শত্রুর মোকাবিলা করেই কাদের বাহিনী যুদ্ধ শিখছে
১৯শে এপ্রিল। ময়মনসিংহের পথে রওনা হয় পাকবাহিনী। পথে কালিহাতিতে তাদের বাধা দেয়া হয়। নেতৃত্ব ছিল ইপিআর-এর। কাদের সিদ্দিকীও এদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। শত্রুপক্ষের মেজর কামাল সহ বহু খান সেনা এই যুদ্ধে হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ডিফেন্স উঠিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এদিকে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাদের সিদ্দিকী। সঙ্গে রয়েছেন কয়েকজন মুক্তিপাগল যুবক। কাদের সিদ্দিকী বলছিলেন, আমার আয়ত্তে কুড়ি পচিঁশটি বন্দুক ছিল। এগুলো নিয়ে পাহাড়ে চলে গেলাম। লুকিয়ে রাখলাম। কয়েকদিন পর শুনতে পেলাম কাদের সিদ্দিকীর মাথা কেউ এনে দিতে পারে তাকে লাখ টাকা পুরুস্কার দেয়া হবে। ভয় পেলাম প্রথমে। আমাদের দেশে হাজার টাকার জন্য মানুষ মানুষকে খুন করে। আমাকে তো ধরিয়েও দিতে পারে। অনেকগুলো যুবক ও তরুণ আমার সাথে গিয়েছিল। তাদের কয়েকজনকে ফিরিয়ে দিলাম। আমি তখন কিছুটা ফ্রাস্ট্রেটেড। আমি পারবো কিনা সন্দেহ ঢুকছে মনে। আমি যে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে পারবো তা তখন আমার জানা নেই। সহগামী বন্ধুদের বললাম, তোমরা চলে যাও। তোমরা এখনো দোষী সাব্যস্ত হয়নি। আমি মনস্থির করলাম এমনিভাবে পালিয়ে থাকবো। যদি কোনদিন সুযোগ পাই এবং একজন পাকসেনাকেও হত্যা করতে পারি তাহলে মনে সান্ত্বনা পাবো তবু তো একটাকে মারলাম।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, কিন্তু পরে দেখলাম আমাকে জঙ্গলে কাটাতে হলো না। মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ পাগল। সংগ্রামের জন্য তাদের দারুণ আগ্রহ। লাখ টাকার বিনিময়েও তারা ধরিয়ে দিতে রাজী নয়। এভাবে কয়েকদিন কেটে গেলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছেলেরা এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কাদের ভাই, কোথায় ট্রেনিং হচ্ছে? আপনি কোথায় ট্রেনিং দিচ্ছেন, বলুন। বুকে অনেক ভরসা পেলাম। রিক্রুট শুরু করলাম। ৬ই মে নাগাদ আমার দলের লোকসংখ্যা দাঁড়ালো ৪০০ জন। ১৪ই মে বাহেরাতৈলে পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে আমার জোয়ানদের শপথ করালাম যতদিন বাংলাদেশ স্বাধীন না হবে, বঙ্গবন্ধু ফেরত না আসবেন, ততদিন আমাদের যেই জীবিত থাকি যুদ্ধ করবো। সেই থেকে আমাদের সুপরিকল্পিত যুদ্ধ শুরু হলো।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমি চেষ্টা করেছি আমাকে ছায়া দেয়ার মতো এবং নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে যদি পেতাম। আমরা তার হুকুম মেনে কাজ করতাম। অনেকে এসেই আমার সাথে যোগদান করেছে। প্রথমে ভেবেছি এই বোধ হয় কোন নেতা পাবো। কিন্তু পরে দেখেছি তারা আমাকে নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করেননি বরং আমার কাছ থেকে নেতৃত্ব আদায়ের চেষ্টা করেছে। তাদের জোরেই আমি নেতা হয়েছিলাম।
কাদের সিদ্দিকী বলেন, কাদের বাহিনী নাম আমি দিইনি। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেই প্রথম আমাদের যুদ্ধকে কাদেরিয়া মার বলে বর্ণনা করে। আমার বাহিনীর নাম দেয় কাদের বাহিনী। পরে আমার ছেলেরাও এই নাম গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আমাদেরকে কাদের বাহিনী নামে অভিহিত করেন। কিন্তু আমি আগেও ভাবতাম এবং আজো ভাবি স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমরা মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা।
৩রা জুন কাদের বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয় গোপালপুর, মধুপুর ও টাঙ্গাইল থানার সম্মিলিত পুলিশ বাহিনীর সাথে। খণ্ডযুদ্ধ হয় বইলামপুরে। হেরে পুলিশ বাহিনী পালিয়ে যায়। সাতজন পুলিশ কাদের বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। ১২ই জুন হলো বল্লার যুদ্ধ। পাঁচ ঘণ্টা চলে এই যুদ্ধ। কাদের সিদ্দিকীর ভাষায় জনগণের মনোবল বৃদ্ধির জন্য প্রথম পর্যায়ের এই যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিল। দল সংগঠনের পর খানসেনাদের সাথে এটা ছিল আমাদের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। আমরা ছিলাম প্রায় ১৫০জন। কিন্তু পজিশন নিয়েছিলাম কৌশলগত কারণে মাত্র ১৩ জন। সেই যুদ্ধে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। আহত কত হয়েছিল বলতে পারবো না। যুদ্ধে ওরা হেরে গিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা তখনো গুলি চালিয়ে একটি কভার সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। আমি তখন ভাবছি, খান সেনাদের অন্তত কয়েকটি লাশ আমাদের নিয়ে যেতেই হবে। তাহলে মানুষ বিশ্বাস করবে যে আমরাও লড়তে পারবো। আপ্রাণ চেষ্টা করে পাঁচটি লাশ নিয়ে এলাম। একটি লাইট মেশিন গানসহ ৯টি রাইফেলও হস্তগত করলাম। কিন্তু সেদিন মেশিনগান রাইফেলের চেয়েও বড় কাজে এসেছিল ওই লাশগুলো। পাঁচটি লাশ দেখার জন্য কুড়ি হাজারের মতো লোক জমায়েত হয়েছিল। এমন কোন লোক ছিল না যে লাশগুলোকে সেদিন ঘৃণাভরে লাত্থি মারেনি। পরে লাশগুলোকে আমরা নদীতে ভাসিয়ে দিই। এরপর জনগণের মনে এক অদ্ভুত উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল।
আগষ্ট মাসে কাদের সিদ্দিকীর হাতে গুলি লাগে। টাঙ্গাইল থেকে ১২৮ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তিন দিনে তিনি সীমান্তের ওপারে গিয়ে পৌঁছেন। ২৩শে আগষ্ট তিনি চলে যান। বাংলাদেশে আবার ফিরে আসেন ১৩ই সেপ্টেম্বর। ভারত অবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকী বলেন যে, ‘ভারতীয় বাহিনী আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেছে। আমার যদ্দুর জ্ঞানবুদ্ধি আছে তাতে মনে করি ভারতীয় বাহিনীর লোকেরা খুব ভালো করেই অনুভব করেছে যে আমাদের স্বাধীন করা উচিত’।
কাদের বাহিনীর সংগঠন গত ব্যাপারে কয়েকটি প্রশ্নও আমি কাদের সিদ্দিকীর কাছে রেখেছিলাম। তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক হিসাবে ছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। প্রত্যেক ইউনিয়ন, গ্রাম এবং ওয়ার্ডে এই বাহিনী ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখতো না। মুক্তিফৌজ কোথাও অপারেশনে গেলে বা ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করলে তাদের খবরদারির ভার থাকতো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কয়েকটি দল ছিল। এগুলো হলো হেলথ কোর, যোগাযোগ দল ও যুদ্ধের দায়িত্ব প্রাপ্ত যোদ্ধাদল। এই শেষোক্ত শ্রেণীই ছিল সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী। যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য কোন ক্ষেত্রের অভাব ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রেই তারা প্রশিক্ষন পেয়েছে। বিশেষ কোন ট্রেনিং দিয়ে তাদের যুদ্ধ শেখাতে হয়নি। শত্রুর মোকাবেলা করেই তারা যুদ্ধ শিখেছে। টাঙ্গাইল জেলায় কাদের বাহিনী তাদের তৎপরতা সর্বাধিক কেন্দ্রিভূত করেছিল। পাঁচটি সেক্টরে জেলাটি বিভক্ত ছিল। কোম্পানী ছিল ৯৭ টি। সেক্টরের অধিনায়ক হিসাবে কাউকে কখনো বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। একজন সিনিয়র কোম্পানী কমান্ডারের উপর তার নিজস্ব কোম্পানী ছাড়াও সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হতো।
বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদর দফতর ‘মহানন্দপুরে’ অবস্থিত ছিল। বাহিনীর একজন প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন। একাত্তর সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে সরকারের অনুমতিক্রমে কাদের বাহিনী জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সকল দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেন।
কাদের বাহিনীর একটি সিকিউরিটি বা ইনটেলিজেন্স বিভাগ এবং সাথে সাথে কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ব্যবস্থা চালু ছিল। বাহিনীর লোকজন সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করে রিপোর্ট করা ছিল এদের কাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। কাদের বাহিনীর সিগন্যাল বা কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থা ছিল অদ্ভুত। সর্বক্ষন বিভিন্ন এলাকায় রুটিনমাফিক সিগন্যালম্যানের কাছে দ্রুত দৌড়ে দিয়ে খবর পৌঁছে দিতো। সে পৌঁছে দিতো পরের পয়েন্টে। এমনি করে করা হতো খবর এবং তা সব সময়ই (বিশেষ করে যা জরুরী গোপন আশু নির্দেশ) থাকতো লিখিত। বিভিন্ন পয়েন্টের সিগন্যালম্যানের নাম তাতে স্বাক্ষরিত থাকতো। কাদের সিদ্দিকী জানান যে, এভাবে ১০ মাইল দুরবর্তী কোন স্থানে খবর পাঠাতে তাদের সময় লাগতো বড়জোর ২৫ মিনিট। নভেম্বর মাস থেকে কাদের বাহিনীর শক্তিসম্পন্ন বেতার ব্যবস্থা চালু করে।