এক সপ্তাহের লড়াইয়ে আরও সহস্ত্রাধিক শত্রু সৈন্য নিহত
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট- কুমিল্লা, চট্টগ্রাম- নোয়াখালী, ময়মনসিংহ- টাঙ্গাইল, দক্ষিণ- পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গ সেক্টরের বিভিন্ন রঙ্গানে দিনের পর দিন পাক- ফৌজের উপর গেরিলা কৌশলে চোরাগোপ্তা কখনো ঝটিকা না অতর্কিত হামলা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এতে গত এক সপ্তাহে অন্তত আরো এক সহস্ত্র পাকসৈন্য নিহত হয়েছে।
গত ৯ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউরা সাব- সেক্টর এবং বিবিরবাজার এলাকায় পাকফৌজের উপর এক অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী আক্রমণের ফলে পাকহানাদার বাহিনীর ৩শত সৈন্যকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য বিবিরবাজার থেকে সোনামুড়া সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী সাফল্যের সাথে তাদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করে দেয়।
একই দিকে মুক্তিবাহিনী রংপুর জেলার দুর্গাপুর থানায় পাকফৌজের একটি ঘাঁটির উপর আকস্মিক হামলা চালায়। গেরিলা কৌশলের আক্রমণে পাক- ফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং এলোপাতারি গোলাগুলি ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু তবুও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নির্ণয় করতে বেরথ। মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাক- ফৌজের ৬ জন সৈন্য প্রাণ হারায়।
মুক্তিফৌজের মেহেরপুরে উপকণ্ঠে ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে পাক-হানাদার ঘাঁটির উপর শেল বর্ষণ করে। অন্যদিকে ভৈরব নদীর পশ্চিম তীরে মেহেরপুরের একটি গুপ্তস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন সুবেদারসহ বেশ কয়েকজন জল্লাদবাহিনীর সৈন্যকে হত্যা করে।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডে চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রায় ৭ মাইল দূরে জয়রামপুরের কাছে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ফলে দর্শনার দিকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এবং পাকবাহিনীর রসদ সরবারহের পথ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
গত ১০ই মে মুক্তিবাহিনী আখাউরা সেক্টর পাক- ফৌজের উপর আকস্মিক ভাবে এক বিরাট হামলা চালায়। এই সেক্টরের প্রচণ্ড লড়াই যে ৪ শত খান সেনা খতম হয়েছে। এ ছাড়া পাক-ফৌজের কাছ থেকে মুক্তিবাহিনী একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার হস্তগত করেছে।
এদিকে সিলেট জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি তেলিপাড়া একালায় প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক ফৌজের প্রচণ্ড লড়াই বাধে। তেলিয়াপাড়া চা-বাগানটি পূর্ণদখল করার জন্য পাক ফৌজ প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী এর সমুচিত জবাব দেয়। এই সংঘর্ষে ১২ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। তাদের মধ্যে দুজন অফিসারও আছে।
ইয়াহিয়া- টিক্কার জল্লাদ বাহিনী কুমিল্লা জেলার তিতাস প্লান্টটি ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প কারখানাগুলো অচল হয়ে পড়েছে।
মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা- চট্টগ্রাম সড়কের শুভ পুরে সেতুতে অবস্থিত হানাদার বাহিনীর উপর এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে তাদেরকে দিশেহারা করে তোলে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। উত্তর পশ্চিমে সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আরও ৬০ জন পাকফৌজের ৭টি গাড়ীতে অগ্নিসংযোগ এবং তিনটি বাংকার ধ্বংস করে দেয়া হয়।
মুক্তিবাহিনী গত মঙ্গলবার রংপুর জেলার কোলাঘাট, মোগলাই ও ওমর থানায় পাক সৈন্য ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ আক্রমণে মোগলহাট পাক ফৌজ হতাহত হয়। দিনাজপুর মুক্তিবাহিনী পার্বতীপুর – সান্তাহার রেল রুটে এবং পাঁচবিবি ও জয়পুরহাট শহরে পাকফৌজের ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে সড়ক রেল যোগাযোগ বেবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। জয়পুরহাটের সংঘর্ষে ৭জন পাক হানাদার খতম হয়েছে।
মুক্তিফৌজের কমান্ডোরা কুড়িগ্রামে পাকঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে পাকফৌজের হাতে বন্দী ১২ জন মুক্তিসেনাকে ছিনিয়ে আনে। এছারা ধারলা ও কুড়িগ্রামের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু কমান্ডোরা ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
গত ১২ মে মুক্তিবাহিনী কসবা অঞ্চলে পাকফৌজের ওপর হামলা চালান। মুক্তিবাহিনী এখানে দু’মুখী এমন আক্রমণ চালান যে পাকফৌজ দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও পাকফৌজের মধ্যে এই ভয়াভহ আক্রমণে একশত ২৭ জন পাকফৌজ নিহত হয়। এদের মধ্যে একজন মেজরও ছিলেন।
-জয়বাংলা, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ১৯মে, ১৯৭১