সিলেট ফ্রন্টে প্রতিরোধ ভাঙতে ব্যর্থ পাক আর্মি
(অনুবাদ)
আগরতলা, ২৬শে এপ্রিলঃ সিলেটের শেরপুর ফেরিঘাটে আজ দিনের প্রথমভাগে পাকিস্তানী বিমান ও স্থল বাহিনী একযোগে হামলা চালায়। টানা চারদিন হামলার চতুর্থদিনেও আজ বীরদর্পে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা রুখে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী। সীমান্তের ওপার হতে পাওয়া সুত্র থেকে জানা যায় যে এ সপ্তাহের শুরুর দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। যথেষ্ট পরিমান লোকবল এবং পিএএফ প্লেন সহযোগে ফেরি ঘাটে বোমা হামলা চালানো স্বত্বেও তারা মুক্তিবাহিনীর শক্ত প্রতিরোধ ভাঙতে পারেনি। শেরপুর ফেরিঘাট কুশিয়ারা নদীর উপরে অবস্থিত। কুমিল্লার আখাউড়া এবং সিলেটের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম এই ফেরি।
এরই মধ্যে জানা যায় যে, সিলেট শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত গোপালগঞ্জ এলাকায় আজ ৪জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা তাদের ফায়ারিং রেঞ্জ থেকে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ২২জন পাকিস্তানী সেনাবাহিনির একটি দলকে ঘায়েল করে। যদিও এসময় তারা পিএএফ প্লেন থেকে নিক্ষেপিত বোমার শেলে আহত হয়।
পাকিস্তানী বাহিনী, গানবোটের সাহায্যে বরিশালের মধুমতী নদীর পার হচ্ছে এবং এসময় তারা নদীর দুইপারের গ্রামে বোমা হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করছে বলে জানা যায়। ধীরে ধীরে তারা বরিশাল শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই গানবোটগুলি বংগপোসাগর থেকে মধুমতী নদীতে প্রবেশ করে, এবং এই নদীটির অসংখ্য শাখা-উপশাখা পুরো বরিশাল জেলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে আছে। ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার এ গুরুত্বপূর্ণ জেলাটিতে এখনও পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধের প্রভাব খুব একটা পরেনি।
মুক্তিবাহিনীরা খুলনায়ও পাকবাহিনীর দখলকৃত রেডিও স্টেশনে গেরিলা কৌশলে হামলা চালায়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী বাহিনী চট্টগ্রাম-কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম-সিতাকুণ্ড এর মধ্যবর্তী যোগাযোগ ব্যবস্থা পুণরুদ্ধারের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় এইসকল এলাকার রাস্তা এবং রেইলরোড চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে।
সীমান্তের ওপারের মুক্তিবাহিনী থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে আজ তিতাস নদীর নিকটে অবস্থিত সাবেপুরে গেরিলা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ৫০ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। সকালে যখন পাকসেনারা তাদের রোজকার অনুশীলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনি এই গেরিলা মুক্তিবাহিনী সবার অলক্ষ্যে ক্যাম্পে প্রবেশ করে তাদের উপরে অতর্কিত হামলা চালায়।
কিছু অনিয়মিত সশস্ত্র সৈন্য ছাড়া আর সকল পাকিস্তানী সৈন্যদের আজ ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী পঞ্চগড় জেলা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে, একি ঘটনা ঘটেছে নিলফামারিতেও।
কুমিল্লা সেক্টরে লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একদল পাক্ সেনার উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী। সেনাদের দলটি চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। উক্ত হামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়েছে।
যদিও এই হামলা পালটা হামলার মধ্যে ময়মন্সিংহ জেলায় পাকিস্তানী সেনারা এখনও তাদের নিয়ন্ত্রন বজায় রেখেছে। প্রবল বোমা ও ভারী আর্টিলারি বহর হামলার মাধ্যমে তারা উক্ত জেলায় মুক্তিবাহিনীদের প্রতিহত করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে আসা খবরে জানা যায় যে টানা এক সপ্তাহ ধরে পাকবাহিনীর সাথে প্রবল সংঘর্ষের পর ময়মন্সিংহ অঞ্চলের পতন ঘটে। পাকিস্তানী স্থলবাহিনী এই এলাকায় প্রবেশের পূর্বে এর বহির্ভাগে প্রবল পরিমানে বিমান থেকে বোমা হামলা, ভারী আর্টিলারি বহর থেকে গোলাবর্ষণ চালায় ও মর্টারশেল নিক্ষেপ করে।
শান্তাহার এবং গোরাঘাট থেকে বগুড়ার দিকে অগ্রসরবরতী পাকবাহিনী সহজেই শহরটির দখল নিতে পেরেছে। পাকিস্তানী বাহিনীর মজুদ গোলাবারুদের ব্যাপকতা মুক্তিবাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি হওয়াতে উক্ত এলাকার অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী আগেই নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। বগুড়া থেকে পাকবাহিনী ক্রমশ উত্তর-পশ্চিমের জামালপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা যায়।
গত রাতে কুষ্টিয়ার ভৈরব নদীর পশ্চিমপারে অবস্থিত ইছাখালিতে পাকিস্তানী সীমান্ত ফাড়িতে মুক্তিবাহিনী চড়াও হয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। অতঃপর তারা ফাড়ির চারপাশে পরিখা খনন করে এবং ভৈরব নদীর উপর অবস্থিত ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়।
আজ সকাল থেকে মুক্তিবাহিনী ইছাখালি থেকে দুই মাইল দূরের মেহেরপুর শহরে অবস্থিত পাকিস্তানী সেনা ফাড়িতেও মর্টারশেল নিক্ষেপ করা শুরু করে এবং সেনাদলটি বাধ্য হয়ে মেহেরপুর থেকে ৫ মাইল দুরের মায়ামারি গ্রামের একটি বাশবাগানে অবস্থান নেয়।
-হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ২৭ এপ্রিল, ১৯৭১