You dont have javascript enabled! Please enable it!

কাদের বাহিনীর গঠন ও যুদ্ধ তৎপরতা-২
কাদের বাহিনী সাড়ে তিনশো লড়াই-এ অংশ নিয়েছে

(কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত। প্রতিবেদনটি দৈনিক বাংলা ৮-১৩ ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে বিভিন্ন শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ)

কাদের বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার। এদের সহায়ক স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা ছিল ৭২ হাজারেরও বেশী। একটি সেনাবাহিনীরমতো সুশৃঙ্খল প্রশাসন ব্যবস্থা। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনার কিছু অংশ ছিল কর্মক্ষেত্র, ৫টি সেক্টরে বিভক্ত ছিল সমগ্র এলাকা। মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত ছিল ৯৭ কোম্পানীতে। ৫টি সেক্টরে ছিল পাঁচটি সদর দফতর। কোম্পানীগুলোরও ছিল পৃথক সদর দফতর। এসব সদর দফতর ছিল ভ্রাম্যমাণ। এছাড়া সবার ছিল একটি উর্ধ্বতন স্থায়ী সদর দফতর যেখানে হানাদার পাকিস্তানীরা কোনদিনই পা ফেলতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনীতে ছিল সিগন্যালার- হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধ বর্ণনায় যে ধরনের সিগন্যালার বা খবর সরবরাহকারীর সন্ধান মেলে তেমনি। আবার এর সাথে সাথে ছিল বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা।

এই বাহিনীর কোন যোদ্ধা অধিকৃত বাংলাদেশের বাইরের কোন জায়গা থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসেনি। অধিকৃত এলাকাতেই তারা পেয়েছেন প্রশিক্ষণ, আঘাত হেনেছেন শত্রুর উপরে, ধ্বংস করেছেন শত্রুর হানাদারদের আর একের পর এক মুক্ত করেছেন অধিকৃত অঞ্চল। মুক্ত এলাকায় চালু করেছেন বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা ১৬ই ডিসেম্বরের অনেক আগেই। একটি সেনাবাহিনীতে যে সব উপকরণ থাকা প্রয়োজন তার প্রায় সব কিছুই এদের ছিল। হাসপাতাল ছিল, যোদ্ধাদের উদ্দীপনা জাগানোর জন্য ছিল সাংস্কৃতিক দল। রণাঙ্গন নামে একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র তারা প্রকাশ করতেন। ছিল সুষ্ঠ গণসংযোগ ব্যবস্থা। আরেকটি কথা- শুধু বিমান ছাড়া একটি সশস্ত্র বাহিনীর যে সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকা প্রয়োজন পরিমাণে সামান্য হলেও তার অনেকগুলোই তাদের কাছে ছিল। শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে তারা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছিলেন। ব্যাপক সম্মুখসমর, খণ্ড যুদ্ধ ও ছোটখাটো সংঘর্ষ সহ বাহিনীর মোট লড়াইয়ের সংখ্যা সাড়ে তিনশোরও বেশী। তাদের হাতে নিহত হয়েছে সহস্রাধিক খানসেনা ও রাজাকার। আর এই বাহিনীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হলো একত্রিশ জন।

তাদের নিজস্ব যুদ্ধপদ্ধতি ও কৌশল ছিল, গেরিলা যুদ্ধ তারা করেছেন। ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অনেক সম্মুখ সমরে। গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধের একটি রীতি হলো ‘হিট অ্যাণ্ড রান’ অর্থাৎ আঘাত হেনে পালিয়ে যাও। কিন্তু এই বাহিনী গেরিলা যুদ্ধে একটি নবতর রীতি সংযোজন করেছিল। তা হলো ‘সাডেন হিট, ষ্টে অ্যাণ্ড অ্যাডভান্স’ অতর্কিতে এসে আঘাত হানো, অবস্থান করো ও এগিয়ে যাও।

বাহিনীর নাম কাদের বাহিনী আর অধীনায়কের নাম কাদের সিদ্দিকী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাহিনী আর অধিনায়কের নাম চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে। কাদের বাহিনীর নাম শুনলে হানাদার পাকিস্তানী ও তাদের সহযোগীদের বুকের পাঁজরে ত্রাসের কাঁপন জাগতো। আর কাদের সিদ্দিকী রূপকথার নায়কের মত একটি নাম, অধিকৃত বাংলাদেশ একটি অঞ্চলের মুক্তিপাগল বাঙালির কাছে যে নাম ছিল আস্থা, প্রত্যয়, সাহস, সংগ্রাম ও বিজয়ের বরাভয় আর হানাদারদের কাছে ছিল ভীতি আর বিলুপ্তির পরোয়ানা।

…… দলগত বা বাহিনীগতভাবে ‘কাদের বাহিনী’ প্রথম যুদ্ধ সংগটিত হয় একাত্তর সালের ২২ শে মে চারানে। এই সংঘর্ষ চল্লিশ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। যুদ্ধে ১৫ জন খান সেনা নিহত হয়। আহত হয় আরো বেশী। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ হতাহত হয়নি। দুজন গ্রামবাসী শহীদ হন। এরপর থেকে চলেছে খান সেনাদের উপরে অব্যাহত আক্রমণ। খান সেনাদের অস্ত্রবাহী জাহাজের উপর হামলা চালিয়ে এক কিস্তিতেই দখল করেছে একুশ কোটি টাকার গোলাবারুদ। ২৩ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে টাঙ্গাইল থেকে কড্ডা পর্যন্ত রাস্তায় ১৭টি গুরুতবপূর্ণ সেতু ধ্বংস করেছে তারা। একাত্তরের নভেম্বর নাগাদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ থানা মুক্ত করেন তারা এবং অমনি কয়েকশ অপারেশন। ১২ই ডিসেম্বর মুক্ত হয় টাঙ্গাইল। মেজর জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও ব্রিগেডিয়ার সানত সিং- এর ভারতীয় বাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে কাদের বাহিনী অগ্রাভিযান করে ১২ই ডিসেম্বর পরবর্তী কয়েকটি দিন। ১৬ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী যখন সবার আগে ঢাকা প্রবেশ করে তখন তাঁর সাথে ছিল কাদের বাহিনী ও কাদের সিদ্দিকী।

বাঘা সিদ্দিকীর সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমি মিলিত হয়েছিলাম। আমার টেপ রেকর্ডারে তিনি একনাগাড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা তাঁর বক্তব্য রাখেন। ২৫শে মার্চের পরবর্তী পর্যায়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বাহিনী সংগঠন থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের কথা বলেন।

কাদের সিদ্দিকী বলেন যে, কোন বাহিনী গঠনের মানসিকতা নিয়ে অন্তত প্রথম অবস্থায় তিনি যুদ্ধে নামেননি। তিনি বললেন, যখন ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া আমাদের উপর তার বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি আগে ভাবতাম কোন কিছুর সমাধান হিংসাত্মক উপায়ে হয় না। ২৩শে মার্চ আমরা অধিকার আদায়ের শপথ নিলাম। এবং সেদিন প্রথম সবক নিলাম প্রয়োজন হলে অস্ত্রের মাধ্যমেও রাজনীতি করতে হতে পারে। ২৫শে মার্চের পর টাঙ্গাইলে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেখানে আমার কোন যোগ্যতা নেই। তার জন্য কোন দায়িত্ব না পেলেও নিজে একজন কর্মী হিসাবে থাকার চেষ্টা করলাম। আমি আগে থেকেই জানতাম রাজনীতির মঞ্চের নেতৃত্ব আর যুদ্ধের নেতৃত্ব এক জিনিস নয়।

৩রা এপ্রিল, ১৯৭১ সাল। হানাদার পাক বাহিনী এগিয়ে এলো টাঙ্গাইলের পথে। তাদেরকে সাটিয়াচড়ায় বাধা দেয়া হয়, বললেন কাদের সিদ্দিকী। সেই যুদ্ধ প্রাক্তন ইপিআর’রাই করেছিল। মাত্র ২ প্লাটুন ইপিআর সেদিন বাধা দেয় হানাদার খান সেনাদের একটি ব্যাটালিয়নকে। যুদ্ধে আমাদের হার হয়। ভাবলাম পাহাড়ে পালিয়ে চলে যাবো। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাবো না। যা হয় দেশেই হবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!