শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
বাংলাদেশের ঘটনাবলীর উপর বৃটিশ এম,পি মিঃ পিটার শোর-এর বক্তব্য | মান্থলী কন্টেম্প্রারী | ৩১ আগস্ট,১৯৭১ |
“নিদারুণ যন্ত্রণার মৃত্যু এবং জন্মের নাভিশ্বাস”
বাংলাদেশের ঘটনা একটি প্রাচীন জাতির(পাকিস্তান) নির্মম মৃত্যু এবং একটি নতুন জাতির (বাংলাদেশ) জন্মের নাভিশ্বাস (আকস্মিক তীব্র যন্ত্রণা)।
বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান হল অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং পূর্ব বাংলার মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা।
বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সাথে কথা বলে আমি জানতে পারি, মোটকথা স্বাধীনতাই পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিকতা আনতে পারে।
ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে আমি বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করবো যাতে তারা পাকিস্তানের বোধোদয় ফিরিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সাময়িকভাবে তাদের অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করে।
যুক্তরাজ্যের উচিৎ পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের প্রতি সকল সাহায্য বন্ধ করে দেয়া যতক্ষন না পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের নৃশংস দমন বন্ধ না করবে।
মিঃ পিটার শোর, ব্রিটিশ এম,পি
আগস্ট ৩১, নয়া দিল্লী।
পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে ব্রিটিশ এমপি জনাব বার্নার্ড ব্রেইন এর বিবৃতি
যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনই হস্তক্ষেপ না করে তবে, রাত্রি যেমন নিশ্চিত দিন অনুসরণ করে চলে তেমনি অক্টোবর নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানেও একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হতে পারে। গত সপ্তাহে টরোন্টোতে কানাডার অক্সফাম কতৃক আয়োজিত একটি বেসরকারি সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞগণ এরুপ অসন্তোষজনক উপসংহারে পৌঁছেছেন।
গত মাসে, বিশ্বব্যাংকের একটি মিশন পূর্ব পাকিস্তান সফর শেষে রিপোর্ট করেন যে, তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখছেন না । মানুষ এখনো ভীত এবং অনাস্থাবাদী । অনেক কর্মী এবং সরকারি কর্মচারী দায়িত্বে রিপোর্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। যোগাযোগ ব্যাবস্থা সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়েছে।
সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। ভারতে এখন ৭.৫ মিলিয়ন শরণার্থী এবং তাদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের ভয়াবহ শারীরিক অবস্থা পিছনে ছুটে যাওয়াদের সঙ্কটাপন্ন দশার যথেষ্ট প্রমাণস্বরূপ। বিদ্রোহ অব্যাহত রয়েছে। প্রদেশের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এখন বেসামরিক প্রশাসন থেকে দূরবর্তী, একটি গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন ।
এখন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে বৃহত্তর দুর্ভিক্ষ এগিয়ে আসছে সেই বিশ্বাসের ভিত্তি কী?
প্রথমত, এটা স্বীকৃতি দিতে হবে যে, প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং সমৃদ্ধ মাটি থাকা সত্ত্বেও এই প্রদেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টি একটি সার্বজনিন রোগ। এখানে মৌলিক খাদ্য ভাত এবং সবজি, মাছ ও ডাল সম্পুরক খাদ্য। মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য বিরল বিলাসদ্রব্য। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত বছর গড় মাথাপিছু খাদ্যশস্য ভোগ ছিল ১৬.১ আউন্স। যা উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের ২৭০০ ক্যালোরির তুলনায় শুধুমাত্র ১৭০০ ক্যালোরির যোগান দেয়। বস্তুতপক্ষে, পাকিস্তান সরকার কতৃক ১৯৬৪ সালে পরিচালিত পুষ্টি জরিপের তথ্যানুযায়ী,পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামীণ জনসংখ্যার গড় প্রোটিনযুক্ত খাবার গ্রহণ শতকরা ৮৫ ভাগ পর্যন্ত অপর্যাপ্ত ছিল এবং অর্ধেক ছেলেমেয়েরা অপুষ্টির সীমান্তরেখার উপর ছিল। শিশু মৃত্যুর হার তাদের পঞ্চম জন্মবার্ষিকী পর্যন্ত ২৬ শতাংশ ছিল যা ইউরোপে গড় ২.৪ শতাংশ।
এসবের প্রভাব টরন্টো সম্মেলনে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ডঃ জন রোড দ্বারা বর্নিত হয়, যিনি সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছেন। তাঁর মূল বিষয়টা ছিল যে একটি মানুষ, যার খাদ্য এবং কল্যাণ স্বাভাবিক অবস্থাতেই অত্যন্ত প্রান্তীয়, সেখানে যদি শুধুমাত্র একটি চিরাচরিত খাবার সরবরাহে প্রান্তিক ঘাটতি হয় তবে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।তা সত্ত্বেও, যদি একটা বড় ঘাটতি হয় তবে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ অনিবার্য এবং লক্ষ লক্ষ মৃত্যু নিশ্চিত।
ঘাটতি সম্পর্কে তথ্য কি কি? ১৯৬৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান বছরে গড়ে ১০.৮ মিলিয়ন টন শস্য উৎপাদন করে, কিন্তু এখনো চলমান ঘাটতি মেটাতে বছরে ১.২ মিলিয়ন টন আমদানি করতে হয়। চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক কার্যসূচী দেশীয় উৎপাদনে ১৯৭৫ সাল নাগাদ একটি বৃহৎ বৃদ্ধি পরিকল্পনা করে । কিন্তু তা যদি অর্জন করাও যায়, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আমদানি এখনও প্রয়োজনীয় হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, আদৌ বৃদ্ধি না পেয়ে, উৎপাদন মারাত্নক ভাবে ব্যাহত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কতৃক আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য তৈরি করা সাম্প্রতিক হিসাবের উপর ভিত্তি করে ডঃ রোড কতৃক উদ্ধৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী,আগামী বছরের দেশীয় উৎপাদন বর্তমান সমস্যার পুর্বের অনুমেয় হিসেবের চেয়ে ২.২৮ মিলিয়ন টন কম হতে পারে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, পূর্ব পাকিস্তান বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পর বৃহত্তম খাদ্য ঘাটতির মুখোমুখি। দুর্ভিক্ষে যে তিন মিলিয়ন মানুষের ক্ষতি হয় তা স্মরণ করে এই বিষয়ে জড়িত বিষয়গুলোর ব্যাপারে ধারণা উপলব্ধি করা যাবে।
এরুপ ভীতিকর পরিস্থিতির কারণসমূহ গণনা কঠিন নয়।শত হাজার কৃষক ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং এখনও পালাচ্ছেন। কৃষিঋণ ব্যাবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। গণপূর্ত কার্যক্রম ও বেসরকারি ব্যবসায়িক কার্যক্রম বস্তুত স্থগিত আছে, এবং প্রদেশের সর্বত্র নগদ অর্থের তীব্র ঘাটতি বিরাজমান। গোপন মজুত বাড়ছে এবং চালের দাম আচমকা বেড়ে গেছে।
ডঃ রোড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমেয় ত্রাণ উদ্ধৃত করে বলেন যে, দেশীয় উৎপাদনের সম্পূরক হিসেবে ২.৯ মিলিয়ন টন শস্য আমদানি প্রয়োজন হবে, গড় মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ১৫ আউন্স (১৬০০ ক্যালোরি) নিশ্চিত করার জন্য। এটি একটি সর্বনিম্ন ধারণা, যেহেতু একজন প্রাপ্তবয়স্কর ১৬০০ থেকে ১৯০০ ক্যালোরি প্রয়োজন সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১৯৭০ সাল নাগাদ, কোন স্বাভাবিক বছরে খাদ্যশস্যের সর্বাধিক আমদানি ছিল ১.৫ লাখ টন, তাই প্রায় দ্বিগুণ পরিমান আমদানি ও তার সুষম বন্টনের সম্ভাবনা বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘাটতিপূর্ণ।
এমনকি যদিও প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য জাহাজে যেতে পারে এবং খালাস হতে পারে, তাদের ঘাটতিপুর্ন এলাকায় স্থানান্তর করা ক্ষমতা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ।চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বন্দর ধারণক্ষমতার নিচে পরিচালিত হচ্ছে। কারণ প্রচুর বন্দর শ্রমিক পালিয়ে গেছে। সামরিক সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের অন্তর্ঘাত ক্রিয়াকলাপ দ্বারা সড়কএবং রেল যোগাযোগ গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়েছে।
প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, এবং এই অনুপাত এখন সম্ভবত আরও বেশি কারণ শহুরে জনসংখ্যার অর্ধেক পালিয়ে গেছেন। কিন্তু এখানে, যেখানে প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখল সেখানে সবচেয়ে বেশি ভঙ্গুর। বাস্তবে ভয় যে, যদি খাদ্য বিতরণ শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে তারা প্রথমে আদেশের পুন ইকেপ্রতিষ্ঠাঅগ্রাধিকার দেবে এবং খাদ্যকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করবে না । যদি সেটা হয়, বিদ্রোহীরা এই প্রক্রিয়া ব্যাহত করাবে সে আশা করা যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে ডঃ রোড টরন্টো সম্মেলনে তিনটি জরুরী প্রয়োজনের কথা বলেন। প্রথমত, আন্তর্জাতিক মতামতকে দাবী জানাতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিপক্ষ দলকে খাদ্য আক্রান্ত এলাকায় পৌঁছানোর অনুমতি দিতে হবে যা সেনা বা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয়ত, খাদ্য সরাসরি প্রয়োজনগ্রস্থ মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য একমাত্র নিশ্চিত পথ হল, পাকিস্তান সরকারকে এটা মেনে নিতে হবে যে খাদ্য বিতরণ জাতিসংঘের কর্মীদের তত্ত্বাবধানে এবং অধীনে হওয়া উচিত। তৃতীয়ত, একটি বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক দলকে বিলম্ব ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে। ইহার কাজ হবে সর্বাধিক প্রয়োজনগ্রস্থ এলাকাসমূহ নির্ধারণ করা, বর্তমান খাদ্য মজুদ মূল্যায়ন করা, ত্রাণসামগ্রীর ধরণ এবং পরিমাণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা এবং বেসামরিক উদ্দেশ্যে যোগাযোগ ও পরিবহন সুবিধাসমূহ মেরামতের তদারকি করা, আকাশ এবং জলপথে সহজগম্য খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা এবং বিতরণের জন্য যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতি প্রণয়ন।
এরুপ প্রয়োজনীয়তায়, এবং তাদের দ্রুত মেটানোর ক্ষেত্রে, কার্যকর ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত করার যুক্তিসঙ্গত একটি সুযোগ রয়েছে। তাৎক্ষণিক চাহিদা পুরণে, জরুরী খাদ্য সরবরাহ করা উচিত। বন্দরে যানজট এড়াতে, এবং সড়কের ভাঙ্গন এড়াতে এবং রেল যোগাযোগে উপকূলে জাহাজ ব্যবহার করা উচিত। আঞ্চলিক কেন্দ্রসমূহে পৌঁছাতে বিস্তৃত জলপথে একটি ছোট নৌবহর-ব্যাবস্থা ব্যবহার করা যেতে পারে।
কিন্তু সময় গুরুতরভাবে সংক্ষিপ্ত। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এখনই কাজ করতে হবে অথবা একটি অকল্পনীয় মানবিক দুর্যোগ প্রত্যক্ষ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।