পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা
আগরতলা, ২৭ শে এপ্রিল (পি টি আই)- বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে ব্যাপকভাবে গুপ্ত ও গেরিলা আক্রমণ যেমন চালিয়ে যাচ্ছেন, ওদিকে পাক্তিস্তান জঙ্গী বাহিনী আজ উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে আসামের কাছাড় জেলার সংলগ্ন শ্রীহট্ট সীমান্তের দিকে নতুন অভিযান শুরু করেছে।
বাংলাদেশ থেকে আজ রাত্রে যে সংবাদ পাওয়া যায় তাতে বলা হয় যে, মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ের পর পাকবাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী কুশিয়ারা নদী সম্মুখে হাজির হয়েছে।
কিন্তু শ্রীহট্টের দিক থেকে পাক বাহিনীর যে দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিক থেকে অভিযানকারী অপর একটি ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের আশায় এক সপ্তাহ পূর্বে রওয়ানা হয়েছিল, তারা এখনও গুরুত্বপূর্ণ শেরপুর খেয়াঘাট দখলের জন্য মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ে আটকে আছে।
সংবাদ এ-ও জানা যায় যে, পাক বিমানবাহিনীর বারবার বোমাবর্ষণ ও ব্যাপক ধ্বংসসাধন এবং দুরপাল্লার কামান দাগানো সত্ত্বেও মুক্তিফৌজ শ্রীহট্টের মাইল পনের দূরে অবস্থিত শেরপুরে পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন এবং তাদের আক্রমনে পাক জঙ্গী ফৌজ বহু সংখ্যায় হতাহত হয়েছে।
উপকূলবর্তী শহরগুলি দখলের চেষ্টাঃ প্রকাশ, মধ্য রণাঙ্গনে পাকিস্তানী ফৌজ বগুড়া ও ময়মনসিংহ থেকে যমুনার উভয় তীর ধরে অভিযান চালিয়েছে। নদী তীরবর্তী শহরগুলি পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতে পাওয়ার জন্যই তাদের এই উদ্যম। পাক বিমানবাহিনী আজকে বগুড়ার পূর্বদিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করেছে। বিশেষ করে যমুনার পশ্চিম উপকূলবর্তী সিরাজগঞ্জ, কাজীপুর ও হরিপুর শহর কয়টি বিধ্বস্ত হয়।
জামালপুর তুমুল সংগ্রামঃ পূর্ব তীরে ময়মনসিংহের দিক থেকে অভিযানরত পাকিস্তানী ফৌজ জামালপুর ঢুকেছে। ওখানে মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রচণ্ড সংগ্রাম চলেছে এখন অবধি। সংবাদে বলা হয় যে, ঢাকা, মধুপুর ও কিশোরগঞ্জ থেকে পাকফৌজের যে দলটি ময়মনসিংহের ওপর জড়ো হয়েছিল, এতক্ষণে তারা ঐ শহরে সদর কার্যালয় স্থাপন করেছে।
বরিশাল শহর এখনও মুক্তিফৌজের হাতেঃ দক্ষিণ রণাঙ্গনে এখন পর্যন্ত বরিশাল শহরটি মুক্তিফৌজের কর্তৃত্বে। ফরিদপুর থেকে অভিযানরত পাকবাহিনীকে গেরিলারা বরিশালের পথে অনেক জায়গায় সংগ্রামের মুখে ফেলেন। নদী তীর বরাবর পাকিস্তানী গানবোট ও মুক্তিযুদ্ধাদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময়ের সংবাদও পাওয়া গেছে।
সৈন্যরা চট্টগ্রামে শ্রমিক পাচ্ছেনাঃ চট্টগ্রামে পাকবাহিনী নাকি ১৩,০০০ বন্দর শ্রমিকের মধ্যে বন্দুক দেখিয়ে মাত্র ১৪০০ জনকে জরুরী মালপত্র উঠানো নামানোর কাজে সংগ্রহ করতে পেরেছে। অধিকাংশ বন্দর ও ডক শ্রমিক পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলি এড়িয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
চৌকি দখলের চেষ্টা বানচালঃ শিলিগুড়ি থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের দিনাজপুরে কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। এই এলাকাটি পশ্চিম দিনাজপুরে রাধীকাপুর সীমান্ত শহর থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। সীমান্তের ওপর থেকে এই খবর পাওয়া গেছে।
মুক্তিফৌজের অতর্কিত আঘাতঃ শিলং থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিফৌজ বিরাট এক অঞ্চল জুড়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্তা আরও জোরদার করে তুলেছে। কয়েকটি এলাকায় আজ পাকবাহিনীর উপর তারা অতর্কিতে আঘাত হেনেছে। বগুড়া শহরের দক্ষিণ-পূর্বে শেরপুরে এলাকায় মুক্তিফৌজ পাক বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য করতোয়া নদী পার হওয়ার সময় এই সংঘর্ষ শুরু হয়। নিকটবর্তী কাজিপুর এবং হরিপুর এলাকায় মুক্তিফৌজ ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে।
কুমিল্লা ফ্রন্টে গঙ্গাসাগর এবং ইমামবাড়ী স্টেশনের মধ্যবর্তী একটা এলাকায় মুক্তি সংগ্রামী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে বহু সংখ্যক পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
কুচবিহার থেকে প্রাপ্ত একটি খবরে জানা গেছে, হানাদারের কুড়িগ্রাম দখলের চেষ্টা মুক্তিবাহিনী বানচাল করে দিয়েছেন। একটি পাক অগ্রবর্তী বাহিনীর পাঁচজন সৈন্যকে মুক্তি সংগ্রামীরা গুলি করে মেরেছেন এবং ধরলা নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছেন। এই পাক সৈন্যেরা হাতে তৈরী নৌকাতে করে ধরল নদী পার হচ্ছিলো।
পাক বিমান ভূপাতিতঃ শিলং থেকে পিটিআই জানাচ্ছে, খাসি পাহাড়াঞ্চল ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের শ্রীহট্ট ফ্রন্টে একদল মুক্তি সংগ্রামী আজ সকালে একটি পাক জঙ্গী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে। বিমানটি হরিপুরে সার কারখানার দিকে যাচ্ছিল।
-যুগান্তর, ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১