয়” নামে যে শব্দ গুচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে তা অযৌক্তিক এবং তা বাস্তবায়ন অসম্ভব। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্থানের সংঘর্ষ এখন অনেকটাই প্রশমিত হয়ে গেছে এবং পূর্ব পাকিস্থানের বেশিরভাগ অংশ এবং বেশিরভাগ মানুষের উপর পাকিস্থান সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্থান সরকারের অফিশিয়াল বক্তব্য হচ্ছে পূর্ব পাকিস্থানের সশস্ত্র সংঘর্ষ শেষ হয়ে গেছে এবং সেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার কাজ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা পূনর্ব্যক্ত করেছেন। এই পরিস্থিতিতে সব চেয়ে কঠিন সমস্যা হচ্ছে পাকিস্থানের অবস্থা সত্যিকার অর্থেই কবে ঠিক হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না।
আমি আশা করি নির্বাহী বিভাগের এই বক্তব্য আপনার উপকারে আসবে। এই রিপোর্টটি জমা দেবার ব্যাপারেও আমাদের কোন আপত্তি নেই।
আপনার একান্ত
ডেভিড এম এবশায়ার
সহকারী সচিব, কঙগ্রেশনাল রিলেশনশিপ