You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৩৩। ভারত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের তৎপরতা সম্পর্কে আলোচনা ভারতের লোকসভার কার্যবিবরনি ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

 লোকসভা দশটায় আরম্ভ হয়

( জনাব. স্পিকার আসন গ্রহণ করেন)

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু. (ডায়মন্ড হারবার): স্যার, আমি মার্কিন সপ্তম নৌবহর এর আগমনের কারণে ভারতের উপর প্রভাব – এর উপর একটি মুলতবি প্রস্তাব নোটিশ দিয়েছি।

ভারত মহাসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর এর চলাচল

জনাব স্পীকার: তিনি একজন পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি একটি বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব দিয়েছেন যা সরকারের আমলে আছে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। সরকার কি এটা জ্ঞ্যাত আছেন?

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: এটা অনুযোগের জন্য নয়।

জনাব. স্পিকার: দয়া করে বসুন।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: সরকার একটি বিবৃতি দিতে পারে। আমিও একটা মনোযোগ আকর্ষণ নোটিশ দিয়েছি।

জনাব. স্পিকার: আমি দেখব বিষয়টা।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: এখন আপনি আপনাকে সামান্য সময় দিয়েছেন। আমাকে আমার সাবমিশন করতে দিন। এটা সরকারের কাছে অনুযোগের বিষয় নয়। কিন্তু আমরা চাই এই হাউস এই বিষয়টির উপর আলোচনা করুক কারণ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জনাব. স্পিকার: অনুগ্রহ করে মুলতুবির ব্যাপারে কোন নতুন সংজ্ঞা দিতে হবে না।

শ্রী এস এ শামীম (শ্রীনগর): মুলতবি প্রস্তাব মানেই একটি তিরস্কার প্রস্তাব নয়। আমি শুধুমাত্র স্পষ্ট করছি মাত্র।

জনাব. স্পিকার: নতুন সংজ্ঞা দিতে হবে না।

শ্রী এইচ এন মুখার্জি (কলকাতা, উত্তর-পূর্ব): স্যার, আমি ভারত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের বিচরণের ব্যাপারে এখানে কিছু বলতে চাই। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র এই রিপোর্টের ব্যাপারে অসঙ্গতি প্রকাশ করেননি। তিনি আরও বলেছেন এটি করা হয়েছে ঢাকায় মার্কিন ব্যক্তিদেরকে নিরাপদে ফেরত নেয়ার জন্য। এখন মনে হচ্ছে সেই পুরানো দিনের যুদ্ধ নীতির গানবোট পলিসি শুরু হয়েছে। কূটনীতি ও ব্ল্যাকমেইল ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ভারত এটা সমর্থন করতে পারে না। সুতরাং, আমি আপনার মাধ্যমে সরকারের কাছে অনুরোধ করতে চাই, অতি বিলম্বে সরকার এই ব্যাপারে দেশবাসীকে অবগত করুন এবং সংসদে বিষয়টি সমাধান করুন। সবার অনুমতিক্রমে। কারণ এরা সবাই পুরো দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমাদের এমনভাবে এক হতে হবে যাতে কেউ আমাদের টলাতে না পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – যারা ভিয়েতনামে মার খেয়ে ফিরেছে – তারা এখন চিনের সাথে গড়াগড়ি দিয়ে আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। এবং আমরা যদি নুয়ে পড়ি এটা ভয়ানক হবে। আমি বলছি না যে সরকার নুয়ে পড়তে যাচ্ছে। আমি আমার দেশের কাছ থেকে ভাল কিছু প্রত্যাশা করি। এজন্যই চাই সরকার এই সংসদে এটা নিয়ে আলোচনা করুন এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কি করতে যাচ্ছি তা প্রকাশ করুন এবং দাম্ভিক ও অহংকারীভাবেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সিধান্তের জবাব দেব।

শ্রী জ্যোতির্ময় বসু: স্যার এটা একটা চতুর এবং পরিকল্পিত পদক্ষেপ যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন সিঙ্গাপুর এর মালাক্কা প্রণালিতে জাহাজগুলোকে সম্ভ্যাব্য চূড়ান্ত নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছেন। তিনি সেগুলোকে বঙ্গোপসাগরে এগিয়ে যেতে বলেছেন ঢাকায় মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করার অজুহাতে। এবং তিনি পরমাণু চালিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এন্টারপ্রাইজকেও এই আদেশ করেছেন। এটা শুধুমাত্র পরমাণু চালিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এন্টারপ্রাইজ না বরং এতে কিছু এম্ফিবিয়াস (উভচর) জাহাজ ও ডেস্ট্রয়ার আছে যা আসলে গত শুক্রবার তার গন্তব্যের উদ্যেশ্যে রওনা দিয়ে ফেলেছে। এই এন্টারপ্রাইজ একটি ৯৯০০০ টনের জাহাজ যাতে তার রক্ষীবাহিনী আছে। এটি ইউ এস এর সবচেয়ে বড় ক্যারিয়ার। এবং এটি পরমাণু শক্তি সম্পন্ন। এটি একটি বৃহত্তম বিমান বাহক যাতে আছে ১০০ ফাইটার বোমারু বিমান, পরিদর্শনকরণ এয়ারক্র্যাফট, যোদ্ধা ও হেলিকপ্টার। এটা মার্কিন ৭ম নৌবহরের একটি অংশ। এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ভারতের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। অতএব, এই বিষয়টি এই হাউসে আলোচনা করা দরকার।

শ্রী এস এম ব্যানার্জী (কানপুর): স্যার, প্রফেসর আর এন মুখার্জি যা বলেছেন তার আমি আমি তেমন কিছু যুক্ত করতে চাইনা। আমি বলতে চাই যে এটা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের একটি নতুন পদক্ষেপ। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে যারা প্রতিদিন আত্মসমর্পণ করছে। গতকাল সকালে পাকিস্তান রেডিও, বিশেষ করে লাহোর রেডিও একটি বিবৃতি দেয়। তারা বাংলাদেশে তাদের সৈন্য ও অফিসারদের একটি বার্তা প্রদান করে যে আমেরিকান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ সমর্থনে তাদের জন্য ৭ম নৌবহর আনতে অঙ্গীকার করেছে। এটি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের একটি নতুন পদক্ষেপ, একটি খুব অশুভ পরিকল্পনা, এবং এটি ভারতের জন্য একটি হুমকি।

আমি জানি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকার এতে আতংকগ্রস্ত হবে না। এমনকি যদি তারা ৭ ম নৌবহর নিয়ে আমাদের দেশ স্পর্শ করার সাহস করে তাহলে তাদের উত্তর কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের মত ভাগ্য বরণ করতে হবে। আমি জানি যদি অ্যামেরিকা ভারত আক্রমণ করে তবে তা হবে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের ওয়াটারলু। কথায় আছে ঘেউ ঘেউ করা কুকুর কদাচিৎ কামড়ায়। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে কুকুর যেন ঘেউ ঘেউ না করে। আমরা পবিত্র মাটির জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।

জনাব. স্পিকার: এখন, কাগজপত্র রাখুন।

বিবৃতি: ভারতে পাকিস্তানের আগ্রাসন সংক্রান্ত সর্বশেষ অবস্থান।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (শ্রী জগজীবন রাম): জনাব ডেপুটি স্পিকার, আজ আমাদের উপর পাকিস্তান দ্বারা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার এগারোতম দিন। শত্রু তার আক্রমণের লক্ষ্য অর্জনে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায়, পাকিস্তানী বাহিনী প্রচুর লোকসান দেবে। যা শুধুমাত্র বিদেশি উৎস থেকে তারা মেটাতে পারে। আমি আপনাকে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধের বিস্তৃত ধারনা দিতে চেষ্টা করব।

কারগিল এবং তিথওয়াল সেক্টরে বেশ কিছু পোস্ট দখল করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে যে শত্রুদের যান এই এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবেনা।

উরি, পুঞ্চ, রাজাউরি এবং নাউশেরা সেক্টরে শত্রুর পক্ষের প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধবিরতি লাইন থেকে চাপ বিরতি নেয়া হয়েছে। আরও কিছু পোস্টে অভিযান চালিত হয় এবং কয়েকটি আমাদের দখলে আসে। আমাদের রণকৌশলগত অবস্থান এখন অনেক ভালো এবং শ্রেয়।

হাউস ছিম্ব খাতে উন্নয়নের ব্যাপারে এখন সতর্ক। এক পর্যায়ে শত্রুরা মুন্নাওয়ার তাওই এর পূর্বাঞ্চলীয় পাড়ে এগিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চায়। শত্রুরা ইস্টার্ন ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য হয়। শত্রুরা যদিও এখনও মুন্নাওয়ার তাওই এর পশ্চিমে উপস্থিত কিন্তু পূর্ব পাড়ে আমাদের প্রতিরক্ষাবাহিনী তাদের প্রচেষ্টা বানচাল করেছে। আমাদের বাহিনী এখন নদীর পূর্ব তীরে পরিখা খনন করেছে এবং ভালো অবস্থানে আছে এবং এখন তারা পশ্চিম তীরে টহল করতে সক্ষম। সাম্বা-পাঠানকোট সেক্টরে আমাদের অনুসন্ধান যথেষ্ট কৌশলী অবস্থানে উন্নত হয়েছে এবং পিছনে আমাদের অত্যাবশ্যক সড়ক যোগাযোগ এখন আরও সুরক্ষিত।
পাঞ্জাব সেক্টরে শত্রু আমাদের অঞ্চল দখলের জন্য বারবার প্রয়াস চালায়। কিন্তু রবির দুপাশে ছিটমহলের দখল আমাদের। আমাদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। গত কয়েক দিন ধরে, সেখানে তেমন কিছুই হয়নি।

সন্মানিত সদস্যদগন শত্রুরা জয়সালম সেক্টরের রামগড় এলাকায় যে আক্রমণের চেষ্টা করেছে সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এই প্রয়াসে শত্রুদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিসহ তারা হতাশ হয়েছে.। তাদের আমাদের অঞ্চল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে এবং এখন আমরা তাদের সীমানার মধ্যে কয়েক মাইল অগ্রসর হয়েছি। বার্মার সেক্টরের আরও দক্ষিণে নয়া চরে যুদ্ধ আগাচ্ছে। বাহিনীরা তাদের অবস্থান চাঙ্গা করেছে এবং ভালো জবাব দিচ্ছে। আমি এই হাউজে জানাতে চাই যে রাজস্থান বর্ডারের হুমকি দূর করা হয়েছে।

কুচ সেক্টরে আমাদের বাহিনী ভিরাঅয়াহ গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে এবং নাগাড়পার্কার এলাকা দখল হয়। আমাদের বাহিনী এখন সিন্ধু প্রদেশের প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটারের কাছে। সেই এলাকায় সাধারণ নাগরিক বিষয়ক ব্যাপারগুলো এখন দেখাশোনার চেষ্টা চলছে।

এখন, আমি পূর্ব ফ্রন্টের ব্যাপারে বলব। সন্মানিত সদস্যরা এই ব্যাপারে সচেতন যে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলে এক সঙ্গে আমাদের বাহিনী বাংলাদেশের বৃহৎ এলাকায় স্বাধীনতা সফল করার কাজ করছে। নোয়াখালী, লাকসাম, চাঁদপুর, ফেনী, কুমিল্লা, গাইবান্ধা, সিলেট, ময়মনসিংহ, জামালপুর, কুষ্টিয়া, যশোর ও হিলি প্রধান শহরগুলোতে দুই শক্তির সম্মিলিত হামলায় সেগুলোতে এখন পাকসেনারা ভূপতিত। পাকিস্তানি সৈন্যদের কিছু জোট এখন আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আমাদের দ্রুতগতি ঠেকাতে শত্রুরা সেতু ধ্বংস এবং নদীতীর ধ্বংস করছে। মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাহিনীকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে এবং নদী পাড় হতে সাহায্য করছে। আমরা হেলিকপ্টার ব্যবহার করছি শত্রু লাইনের পিছনে আমাদের সৈন্য পৌঁছাতে। এয়ার প্যারাট্রুপ্স ইতিমধ্যে ঢাকার উত্তর এলাকায় নেমেছে। এবং তারা মুক্তিবাহিনী এবং আমাদের স্থল বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।

আমাদের বাহিনী এখন বিভিন্ন দিক থেকে ঢাকা আগাচ্ছে। ঢাকার কিছু অংশ আমাদের আর্টিলারি সীমানার মধ্যে আছে। আগে আমাদের চিফ পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে দুইটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন যার কোন জবাব আসেনি। পরে তিনি তৃতীয় একটি বার্তা জেনারেল রাও ফরমান আলী বা অন্য কোন কর্মকর্তা যিনি ঢাকা গ্যারিসন কমান্ডিং করছেন তার কাছে পাঠান। তিনি লিখেছেন সবার উচিৎ নিরপরাধ রক্তপাত প্রতিরোধের জন্য দায়িত্ব নেয়া। তিনি দখলদার বাহিনীর কমান্ডার এর কাছে আপিল করেছেন যেন তাকে তার মানবিক দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পালনের ব্যাপারে সহযোগিতা করা হয়। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন যে ক্ষেত্রে ঢাকা গ্যারিসন যদি প্রতিরোধের প্রস্তাব বহাল করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সকল বেসামরিক নাগরিক এবং বিদেশী নাগরিকদের সংঘাতের এলাকা থেকে যেন নিরাপদ দূরত্বে অপসারণ করা হয়। আমি বিশ্বাস করি যে অন্তত এই পর্যায়ে জেনারেল মানেকশ এর পরামর্শে তারা মনোযোগ দেবে এবং সেই ভাবে কাজ করবে।

আমরা সংঘাতের এলাকায় বেসামরিক জনগণের ব্যাপারে গভীরভাবে সচেতন আছি। এটা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একমত যে সমগ্র বেসামরিক জনগণ ও বাইরে থেকে যারা সেখানে আছে তাদের প্রটেকশন নিশ্চিত করে আমাদের কাজ করতে হবে।

এটির জন্য আমরা আটকা পড়া বিদেশী নাগরিকদের করাচি, ইসলামাবাদ এবং ঢাকা থেকে সরে যেতে বলেছি। আমাদের বিমান বাহিনী আগাম বিজ্ঞাপিত সময়ে বিরত আছে। যাতে এই সব শহর থেকে সরে যেতে সুযোগ পায়। একইভাবে, ভারতীয় নৌবাহিনী নিরপেক্ষ জাহাজ গুলোকে নিরাপদে পাকিস্তান ছেড়ে যাবার জন্য সাহায্য করার নির্দেশ দেয়া আছে। এই ব্যাপারে জাতিসংঘ এবং বিদেশি সরকারগুলোর আমাদের ডিফেন্স সার্ভিসে কে প্রশংসা করেছে। কিন্তু শত্রুপক্ষ এই যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে তাদের নিজস্ব এয়ারফিল্ডে যুদ্ধ উপকরণ অবতরণ করাচ্ছে এবং তাদের জলভাগে মাইন স্থাপন করছে।

পাকিস্তান বিমানবাহিনী বিমান ধ্বংস করে দেবার জন্য আক্রমণ চালিয়েই যাচ্ছে এবং আমাদের ইনস্টলেশন ও রানওয়ে অব্যবহার্য করার চেষ্টা করছে। হাউস শুনে খুশি হবেন যে এপর্যন্ত তারা আমাদের একটি মাত্র বিমান ধ্বংস করতে পেরেছে এবং আমাদের সবগুলো এয়ারফিল্ড ঠিকঠাক আছে। অন্যদিকে আমাদের প্রতিরোধমূলক হামলায় পাকিস্তানের সংকেত ইউনিট, রানওয়ে এবং অন্যান্য স্থাপনা যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। শত্রুরা দিবালোকে হামলা খুব কম করছে। রাতেও অবশ্য তাদের কার্যকলাপ কমে গেছে। পাক বিমানবাহিনী কিছু অঞ্চলে স্থল অভিযানে ভালো সহায়তা প্রদান করেছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানী বাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করার এবং তাদের সাঁজোয়া গঠন এবং সেনা একত্রীকরণে বাঁধার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

আমাদের বিমান বাহিনীর অপারেশন বাংলাদেশে দ্রুত প্রবেশে বিশাল ভূমিকা রাখছে এবং আমাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের বোমা আরো এলোমেলো এবং ত্রুটিযুক্ত হয়ে গেছে। তারা এখন ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু বেসামরিক টার্গেটে আক্রমণ করছে। তিন দিন আগে জুল্লুন্দুর এর কাছাকাছি কিছু গ্রামে বেসামরিক লোকদের উপর বোমাবর্ষণ করা হয়। প্রায় ১০০ জনের মত হতাহত হয়। জুরজান এ একটি বেসামরিক হাসপাতালে আক্রমণ করা হয়। শ্রীনগরের কিছু বেসামরিক এলাকা পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের নজর কেড়েছে। অন্যদিকে আমাদের বিমান বাহিনী শুধুমাত্র সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করছে। বেসামরিক এলাকা এড়াতে চেষ্টা করছে। হাউস এখন একটি সত্য জানবেন যে ঢাকায় পাকিস্তানি বিমান একটি এতিমখানা ধ্বংস করে আমাদের উপর সেই দায় চাপিয়েছিল।

এই হাউস অবগত আছেন যে ভারতীয় নৌবাহিনী সফলভাবে করাচী ন্যাভাল পোতাশ্রয়ের প্রতিরক্ষাকে ভেঙ্গে ঢুকে গেছিল এবং গাওয়াদার থেকে করাচি পর্যন্ত পাকিস্তানি নৌ ইনস্টলেশনের উপর সফল সাহসী অভিযান চালিয়েছিল। পাকিস্তানি বহরের একটি অংশ ধ্বংস করা হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা সংযোগ ছিন্ন হয়েছে, এবং করাচি সমুদ্র দিয়ে সরবরাহ এবং পাক-অধিকৃত বাংলাদেশে পোর্ট প্রতিরোধ করা হয়েছে। নেভি বিচক্ষণতা এবং নমনীয়তার সাথে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে সক্ষম হয়েছে। কিছু পাকিস্তানি জাহাজ এবং পাকিস্তানের কার্গো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু সাধারণ শিপিং লাইন ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছে – তাদের ব্যাপারটি সন্তোষ্টজনক সমাধান করা হয়েছে। নিরপেক্ষ জাহাজগুলোকে সংঘর্ষের এলাকা থেকে দূরে সরতে পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।

পাকিস্তানি নৌবাহিনী আমাদের বণিক জাহাজের উপর হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের পোর্ট পূর্ণ গতিতে চলছে। এই সব নৌ অপারেশনে, আমরা কেবল একটি ছোট রণতরিবিশেষ হারিয়েছি।
এই হাউস স্বাভাবিকভাবেই হতাহতের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন আছে। গত দশ দিন ধরে তীব্র লড়াইয চলছে। আমার কাছে গত কাল সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত সব তথ্য আছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর হতাহতের তালিকা –
হারিয়ে যাওয়া – ১৬৬২ জন
আহত – ৫০২৫ জন
নিহত – ১৯৭৮ জন

পাকিস্তানের হতাহত আরও অনেক বেশী। আমার কাছে সঠিক তথ্য নেই। সম্ভবত, এখন পর্যন্ত ৪১০২ জন কর্মকর্তা ও পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনী ও তাদের আধা সামরিক বাহিনীর থেকে ৪০৬৬ জন অফিসার ও সৈনিকরা আমাদের হেফাজতে আছে।

আমরা এখন পর্যন্ত ১৭৫ টি পাকিস্তানি ট্যাংক হিসেব করেছি যার ১৮ টি সচল অবস্থায় আমাদের কাছে আছে। আমাদের মাত্র ৬১ টি ট্যাংক ধ্বংস হয়েছে।

৯ জন পাইলট এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৩ জন ন্যাভিগেটর প্রাণ হারিয়েছেন। ৩৬ জন পাইলট এবং ৩ জন ন্যাভিগেটর নিখোঁজ রয়েছেন। আমরা এক নৌ বিমান সহ ৪১ টি প্লেন হারিয়েছি।

পাকিস্তানি পাইলট ও ন্যাভগেটরের ক্ষতির পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে আমুনানিক হিসাবে প্রায় ৮৩ টি বিমান হারিয়েছে বলে জানা যায়।

পাক নৌবাহিনীর বড় লোকসান হল ২ টি ডেস্ট্রয়ার ২ টি মাইন পরিস্কারক, ২ টি সাবমেরিন, ১৬ টি গানবোট এবং ১২ টি বিবিধ নৈপুণ্যের যান। তবে কর্মকর্তা ও পাক নৌবাহিনীর সদস্যের সংখ্যা আমাদের জানা নেই।

হাউস জানেন, আমরা আমাদের ব্যাপক নৌ অভিযানে শুধুমাত্র একটি রণতরিবিশেষ হারিয়েছি। ১৮ জন কর্মকর্তা ও ১৭৩ জন নাবিক এখনো নিখোঁজ। ৬ কর্মকর্তা ও ৯১ নাবিকদের উদ্ধার করা হয়েছে।

আমি নিশ্চিত, এই হাউস সেই সকল অফিসার ও সৈনিক যারা আমাদের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য প্রাণ হারিয়েছেন তাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করবে।

এছাড়া হাউস ধন্যবাদ দেবে এই কারণে যে লড়াইয়ের প্রধান অংশ শত্রু দের মাটিতে হয়েছে এবং আমাদের পশ্চিম সীমানা নিরাপদ দূরত্বে ছিল। এই মহৎ কর্ম সঞ্চালনের জন্য আমাদের ডিফেন্স সার্ভিসেসের প্রতি হাউস কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।

বাংলাদেশ সরকার ও তাদের নিয়মিত বাহিনীকে ধন্যবাদ দিতেই হবে কারণ তারা আমাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে যে কারণে দখলদার বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ অভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তির প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হবে।

জনাব. ডেপুটি স্পিকার: হাউস আগামীকাল সকাল ১০ টা পর্যন্ত মুলতবি করা হল।

বিবৃতি: বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের বাহিনীর
নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ

প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, ইলেক্ট্রনিক্স মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী): জনাব স্পিকার, আমি একটি ঘোষণা দেব যার জন্য হাউস অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিঃশর্তে বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করেছে। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা জিওসি-ইন সি (ভারত ও বাংলাদেশের বাহিনী) আত্মসমর্পণ পত্র গ্রহণ করেন। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত রাজধানী।

এই হাউস এবং সমগ্র জাতি এই ঐতিহাসিক ঘটনায় আনন্দিত। আমরা মহানন্দে বাংলাদেশের মানুষের প্রশংসা করছি। আমরা তাদের বীরত্ব এবং উতসর্গের জন্য সাহসী যুবক ও মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের প্রশংসা করছি। আমরা গর্বিত আমাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রতি, যারা এত চমৎকারভাবে তাদের মান এবং ক্ষমতা দেখিয়েছে। তাদের শৃঙ্খলা ও কর্তব্য নিষ্ঠা সুবিদিত। ভারত কৃতজ্ঞতার সাথে যারা জীবন দিয়েছেন তাদের ও তাদের পরিবারের সঙ্গে থাকবে এবং তাদের আত্মত্যাগ স্মরণ করবে।

জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধের পাকিস্তানি বন্দিদের চিকিৎসার জন্য এবং মানবিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সবস্তরের মানুষের সাথে অবস্থান করতে কড়া নির্দেশ দেয়া হল। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাররাও তাদের বাহিনীকে অনুরূপ আদেশ জারি করেছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার এখনো জেনেভা কনভেনশন স্বাক্ষর করতে সুযোগ পায়নি। তবে তারা ঘোষণা করে যে, তারা সম্পূর্ণরূপে তা মেনে চলবে। যে কোনো প্রতিহিংসামূলক কাজ বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিবাহিনী ও ভারতের সশস্ত্র বাহিনী প্রতিরোধ করবে।

আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে তাদের মুক্তিবাহিনীকে ও মানুষদের সাহায্য করা এবং তাদের উপর আসা আগ্রাসন প্রতিহত করা। পাশাপাশি আমাদের দেশকে সুরক্ষা করা। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী তার প্রয়োজন ছাড়া একটি মুহুর্তের জন্য বাংলাদেশে থাকবে না।

লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা আমাদের সীমানা জুড়ে তাদের বাড়িঘর ফেলে এসেছিল তারা ফিরে যাচ্ছে। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ও জনগণকে কাজ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।

আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি যে এই নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজের লোকদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেবেন এবং শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। একদসঙ্গে তাদের দেশকে সোনার বাংলা করার সময় এসেছে। তাদের জন্য আমাদের শুভ কামনা।

এই জয়জয়কার শুধু তাদের একার নয়। সমস্ত জাতি যারা স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছেন সবাই এর অংশীদার।

বিভিন্ন সদস্যগন: ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ।

শ্রী সমর ঘা (Contai): প্রধানমন্ত্রীর নাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে খচিত থাকবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!